এই রাস্তায় এমনিতেও তেমন লোক জন আসেনা। আর সন্ধ্যার পরে তো একেবারেই না। তাই এই রাস্তা ধরে হাটতে অনেক ভালোলাগে সিয়াইনার। ও হাটে আর ভাবে মানুষ কত অদ্ভুত। এই সামান্য রাস্তা নিয়েও কত আষাঢ়ে গল্প করে। তবে সেগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে ভয়াবহ বেপার হবে। আগে এগুলো ভেবে একটু ভয় ভয় করতো। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
-সিয়াইনা
সিয়াইনা চমকে উঠলো। তারপর তাকিয়ে দেখলো ইশাম।
-তোমাকে কতবার বলেছি এখানে এভাবে একা একা আসবেনা।
-তুমি নীরবতা ভঙ্গ করছো ইশাম। এটা কিন্তু ঠিক না। এই জায়গা নীরব বলেই এতো সুন্দর।
-সিয়াইনা তুমি আবার…
সিয়াইনা ইশামকে থামিয়ে দিয়ে বললো, দেখো ইশাম, এরকম নীরব সুন্দর জায়গা আমাদের দেশে আর খুব বেশী বাকি নেই। তোমাকে আমি এই জায়গার নীরবতা নষ্ট করতে দিবো না। চলো যাই এখান থেকে।
ইশাম শুধু “হুম” শব্দটাই করলো। আর কিছু বললোনা। সিয়াইনার এসব আদ্ভুত কাজকারবার দেখতে ভালোই লাগে ইশামের। এই হ্যালুইনেই সিয়াইনা কিরকম ভুত সেজে ইশামকে ভয় দেখিয়েছিলো। ইশাম যদিও অনেক ভয় পেয়েছিলো তাও ওই দৃশ্য কল্পনা করলে হাসি পেয়ে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এসবের জন্য চিন্তাও হয় অনেক। এই রাস্তাটা একদমই ভালো না। আজই যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত। কিন্তু সিয়াইনাকে এসব বলে কোনো লাভ নেই।
সিয়াইনাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ইশাম চলে আসলো।
আজ সিয়াইনা ভেবে রেখেছে সারা রাত সাগর পারে বসে কাটাবে। কিন্তু ইশামকে এটা জানতে দেয়া যাবে না।
এসময় সাগরপারের জায়গাটা বেশ রিস্কি। অনেক ক্রাইম হয়। আর এদিকটা তো আরো বিপদজনক। সিয়াইনা ওর কালো লম্বা জামা টা পরে এসেছে। কেউ আসলে ওকে দেখে ভুত বা অদ্ভুত কিছু ভাববে। সাধারণ কিছু ভাবার প্রশ্নই আসে না। সমুদ্রের কান্নাকাটির শব্দ খুব তীব্র ভাবে পাওয়া যাচ্ছে। সিয়াইনার খুব মায়া হলো সমুদ্রটার জন্য। কতই না কষ্ট তার।
হঠাৎ গাড়ির শব্দ পেলো সিয়াইনা। দেখলো একটা প্রাইভেট কার এসে থামলো। অন্ধকারের কারণে কারের মডেল জানা গেলো না। কার থেকে দুইজন নামলো। একজন ড্রাইভ করছিলো আর তার পাশের সিটে একজন। দুইজন নেমেই আশেপাশে তাকালো। সিয়াইনা আরো আড়াল হয়ে গেলো। ওরা ওকে দেখতে পেলোনা। সিয়াইনা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। ওরা গাড়ির পেছনে গিয়ে বনেট খুললো। তারপর দুইজন দুই পাশ দিয়ে ধরে কি যেন বের করলো। জিনিসটা নিশ্চয় খুব ভারি। কারণ ওরা খুব কষ্ট করে ওটা সমুদ্রের ধারে নিয়ে যেতে থাকলো। অন্ধকারের কারণে দেখা না গেলেও সিয়াইনা ভালোই বুঝলো যে জিনিসটা কি। ওটা নিশ্চয় মানুষ। হয়তো লাশ বা হয়তো অজ্ঞান। লাশ হলে তো পুতে ফেলতে পারতো। নিশ্চয় সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা প্রমাণ করবে। সিয়াইনা সাথে সাথে থানায় ফোন করে সব জানালো। দেহটাকে ভাসিয়ে দিতে ওরা অন্য দিকে গয়েছে। সিয়াইনা আছে অন্য দিকে। তাই ওকে দেখতে শুনতে পাবে না ওরা। কিন্তু কাজটা তো ঠিক হচ্ছে না। লোকটাকে ভাসিয়ে দিলে তো সমস্যা। কিন্তু সিয়াইনা কি করবে? ওদের কাছে অস্ত্র থাকতে পারে। অস্ত্র অবশ্য সিয়াইনার কাছেও আছে। একটা সেফটি স্রে, একটা ক্লোরফরম স্প্রে, একটা রিভলভার (লাইসেন্স সহ)। কিন্তু এই লোকগুলো তো বেশ ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এদের কাছে এর চেয়েও ভয়ানক সব অস্ত্র থাকতে পারে। তাছাড়া ওরা দুইজন আর সিয়াইনা একা। কিন্তু কিছুতো একটা করতেই হবে। ওরা বুঝতে পারছেনা যে কোন জায়গায় দেহটি ভাসাবে। সিয়াইনা আগে যেয়ে ওদের গাড়ির একটা টায়ার পানচার করে আসলো যাতে পুলিশের গাড়ির শব্দ পেয়েও তাড়াতাড়ি পালাতে না পারে।
ভোর হওয়া হওয়া। সিয়াইনা থানা থেকে বাড়ি ফিরছে। পুলিশ সঠিক সময়ে পৌঁছে গেছিলো। পরে দেখা গেলো যে ওই দুইজনের মধ্যে একজন মেয়ে। সিয়াইনা দূর থেকে বুঝতে পারেনি। আর যাকে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো সে বেঁচে গেছে। অতিরিক্ত মত খাইয়ে অজ্ঞান করে ভাসিয়ে দিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিলো। পরিকল্পনা সফল হয়নি। ভাসাতে পারেনি শেষমেশ। সম্পত্তির জন্য ভাই-ভাবী মিলে লোকটার এই হাল করেছে। কি ভয়ানক বেপার। সিয়াইনা কিছুতেই বেপার টা মাথা থেকে সরাতে পারছেনা। মন মেজাজ পুরোই খারাপ হয়ে গেছে। বাড়ি পৌছে হুইস্কির বোতল নিয়ে বসলো সিয়াইনা। মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার।
পরের দিন বিকালবেলা সিয়াইনা ইশামের কাছে ঘুরতে যাওয়ার জেদ ধরলো। ইশামের হাজারটা কাজ। এর মধ্যেও প্রত্যেকদিনই সিয়াইনার সাথে দেখা করে। কিন্তু ঘুরতে যাওয়ার মতো ওতো সময় ওর নেই। তাও সিয়াইনার জেদ বলে কথা। তাছাড়াও মেয়েটা খুব দরকার না হলে কখনোই কিছু বলে না। সারাটা সন্ধ্যা আজ সিয়াইনাকে দিলো ইশাম। সিয়াইনার মনটা একটু ভালো হলো। কিন্তু আজ রাতে তার সাগরপারে যেতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। আজ রাতটা রেললাইনের ওপর দিয়ে হেটে কাটাবে বলে ঠিক করলো সিয়াইনা।
রেললাইনের ওপর দিয়ে হেটে চলেছে সিয়াইনা। দূর দূর পর্যন্ত কেউ নেই। খা খা মাঠ। শুধু ঝিঝিপোকার ডাক। এর মধ্যে হঠাৎ করে কারোর চিল্লানোর শব্দ পেলো সিয়াইনা। তার সাথে একটি মেয়ের অট্টহাসি। সিয়াইনা শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে ওগিয়ে চললো।
যা দেখলো তা দেখে সিয়াইনার বুক কেপে উঠলো। রেললাইনের ওপর ইশামকে বেধে রেখে হাসছে আমব্রিন। কি ভয়ানক। সিয়াইনা আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলো আমব্রিন ইশামকে বলছে, রাজী না হলে তোমাকে মরতে হবে ইশাম।
ইশাম দৃঢ় গলায় বলছে, কখনো না। আমি সিয়াইনা ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না।
সিয়াইনা শব্দ না করেই ওর ক্লোরফরম এর স্প্রে টা বের করলো। তারপর বাম হাত দিয়ে নিজের মুখে রুমার চেপে ডান হাতে স্প্রে নিয়ে আমব্রিনের দিকে ছুটে গেলো সিয়াইনা। আমব্রিনের কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিয়াইনা ওর মুখের ওপর আচ্ছামত ক্লোরফরম স্প্রে করে দিল। আমব্রিন অজ্ঞান হয়ে গেলো। সিয়াইনা ইশামের বাধন খুলে দিয়ে থানায় ফোন দিল।
সকালে ইশাম সিয়াইনাকে আরেকবার জিজ্ঞেস করলো যে সিয়াইনা কেমন করে জানলো এসব। বেশ কয়েকবার সিয়াইনাকে এই প্রশ্ন করেছে ইশাম। সিয়াইনার একই উত্তর “আমি ধারনা করেছিলাম”।
ইশাম এবার বলেই ফেললো, তুমি রাতকরে ওখানে হাটাহাটি করতে যাওনি তো?
-হ্যা। আসলে আমি হাটতেই গেছিলাম।
-কেনো সিয়াইনা? তুমি এতো অদ্ভুত কেনো? কেনো যাও এভাবে?
-রাত দেখতে। আমার রাত দেখতে ভালো লাগে। আর ওই রাত মানুষজনের ভিড়ে পাওয়া যায়না। একাকী নির্জনতাই পাওয়া যায়। সেই রূপবতী রাতকে দেখতে যাই আমি সিয়াইনা। তুমি কখনোই বুঝবে না।
গল্পের বিষয়:
রহস্য