সন্ধ্যে নেমে এসেছে। পুব আকাশে গেঁওয়া গাছের মাথা ফুঁড়ে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। মৃদু হিমেল বাতাস লেগে নদীর জলে তির তির করে কেঁপে কেঁপে
ভেঙ্গে যাচ্ছে চাঁদের ছায়া। সেদিকে একনজর তাকিয়েই বুকের ভেতরটা ঢিপ করে উঠল। পল্টুকে বললাম, জোরে টান পল্টু। শিগগির করে টান ভাই। বাড়ি ফিরতে
হবে যে! একফালি নৌকাটার পিছনদিকে বসে প্রাণপন শক্তিতে বৈঠা বাইতে বাইতে পল্টুর গলাটা হাঁফধরা শোনাল, টানছি তো রে ভাই। আর মাত্তর এট্টুখানি। নদীর
ঠান্ডা জোলো বাতাস এসে পল্টুর কথা খানিক উড়িয়ে নিয়ে গেল। তাতে আমার মনে বিশেষ ভরসা জন্মাল না। শরীরখানা নদীর দিকে খানিক ঝুঁকিয়ে কাত হয়ে বসে
জলের সঙ্গে বৈঠার ঝপাস-ঝপাং শুনতে লাগলাম। নদীতে এখন জোয়ারের টান। আমরা চলেছি তার বিপরীতে।মাঝনদীতে এসে পৌঁছেছে নৌকা। দুই পাড় এখন সমান
সমান। দূরে আবছা জলরঙা ছবির মতো আমাদের গ্রামের পাড় দেখা যাচ্ছে। পূর্ণিমার চাঁদের ভরন্ত জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। পল্টুর ছোট্ট শরীরখানা ধনুকের
ছিলার মতো বেঁকে আবার টানটান হয়ে উঠছে একটি ছন্দবদ্ধ লয়ে। আমার শুকিয়ে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ্য উৎসাহও দিচ্ছে এরই ফাঁকে ফাঁকে। এসে গেছি
রে বুড়–ন। আর মাত্তর এট্টুখানি। আমি সেই আশাতেই বুকে বাতাস ভরে নিচ্ছি একটুকুন করে। ঢেউ-এর তালে তালে নৌকাখানা খানিক উথলে উঠছে আবার
পরক্ষণেই ছলাৎ শব্দে বুকের ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে নীচে নেমে আসছে। বিপদের সময়ে এলেই শুনেছি মানুষের যত অমঙ্গল চিন্তা হয়। আমারও এখন তাই হচ্ছে।
ফিসফিসে গলায় খালি বলে উঠছি, আমরা ডুবে যাব না তো রে পল্টু? পল্টু ঠোঁট উল্টে আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে। ফুঃ! তোর খালি ভয়। আমার ভয়ের কথা পল্টুর
অজানা নয়। শুধু পল্টুই নয়, এ গাঁয়ের যে কজন বন্ধু আমার রয়েছে, তাদের সক্কলেই জানে এ কথা। শহরের ছেলে বলেই শুধু নয়, জলকে আমার ভীষণই ভয়। তবু
কেন যে ছুটি পড়লেই আমার মন উচাটন হয়ে থাকে, একছুট্টে চলে আসি নদীঘেরা সুন্দরবনের এই ছোট্ট গ্রামটায়। এখানে থাকেন আমার বড়জেঠু, জেঠিমারা।
বড়জেঠিমার কোনও ছেলে-মেয়ে নেই। আমিই সে শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়েছি যেন। তাই প্রতিবারই ছুটির আগে থেকেই হা-পিত্যেস করে বসে থাকেন বড়জেঠু
জেঠিমা… কখন তাদের ছোট্ট বুড়–ন গাঁয়ে ফিরে আসবে। সেই টান কি আমি উপেক্ষা করতে পারি! আর পারি না বলেই আমার ছুটিগুলো এত সুন্দর আর রঙিন হয়ে
ওঠে। ভয় শুধু একটাই। জল। কিন্তু জলের দেশে এসে জলকে এড়িয়ে কি আর থাকা যায়! যায় না।আর যায় না বলেই আমি গ্রামের নোনা পুকুরগুলোর পাড়ে এসে বসে
বসে দেখি, বন্ধুরা কেমন ডুবসাঁতার, চিতসাঁতারের লম্বা লম্বা রেস দিচ্ছে। আমার কাজ ডাঙায় বসে কেবল ওদের জামা-প্যান্টই পাহারা দেওয়া। তবুও তাতেই কত
আনন্দ। সেই জল-ভীতু আমিই কিনা এই ভরা সন্ধ্যায় রাক্ষুসী এক জলথই নদীর বুকে ভেসে রয়েছি একফালি নৌকোয়! কী করে যে এ অসাধ্য সাধন হল, সেও ভারি এক
গল্প! সুন্দরবন নদী-খালের দেশ। বলতে গেলে জলের ওপরেই ভেসে থাকে জীবন। জঙ্গলের গাছপালা ঘিরে রাখে এখানকার মানুষদের আত্মীয়ের মতন। জল আর
জঙ্গল -এই দুই-ই এখানকার সব। মস্ত নদীটাই ঘিরে রাখে গ্রামটাকে তার রূপোলী ফিতের বাঁধন দিয়ে। নদীর ওপারেই গভীর জঙ্গলের সীমানা। বনবিবির চরাচর।
দখিনরায়ের বসতবাটী। সকাল হলেই গোটা গ্রামখানা ব্যস্ত হয়ে পড়ে আপন আপন কাজে। কেউ যায় নদীতে জাল টানতে, কেউ যায় জঙ্গলের চাক ভাঙতে। যাদের
নিজস্ব নৌকা থাকে, তারা ভেসে পড়ে অকুল গাঙে। কিম্বা ভাটির পথে এদিক-ওদিক। ছোটরা মজে থাকে দেদার ছুটির মজায়। অফুরন্ত হই- হুল্লোড় আর খেলাধুলায়।
সুখের জীবন। দুঃখেরও জীবন। মাঝে মাঝেই ঝড়ঝঞ্ঝা আসে।বিপদ- আপদ আসে। নদীতে জাল ফেলতে গিয়ে কেউ জল-কামোটের শিকার হয়। কাটা পা নিয়ে ফেরে
মানুষটা। কেউবা জঙ্গলে চাক ভাঙতে গিয়ে আর ফিরে আসে না। বনের রাজার মুখের থেকে ফিরে আসা সহজ কথা নয়। এসব গল্প হয়ত অনেকেরই জানা। পল্টুদের
মাছধরা ছোট্ট নৌকাটা অনেকদিন ধরে খাঁড়িতে বাঁধা পড়ে। ওর কাকারা এখন তামিলনাড়ু–র কাজে। নৌকাখানা জলে ভাসাবার মতো কেউ নেই ওদের বাড়িতে।
আমাদের কয় বন্ধুর ছুটির আড্ডা সেখানেই জমে। আমি শহুরে ছেলে বলে আমার খাতির সেখানে একটু বেশিই। শুধু সাঁতার কাটার কথা উঠলেই একটু যা…! তবে তাতে
আমার কদর কমে না। গোড়ালি সমান জলে বাঁধা নৌকায় চড়ে তখন আমরা সবাই কলম্বাস। সদ্য ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা ভাস্কো-দা-গামা। গরানের
ভাঙা ডাল হাতে নিয়ে বাইচ বাইচ খেলাটাও শিখে নিয়েছি যুত করে। খেলাটা দিব্যি জমছে কদিন ধরে রোজ বিকেলে। আমাদের মধ্যে পল্টুই একটু বেশি সাহসী। সাহস
হবে নাই বা কেন! বারো বছরের অমন একটা ছেলে যদি কাকা জেঠাদের সঙ্গে ওই পুচকে ডিঙি নৌকায় চড়ে মাছ ধরার নামে তিনমুখের গাঙ পেরিয়ে তালগাছ সমান
ঢেউ-এর সাথে লড়াই দিয়ে এসে আমাদের সাথে গল্প করতে পারে, সাহস-টাহস তার কাছে তুচ্ছ। তাই আমরা ওকে একটু বেশিই খাতির করি। পল্টু দলনেতার ভূমিকা
পেয়ে খুশিই হয়। মাঝে মাঝে আমাদের প্রস্তাব দেয়, চ ভাই নৌকো খুলে তোদেরও খানিক জঙ্গলের বাতাস খাইয়ে আনি গিয়ে! সাহসে কুলোয় না কারুরই। ভয়ে
আমাদের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়। না বাবা, পল্টুকে বিশ্বাস নেই। ও সব পারে। আমরা পারি না। পাড় আসতে খুব বেশি বাকি নেই। নরম কাদাভর্তি ডাঙাটায় চাঁদের
আলো এসে এলিয়ে পড়েছে। বুকের মধ্যে একটা ফুরফুরে বাতাস এসে ঢুকে পড়ছে যেন এবার। তাহলে সত্যিই আমাদের বিপদ কেটে গেছে। সারাটা বিকেল ঢেউ-এর
সাথে লড়াই করেছে পল্টু ওর ছোট্ট হাতে। হাঁপিয়ে উঠেছে তা-ও ভেঙে পড়েনি। সাহস জুগিয়েছে আমাকে। ওর অনভিজ্ঞ হাতে পল্টু এখন পাড়ের দিকে নিয়ে চলেছে
নৌকাটাকে। দেখতে দেখতে আমাদের নৌকাটা খাড়ির মধ্যে এসে ঢুকে পড়ল।আর মাত্র কয়েক পা। মনে হচ্ছে অসাধ্য সাধন করে ফিরছি। বীরের মতো তাই
নৌকাটাকে ডাঙায় ভিড়ানোর সময়টুকুও দিলাম না আর পল্টুকে। দিলাম জোরসে এক লাফ। আর গিয়ে পড়লাম এক হাঁটু থকথকে নরম কাদার মধ্যে। কান্ড দেখে হি
হি করে হেসে উঠল পল্টু। তবু পল্টুর ওপর রাগ হল না। ওকে এখন আমার গুরু বলে মানতে ইচ্ছে করছে। ভাগ্যিস ওর কথা শুনে বেরিয়ে পড়েছিলাম সাহস করে!
নইলে কি আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা ঘটত কোনদিন! জলাতঙ্ক রুগীই থেকে যেতাম চিরটা কাল। ভয় শুধু একটাই। বাড়িতে গেলে বুঝি আজ পিঠের চামড়া আর
আস্ত থাকবে না দু’জনেরই। সেই দুপুর থেকে দু’জন বেপাত্তা। এতক্ষণে কি আর কারুর জানতে বাকি আছে! কলম্বাস হওয়া জন্মের মতো ঘুচে না যায় আজ। বাড়ি গিয়ে
কী অযুহাত দেওয়া যায়, সেটা ভাবছিলাম মনে মনে। পল্টুও নৌকাটাকে ততক্ষণে খাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে সবে নামতে যাবে। গেঁওগাছের গায়ে নৌকাটাকে বাঁধতে, এমন
সময়… খাঁড়ির গা ঘেঁসে প্রায় দশ-পা দূরের নলবনটা প্রচন্ড জোরে কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। বাতাসও তো
নেই এমন যে নলবনটা ওরকম কেঁপে উঠবে! কোনও এক অজানা ভয়ে শরীরটা যেন শিরশির করে কেঁপে উঠল।চেঁচিয়ে পল্টুকে ডাকতে গেলাম, কিন্তু গলাদিয়ে
কোনও আওয়াজ বেরোল না। কারণ ততক্ষণে নলবনের হালকা ঝোপের আড়াল ছাপিয়ে ধবধবে চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এসেছে সাত- আট ফুটের মস্ত ডোরাকাটা
শরীরটা। নীল দুখানা চোখ জ্বলছে ধকধক করে। স্থির হয়ে মেপে নিচ্ছে যেন আমাকে। ভয়ে হৃৎপিন্ড স্তব্ধ হয়ে এল। পাঁকের মধ্যে পা-দুটো যেন জড়িয়ে এল আরও।
পল্টুর চিৎকার শুনতে পেলাম, পালা বুড়–ন। পালা শিগগির। বাঘ! বাঘ! হালকা শীতের মধ্যেও ঘেমে উঠলাম। ঝপাস করে শব্দ উঠল একটা। বুঝলাম পল্টু ঝঁপিয়ে
পড়েছে এক কোমর জলে। ফ্যাকাসে চোখে তাকিয়ে দেখলাম ডুব সাঁতার দিয়ে পল্টু ভেসে যাচ্ছে নদীর গভীরের দিকে। আর আমি! কী করব এখন! কথা হারিয়ে
ফেলেছি। গলার কাছে দলা পাকিয়ে জমে শক্ত গেছে যেন সব। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে একটা। বোবা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম মূর্তিমান সেই
দানবটার দিকে। তালপাতার মতো ঠকঠক করে কাঁপছে তখন আমার গোটা শরীরটাই। দানবটা এগিয়ে আসতে লাগল ধীর পায়ে। লক্ষ্য স্থির । ধ্বধকিয়ে জ্বলছে
চোখদুটো। এইবুঝি সব শেষ! আর দু- একটি মুহূর্তমাত্র। শুনেছি জঙ্গলে খাবার ফুরোলে লোকালয়ে বাঘ আসে। জঙ্গল ফুঁড়ে মস্ত নদী পেরিয়ে ভেসে আসাটা তাদের
কাছে নস্যি। আর ক্ষুধার্ত বাঘমাত্রই ভয়ানক হিংস্র। এ যে কতদিনের অভুক্ত তাও আমার জানা নেই। ভয়ে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে আমার। মোচড়
দিচ্ছে এবার চারপেয়ে শরীরটা। সামনের দু- পা সামান্য বাঁকিয়ে মুখটাকে নামিয়ে এনেছে নীচে। লাফ দেবে নিশ্চয় এবার! ডুকরে কেঁদে উঠলাম মাআআ… বলে। সে
কান্না গলা ফুঁড়ে বাইরে এল না কিছুতেই।এক হাঁটু পাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে দারুণ আতঙ্কে শরীরটাই শুধু কাঁপতে লাগল আমার থিরথিরে বাতাসে কাঁপা পাতার মতো। সে
কাঁপুনির শব্দটা বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটোতে লাগল। হঠাৎ ঝোপের মুখে প্রচন্ড জোরে সপাং করে একটি শব্দ হল।একবার। দু’বার। তিনবার। মুখ ঘোরাল হিংস্র
শরীরটা। এ কী দৃশ্য দেখছি! ছোট্ট চেহারার কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে ঝোপের মধ্যে। হাতে তার লম্বা হেঁতালের ডাল। তাই দিয়ে সে সপাটে বাড়ি মারছে নলখাগড়ার বনে।
দারুণ চমকে উঠলাম। এ কি সাহস, নাকি দুঃসাহস! মূর্তিমান যমের সঙ্গে লড়াই করেছ তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে! চাঁদের আলোয় চিনতে পারলাম না। কে ও? ঘ্রাউউউউ…!
বিকট একটা হুঙ্কার তুলে এবার ঘুরে দাঁড়াল বাঘটা। কেঁপে উঠল মাটি, জল থরথর করে। চাঁদের আলোটাও পর্যন্ত ত্রাসে কেঁপে উঠল নদীর জলে। একটা মেয়েলি গলা
চিৎকার করে উঠল সেই সঙ্গে, পালাওওও…! বুড়–ন দা… পালাও…! পালাও শিগগির! গলাটাকে চিনতে পারলাম না! নাকি চেনা চেনা মনে হল খুব! তখনই বুঝতে
পারলাম, এ যে নমিতা! ও ছাড়া এই গ্রামে আমাকে চেনেই বা কোন মেয়ে! আর বুড়–নদা বলে ডাকবেই বা কে! আশ্চর্য! এত সাহস নমিতার! চোখ ফেটে জল বেরিয়ে
এল আমার। কৃতজ্ঞতায় নয়, লজ্জায়।মনটা অপরাধবোধে ভ’রে উঠল। বছর তিনেক আগে এক ছুটিতে জেঠুর বাড়ি এসে এই নমিতাকেই আমি চোর বলে অপমান
করেছিলাম। আমার হারিয়ে যাওয়া চাইনিজ ঘড়িটাকে চুরির দায় নিয়ে বাড়িছাড়া হয়েছিল ছোট্ট নমিতা। আর কোনদিন তাকে দেখিনি আমি। নমিতার জলভরা মুখটা
মনের আয়নায় ভেসে উঠল। ওর মা জেঠুর বাড়িতেই কাজ করত। নমিতাও খেলতে আসত মায়ের সাথে।আমাকে ভারি পছন্দ করত। ছেঁড়া তাপ্পিমারা ফ্রকের সেদিনের
ছোট্ট নমিতাকে ছবির মতো দেখতে পাচ্ছি এখন। জেঠির হাতের চড় খেয়ে লাল হয়ে গেছে গাল। তবুও একটা কথা ফোটেনি ওর মুখ থেকে সেদিন। পা দুটো মাটির সঙ্গে
চেপে বোবা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়েছিল মেয়েটা! ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল জলভরা বোবা দুটি চোখের দৃষ্টি নিয়ে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে
রইলাম নমিতার দিকে। বাঘের কথা যেন ভুলে গিয়েছি আমি। তীব্র অপরাধবোধে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে লাগলাম। ঘোর কাটল ঘ্রাউউউউ… শব্দের প্রচন্ড হুঙ্কারে।
সপাটে হেঁতালের ডালের বাড়ি খেয়েছে একটা। নমিতার হাতের লাঠি আছড়ে পড়েছে তার মুখে। প্রচন্ড খেপে উঠল বাঘটা। দুই থাবা উঁচিয়ে এবার লাফ দিল নমিতাকে
লক্ষ্য করে। নমিতাও দারুণ ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করে উঠল গলা ছেড়ে, পালাওওওও… বুড়–ন দা আ… আ…! হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না আআ আ…! পালাও
শিগগির… পা লা ও ও ও ও! শরীরে হারানো শক্তি ফিরে এল। নরম আঠালো পাঁকের মধ্যে থেকে ঢুকে যাওয়া হাঁটুদুটো প্রবল শক্তিতে তুলে এনে হাঁচড়েপাচড়ে উঠে এলাম
নদীর ভেড়িতে। বাঘটা পেঁচিয়ে ধরেছে নমিতার শরীরটাকে।কান্না উঠে এল আমার গলা ঠেলে। রুদ্ধ কন্ঠে চিৎকার করে উঠলাম, নমিতা… ! নমিতা চেঁচাচ্ছে ওর
সর্বশক্তি দিয়ে। করুণ আর্তির মতো শোনাচ্ছে নমিতার গলা। পালাও বুড়–ন দা… দাঁড়িয়ে থেকো না… পায়ে পড়ি… পালাও শিগগির…!মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে শরীরটাকে
টেনে নিয়ে চললাম। দু-পা দৌড়োনোর পর ঝোপ জঙ্গল ঠেলে কোথা থেকে পল্টু উঠে এল হঠাৎ। আমার হাতটায় হ্যাঁচকা টান মেরে দৌড় লাগাল সজোরে। দৌড়তে
দৌড়তে দু’জনেই হাঁপাতে লাগলাম। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে আমার। পল্টুকে বললাম, পল্টু… নমিতা…! পল্টু আমার হাতখানা ধরে আরও জোরে দৌড়াতে শুরু
করল। কতবার পল্টুকে বলতে চেষ্টা করলাম, পল্টু রে নমিতা রয়ে গেছে একা ওই নলখাগড়ার বনে। বাঘের মুখ থেকে ওকে বাঁচানো দরকার… মুখ দিয়ে কথা ফুটল
না…
***
গ্রামে ততক্ষণে চাউর হয়ে
গেছে বাঘের খবর। বাঘের ওই ভয়ানক হুঙ্কার কানে এসে পৌঁছেছে গ্রামশুদ্ধ সকলের। আমাদের দু’জনকে ফিরে আসতে দেখে বাড়ির সবার ধড়ে যেন প্রাণ এল। বড়
জেঠা এগিয়ে এসে সবে কানটা আমার টেনে ধরতে গিয়েও কী ভেবে যেন কিছু বললেন না। গ্রামশুদ্ধ লোক বাঘ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমার মনটা তখন
আকুল বিকুলি করছে প্রায়। কাকে বলি নমিতার কথা! কাকে বলব এখন! মেয়েটাকে কি তবে আর বাঁচানো গেল না? বড়জেঠির কাছে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
কাদাসুদ্ধু গায়ে জেঠি আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন। ফুঁপাতে ফুঁপাতে তবুও আমি জেঠিকে বলে ফেললাম নমিতার কথা। জেঠি একটাবার তুমি বড় জেঠাকে
বলো না, এখনও গেলে বুঝি বাঁচানো যাবে নমিতাকে…! জেঠি আমার কথা শুনে দু-মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠলেন হু-হু
করে। আমি বড়জেঠির গা ধরে ঝাঁকাতে থাকলাম, জেঠি, ও জেঠি একটাবার বলো না জেঠাকে… এখনও গেলে নমিতাকে… নইলে যে বাঘেই খেয়ে ফেলবে মেয়েটাকে!
জেঠি আমাকে শক্ত করে চেপে ধরলেন। কান্নাভেজা গলায় বললেন, পোড়াকপালি! যাকে তিনবছর আগেই খেয়ে গেছে বাঘে, তাকে আর নতুন করে কী খাবে বাবা!
নলখাগড়ার বনের ধারেই তো নমিতার শ্মশান! পোড়াকপালি আমার! হু-হু করে কেঁদে উঠলেন বড় জেঠি। আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। দু’গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে
আসছে। যার জন্যে জীবন ফিরে পেলাম, কানে স্পষ্ট ভেসে আসছে তার কান্নাভেজা গলার করুণ আর্তি – পালাও বুড়-ন দা… দাঁড়িয়ে থেকো না… পায়ে পড়ি… পালাও
শিগগির…!
………………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………..