বছর দুই এর আগের কথা। আমি তখন ফুলের দোকানে কাজে ধুকেছি। আমার বাড়ি শ্যামনগর। তবে আমি কলকাতার এক সুপরিচিত দোকানে কাজ করতাম, দোকানের মালিক আমাকে খুব ভালো বাসতো, নিজের হাতে আমাকে কাজ শেখাতো। একমাস এর মধ্যে আমার হাত বেশ স্পীডে ছূটছিলো, গাঁদাফুল, রজনীগন্ধা, জবা,বেল,নীল এসবের মালা আমি নিজের হাতে বানানো শিখে গিয়েছিলাম। আর আমাদের দোকান-টা ছিলো একটা বিরিয়ানির হোটেলের সামনে। ওখান থেকে আমি মাঝেমধ্যে বিরিয়ানি খেতাম, মালিক খাওয়াতো।
একদিন সেই বিরিয়ানির দোকানের সামনে একটা বড়ো গাড়ি এসে থামলো তারপর….
আচ্ছা, গত ১৮ জানুয়ারি, আমার মেয়ের বিয়ে, বিরিয়ানি হবে। মেয়ের ইচ্ছা গ্রামে বিয়ে করবে, আর গ্রাম্য রীতিনীতি মেনেই বিয়ে করবে। বোঝেন তো একটা মাত্র মেয়ে, এইজন্য শহর থেকে ভালোভালো রাঁধুনি খুঁজে নিয়ে যাচ্ছি, মেয়ে স্পষ্ট বলে দিয়েছে শহর থেকে আনা খাবার খাবোনা।
অতি কষ্টে আমরা বুঝিয়েছি যে বিরিয়ানি – টা হোক, আর বাদবাকি খাবার তোর মনমতোন হবে। মেয়ে রাজি হয়েছে। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কি?
বিরিয়ানির দোকানের কর্মচারী – হ্যাঁ হবে, তবে অগ্রিম কিছু দিয়েযান।
ওই লোক-টা – এই নিন, ধরুন।
টাকা দিতে দিতে আবারো বলে উঠলো – আচ্ছা দাদা এখানে ভালো ফুলের দোকান কোথায় পাবো বলতে পারেন?
বিরিয়ানির দোকানের কর্মচারী – ওইতো সামনে,
আমাদের দোকানের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলো।
মালিক আর ওই লোক-টা বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো, তারপর ওই লোক-টা চলে গেলেন।
মালিক আমাকে এসে বললো – গত ১৮ জানুয়ারি, আমাদের একটা বিয়ের কাজ আছে। ১৪,০০০ হাজার চেয়েছি। ৭,০০০ টাকা লাভ হচ্ছে। তোকে ১০০০ দেবো ক্ষণ?
আমিতো আহ্লাদে গদগদ। আমি রাজী হয়ে গেলাম মালিকের সাথে যেতে।
দেখতে দেখতে ১৮-ই জানুয়ারি বিয়ের দিন চলে এলো। আমি একদম সকালে চলে গেলাম মালিকের সাথে ওইবাড়িতে। গিয়ে সকলের সাথে আলাপ করলাম। যে গ্রামে বিয়ে হচ্ছে সেই গ্রামের অলগলি আমার সবচেনা। আমি ওই বাড়ির সকল লোকের সাথে বন্ধুর মতন মিশতে লাগলাম। এমন সময় খেয়াল করলাম উপর থেকে যার বিয়ে হবে সে আমাকে ইশারায় ডাকছে,
আমি ধীরপায়ে আস্তে আস্তে পা বাড়াতে লাগলাম তার দিকে।
আমাকে পেছন থেকে ওইবাড়ির-ই একজন লোক বললো – কোথায় যাচ্ছেন দাদা?
আমি – কনের মাথার মুকুট-টাতে কটা গোলাপ আঁটবে, আর সাইজ টাইবা কেমন হবে তারজন্য কনের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি, যাই গিয়ে দেখে আসি এছাড়াও আর ও কাজ আছে,
উনি বললেন যাও – আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম।
ওই দিদি-টা আমাকে বললো – এই তুমি, ভ্যান চালাতে না ইঞ্জিন ভ্যান।
আমি – হুম, কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে।
ওই দিদি-টা বললো – দেখো তুমি যতো টাকা চাও পাবে, শুধু একটু উপকার করবে ভাই, আমি আজ সন্ধ্যাবেলায় এখান থেকে পালাবো, আমার জন্য পালানোর ব্যবস্থা করে দেবে,
আমি – কিন্তু কেন পালাবে তুমি?
ওই দিদি-টা বললো – সে ভাই, সন্ধ্যাবেলায় বলবো, তুমি দয়া করো আমার উপর। আমি এখানে কাউকে চিনিনা। আর এইজন্য আমি গ্রামেই বিয়ে ঠিক করেছি। কারণ শহরে হলে আমি পালাতে পারতাম না।
আমি – ভাই বলে ডেকেছো যখন তখন নিশ্চয় সাহায্য করবো।
ওই দিদি-টা বললো – আর বলছি কি ভাই মালা আর সিঁদুরের কৌটো আলাদা করে সরিয়ে রেখো।
আমি – আচ্ছা আজ সন্ধ্যাবেলা – তে তৈরি থেকো।এইবলে বেড়িয়ে আসলাম। মনে তখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরছিলো। সেইসব প্রশ্নের উত্তর – টা এখন না পাই রাতে পাবো এইভেবে নিজেকে শান্ত করলাম।
দিদির কাছ থেকে ফিরে এসে মালিক কে এই ব্যাপারে কিছু বললাম না। আমি আর মালিক ফুলের গেট সাজানোর কাজে লেগে পড়লাম। আমাদের কে যে দিদির বিয়ে হচ্ছে তার বাবা সমীর বাবু রাতে খাবারের কথা বলে গেছেন। দুপুরের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে গেছিলো আমাদের। তারপর খাওয়া দাওয়া করে আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম। আমি আগেই বলেছি এই জায়গা-টা আমার চেনা। কয়েকজন বন্ধু আছে এখানে আমার। তাদের সাথে বিকেলে দেখা করলাম। সকলের থেকে সাহায্য চাইলাম। ওরা রাজি হয়ে গেলো।
এখানে মাইলের পর মাইল গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই ভ্যান-ই একমাত্র অবলম্বন। সকলে মিলে ঠিক করলাম আমরা মন্ডপের পিছনের রাস্তা দিয়ে বউকে ভাগিয়ে নিয়ে যাবো। কথামত কাজ। সন্ধ্যার একটু আগে আমার বন্ধুরা এসে হাজির হয়ে গেছে। চারজন চারটে ভ্যান। আমি বিয়ের মন্ডপ থেকে মালা, সিঁদুরের কৌটো সড়িয়ে রেখেছিলাম। এবার খালি বর আসার অপেক্ষা। তখনি মোক্ষম সময়। দেখতে দেখতে বর ও চলে আসলো আমি দৌড়ে উপরের ঘরে যেতে যাবো তখনি দেখি দিদি নীচে আসছে। দিদি বললো তাড়াতাড়ি চলো। আমরা মন্ডপের পেছন দিয়ে দিলাম দৌড়। দিদিকে আমার একটা বন্ধুর ভ্যানে উঠালাম আমার বন্ধু সুমন ভ্যান চালাতে লাগলো। ও গ্রামের ছেলে এসব ওর অভ্যাস আছে। বেশ কিছু-টা দূর চলে আসার পর দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম – দিদি এবার বলো আমরা কোথায় যাচ্ছি?
দিদি – বলছি তার আগে আমাকে বলো এখানে তেঁতুল তলা বলে কোনো নিরিবিলি জায়গা আছে?
আমি – হ্যাঁ।
দিদি – ওইখানে চলো। আমরা ওই তেঁতুলতলার দিকে রওনা দিলাম।
যেতে যেতে দিদি এবার এক এক করে আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিতে লাগলো।
দিদি এই গ্রামেরি একটা কে ভালোবাসে। যে দিদির সাথে কলেজে পড়তো। তারসাথেই বিয়ে করতে চলেছে দিদি। ওই ছেলেটার নাম সোম। আর দিদির নাম মিষ্টি। সোম গরীব ঘরের ছেলে এইজন্য মিষ্টির বাবা ওর সাথে বিয়েতে রাজী হয়নি তাই পালিয়ে বিয়ে করবে।
সোমের তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে থাকার কথা। ওখানেই ওরা বিয়ে সারবে।
তেঁতুল তলায় পৌঁছে দেখি একজন লিকলিকে কালো চেহারার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মনেমনে হাসলাম যে এমন ও হয়। শহরের সুন্দর মেয়ের সাথে গ্রামের এইরকম একটা ছেলের বিয়ে।
আমরা মোট চারবন্ধু ও সাথে বর-বউ মোট ছয়জন ছিলো। আমরা ওইখানেই ওই দিদির বিয়ে করালাম। দিদি আর দাদা মালাবদল করে, ওইখানেই সাতপাক ঘুরলো। ব্যস..তারপরেই সিঁদুরদান। বিয়ে সম্পুর্ন।
আসল ধাক্কা তো আমরা সকলে তখনি খেলাম যখন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দিদি-কে বললাম – দিদি এবার তোমরা কোথায় থাকবে?
দিদি বললো – এই গাছের উপরে।
আমি – মানে?
দিদি – হ্যাঁ রে, ওইদেখ আমার বরের দেহ ঝুলছে তেঁতুল গাছের ওপাশে। আমরা দৌঁড়ে গিয়ে দেখি যার সাথে আমরা দিদি-টার বিয়ে দিলাম সেই ছেলেটার দেহ ঝুলছে ওই তেঁতুল গাছে। আমাদের চারজনের অবস্থা তখন অজ্ঞান হবার পর্যায়।
দিদি বললো – ভয় পাস না রে। আমাদের বিয়ে আসলে কেউ মানতে চাইনি। তাই আমরা দুইজনেই সুইসাইড করেছি। এতক্ষণে হয়তো আমার ডেডবডি-টা আমাদের গ্রামের বাড়ির সবাই দেখে ফেলেছে।
আমি – তারমানে তুমি…তুমি….তুমি….
দিদি – হ্যাঁ রে ভাই, আমিও মৃত। ভয় পাস না তোদের আমরা কোনো ক্ষতি করবোনা। ভালো থাকিস তোরা। আর হ্যাঁ সুমন ভাই। তুমি দারুণ ভ্যান চালাও। ভীষণ মজা পেয়েছি। যাও ভ্যানে গিয়ে দেখো আমার কিছু গহনা আছে, সেগুলো তোমরা সকলে ভাগ করে নিও। আমরা তাহলে আসছি কেমন?
ওই দিদি-টা তার স্বামীর হাত ধরে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ওই অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম তারা আসতে আসতে একটু একটু করে দুইজনেই পুরোটা মিলিয়ে গেলো।
আমরা সকলে মিলে দিদিদের জানালাম ” বিবাহ জীবন তোমাদের অনেক শান্তিতে কাটুক ”
তখন আমাদের সকল বন্ধুদের চোখ থেকে জল বেয়ে পড়ছিলো।