প্রত্যেক বার বিভিন্ন কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় একজন মহিলাকে দেখতে পাই। দরজার পাশে বসে মহিলা তিলওয়াত করেন। বোরখা পরিহিত আপাদমস্তক ঢাকা একদম। কেউ কোন কিছু উনাকে বলে না মাঝে মাঝে দেখি দু একজন নার্সের সাথে কথা বলেন আর তিলওয়াত শেষে কেবিনের রোগীদের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে চলে আসেন। ব্যাপারটা বেশ অবাক করার মত হলেও আমি খেয়াল করার মত এত সময় পাইনি। মা’কে নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
গত মাসে মায়ের ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে। মাঝামাঝি স্টেপে আছে অপারেশন করাতে হবে তাও লাইফ সিকিউরিটি ৪০% বাকি ৬০% অন্ধকার। তবুও আপু এত বড় রিক্সটা নিলেন। মা ছাড়া আপন বলতে পরিবারে আর কেউ নেই আমরা তিন বোন বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হল। চাচাদের সাথে সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা হয় এরপরেও আমাদের অংশে কম কারণ আমাদের কোন ভাই নেই বলে! এরপর আমরা গ্রাম ছেড়ে লক্ষ্মৌতে এসে থাকা শুরু করি শহরের শেষ প্রান্তে একটএ নিরিবিলি এলাকা। যা পেয়েছি তা দিয়ে এবং আমার আর আপু অল্প কিছু ইনকাম দিয়ে মায়ের অপারেশনের টাকা জোগাড় করা হয়েছে বহু কষ্টে। মায়ের অপারেশনের দুদিন বাকি অপারেশনের আগে যত রকমের টেস্ট করা প্রয়োজন সেগুলো চলছে এখন। লাস্ট একটা ইউরিন টেস্টে মায়ের কিডনিতে প্রবলেম ধরা পড়ে। আমরা আরো ভেঙ্গে পড়ি এমনিতে ডাক্তার উনার কনডিশন আমাদের বলে দিয়েছে তার উপর এরকম সমস্যায় অপারেশন কতটা প্রভাব ফেলবে ভাবতে ই আমাদের গা শিউরে উঠছিল। তখনি মাথার উপর কারো হাত অনুভব করলাম। আপু কিছু মেডিসিনের জন্য বাইরে গেছে আমি একা কেবিনের বাইরে। তাকাতে ই দেখি ওই ভদ্র মহিলা।
আমার মাথায় হাত রেখে বলছেন, কিছু ই হবে না তোমার মায়ের যার এমন সন্তানরা আছে সে এত তাড়াতারি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারে না আর উপরওয়ালা তো আছেন উনি দেখছেন সবকিছু কোন সন্তান বাবা মায়ের জন্য মন থেকে কিছু চাইলে তাকে সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দেন না। এসব বলে আরেকবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলেন। আমিও আর বলার মত কিছু পেলাম না। মায়ের অপারেশনের দিন চলে আসলো। হুট করে ডাক্তার জানালেন মায়ে অপারেশনে রক্ত লাগবে। কিন্তু এত অল্প সময়ে কোথায় হতে রক্ত আসবে! তাও এত রেয়ার গ্রুপের রক্ত। AB- রক্তের গ্রুপ আমাদের কারো ই নেই। আপু প্রায় রেগে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে লাগলেন। রক্ত যখন লাগবে তাহলে আগে জানানো উচিত ছিল আমাদের। সময় নিয়ে আমরা ম্যানেজ করে রাখতাম এত অল্প সময়ে এখন রক্ত কোথায় পাওয়া যাবে।
আমি আপুকে শান্ত করলাম। সবার কাছে খবর পাঠিয়ে দিলাম। সোশ্যাল মাধ্যমেও ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে হেল্প চাইলাম দু একজন পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু একজন প্রেগন্যান্ট আর আরেকজন যাকে অনেকটা দূর থেকে আনা হয়েছিল শেষ ভরসা হিসেবে কিন্তু উনার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। কোন পথ খোঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। আর আমাদের বড় বা গুরুজন বলতেও কেউ নেই যে একটু সাহস দিবে। একমাত্র মা ই আমাদের সবকিছু। মায়ের মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন জানি করছিলো। বার বার সৃষ্টিকর্তাকে বলছিলাম আমাদের শেষ আশ্রয় টুকু যেন কেড়ে না নেন। হঠাৎ করে নার্স বলল রক্ত পাওয়া গেছে।ডাক্তার তখনি আর দেরি না করে অপারেশন রুমে চলে গেলেন। প্রায় আড়াই ঘন্টা অপারেশন চলতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত মায়ের অপারেশন সাকসেসফুল হয়। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া জানিয়ে আমরা দু বোন নফল নামাজ আদায় করি। নামাজ শেষ করা অবস্থায় হটাত মনে পড়ল রক্তের কথা। কে রক্ত দিল। বা নার্স কোথা থেকে রক্ত জোগাড় করলেন অপারেশনের টেনশনে মাথা থেকে চলে গিয়েছিল এ বিষয়টা। নামাজ থেকে উঠে ওই নার্সের কাছে গেলাম। গিয়ে জানতে চাইলাম রক্ত কোথায় হতে এনেছেন বা কে দিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ওই নার্স আমাকে জবাব দিতে নারাজ। আমি উনাকে অনেক জোড়াজুরি করলাম তাতে তিনি বলবেন না কিন্তু আমিও না জেনে ছাড়ব না। সবশেষে বললাম শুধু কে দিয়েছে সেটা জানতে চাই কার উসিলায় আল্লাহ আমাদের মাকে আমাদের কাছে সুস্থ করে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন ওই বোরখা পরিহিত মহিলা। আমি জানতে চাইলাম উনি কোথায়। নার্স বললেন উনি নেই। নেই মানে বাসা কোথায় উনার।
যখন নার্স বললেন, একজন মৃত ব্যক্তির কোনো বাসা থাকে না তখন আমার সারা শরীরের লোমগুলো যেন কাটা দিয়ে উঠল। একজন জীবন্ত মানুষকে উনি মৃত বলছেন কেন? আর আমি নিজের চোখে কয়েকবার দেখেছি উনাকে আর অন্য নার্সদের সাথেও তো কথা বলেছেন। তখন নার্স বললেন,, উনি এখানে সব পুরনো নার্সদের সাথে হটাত কথা হয় আর এখানে পুরনো নার্স বলতে দুজন! আর কেউ উনাকে দেখেন না। গত পাঁচ বছর আগে এই হাসপাতালে ই উনার মৃত্যু হয়! সংসারে আপন বলতে কেউ নেই। শ্বশুরবাড়িতে উনার কোন কদর ছিল না। চার মেয়ের জন্মের পর ছেলে সন্তানের মুখ দেখতে চায় পরিবার কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। চার মেয়ের পরে নাকি উনার ব্যাস্টক্যান্সার ধরা পড়ে বুকের একপাশ কেটে ফেলে দেয়া হয়। শুরু হয় সব মিলিয়ে আরো অশান্তি।
আরেকটা বিয়ে করেন। শ্বশুরঘরের সংসারে দিন দিন অপ্রয়োজনীয় বস্তু রূপে পরিনত হতে লাগলেন। শুধু মাত্র চার মেয়ের জন্য সেখানে থাকা। চার মেয়ের মধ্যে একজন মারা যায় রোগে। বাকিরা বড় হওয়ার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে দেন ওদের দাদা। বেশ ভালো জায়গায় বিয়ে হয়ে যায় মেয়েদের তিনজনের মধ্যে দুজন ই স্বামীরর সাথে দেশের বাইরে। আরেকজন বরের চাকরির সুবাদে অন্য বিভাগে থাকে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আরো একা হয়ে গেলেন। যে যার মত ব্যস্ত সপ্তাহে একবার খোঁজ নেয় মনে পড়লে। সংসারে উচ্ছিষ্ট বস্তুতে ধাবিত হলেন। ঘরের বিভিন্ন রকম মানসিক অশান্তিতে শ্বশুরের কাছে আবদার করলেন শেষ বয়সে তাদের ওই ক্লিনিকে কাটিয়ে দিবেন। বলেছিলেন নাকি অন্যের কষ্টের ভাগীদার হলে নিজের কষ্ট কিছুটা কমে।
চলে আসলেন এখানে। প্রতিদিন রোগীদের সাথে আনাগোনা বাড়ে তাদের কাজে সাহায্য কিংবা অবসরের সঙ্গী হয়ে পড়েন তিনি। কিংবা কারো শেষ মুহূর্তে তার পাশে বসে শেষ যন্ত্রনা কিছুটা লাঘব করতে তিনি ব্যস্ত। একসময় উনারও সময় আসে। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন উনার বাড়িতে চলে যান কিন্তু দুদিন থেকে ই চলে আসেন। শান্তি পাননি। মেয়েদের খবর দেওয়া হল। ওরা আসবে আসবে বলে দিন গড়াতে লাগল। আসে না। ছোট মেয়ে শারীরিক অসুস্থতার জন্য জার্নি করতে পারবে না তবে আসবে! কবে আসবে কারো জানা নেই। বাড়িতে এমন কেউ নেই যে আপন বলে দেখাশোনা করবে!! উনার শ্বাসকষ্টের খুব সমস্যা ছিল। প্রত্যেকটা বার উনি আপন কাউকে খুঁজতেন পাশে কিন্তু পেতেন না। খুব কান্না করতেন একা একা।
আমাকে বলতেন উনার পাশে বসে যেন আমি কিছু তিলওয়াত করি আমি করতাম কিন্তু শেষ বার আর পাড়িনি ।
শেস রাতে এখানে আমরা দুজন নার্স ছিলাম উনার খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমাকে আবার অনুরোধ করলেন আমি যেন উনার পাশে থাকি তখনি আমার ফোন আসলো আমার মেয়ে অসুস্থ। ফোনে কথা চলে গেলাম অফিস রুমে। বাসায় যাব কিন্তু মন মানছিল না অনেকদিন যাবত উনাকে কাছে থেকে দেখেছি অনেকটা মায়ায় জড়িয়ে গেছিলাম তারপরও আমার সাথের জনকে রেখে বাসায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উনি বার বার আমার হাত ধরছিলেন কিছু বলতে পারছিলেন না। তবুও আমি চলে গেলাম। কিন্তু যখনি আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠতে যাব তখনি পিছনে কিসের একটা আওয়াজ পেলাম। তাকাতে ই দেখি উপর থেকে কেউ একজন পড়ে গেছে। কাছে যেতে ই দেখলাম ওই মহিলা!! আমার গা শিউরে উঠল।
সাথে সাথে ফোন আসল আমার ধরতে ই শুনলাম অপর নার্স বলছে উনি আর নেই মাত্র মারা গেলেন কেবিনে! আমি আবার শিওর হওয়ার জন্য বললাম কোথায়? সে বলল কেবিনে। তাহলে আমার সামনে কে পড়ে আছে। দৌড়ে আবার উপরে চললাম। গিয়ে দেখলাম ঠিক ই বেডে মৃতদেহ। উনার বাসায় ফোন দিলাম বাকি কাজ করতে আমরা দুজন এদিকওদিক ঘুরছি কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখি বেডে কেউ নেই কোন লাশ নেই!! আমরা থরথর করে কাপছিলাম। একটু আগের ঘটনাও বললাম জানলা দিয়ে নিচে তাকাতে ই দেখি সেখানেও কোন লাশ নেই শুধু রক্ত!! আমরা সেন্সলেস হয়ে যাই। ওরদিন জ্ঞান ফিরলেও আর ওই মহিলাকে দেখতে পাইনি। কাউকে কিছু বলার মত ছিল না।
উনার শ্বশুরবাড়ির দুএকজন এসেছিল যখন লাশ পায় তখন আর এত মাথা ঘামায় নি। মনে মনে হয়ত ভেবেছে আপদ বিদায় হয়েছে। এরপর থেকে এখানে অনেক সময় অনেক রাতেও ওই মহিলাকে দেখা যায় তবে সবাই দেখতে পায় না। কিছু কিছু মানুষ দেখে। আর এ নিয়ে ৫ বার রক্তের অভাবে কোন মা মারা যায় নি। কিভাবে জানিনা উনি এসে দিয়ে যায়। আর খুব আকুতি করে বলে কোন মা যেন সন্তানদের একা করে চলে না যান অকালে।। অদ্ভুত!! সমস্ত কিছু শোনে আমার মাথা ঝিম ধরছিল। ব্লাড ঠিক ই ছিল। মাও সুস্থ হলেন আমি আপুকে আর কিছু বলিনি। তবে বাড়ি ফেরার পর হটাত হটাত মাকে ওই মহিলার মত মনে হত!! আমি ভয় পেয়ে যাই। মাঝরাতে তিলওয়াতের আওয়াজ পেতাম। ঘর থেকে উকি দিতাম চমকে উঠতাম মা নিজেরর ঘরে বোরখা পড়ে তিলওয়াত করছেন মা!!! কেমন জানি কেঁপে কেঁপে উঠে বুক। এ কোন রহস্য চলছে জীবনে….
গল্পের বিষয়:
রহস্য