হিংসার চিহ্ন সর্বত্র। প্রচন্ড দ্বেষে কেউ যেন পুরো ঘর তছনছ করে দিয়েছে। তীব্র ঘৃনায় এক্সপেরিমেন্টাল জিনিস সমেত ছোট-বড়ো বিকার পাত্র গুলো এদিক ওদিক অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে ঘরময়। প্রতিটা ক্যামিক্যাল একটা আর একটার সাথে মিশ্রিত হয়ে, বিশ্রীরকম গন্ধের সাথে বিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য যুক্ত একটা বিক্রিয়া শুরু করেছে। যা রসয়ান বিদ্যার বই এর পাতা ওল্টালেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এইসব দেখা ইস্তক, রাগে গষগষ করছে একটি লোক। এত দিনের পরিশ্রম পন্ড হয়েছে তাঁর। দারুন পরিশ্রমের সাথে ভীষণ রকম আধ্যাবসায়ের সাক্ষী, এই এক্সপেরিমেন্ট। এক ঝটকায় কে যেন সবটুকু ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। কনফারেন্সে না গেলে হয়তো এ অঘটন রোখা যেতে পারত। সবটাই এত আকস্মিকভাবে ঘটেছে! যার কোনোরকম তথ্যভিত্তিক তথ্য নেই। পুলিশ এসে সারেজমিনে তদন্ত করেও কিছুই উদ্ধার করে উঠতে পারেনি। তদন্ত বহাল।
এক একর জমির উপর বাড়ি, প্রফেসর অলোকরঞ্জন উপাধ্যায় এর। কলেজ, ভার্সিটির দায়িত্ব ভার থেকে ভার মুক্ত হয়ে বুঁদ আছেন নিজের গবেষণায়। পুরোনো কিছু ছাত্র তাঁর আন্ডারে গবেষণা মূলক কাজে শিক্ষার্থীর সাথে অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে কর্মরত। প্রফেসরের বাড়ির একটি তলায়, বিস্তর জায়গা জুড়ে তৈরী করা হয়েছে একটি গবেষণার ঘর। প্রফেসরের নিত্য নূতন অবিশ্বাস্য গবেষণার সাক্ষী তাঁর ছাত্ররা। ঘরে কোথাও ছড়িয়ে রয়েছে নানান রকমের মেশিন। তো কোথায় সারাক্ষন শোনা যায়, বুদবুদের মলিন একটা শব্দ। ইদানিং প্রফেসর একটি নব্য গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন। সেই গবেষণায় সাফল্য এলেই তিনি নাকি গোটা বিশ্বে রাজ করবেন। ব্রহ্মান্ড জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে তাঁর নাম। এ গবেষণা তিনি, সবার অলক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তাঁর খুব বিশ্বস্ত ছাত্ররাও বিষয়টিতে অবগত নয়। ভীষণ গোপন ভাবে চলছে এই কর্মকাণ্ড। কিন্তু কিসের কারণে এই গোপনীয়তা !
-‘হ্যালো’।
-‘থানা থেকে বলছি’।
-‘আমরা আর একবার আপনার ল্যাবরেটরি রুম টি পর্যবেক্ষণ করতে চাই’
-‘আজই’।
আরও একবার ফরেন্সিক টিম সমেত হাজির কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার, জন্মেজয় ভরদ্বাজ। ফরেন্সিক টিম পুরো কক্ষটাকে পাখির চোখের মতো ছানবিন করছে। একটি ও প্রমাণ চোখের আড়াল যেন না হয়। সেই ফাঁকে পুলিশ অফিসার, প্রফেসরের সাথে টুকরো কিছু কথাবার্তা চালাচ্ছেন।
-‘আপনার সত্যিই কাউকেই সন্দেহ হয় না’?
পুলিশ অফিসারের একই প্রশ্নের উত্তরে প্রফেসর মাথাটা এদিক-ওদিক করলেন। যার জবাব ‘না’। পুলিশ অফিসার জন্মেজয় ভরদ্বাজ, ছানবিন শেষে প্রফেসরের থেকে বিদায় চাইলেন। কিছু খবর পেলে জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি প্রফেসরের বাড়ি ত্যাগ করলেন। আজ তমোঘ্ন’র জন্মদিন। গরিব হওয়া সত্বেও তার মেধায়, বাধা তৈরী করতে পারেনি। মেধাবী হওয়ার কারণে একদিন সে প্রফেসরের নজরে পড়ে যায়। সেই থেকে প্রফেসর দায়িত্ব নিয়ে তমোঘ্ন কে জীবনের প্রতিটা ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। তমোঘ্ন যৎপরোনায় কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার সমস্ত উচ্চশিক্ষা শেষ করে প্রফেসরের গবেষণা মূলক কাজের সাথে যুক্ত করেছে নিজে। প্রফেসরের বাড়িতেই তমোঘ্নর জন্মদিনের উৎসব পালন হচ্ছে। কেক কাটা পর্বের পর ভূরিভোজ সেরে একে একে সবাই বাড়ি ফিরল।
পরদিন সকালে গবেষণার ঘরে প্রফেসর, তমোঘ্ন সহ বাকি ছাত্রদের ডেকে পাঠালেন। সময় মতো সবাই উপস্থিত। যথা সময়ে প্রফেসর এলেন। এসেই জানিয়ে দিলেন, তিনি আপাতত কোনো নূতন গবেষণায় হাত দেবেন না। কিছু দিনের ছুটি চাইছেন তিনি। সাথে দিন কয়েক তাঁর ছাত্রদের ও ছুটি ঘোষনা করলেন। হপ্তাখানেক পর ছুটি কাটিয়ে সবাই ফিরল। গবেষণার কাজ আবারও শুরু হ’ল। আবার সেই লালের সাথে নীল, নীলের সাথে সবুজ রঙের মিশে যাওয়ার খেলা শুরু হ’ল। একটানা কাজের পর ছোট্ট বিরতি, সবাইকে উৎফুল্ল করে তুলেছে যেন। সবাই ব্যস্ত যে যার কর্মকান্ড নিয়ে। তমোঘ্ন একটা বিকার পাত্রের সামনে এসে থেমে গেল। কাছেই খাঁচায় একটা ছোট্ট গিনিপিগ। ভেবেও, খুঁজে পেল না এই এক্সপেরিমেন্টের কথা। বাকি বন্ধুদের ডাকল তমোঘ্ন। সবার কাছেই সেটি একদম নূতন ঠেকছে।
এমতাবস্থায় প্রফেসর অলোকরঞ্জন উপাধ্যায় সেখানে উপস্থিত হলেন। তমোঘ্ন সমেত বাকিদের সেই নূতন এক্সপেরিমেন্টের কাছে দেখেই, অযাচিতভাবে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। যা তাঁর ছাত্রদের কাছে, নূতন গবেষণার মতোই নূতন। তাঁদের কঠোর এবং প্রয়োজনের তুলনায় কঠিন গলায় নির্দেশ দিলেন, সেই নূতন গবেষণায় নাক না গলাতে বা তার ধারে কাছে না ঘেঁষতে। পরদিন সকালে সবার আগে তমোঘ্ন এল প্রফেসরের বাড়ি। তখন প্রফেসর চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। সাথে অভ্যাসমতো খবের কাগজের পাতায় চোখ বুলোচ্ছেন। তমোঘ্ন বেশী কথা না বলে, প্রফেসর কে সুপ্রভাত জানিয়ে গবেষণাগারে চলে গেল। গিয়েই দেখল, গত দিনের গবেষণার জিনিস পত্র সব উধাও। কালকের পর, প্রফেসরকে সে সব কারণ জিজ্ঞাসা করার সাহস তমোঘ্ন অকারণ ভেবে পিছিয়ে গেল। কিন্তু মনের গভীরে কোথাও একটা প্রশ্ন জেগেছে তার। প্রফেসর কি কিছু লুকোতে চাইছেন!
গত কয়েকদিন ধরে সারা শহর জুড়ে আকস্মিক ভয় উপস্থিত হয়েছে। কোথায় তার উৎস জানা নেই। শহরবাসী কার্যৎ ঘরবন্দি হয়ে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ঘরে বন্দি থেকেও তারা নিজেদের একদম বিপন্মুক্ত ভাবতেই পারছেন না। কখন যে মৃত্যু এসে আছড়ে পড়বে কে বলতে পারে। সারা শহর যেন শ্মশান পুরিতে পরিনত হয়েছে। যে শহরে, পাখির কুহতানের পরিবর্তে ঘুম ভাঙত গাড়ির আওয়াজে, কারখানার সাইরেনে। সে শহরে শহরবাসী ঘুমোতে ভয় পায়। স্কুল-কলেজ-অফিস-কাছারি সব বন্ধ। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা থেকে শহরবাসী বিচ্ছিন্ন। একটা মানবরূপী দানবের ভয় গোটা শহরটাকে ভয়ের চাদরে আচ্ছাদন করে রেখেছে। অবলীলায় চলছে তার তান্ডব। পুলিশ প্রশাসন সবাই বিপর্যস্ত। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাগে আনতে পারে নি। মানবরূপী দানব তার, অদৃশ্য শক্তি তে সারা শহরকে পরিচালনা করছে। সেই এখন সর্বময় কর্তা। নূতন শাষকের শাষন চলছে গোটা শহর জুড়ে।
কনফারেন্স হলে সমবেত হয়েছে তাবড় তাবড় গবেষক। দানবাকৃতি মানব কে কন্ট্রোলে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা সবাই করে চলেছে। ভিন্নধর্মী মতামত পেশ চলেছে। কফির পর কফির কাপে ধোঁয়া উঠছে। দীর্ঘ আলোচনার পরও কেউ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছেন না। রাতের পর রাত। দিনের পর দিন চলছে শুধুই আলাপালোচনা। সবাই যখন এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। টেবিলের এক কোনে একটা চেয়ারে অপেক্ষাকৃত বেশীই স্থির হয়ে বসে আছেন একটি মানুষ। প্রফেসর অলোকরঞ্জন উপাধ্যায়। তিনি বেশ জানেন, দানবাকৃতি মানবের উৎস স্থল। মনে মনে নিজেকে হয়তো এখন দুষছেন তিনি। তাঁর লোভের শিকার গোটা শহরবাসী। মনের মধ্যে একরাশ ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি হলেও, তমোঘ্ন কে কি যেন একটা কুরে খাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। কারণ না জানা অবধি তার মন অশান্ত থাকবেই। মনের মধ্যে যতটা সাহস আনা যায় তার থেকেও বেশী সাহস এনে, বুকের ধুকপুক শব্দ টা কমিয়ে তমোঘ্ন পা বাড়িয়েছিল প্রফেসরের ঘরের দিকে। তাকে জানতেই হবে প্রফেসর কি লুকোচুরি খেলছেন !
দু’পা এগোলে একপা পিছিয়ে আসে। এরকম করতে করতে তমোঘ্ন একটু একটু করে এগিয়ে এসে দেখে প্রফেসর তখন লিভিং রুম ত্যাগ করেছেন। নীচের তলায় সারা বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে প্রফেসর কে চোখে পড়ল না তার। গার্ডেন এরিয়া তেও নেই প্রফেসর। কোথায় যেতে পারে ভাবতে ভাবতেই তমোঘ্নর পা জোড়া অজান্তেই উপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। তমোঘ্ন সহ বাকি সবার সীমানা ছিল প্রফেসরের বাড়ির নীচের তলা অবধি। উপর তলায় প্রফেসর বিশেষ বিশেষ কাউকে অ্যালাও করতেন। বেশীর ভাগ কাজকর্ম তিনি নীচের তলায় বসেই করতেন। উপরের তলাটিতে বিশেষ ভাবে গোপনীয়তা বজায় থাকত। তিনি প্রাইভেসি কে প্রায়োরিটি দিতেন।
-‘ হ্যাঁ গবেষণার কাজ চলছে’।
-‘ তৈরী করেছি আপনার মনের মতো জিনিস’।
-‘আপনি যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি’।
-‘আমার পেমেন্ট টা যদি’
আরও কিছু কথার পর ফোন রেখে দেন প্রফেসর। এপ্রান্তের সব কথা তমোঘ্ন শুনতে পেলেও কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। কিসের কথা, কার সাথেই বা কথা; কিসের পেমেন্টের কথা প্রফেসর বলছেন! এসব ভাবনা নিয়ে প্রফেসরের ঘর থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল তমোঘ্ন। হঠাৎই দেখল, প্রফেসরের পা জোড়া এগিয়ে চলেছে কোনো কিছু কে উদ্দেশ্য করে। দূর থেকেই অবাক দৃষ্টি তে তমোঘ্ন আবিষ্কার করল গত রাতের সেই খাঁচায় বন্দি গিনপিগটাকে।
পরদিন সকালে প্রফেসর সবাইকে ফোনে বার্তা দেন আজ তাঁর বাড়ি না আসতে। বিশেষ কাজে তিনি বাইরে যাবেন। প্রফেসরের ফোনটা পেয়েই তমোঘ্ন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো লাফিয়ে ওঠে। সুযোেগর হাতছানি অবলীলায় হাতছাড়া করলে চলে না। প্রফেসরের কর্মকান্ড জানার এই প্ল্যাটিনাম সুযোগ। প্রফেসরের ফোন পাওয়ার আরও আধ ঘন্টা পর তমোঘ্ন বাড়ি থেকে বেরুল। তার বাড়ি থেকে প্রফেসরের বাড়ির দূরত্ব মিনিট দশ। প্রফেসরের বাড়ির সামনে আসার পরই তমোঘ্ন চমকে উঠল। প্রফেসর তখনও বেরোয় নি। লিভিং রুমে বসে দিব্যি ওভালটিন খাচ্ছেন। তাহলে কি আরও আধ ঘন্টা অপেক্ষায় থাকার পর প্রফেসর বাড়িতেই থাকলেন। তমোঘ্ন অনেক ভেবে একটা ফন্দি আঁটল। সাথে তার জেদি মন আরও জেদি হয়ে উঠেছে, সবকিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার। গার্ডেন এরিয়া পেরিয়ে খোলা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল তমোঘ্ন। তাকে দেখেই প্রফেসর একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-‘কি ব্যপার তমোঘ্ন’?
-‘আজ তো ছুটি দিয়েছিলাম ‘।
প্রফেসর যে তার আসাতে বেশ খুশি হননি তা তমোঘ্ন দিব্য বুঝল। প্রফেসরের মুখ দেখে মনে হ’ল তাঁর বিশাল কোনো কর্মকাণ্ডে ব্যঘাত ঘটাতে তমোঘ্ন’র আবির্ভাব। আমতা আমতা করে তমোঘ্ন শুরু করল,
-‘না মানে স্যার একটা ইকুয়েশন এ আটকে গেছি’।
-‘কাল তো আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়নি ভেবেছিলাম আজ জিজ্ঞেস করে নেব’।
-‘কিন্তু আপনি তাই আমি তমোঘ্ন’র কথা শেষ করার আগেই প্রফেসর বিরক্তি সহকারে বলে উঠলেন,
-‘ঠিক আছে এসো’।
এমন সময় প্রফেসরের ফোন বেজে উঠল। অনেকক্ষন ধরে কথোপকথন চলছে। ফোনে কথা বলতে গিয়ে প্রফেসর নিজের অজান্তেই বাগানে বেরিয়ে চলে এসেছেন। সেই সুযোগে তমোঘ্ন একদৌড়ে সোজা উপরে উঠে প্রফেসরের ঘরে। ঘরে ঢুকেই প্রথমে তার চোখ পড়ল গিনিপিগটার উপর। আগের থেকে একটু বেশীই যেন বড়ো হয়ে গেছে। মাত্র তিনদিনে এতটা পরিবর্তন !
প্রফেসর আসার আগেই একটা ডায়েরি তমোগ্ন’র হাতে পড়ল। পাতা ওলট পালট করতে গিয়ে একটা পাতায় চোখ আটকে গেল তার। প্রফেসর যে এত নীচে নামতে পারে সে আশা তো দূর স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ডায়েরির পাতা যত ওল্টাচ্ছে তত অবাক হচ্ছে তমোঘ্ন। তার খেয়াল ছিল না প্রফেসরের অস্তিত্ব এর কথা। কখন প্রফেসর তাঁর ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তাও টের পায়নি তমোঘ্ন। প্রপেসরের ক্রোধ বহ্নি যেন গ্রাস করবে তমোঘ্নকে। ছুটে গিয়ে বাজ পাখির মতো ছোঁ মেরে ডায়েরি টা তমোঘ্ন’র হাত থেকে প্রফেসর নিজের অধীনস্থ করলেন। অবিশ্বাস্য চোখে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে তমোঘ্ন…..
-‘কেন স্যার ‘?
-‘কেন’?
না! কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। দানব-মানব তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে অবলীলা ক্রমে। যারা তাকে একবার চাক্ষুষ করেছে, তার চোখ দিয়ে ঠিকরে বেরোতে দেখেছে রাগ-বিদ্বেষ-ঘৃনার এক অগ্নিকুণ্ড। কেউ বুঝে উঠতে পারছে না কোথা থেকে এই দানবের আকস্মিক উৎপত্তি। কি চায় সে, তাও অজানা। অজ্ঞাত। রোগের কারণ না জেনে চিকিৎসা করা অসম্ভব।
কনফারেন্স হল থেকে বেরিয়ে প্রফেসর অলোকরঞ্জন উপাধ্যায় চার আসন বিশিষ্ট নীল রঙা মারুতি এইট হান্ড্রেডে চড়ে বাড়ি ফিরলেন। লিভিং রুমে এসে ক্লান্ত শরীর টা ছেড়ে দিলেন। প্রথমবার নিজেকে, নিজের অধ্যাবসায় কে সন্দিহান চোখে দেখছেন তিনি। কোথাও নিজেকে দোষারোপ করছেন হয়তো। এলোমেলো চিন্তায় ছেদ টানল, বেজে ওঠা ফোনের আওয়াজ।
-‘স্যার কাল একবার থানায় আসতে পারবে’?
-‘জরুরি দরকার ‘।
কথামতো পরদিন প্রফেসর থানায় হাজিরা দিলেন। তলবের কারন জানতে চাওয়ায় পুলিশ অফিসার জন্মেজয় ভরদ্বাজ পুলিশ স্টেশানে পাতা বেঞ্চের দিকে আঙুলের নির্দেশ করলেন। বয়সের ভারে নুব্জ দু’টি দেহে দারিদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট। ইশারায় তাঁদের কাছে ডাকলেন।
-‘স্যার, এনারা তমোঘ্নর মা-বাবা’।
-‘এঁদের কাছেই জানতে পারি তমোঘ্ন আপনার প্রাক্তন ছাত্র। ও নিখোঁজ অনেকদিন যাবৎ।’
-‘আপনি যদি কিছু’
গলার স্বর বুজে আসছে প্রফেসরের। টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জল নিঃশেষ করলেন। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলেন,
-‘কিছু জানি না। খবর কিছু পেলে জানাব’।
বলেই মনে হ’ল যেন সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন। সোজা বাড়ির পথ ধরলেন। পুলিশ স্টেশান থেকে ফেরার পর মনে হচ্ছে যেন, প্রফেসর কে ক্লান্তি যেন একটু বেশিই গ্রাস করেছে। সেদিনের ঘটা ঘটনাটা যদি না ঘটত! ডায়েরি টা বাজপাখির মতো প্রফেসর, তমোঘ্ন’র হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেও ততক্ষণে তমোঘ্ন’র কাছে সবটাই কাঁচের মতো পরিষ্কার। প্রফেসর কে তাক করে ভীষণ উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল,
-‘ আপনাকে আমি এই কুকর্ম কিছুতেই করতে দেবো না’। বলেই খাঁচায় থাকা গিনিপিগের দিকে এগিয়ে গেলো। প্রফেসর ও প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে তমোঘ্ন’র দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একবার তিনি তমোঘ্নকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
-‘এই গবেষণা সফল হলে জাপানিরা আমাকে, একটা মোটা টাকা দেবে। সাথে চিফ সায়েন্সটিস্টের পদ। তুমি আমার পার্টনার হয়ে যাও তমোঘ্ন। আমরা বিশ্বে রাজ করব’। ভীষণ রাগে অথচ কাঁপা কাঁপা গলায় তমোঘ্ন জবাব দিয়েছিল,
-‘আমি বিজ্ঞানের পূজারী।’
-‘আপনার থেকেই শিখেছি’।
-‘বিজ্ঞানের ব্যবহার ব্যবসার জন্য নয়’। প্রফেসর, সামনে থাকা টেবিলের উপর চপেটাঘাত করে তমোঘ্ন’র উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
-‘কতদিন আর গরিব হয়ে বাঁচবে’?
-‘মোটা টাকার অফার দিচ্ছি’।
-‘রাজি হয়ে’
প্রফেসর কথা শেষ করার আগেই টেবিলের উপর থাকা বিকারগুলো প্রচন্ড রাগে তমোঘ্ন ফেলে দিল। এত দিনের গবেষণা, মাটিতে গড়াগড়ি যেতে দেখে প্রফেসর রীতিমতো চন্ডাল মূর্তি ধারন করে ড্রয়ার থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে তমোঘ্ন’র ঘাড়ে বসিয়ে দেন। এরপর তমোঘ্ন’র আর কিছুই মনে নেই। সংজ্ঞাহীন শরীরের আশ্রয় হয়েছিল শহর থেকে অনেক দূরে, মানুষের বসবাস হীন একটা জায়গায়। তার একমাত্র সাক্ষী প্রফেসর।
কিছুদিন শান্ত থাকার পর শহরের অবস্থা আবারও দুর্বিষহ করে তুলেছে দানবটা। ভীষণ আক্রোশে সারা শহর তছনছ করে বেড়াচ্ছে সে। সারা শহর জুড়ে না বলা জনতা কার্ফু জারি হয়েছে যেন। পুলিশ প্রশাসন অসহায় হয়ে মিলিটারীদের সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো তিন গাড়ি মিলিটারী মোতায়েন করা হয়েছে সারা শহরে। দানবকে ধরার যতরকমের উপায় আছে সবটুকুই নেওয়া হয়েছে। কোথাও একটু ও ফাঁক ফোকর নেই। বাজপাখির নজরদারি চলছে মিলিটারী সেনাদের। দনবকে দেখলেই ফায়ারিং করার নির্দেশে সবাই তৎপর। হঠাৎই কোথা থেকে ধূলোর বাতাস শুরু হ’ল। প্রচন্ড উচ্চতায় ভর করে একটা শরীরের প্রবেশ ঘটছে। হাতের সামনে যা পাচ্ছে তছনছ করে দিচ্ছে। দানবকে দেখা মাত্রই ফায়ারিং শুরু।
মানব রূপী দানব পিঠ ঘুরিয়ে পালিয়ে যায় নি। লড়াই চালিয়ে গেছে প্রচন্ড পরাক্রমে। একসময় সে নেতিয়ে পড়েছে। নেতিয়ে পড়া প্রচন্ড শরীরটাকে ক্রেনে করে উঠিয়ে একটা অডিটোরিয়াম এ এনে বন্ধ করা হয়েছে। আগের থেকে সেই দানব অনেকটাই শান্ত। একটু ঠান্ডা হতে দানবের সাথে পুলিশের দীর্ঘ জিজ্ঞাসা বাদ পর্ব চলেছে। প্রফেসর অলোকরঞ্জন উপাধ্যায় কে আনা হয়েছে, সেই মানব রূপী দানবের কাছে। পরস্পর মুখোমুখি হতেই দানবটা প্রচন্ড ঘৃনায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে প্রফেসরের থেকে। প্রফেসর একটু এগিয়ে গিয়ে দানবটার গায়ে স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে ধরা গলায়…..
-‘সরি তমোঘ্ন’।
-‘আই ওয়াজ রং’।
-‘আমি আমার সব দোষ স্বীকার করছি’।
মানবরূপী দানবের এই অবিশ্বাস্য বিদঘুটে বিবর্তনের কারণের দায় ভার বর্তেছে প্রফেসর অলোকরঞ্জনের উপর। তমোঘ্ন’র দানবাকৃতি পরিবর্তনের কারণ এক এবং একমাত্র প্রফেসর। দানব, তার সমস্ত পুরোনো ইতিহাস, প্রফেসরের কুকর্মের কথা পুলিশকে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছে। ফল স্বরূপ, প্রফেসরের গবেষণায় এবং গবেষণাগারে জন্ম জন্মান্তরের জন্য তালা পড়েছে। প্রমাণের উপর ভিত্তি করে, প্রফেসরের জায়গা হয়েছে শ্রীঘরে। শ্রীঘরে আসার আগে প্রফেসর, তমোঘ্নকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিজ্ঞান কে তিনি আশীর্বাদের কাজে লাগাবেন।
দেশের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রমের কারণে, তমোঘ্ন’র শরীরে পুশ করা ভাইরাসের অ্যান্টিভাইরাস আবিষ্কারে সফল হয়েছেন তাঁরা। ধীরে ধীরে মানবরূপী দানব, তমোঘ্নকে স্বাভাবিক বানিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টায় আছেন তাঁরা।
শ্রীঘরে বসে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তের সাথে সাথে প্রফেসর কিছু গবেষণা করার কথা ভেবে ফেলেছেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পুলিশের পরামর্শক্রমে প্রফেসর কে একটি জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে, তাঁর সমস্ত এক্সপেরিমেন্টাল কাজকর্ম চালানোর জন্য। এবার তাঁর আবিষ্কার, তমোঘ্ন’র অভিশপ্ত জীবনের অভিশাপ এর পরিবর্তে বিজ্ঞানের আশির্বাদ হিসাবে আশিস প্রদান করবে। কারণ, প্রফেসর অলোকরঞ্জন উপাধ্যায়, তমোঘ্ন’র কাছে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ।