আশ্রয়

আশ্রয়

“দেখো, দেখো, আবার বেরিয়েছে বিজ্ঞাপনটা!” সকালের বাংলা খবরের কাগজটা প্রায় ডাক্তার সান্যালের চোখের ওপর মেলে ধরলেন প্রতিমা।

“কিসের বিজ্ঞাপন?” ইংরেজী কাগজ থেকে চোখ তুলে ডাক্তার সান্যাল দৃষ্টি নিমগ্ন করার চেষ্টা করেন প্রতিমার মেলে ধরা কাগজটার দিকে।

“আবার ভুলে গেলে? বলছিলাম না, কাল রাত্তিরে? আরে ওই বৃদ্ধাশ্রমের কথাটা। আমি এই ফোন নম্বরে কথা বলেছি কাল বিকেলে।” প্রতিমা আঙুল নির্দেশ করে ফোন নম্বরটা দেখালেন, তারপর বলতে লাগলেন, “ওরা বলেছে এককালীন টাকাটা একটু বেশি দিলে গঙ্গার ধারে বারান্দা-ওয়ালা ঘর বরাদ্দ করবে আমাদের জন্যে। আর কটাই বা টাকা? তাছাড়া মাসে মাসে যে টাকাটা দিতে হচ্ছে সেটাও এমন কিছু বেশি নয় ।আমাদের এখনকার খরচের থেকে তো অনেকটাই কম।”

সকালের প্রথম চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপটা নাবিয়ে রাখতে-রাখতে ডাক্তার সান্যালের হাতটা একটু কেঁপে গেল। বিজ্ঞাপন থেকে চোখ তুলে সরাসরি স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালেন তিনি, তারপর বললেন, “তাহলে এই বাড়িটার কী হবে?”

“একটা কিছু গতি করতে হবে। বিক্রি করে দেওয়াই ভাল। শুভ তো কোনও দিনই আর দেশে ফিরে আসবে না। সুমন্তও বলছিল ওর শরীর আর দিচ্ছে না, এবার ও দেশে ফিরে যেতে চায়, বর্ধমানে।”

সুমন্ত ডাক্তার সান্যালের খাস লোক, মানে ড্রাইভার কাম সহকারী, কাম ভাই, কাম বন্ধু। প্রায় আটত্রিশ বছর ধরে ডাক্তারের নিত্যসঙ্গী। ডাক্তারকে দাদা বলে ডাকে। স্ত্রী প্রতিমা ছাড়া আর যার পরামর্শ ঋজু মেরুদণ্ডের আত্মপ্রত্যয়ী, একবজ্ঞা ডাক্তার শোনেন, সে হল এই সুমন্ত। অবিশ্যি সেটা ডাক্তারির বাইরের পরামর্শ। প্রতিমার কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন ডাক্তার সান্যাল,”সুমো, অ্যাই সুমো,” বলে হাঁক দেন।

প্রতিমা বলে ওঠেন, “আহা, অত চেঁচাচ্ছ কেন?” সকালে প্রাতঃভ্রমণ সেরে বারান্দায় নিজের চেয়ারে সবে বসেছেন ডাক্তার সান্যাল। চিরকালীন অভ্যাস মত খবরের কাগজে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছিলেন, তারপর থেকে একের-পর এক বোমাবর্ষণে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সুমন্ত এসে সামনে দাঁড়ালো, “দাদা বলো।”

“তুই নাকি চলে যাবি বলেছিস তোর বৌদিকে?”

প্রতিমা ঝংকার দিয়ে ওঠেন, “আরে না, না , সেভাবে বলেনি।”

“তুমি চুপ কর, আমি ওর মুখেই শুনতে চাই। কি রে?”

“দাদা, বিলেত থেকে ফিরে তুমি যখন বর্ধমান মেডিকেল কলেজে পড়াতে এলে সেই থেকে আমি তোমার সাথে। আজ প্রায় আটত্রিশ বছর কেটে গেল। ছেলেপিলে গুলো বড় হয়ে লায়েক হয়ে গেছে, বলছে, বাবা আর কাজ করতে হবে না। তাছাড়া শরীরটাও আর দিচ্ছে না, দাদা।”

“কি হয়েছে তোর? যা স্টেথো আর প্রেশার মাপার যন্ত্রটা নিয়ে আয়। ডাক্তারি তো একেবারে ছাড়িনি, ভুলে যাই নি সব কিছু এখনও।”

“না না, তেমন কিছু নয়, তবে শরীর আর বইছে না। তাই বৌদিকে বলছিলাম…” কথাটা অসমাপ্ত রেখে থেমে যায় সুমন্ত।

বিষণ্ণতায়, একাকীত্বে ডুবে যেতে-যেতে কখন যেন নিজের মধ্যেই নিজে হারিয়ে যান ডাক্তার সঞ্জয় সান্যাল। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবার পরেও ডাক্তারি চালিয়ে গেছেন বেশ কয়েক বছর, কিন্তু গত দু’বছর হল প্রাইভেট প্র্যাকটিস থেকে পাকাপাকি অবসর নিয়ে নিয়েছেন তিনি। আগামী অক্টোবরে আটাত্তর পূর্ণ হবে তাঁর, একমাত্র ছেলে শুভঙ্কর আমেরিকা প্রবাসী। কোনোদিন যে দেশে ফিরে আসবে সে আশা তিনি বা তাঁর স্ত্রী প্রতিমা কেউই করেন না। ছেলে অবশ্য অনেকবার তাঁদের অনুরোধ করেছে তাদের সঙ্গে পাকাপাকি আমেরিকায় চলে আসতে। কিন্তু মন সায় দেয় নি তাঁদের, এই দেশ, এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে আস্তানা গাড়তে। ছেলেকে তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, আবার দেশ ছাড়বেন বলে বিলেতের প্রতিষ্ঠিত জীবন থেকে এখানে ফিরে আসেন নি। তাছাড়া বিদেশের মাটিতে মরতে বড় ভয় লাগে তাঁর।

প্রতিমা প্রাতরাশের জন্যে দুবার তাড়া দিয়ে গেছেন। পেশা থেকে অবসর নিলেও নিকটবর্তী বস্তিবাসী রুগীদের বিনা পয়সায় এখনও দেখে দেন তিনি। এর জন্যে বাড়ির একতলায় একটা চেম্বার আছে তাঁর। আজ কিছুতেই আর মন বসতে চাইছে না। খেতে-খেতে সুমন্তকে দেখে আসতে বলেন কোনও রুগী অপেক্ষায় আছে কিনা। সুমন্ত দেখে এসে জানায় জনা সাত-আট অপেক্ষারত। একবার ভাবেন তাদের চলে যেতে বলবেন, কিন্তু অবিচল কর্তব্য-বোধ তাঁকে সেই কাজে বাধা দেয়। অথচ মানসিক ক্লান্তিতে আজ যেন তাঁর ভগ্নপ্রায় অবস্থা। প্রাতরাশ অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়েন তিনি। তাঁকে উঠতে দেখে প্রতিমা হাঁ-হাঁ করে ওঠেন, “কি হল? হঠাৎ উঠে পড়লে কেন?”

“ভালো লাগছে না,” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ডাক্তার সান্যাল।

“সকালবেলা তোমাকে কথাগুলো বলাই আমার ভুল হল,” নিজেকে দোষারোপ করতে থাকেন প্রতিমা।

রাত্রে কিন্তু প্রসঙ্গটা আবার তুললেন প্রতিমা। বললেন, “শোনো, আমি ওদের সাথে আবার কথা বললাম। ওরা বলল এখন কিছু টাকা দিয়ে আপাতত ঘরটা বুক করে রাখা যাবে। তারপর না হয় মাস-কয়েক বাদে এদিককার সবকিছু গোছগাছ করে আমরা চলে যাব ওখানে। আর সুমন্ত যখন চলে যেতে চাইছে ওকে আটকে রাখা কি ঠিক হবে?”

“সুমো চলে যাবে ঠিকই করে ফেলেছে, তাই না? আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে?”

“ওরও তো বয়েস হচ্ছে, তাছাড়া ওর ছেলেমেয়েরাও ওকে আর থাকতে দিতে চাইছে না।”

“হুঁ, বুঝলাম, শুভকে বলেছ?”

শুভ, আজ প্রায় পনেরো বছর আমেরিকা প্রবাসী। এখানে আর ফিরে আসার ইচ্ছে নেই। বছরে একবার এদেশে আসে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে। ঐ কদিন খুব হইচই হয় বাড়িতে। বিশেষ করে নাতনীকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন সান্যাল দম্পতি, বাড়িতেও লোক সমাগম বাড়ে। কিন্তু তারপর ওরা ফিরে গেলে আবার নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে তাঁদের, বিশেষ করে প্রতিমাকে। ডাক্তার সান্যালের তবু সময় কাটানোর জন্যে সকালে রুগী দেখা আছে, মাঝে মধ্যেই ছাত্ররা যাতায়াত করে, কিন্তু এত-বড় বাড়ির মধ্যে এই একাকীত্বে, এই শূন্যতায় প্রতিমা প্রায়ই হাঁপিয়ে ওঠেন। তাছাড়া তাঁর আরও ভয়, ডাক্তার সান্যাল তাঁর থেকে সাত বছরের বড়, তিনি যদি আগে চলে যান তাহলে বাকী জীবন কিভাবে কাটবে তাঁর। সেই হয়তো মাথা নিচু করে ছেলের কাছে আশ্রয় নিতে হবে। ভাবতে-ভাবতে মাঝে-মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসেন প্রতিমা। পাশে শায়িত দীর্ঘকায় মানুষটার দিকে চেয়ে নাইট-ল্যাম্পের আলোয় তাঁর শ্বাস নেওয়া দেখে তবে নিশ্চিন্ত হন।

“কী হল? শুভকে জানিয়েছ এসব কথা?” ডাক্তার সান্যাল উত্তর না পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে খেঁকিয়ে ওঠেন।

“হ্যাঁ, এই তো একটু আগে কথা হল।”

“কী বলল?”

“বলল, মা তোমরা এখানে চলে এসো। আমার আর এখনকার শেকড় উপড়ে দেশে ফেরা সম্ভব নয়।”

“বা! বা! শেকড়! যে দেশ তোকে জীবন দিল, লালন-পালন করল, বাঁচার স্বীকৃতি দিল তার শেকড় উপড়াতে কই সময় লাগল না তো! আর বিদেশের শেকড় উপড়াতে যত যন্ত্রণা? বা! তা তুমি কি বললে?”

“বললাম, আর যে কটা দিন বাঁচব দেশ ছেড়ে যেতে চাই না। বিদেশে মরতে পারব না।”

“তারপর!”

“তারপর আর কী? বউমা আর নাতনীকে ধরিয়ে দিল। তাঁদের সাথে কথা বলতে-বলতে কেটে গেল বাকী সময়টা।”

“বাহ!অপূর্ব! আমার একেক সময় কী মনে হয় যেন? মনে হয় আমরাই চরম অশিক্ষিত। একমাত্র সন্তানকে শুধু লেখাপড়াই শিখিয়েছি। দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শেখাই নি।” আক্ষেপ ঝরে পড়ে বৃদ্ধ ডাক্তারের গলা থেকে।

“কিন্তু সে তো তোমাকে দেখেও কিছু শিখল না গো। জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকেই গুরুত্ব দিল সবচেয়ে বেশি।”

“সুখ খুব আপেক্ষিক শব্দ প্রতিমা। কে যে কিসে সুখী হবে, সেটা নির্ভর করে তার চরিত্র, মানসিক গঠন এমন কি পারিপার্শ্বিকের ওপরেও। যাকগে, সুমন্ত যদি যেতে চায়, যেতে দাও। আমরা বরং ভদ্রেশ্বরে ওঁই বৃদ্ধাবাসেই চলে যাব। আর এই বাড়িই বা রাখব কার জন্যে? বিক্রিই করে দেব।”

এ কথায় উদ্বেগ কিছুটা কাটল প্রতিমার। জীবনের একটা পর্যায় বোধহয় শেষ হল। আবার নতুন এক পর্যায়ের সূত্রপাত ঘটাবার প্রস্তুতি নিতে হবে তাঁকে। তিনি শুধু বললেন, “শোনো এই বাড়িটা এক্ষুনি বিক্রি করার দরকার নেই। একজন কেয়ারটেকার রেখে যাই বরং। যদি ওখানে থাকতে ভালো না লাগে ফেরৎ চলে আসব। আর তাছাড়া…”

“তাছাড়া কি?” প্রশ্ন করে মনে মনে হাসলেন ডাক্তার সান্যাল। তাঁর কর্মব্যস্ততার মাঝে সংসারে কোনোদিনই সেভাবে মন দিতে পারেননি তিনি। শুধু অর্থই দিয়েছেন। বাড়ির ডিজাইন, রঙ থেকে শুরু করে ইন্টিরিয়রের সমস্ত পরিকল্পনাই প্রতিমার। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন প্রতিমা এই বাড়ি, এই সংসার। তাই একেবারে ছেড়ে যেতে বোধহয় কষ্টটা একটু বেশিই হবে তাঁর।

“না মানে, তাছাড়া মাঝে-মধ্যে এখানে এসে থাকা যাবে, যদি ওখানে একঘেয়ে লাগে। শুভ’রাও তো বছরে একবার অন্তত আসে। তখন ওরা কোথায় থাকবে?”

“শুভ’র মায়া এবার ত্যাগ কর প্রতিমা।” অভিমানী শোনায় সঞ্জয় সান্যালের কণ্ঠস্বর।

“কি বলছ তুমি? সন্তানের মায়া কি অত সহজে যায়?”

প্রায় দুমাস কেটে গেল তাঁদের এই বৃদ্ধাশ্রমে। সান্যাল-দম্পতির জনপ্রিয়তা দারুণ এখানে। ডাক্তারবাবু খুব ভালো আছেন। অন্য আবাসিকদের চিকিৎসা করেন নিয়মিত। সুমন্ত ফিরে গেছে বর্ধমানে, তার নিজের বাড়িতে। ডাক্তারবাবু তাঁর গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন কোথাও যেতে হলে ভাড়া করা গাড়িতে যান। এরমধ্যে কয়েকবার আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া হলেও নিজের বাড়িতে আর ফেরা হয়নি তাঁদের। ছেলের ফোন আসে প্রায়ই। নিয়মিত সে খোঁজখবর নেয় তাঁদের। মাঝে-মধ্যে নাতনীর সাথেও কথা হয়। এখন একাকীত্ব অনেক কমে গেছে প্রতিমার। বৃদ্ধাবাসে কিছু-না কিছু আনন্দের উৎস রোজই থাকে প্রায়। আজ কারুর জন্মদিন তো কাল কোন দম্পতির বিবাহ-বার্ষিকী। এখানে সব কিছুই সবাই মিলে পালন করে। শুধু এই ক’মাসে মাত্র তিনবার তাল কেটেছিল। তিনজনকে চিরবিদায় জানাতে হয়েছে বাকিদের।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশের রঙ ঝাপসা। সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারের বারান্দায় বসে আছেন তাঁরা দুজন। অনেক গল্প হচ্ছে পুরনো দিনের। প্রতিমা প্রায় বালিকার মত উচ্ছ্বসিত। আজ তাঁদের নাতনীর জন্মদিন। প্রতিমা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ফোন করে। অনেক কথা হয়েছে ঠাম্মা-নাতনীতে। বৃদ্ধাবাসের আবাসিকদের জন্যে এই উপলক্ষে খাওয়ানোর বিশেষ বন্দোবস্ত করেছিলেন তাঁরা। প্রতিমা নাতনীর নামে পূজোও দিয়েছেন কাছের মন্দিরে। সব ছবি হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকের মাধ্যমে পৌঁছে গেছে সুদূর আমেরিকাতে।

হোমের বিছানায় সারাদিনের ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছেন বৃদ্ধ দম্পতি। সাধারণত খুব ভোরে ঘুম ভাঙে ডাক্তারবাবুর। প্রতিমা চিরকালই পরে ওঠেন ঘুম থেকে। উনাকে ডেকে তুলতে হয়, এখনও তাই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রতিমাকে দুবার ডাকলেন সঞ্জয়। সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত রাখলেন। এ কি ? গা তো বেশ ঠাণ্ডা। নাড়ি দেখলেন। না, সাড়া নেই। বুকে কান পেতে হৃদপিণ্ডের শব্দ শোনার চেষ্টাও ব্যর্থ হল। ডাক্তারবাবু নিশ্চিত হলেন তাঁর প্রতিমা তাঁকে ফাঁকি দিয়ে বিসর্জনের পথে পাড়ি দিয়েছেন। ছেচল্লিশ বছরের যৌথ জীবনে এই প্রথম তাঁকে অমান্য করে চলে গেলেন প্রতিমা, লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসককে সামান্যতম চিকিৎসারও সুযোগ না দিয়ে। ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন। প্রথমেই খবর দিলেন হোমের ম্যানেজারকে। তারপর মুঠোফোন বের করে খুঁজতে লাগলেন ছেলের নম্বর। ফোন লাগল। ও প্রান্ত থেকে ঘুম জড়ানো গলায় ছেলে বলল, “হ্যাঁ বাবা! এত রাত্রে কি ব্যাপার?”

“তোমার মা আর নেই।” শান্ত সমাহিত গলায় বললেন ডাক্তার সান্যাল।

“সে কি?” কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলে ওঠে শুভঙ্কর।

“শোন তোমার এক্ষুনি আসার দরকার নেই। সে রকম বাধ্যবাধকতা নেই কোন কিছুর। আর অন্তিম সংস্কার আমিই করতে পারব। তুমি পারলে সময় করে এস একবার, তোমাকে কয়েকটা জরুরী কথা বলার আছে। আমারও তো সময় ফুরিয়ে আসছে।” অভিমানী গলায় কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিলেন তিনি, ছেলেকে আর কোন কথা বলার সুযোগ দিলেন না।

আগামীকাল প্রতিমার শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের আয়োজন তাঁদের নিজেদের বাড়িতেই করেছেন ডাক্তার সান্যাল। কয়েকজন আত্মীয় এবং বন্ধুও এসেছেন। হোমের ম্যানেজার আর কর্মচারীরা সবাই সাহায্য করেছেন তাঁকে। এতদিন বেশ শক্ত হয়েই আছেন তিনি। আজই মনটা কেমন যেন উতলা তাঁর । ছেলে আসবে আজ। ঘরে পায়চারি করছেন তিনি। তারপর হঠাৎ প্রতিমার একটা কম-বয়েসি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন, “তোমারই তো নিঃসঙ্গতার ভয় ছিল বেশি। আমার থেকে সাত বছরের ছোট ছিলে তুমি। আমাকে ফাঁকি দিয়ে বেশ চলে গেলে তো।” বলতে-বলতে দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল তাঁর।

“বাবা!” শুভঙ্করের স্বরে তন্ময়তা ভাঙে ডাক্তার সান্যালের।

“এসেছ? এসো। তাহলে মায়ের শ্রাদ্ধ তুমিই করতে পারবে। আমাকে আর ওসব ঝক্কি পোহাতে হবে না। বস, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

বিমূঢ় হয়ে বাবার পাশে সোফায় বসে পড়ে শুভঙ্কর। ডাক্তার সান্যাল বলেই চলেন, “সেদিন ফোনে তোমায় বলেছিলাম তোমার সাথে আমার কথা আছে। আজ সেই কথাটাই তোমাকে বলে যেতে চাই। সেটা না জানালে অন্যায় হবে। হয়ত মরেও আমি শান্তি পাবো না।”

“কি কথা বাবা?” উদ্বিগ্ন শোনায় শুভঙ্করের গলা।

ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে আমি মেডিকেল এডুকেশন সার্ভিসে যোগ দিই। প্রথম পোস্টিং বর্ধমান মেডিকেল কলেজে। আমার তখন চৌত্রিশ বছর বয়েস। বেশ কয়েক বছর বিয়ে হয়েছে, কিন্তু সন্তানহীন। আরও দুবছর অতিক্রান্ত হয় ওখানে। তারপর একদিন” এই পর্যন্ত বলে দম নেবার জন্যে থামেন বৃদ্ধ।

“একদিন কি বাবা?”

“একটি শিশুকে জন্মের পর হাসপাতালে ছেড়ে চলে যায় তার মা। পরিত্যক্ত শিশুটি বর্ধমান মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে নার্সদের স্নেহে বড় হতে থাকে। অনেক খোঁজ চলে তার বাবা-মার, কিন্তু কিছুতেই হদিশ পাওয়া যায় না তাঁদের। এদিকে এক নিঃসন্তান ডাক্তারের স্ত্রী বিয়ের ছয় বছর পরেও সন্তান না হওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তখনকার দিনে সন্তানহীনাকে অভিশাপ ভাবা হতো। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রশ্নে জেরবার সেই ডাক্তার-পত্নী।”

“কিন্তু তুমি হঠাৎ এসব আমাকে কেন বলছ বাবা?”

“শোনো, তারপর সেই ডাক্তারবাবু নার্সদের সাথে আর তাঁর অন্যান্য ডাক্তার কলিগদের সাথে পরামর্শ করে শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে এসে তুলে দেন তাঁর স্ত্রীর কোলে। দক্ষ চিকিৎসক হবার সুবাদে জেলা জজের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই আইনত দত্তক নিতে খুব সমস্যা হল না তাঁর। তখন আইনের কড়াকড়িও ছিল না এত। তারপর আত্মীয়-স্বজনদের এড়িয়ে তিনি বদলী নিয়ে চলে যান নর্থ-বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে, ফিরে এলেন কলকাতায় প্রায় আট-বছর পরে।”

“কিন্তু তুমি আজ এসব কথা আমাকে হঠাৎ কেন বলছ?”

“কারণ ওঁই ডাক্তারের নাম সঞ্জয় সান্যাল।”

“মানে?”

“হ্যাঁ। তুমিই সেই শিশু। কিন্তু তোমার পিতৃ-মাতৃ পরিচয় আমি জানিনা। সম্ভবত কোন কুমারী মায়ের সন্তান তুমি।”

“বাবা!” একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে শুভঙ্করের বুক থেকে।

“এ কথাটা তিনজন জানত। তোমার মা, আমি আর সুমন্ত। তোমার মা আজ আর নেই। কিন্তু আমার মনে হল এই কথাগুলো তোমারও জানা দরকার।”

“সুমন্তকাকা। সুমন্তকাকাকে কেন দেখছি না বাবা। দেশ থেকে কি আসে নি?”

“না, আর আসবেও না কোনদিন। পরশু রাতে হার্ট-অ্যাটাকে চিরবিদায় নিয়েছে সে।” কিছুক্ষণ নীরব থেকে শুভঙ্কর বলে ওঠে, “বাবা, আর কিছু বলবে না।” ম্লান হাসলেন ডাক্তার সান্যাল, “আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ শুভ।”

“একথা কেন বলছ, বাবা?”

“এক নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তান-সুখ দিয়েছিলে তুমি। নিঃসঙ্গতার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলে তাদের।”

“বাবা,” বলে চীৎকার করে শুভঙ্কর জড়িয়ে ধরে ডাক্তার সান্যালকে, তারপর অঝরে কাঁদতে থাকে।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত