পৃথিবীতে ডেভিল বা শয়তানের বাস সেখানে। শূণ্যে বিলীন হয়ে গেছে অসংখ্য প্লেন ও জাহাজ। শত শত বছর ধরে এই জায়গা নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। কারো মতে খোদ ডেভিলের বসবাস সেখানে আবার কারো কাছে এসব নেহায়েত লোক ঠকানো গুজব। কি রয়েছে সেখানে? গডজিলার মত কোন প্রাগৈতিহাসিক দানব লুকিয়ে নেই তো? আজ জানব এই ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্য।
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে আমেরিকার মায়ামি, ব্রিটিশ সরকারের অধীন বারমুডা এবং পুয়ের্তো রিকোর মাঝে প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গমাইলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এই কুখ্যাত এলাকার অবস্থান।
১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সময় সর্বপ্রথম এই স্থানের অস্তিত্ব জানা যায়। কলাম্বাস সেখানে গিয়ে রাতের বেলা অদ্ভুত সব আলো দেখতে পান রাতের আকাশে। শুধু তাই নয়, কলাম্বাসের কম্পাস ঠিকভাবে কাজও করছিল না এই অঞ্চলে প্রবেশের পর থেকেই।
তখন থেকেই এই স্থান নিয়ে শুরু হয় নানারকম আজগুবি সব খবর ছড়ানো। আগুনে হাওয়া দেয়ার মত এসব খবর আরও দ্রুত ছড়াতে লাগলো যখন স্থানীয় কিছু নৌকা মাঝিসমেত গায়েব হয়ে যাবার ঘটনা এর সাথে যুক্ত হল। সবাই ভাবতে শুরু করলো এ অঞ্চলে নিশ্চয়ই কোন অতিকায় দানব রয়েছে যারা নৌকাসুদ্ধ লোক গায়েব করে ফেলছে। কেউ কেউ বলতে লাগলো এখানে নাকি ডেভিল বা শয়তানের সর্দারের বাস।
এরপর থেকে বেশ অনেকদিন লোকমুখে নানান কাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে ১৯৪৫ সালের একটি ঘটনা নতুন করে এই অঞ্চল নিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। কি এমন ঘটেছিল ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর? ফ্লাইট ১৯ নামে একটি রুটিন ট্রেনিং মিশন ছিল সেদিন। যেখানে ইউএস নেভির “অ্যাভেঞ্জার টরপিডো বম্বার নামক ৫ টি যুদ্ধবিমান আকাশে মহড়া দিবে। দুপুর দুইটার কিছু পর উড্ডয়ন হয়।
উড্ডয়নের ৪ ঘন্টা পর প্রথম একটি ডিস্ট্রেস মেসেজ আসে ফ্লাইট কন্ট্রোল রুমে। পাইলটদের বক্তব্য অনুযায়ী সেখানে সবকিছু অদ্ভুত দেখাচ্ছিল, তারা দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, তাদের কম্পাস কাজ করছিল না। শেষবারের মত আরেকটি ডিস্ট্রেস সিগন্যাল আসে, যেখানে পাইলট শুধু বলেন, “আমরা হারিয়ে গেছি। এরপর তাদের উদ্ধারের জন্য আরেকটি উদ্ধারকারী বিমান পাঠানো হলে আনুমানিক ২০ মিনিট পর সেই বিমানটিও নিখোঁজ হয়ে যায়। আজও সেসব বিমানের কোন ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়নি বহু অনুসন্ধান চালিয়েও।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নামটি প্রথম ব্যবহার করেন ভিনসেন্ট গ্যাডিস নামের একজন সাংবাদিক। একটি ম্যাগাজিনের কভার স্টোরি হিসেবে ১৯৬৪ সালে এই নামটি জনসম্মুখে পরিচিতি লাভ করে।
সেই বিমান দূর্ঘটনার পর থেকে এমন হাজারো জাহাজ ও প্লেন শূণ্যে বিলীন হয়ে গেছে যার কোন হদিস আজও মেলেনি। তাহলে কী এমন প্রাকৃতিক শক্তি লুকিয়ে রয়েছে এখানে, যা এত শত শত বিধ্বংসী যান একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে বিজ্ঞানে। দীর্ঘদিন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে গবেষণা শেষে এই অঞ্চলের এমন বৈরুপ আচরণের কারণ বেরিয়ে এসেছে।
প্রথমত, এই অঞ্চলে পানির একেবারে নিচেই লুকিয়ে রয়েছে খাড়া সব প্রবাল প্রাচীর যা দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হয় না। এর ফলে যখনি কোন বড় জাহাজ একটু অসতর্ক হয়, তখনি ঘটে বড় রকমের সব দুর্ঘটনা। যেখানে লোহার তৈরি জাহাজই টিকতে পারে না সেখানে আগেরদিনের কাঠের তৈরি নৌকা তো একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে যেত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে এখনো প্রায় ৩০০ র অধিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে রয়েছে।
আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে, এই অঞ্চলে আটলান্টিক মহাসাগরের সবচেয়ে অশান্ত ও বৈরী বায়ুপ্রবাহ বিদ্যমান। এর সাথে যুক্ত হয় তিন দিক থেকে আসা দুর্ধর্ষ স্রোত। ফলে প্রচন্ড বেগে বায়ুপ্রবাহের সাথে সমুদ্রের জল ও উঠে এসে তৈরি হয় এমন সব অপ্রতিরোধ্য ঘূর্ণিঝড় যা বড় বড় যুদ্ধবিমান কিংবা জাহাজকেও নাস্তানাবুদ করে দেয়। কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাওয়া এসব প্লেন কিংবা জাহাজের অধিকাংশেরই কোন অস্তিত্বই কেন খুঁজে পাওয়া যায় না?
কারণ বিশ্বের সবচেয়ে গভীর সমুদ্রখাতগুলোর অবস্থান এই অঞ্চলেই। যার ফলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া যানবাহন গুলো সমুদ্রের এত গভীরে চলে যায়, যেখান থেকে উদ্ধার করা তো দূর সেসবের অস্তিত্ব নিশ্চিত করাটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রাগৈতিহাসিক কোন দানব কিংবা ডেভিল- কোনোটিই নয়। প্রকৃতির অদম্য শক্তির কাছে মানুষের সব শক্তিই নিতান্ত তুচ্ছ।