নবাবের গুহা

নবাবের গুহা

তখন আমার আস্তানা নদীর ধারের বাংলো। এক সন্ধ্যাবেলা বারাণ্দাই বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। অদূরে এক শিয়াল তার উপস্থিতি জানান দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। যতদূর চোখ যাই শুধু অন্ধকার অরণ্য, বন্য ঝি ঝি পোকার ডাক আর ঝোপের উপর কতগুলো জোনাকি।

এই সবকিছুই আমার মনের মধ্যে এক রোমাঞ্চ জাগিয়ে তুলল। এখন সবেমাত্র রাত সাড়ে ন’টা। বসে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবলাম রহস্য উদঘাটনটা একটু মধ্য রাত করে করাই ভালো। কলকাতার আমার স্থায়ী বাসভবন থেকে আসার সময়ই কএকটা গল্পের বই সঙ্গে এনেছি। অফিসের এবারের ছুটিটা অন্তত কাজে আসলো। পেশাই আমি একজন ফটোগ্রাফার। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল মহারাষ্ট্রের কোথাও একটা ঘুরে আসতে। তো এবার আমি আমার পুলিশ বন্ধু দীপের ডাকে চলেই এলাম মহারাষ্ট্র। ঐ আমার জন্য গভীর জঙ্গলের এই পরিতক্ত বাংলোটাই থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মূল শহর থেকে আমি এখন বিচ্ছিন্ন, আর তাই এখন এই গভীর অরণ্যে না আছে কোনো সভ্য জনজাতির বাস আর না আছে আধুনিকতার সাক্ষ নেটওয়ার্ক কনেকশান। তবে এই গহন অরণ্যে নদীর ধারে কাটানো কিছুটা সময়, আমাকে বেশ আকৃষ্ট করছে।

বসে বসে এইসব ভাবছি, হঠাৎ মনে হলো নদীর (হাঁটু জল নদী, বর্ষায় তুমুল আকার ধারণ করে) উপরের হলকা কাঠের সাঁকোটা দিয়ে কেউ এইদিকেই আসছে। আমি সজাগ হলাম। এতো রাতে এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে কারোর আসার কথা নয়। আমি সজাগ হয়ে বসলাম। তবে দুজন মানুষ সাঁকো টপকে বাংলোর সামনে আসতে আমি আমার বন্ধু দীপকে চিনতে পারলাম। কিন্তু তারসঙ্গে থাকা ষণ্ডামার্কা আগন্তুক আমার কাছে অপরিচিত।

“দীপ এসো এসো, তোমারি অপেক্ষাই ছিলাম”- আমি দু’পা এগিয়ে গিয়ে ওদের সম্মধন করলাম।
•“Meet with sankar, the caretaker of this bungalow”

দীপের এই কথায় আমি শঙ্করের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম। এরপর দীপ আর আমি গিয়ে আরামকেদারায় বসতে শঙ্কর রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো চা বানাতে। বুঝলাম ভদ্রলোক খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। যাইহোক আমি দীপের সঙ্গে গল্প জমালাম। বাংলোর সামনে যে ছোটো নদী ওটা পেরিয়ে খানিকটা গেলেই একটা গুহা পড়বে। মহারাষ্ট্রের পাঁচ বিখ্যাত গুহাগুলির মধ্যে এটি কোনটাই নয়। এই আদিম গুহার কোনো নামও নেই। কিন্তু ইদানিং এইখানে বড়ই সমস্যা দেখা দিয়েছে। যার কুলকিনারা পুলিশও করতে পারছে না। আর তারজন্যই মহারাষ্ট্র পুলিশ অফিসার দীপ্তেশ দে ইদানিং খুবই চিন্তিত থাকে। এখানে আসার আগেই আমি দীপের থেকে ঘটনাটা শুনেছিলাম। তাই এই কাজে সুবিধার জন্য আমি মানচিত্ত দেখে এই গুহাটাকে পর্যবেক্ষণও করেছি। এটাও দেখেছি যে কিছুটা দুরে আরও এক নাম না জানা ছোটো গুহা রয়েছে যার নাম আমি দিয়েছি A2 আর অলোচ্য গুহাটি A1। দীপের কথা অনুযায়ী কিছুদিন যাবত এই A1 গুহাই নাকি বোমা বিস্ফরন হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা এসব করছে আর কেনই বা করছে তার ইয়ত্তা নেই। তো আমি পরিকল্পনা করি আজ রাতেই আমি গুহাটা দেখতে যাবো। দীপকে কথাটা বলতে একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে

• “এতো রাতে গিয়ে কি করবি? কাল সকালে যাবি। এমনিতেই বিস্ফরন হচ্ছে রোজ। গিয়ে যদি কোনো সমস্যায় পড়ে যাস কি হবে?”
• “আরে কিচ্ছু হবে না। এতো ভাবিস না তো। আমি আজই যাবো তোর সঙ্গে।”

ইতিমধ্যে রাত বারোটা বেজে গিয়েছে আর আমরাও বেরবার জন্য সবকিছু গুছিয়ে তৈরি। আগে নাকি এরম অনেক পুলিশ পাহারা দিয়েও বিস্ফরন আটকাতে পারেনি। মনে মনে ভাবলাম,,,,,,,দেখাযাক আমি কি করতে পারি। যাবার আগে বাংলোর কেয়ারটেকার সঙ্করের ঘরটাও দেখতে ইচ্ছা হলো। ভদ্রলোক গিয়েছিলেন নদীর জল আনতে। তখন দীপ আমাকে নিয়ে ভদ্রলোকের ঘরে গেলো। অদ্ভুতভাবে আমার চোখে পড়ল ঘরভর্তি শুধু বই। আর প্রায় সবগুলোই ইতিহাস সম্পর্কিত। দীপ বললো ও নাকি বাংলোই একা থাকে তাই সময় কাটানোর জন্য বই পড়ে। আমি কএকটা বই হাতে নিয়ে পাতা ওল্টালাম। না বলে অন্যের জিনিসে হাত দেবার জন্য খারাপ ও লাগল। এরপর আমরা দীপের জীপে চেপে রওনা দিলাম। গন্তব্য A1 গুহার কাছে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলাম তখনই আমি দীপকে গাড়ীর চাকা দক্ষিণে ঘোরাবার প্রস্তাব দিই। “কিন্তু বিস্ফরন তো A1 এ হই , তুই ঐদিকে কেন যেতে চাইছিস?”- দীপের এইরম প্রশ্নে আমি একটু বিরক্ত হয়ে ওকে বললাম -“আহ্হ! যা বলছি শোন না” দীপ তাই করলো। জীপের দিক ঘুরিয়ে আমরা ছুটে চললাম শান্ত – স্নিগ্ধ – গন্ডগোল বিহীন A2 গুহার দিকে।

গুহার বেশ খানিকটা আগেই আমরা নামলাম। রিভলবার হাতে নিয়ে দীপকে বললাম কোনো শব্দ না করে যেন ও আমার পিছু নেই। ও হতবাক দৃষ্টিতে আমার পিছু নিল। আমরা সামনে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বন জঙ্গল আর পাথরের মাঝ দিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকতে লাগলাম। কিছুটা অন্ধকারে যাবার পর আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে ভিতর থেকে একটা আবছা মশালের আলো আমাদের চোখে এসে পরলো। সামনে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম আলোর উৎস। হাঁটু মুরে বসে একটি লোক মশালের আলোয় সামনের পাথর ছেনি দিয়ে কেটে চলেছে। ঠিক সেইসময় হঠাৎ A1 গুহা থেকে এক প্রচন্ড বিস্ফরনের শব্দ আমাদের চমকে দিল। নিজেদের সামলে নিয়ে দেখলাম সামনের লোকটির সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। আমি তখন শঙ্করররর বলে চেঁচিয়ে উঠেছি। উনি তো চমকে উঠে আমাদের একঝলক দেখেই দৌড় দিতে গেলেন। কিন্তু অবশেষে দীপের হাতে ধরাশায়ী হতে হলো।

পরদিন সকাল শঙ্করবাবু এখন লকআপে আর A2 গুহা সরকারের দখলে। বাংলোর বারাণ্দাই বসে কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে সামনে বসে থাকা দীপের জিজ্ঞাসাটা মেটাবার উদ্দেশ্যে আমি বলতে লাগলাম “তুই যখন আমকে কেসের কথাটা বলেছিলি তখনই ঠিক করেছিলাম এই রহস্যের সমাধান আমি করব।তাই একটু স্টাডিও করি। আন্দাজ করেছিলাম পাশের গুহাতে গেলে হয়তো কিছু প্রমাণ পাওয়া যাবে। তারপর কাল সঙ্করের ঘরে খেলার ছলেই একটা বই পাই যাতে লেখা ছিল বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা যখন ইংরেজদের কাছে পরাজিত পালিয়েছিলেন তিনি নাকি মহারাষ্ট্রের কোনো এক অজানা গুহায় এসে লুকোন এবং তারসঙ্গে থাকা যাবতীয় ধনসম্পদ তিনি এইখানে পাথরের খাঁজে লুকিয়ে ফেলেন।’

আর সেই নিয়েই গবেষণারত ঐতিহাসিক শঙ্কর দেবনাথ এখানে আসেন এবং এই বাংলোই চাকরি নেন। আর রাত হলেই চলে যেতেন নবাবের সম্পত্তির খোঁজে। আর A1 গুহায় রেখে যেতেন কিছু বিস্ফরক, যেগুলো সুব্যবস্থায় নিজেই ফেটে সরকার বা পুলিশের দৃষ্টি অন্যদিকে আকর্ষণ করে রাখত। আর সেই সুযোগেই তিনি সারতেন নিজের কাজ। এটাই আমি জানতে পেরে যাই। তবে হ্যাঁ কাল লকআপেই ওনার জিনিসে না বলে হাত দেবার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। হা হা হা।”

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত