খুন রহস্য

সকাল সকাল মায়ের চিৎকার শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে যেতেই মা হাউমাউ করে কেঁদে বললো,”তোর রহিমা আন্টিকে গতকাল রাতে কারা যেন নৃশংসভাবে খুন করে গেইটের সামনে ফেলে রেখে গিয়েছে!

 

আমি মায়ের মুখে কথাটা শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।দৌড় দিয়ে বাহিরে এসে রহিমা আন্টিদের বাড়ির দিকে যেতেই দেখলাম অসংখ্য মানুষের শোরগোলে পুরো বাড়িটাতে শোকের ছায়া ভর করেছে।উপস্থিত জনতার চোখ জোড়াতেও আতংক এসে ভিড় করেছে।

দ্রুত হেঁটে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে মৃত রহিমা আন্টির দিকে তাকাতেই পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো ভয়ে।

 

গলার ঠিক মাঝ বরাবর ধারালো ছুরির আঘাতে চিরে দিয়েছে আততায়ীরা।যেমনটা কোরবানির গরু জবাই দেওয়া হয়,ঠিক তেমনি করে।

রক্তের বারিধারায় গেইটের সামনের দিকটাতে পুরোটা রক্তে জমাট বেঁধে লাল হয়ে গিয়েছে।চোখ দুটো খুবলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে দু দিকে।

বিশ্রী আর ভয়ংকর মৃত্যু দেখে শরীরের সমস্ত লোমগুলো শিহরিত হয়ে উঠলো আমার একমূহুর্তের জন্য।

 

মৃত লাশের দিকে আর তাকানোর সাহস হলো না আমার।

ভিড় ঠেলে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো,রহিম চাচা আর তাঁর মেয়ে রুহির ভেঙ্গে পড়া কান্নারত মুখ দুটি।

মা হারানোর শোকে রুহি অনবরত এখনো কেঁদেই চলেছে,আর রহিম চাচা নিজেকে শক্ত করে ধরে মৃত স্ত্রী’র লাশের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে।

 

আমি পা টিপে টিপে রহিম চাচার কাছে গিয়ে জানতে চেয়ে বললাম,”আংকেল কিভাবে হলো এসব?

 

রহিম চাচা কাঠের পুতুলের মত স্থির থেকেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থাকলেন,তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”গতকাল রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আর তোমার চাচি ড্রইংরুমে বসে বসে টিভি দেখছিলাম।

বৃহস্পতিবারের রাত দেখে একটু বেশি রাত অবধি সজাগ ছিলাম।

রাত তখন ১২ টা কি তার একটু বেশিই হবে।

 

তোমার চাচি হঠাৎ করে বলে উঠলো,”ওগো শুনছো,বাড়ির বাহিরে যেন একটা বাচ্চা কান্না করছে মনে হচ্ছে।

 

রুহির মায়ের কথা শুনে আমি টিভির ভলিউম কম করে বললাম,”কোথায়?

 

ঠিক তখনি কানে ভেসে আসলো,সদ্য নবজাতক একটা বাচ্চা শিশুর কান্নার আওয়াজ।

আমি ভালো করে কান পাততেই মনে হলো,কান্নার আওয়াজটা আমাদের বাড়ির বাহিরে ঠিক মেইন রোড থেকে ভেসে আসছে।

 

তোমার আন্টিকে বললাম,”হয়তো পাশের বাড়িতে কোনো বাচ্চা ক্ষুধা লাগতে কান্না করছে।

 

“তোমার চাচি তার কান দুটি আরো সজাগ করে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,” না কোনো বাড়িতে নয়,দেখো আমাদের বাড়ির গেইটের সামনে থেকেই আসছে মনে হচ্ছে।হয়তো কোনো মা তাঁর অভুক্ত বাচ্চাটিকে নিয়ে এই রাতের আঁধারে কোনো আশ্রয় না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

 

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,”এই রাতের অন্ধ্যকারে আর কোনো আপদ ঘরে তুলতে চাই না আমি।হতেও তো পারে,কেউ তার খারাপ পাপের ফল ভোগ করতে না পেরে ফেলে রেখে গিয়েছে ময়লার স্তুপে।

 

রুহির মা জবাবে বললো,”দেখো না বাচ্চাটা কিভাবে কান্না করছে,আমার মন মানছে না।হাজার হলেও মা তো আমি,একটাবার গিয়ে দেখো না?তা না হলে তো বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে।

 

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম,”তোমার মায়া লাগলে তুমি গিয়ে দেখো,বিয়ের আগে সব অাকাম-কুকাম করবে।আর কিছু হয়ে গেলেই তখন রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাবে।এইসব বাস্টার্ডদের জন্যই তো পথশিশুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

 

রুহির মা আমার সাথে আর তর্ক না করে দরজা খুলে সোজা বেরিয়ে গেলো।

কিন্তু কে জানতো,এই বের হওয়ায় তাঁর জীবনের শেষ বের হওয়া হবে।

 

পুরো কথাটা শেষ না করতেই রহিম চাচা আবার ডুকরে কেঁদে উঠে ভেঙ্গে পড়লো।আমার আর সাহস হলো না,পুনরায় জিজ্ঞাসা করবার।

 

আমি রহিম চাচার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার গেইটের দিকে আসতেই দেখলাম,পুলিশ আর ফরেনসিক টিমের লোকজন এসে রহিমা আন্টির লাশটার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ানো লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছে।

ভিড় ঠেলে একজন ইন্সপেক্টর ভিতরে গিয়ে রহিম চাচার কাছে দাঁড়ালো।তারপর কিছুক্ষণ রহিম চাচার সাথে কথা বলার পর বললো,”এই নিয়ে তিনটা খুন হলো একইভাবে।প্রতিটা খুন একইভাবে করা হয়েছে।

আসলে খুনগুলো,খুনি এক প্রকার আনন্দ বা ক্ষোভ থেকেই করছে।কারণ এর আগের দুটো খুন হওয়া লাশের শরীরে থাকা দামি গহনা বা কোনোকিছুই খুনি চুরি করেনি।

এমনকি এই লাশটা থেকেও নয়,তারমানে খুনি কোনোকিছু চুরির উদ্দ্যেশ্যে নয়,বরং নিজেকে সাময়িক আনন্দ দেওয়ার জন্যই খুনগুলো করছে খুনি।। খুনি হতে পারে কোনো সাইকো বা সিরিয়াল কিলার,আবার হতে পারে খুনি একা,বা দলভিত্তিক।এবার সবাইকে সতর্ক করে দিতে হবে এই খুনির থেকে।আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।আমরা পোস্টমর্টেমের জন্য লাশটাকে মর্গে নিয়ে যাবো,আপনার একটা সাইন লাগবে।আর আমাদের সাথে একটু যেতে হবে।

 

রহিম চাচা পাথরের মূর্তির মত ইন্সপেক্টরের সবকথা শুনে গেলেন কোনোকিছু না বলে।

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,”তদন্ত করে কি করবেন,পারবেন আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে?ওরা আমার স্ত্রী’কে গলা কেটে হত্যা করেছে।

যেমন করে,একজন কশাই গরু-ছাগল জবাই করে।আমার স্ত্রী মরার সময় অনেক কষ্ট পেয়ে মরেছে,এখন আর ওর লাশটাকে কেটে ওর আত্মাকে আর কষ্ট দিয়েন না। 

পারলে খুনিকে ধরেন,তার শাস্তির ব্যবস্থা করেন।

 

ইন্সপেক্টর শান্ত গলায় বললেন,”দেখুন আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি।কিন্তু খুনিকে ধরতে হলেও তো আমাদের যথাযথ প্রমাণ হাতে থাকতে হবে।যাকে তাকে তো আর হুট করে খুনি সাব্যস্ত করতে পারিনা।আর এইসকল লাশের তো তদন্ত করতেই হয়।প্লীজ আপনি একটু সহযোগিতা করুন।

 

রহিম চাচা আর কিছু না বলে তাঁদের সাথে থানায় চলে গেলেন।

রুহি তাঁর দাদির হাটুতে মাথা রেখে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে তখনো।

আমিও একমূহুর্ত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।কেন যানি বারবার আন্টির বিভৎস লাশটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

 

রহিম চাচার পিছন পিছন বার হয়ে সোজা বাড়িতে চলে আসলাম।

মা আমাকে দেখেই আগ্রহি চোখে ছুটে এসে জানতে চেয়ে বললো,”পুলিশ এসে নিয়ে গেলো ভাবিকে?

 

আমি মাথা নাড়িয়ে শুধু হ্যাঁ বলে রুমে চলে আসলাম।

কেন যানি কোনোকিছু ভালো লাগছে না।

এভাবে চোখের সামনে একটা হাসি-খুশি পরিবার ভেঙ্গে গেলো।

কিন্তু চাচার মুখে ঘটনাটা শোনার পর থেকে একটা কথায় মাথার ভিতরে ঘুরছে,কান্না তো করছিলো একটা নবজাতক বাচ্চা শিশু,তাহলে আন্টি কিভাবে খুন হলো?

আর পুলিশ বলছিলো এর আগেও নাকি একইভাবে আরো দুটো খুন হয়েছে।

তাহলে কি বাচ্চা শিশুটাকে খুনি খুন করার একটা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে?

 

কোনোকিছুই মাথাতে ঢুকছে না।

সকালটা কোনমতে কেটে গেলো ওসব চিন্তা ভাবতে ভাবতে।

দুপুরে খাওয়ার সময় টিভিতে হওয়া সংবাদ শুনে সেদিকে তাকালাম।

 

আমি যেটা ভেবেছিলাম সেটাই টিভিতে প্রচার হচ্ছে।কোনো একটা চক্র বাচ্চা শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনিয়ে লোকজনে মন নরম করে ফেলছে,তারপর বাহিরে বার করে এনে নৃশংসভাবে খুন করছে।

টিভিতে সংবাদের মাধ্যমে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে,যাতে মাঝরাতে কোনো বাচ্চা শিশুর কান্না শুনতে পেলেও কেউ ঘর থেকে বার না হয়।

 

মা সংবাদ শুনে বললো,”মানুষ এতো খারাপ হয় কি করে?একজন মানুষ হয়েও একটা মানুষকে এমনভাবে খুন করতে একটুও হাত কাপে না তাঁদের?

বাবা তুই অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করিস।

তোকে নিয়েই তো আমার যত ভয়।

 

আমি মাকে অভয় দিয়ে বললাম,”মা তুমি অযথা টেনশন করছো,আর মৃত্যু যার যেখানে লেখা আছে সেখানেই হবে।

তাই বলে কি ভয় পেয়ে চুপচাপ বসে থাকবো।

আর বসে থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে তখন।

 

“তবুও,একটু সকাল সকাল ফেরার চেষ্টা করিস বাবা।

তুই চলে গেলে তো,বাড়িতে আর কোনো পুরুষ মানুষ থাকে না আমি আর তোর বোন দুজনেই তো মেয়ে।ভয় তো একটু লাগবেই তাই না?

 

” আচ্ছা ঠিক আছে।সকাল করেই ফেরার চেষ্টা করবো।আর আমি বাসায় এসে ফোন দিয়ে না বলা অবধি যেন তুমি দরজা খুলবে না,ঠিক আছে।

 

“আচ্ছা ঠিক আছে,এতো আতংকের ভিতরেও আবার নতুন আতংক এসে জুটলো।

 

কথাটা বলে মা আবার রান্না ঘরে ঢুকলো।

 

পরদিন রাতে আমি বিছানাতে বসে বসে ল্যাপটপে অফিসের একটা জরুরি কাজ করছিলাম।হঠাৎ করে মা ছুটে এসে বললো,” খোকা বাহিরে একটা বাচ্চা শিশু কান্না করছে শুনছে পাচ্ছিস?

 

কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখাতে ঠিকমত মায়ের কথাটাও শুনতে পেলাম না।হেডফোন খুলে বললাম,”কিছু বলবা মা?

 

মা কিছুটা অস্থিরতা নিয়ে বললো,”খোকা তুই শুনতে পাচ্ছিস বাহিরে একটা বাচ্চা কান্না করছে!!

 

মায়ের কথা শুনে কান দুটি সজাগ করতেই কানে ভেসে আসলো,একটা বাচ্চার কান্নার আওয়ার।অসহায় হয়ে যেন কান্না করছে বাচ্চাটি।

মা রুম থেকে বাহির হয়ে যেতে চায়লে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,”কোথায় যাচ্ছো মা?

 

মা চোখ-মুখে অস্থিরতা দেখিয়ে বললো,”দেখছিস না বাচ্চাটা কিভাবে কান্না করছে?হয়তো কোনো অভাগীনি তাঁর বুকের মানিককে ফেলে রেখে গিয়েছে।

 

আমি শক্ত চোখে বললাম,”মা তোমার কি মনে নেই,সকালে টিভির সংবাদে কি বলছিলো?

ওটা কোনো বাচ্চা নয়,ওটা হলো সেই সাইকো কিলারের মানুষকে দুর্বল করার মন্ত্র।

তুমি একদম যাবে না।

 

কথাটা বলে আমি আবার কাজে মননিবেশ করালাম।

 

মা রুম থেকে বার হয়ে গেলো।

মিনিট বিশেক পর ছোট বোনটা এসে বললো,”ভাইয়া মা সেই কখন বাহিরে গেছে,এখনো তো ফিরলো না।

 

আমি ভয়ার্ত চোখে ছোট বোনটার দিকে তাকিয়ে বললাম,”কী!! কখন গিয়েছে?

 

“এইতো মিনিট বিশেক হবে।বললো বাহিরে নাকি কে কান্না করছে একটু দেখে আসি।কিন্তু এখনো তো আসছে না।

আমার এমনিতেই রাতে একা একা ভয় করে,আর মা গিয়ে বসে আছে।

একটু ডেকে দাও না ভাইয়া?

 

আমি সঠান বিছানা ছেড়ে উঠে এক দৌড়ে বাহিরে চলে গেলাম।অন্ধ্যকার রাত,মাথার উপর থাকা সোডিয়ামের আলোতে সামান্য কিছু অংশ বাদে সবকিছুই কেবল অন্ধ্যকার।

পকেটে থাকা মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে নিয়ে কয়েকবার মা বলে ডাক দিতেই একটা গোঙ্গানির আওয়াজ কানে ভেসে আসলো অন্ধ্যকারের ভিতর থেকে।

 

আওয়াজ টাকে ফলো করে মোবাইলের টর্চ ফেলে সেদিকে প্রাণপণে ছুটে গেলাম।

অন্ধ্যকারের মাঝে টর্চের আলো পড়তেই,মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বার হয়ে আসলো,” মা…!

 

চলবে….

খুন রহস্য

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=265945178426604&id=100050333705958

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত