শতের মিশ্রণ – পর্ব ১

শতের মিশ্রণ – পর্ব ১

একটা সুমধুর সুর ভেসে আসলো। দক্ষিণ দিকের জানালা শব্দ করে খুলে গেল। কেবলই ঘুম এসে গেছিল। বাইরে প্রচণ্ড শীত। তবে শীতের এখনো বেশ দেরি। শরতের শেষদিকে বৃষ্টি হলে এরকম ঠান্ডা প্রায় হয়। মাথাটা প্রচণ্ড ব্যাথা করছে। দিনখানেক হলো উপর তলার ঘর ভাড়া নিয়েছি। বাড়ির মালিক এক বৃদ্ধা। বিধবা। চার সন্তানের হয়েও একা থাকতে হচ্ছে। এমন সন্তান জন্ম দিয়ে লাভ কি যদি শেষ বয়সে খেয়ালই না রাখে। তিনি নিচতলায় থাকেন। আমাকে তার ছেলের মতোই দেখেন। নিজেকে রান্না করতে হয় না। তিনি নিজেই নিচে ডেকে তার সাথে বসিয়ে খাওয়ান। এমন আদর যে পরের ছেলে পাচ্ছে সে থেকে বুঝা যায় বৃদ্ধার মন তার সন্তানদের জন্য কতটা ব্যকুল। আমার বাবা মা বছর দেড়েক আগে মারা গেছেন। তাদের কথা চিন্তা করতে চাই না। কেমন জানি উদাসীন ভাব চলে আসে। মনে হয় আমি কত একা। ভাই আছে। প্রবাসী। বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে বাইরেই থাকে। দেশে আসে না। এসে কি করবে। কে আছে দেশে। অনেক আগে কার কাছ থেকে শুনেছিলাম বেশ ভালোই আছে। ভালো থাকলেই ভালো। জীবনে বাঁচার জন্য কারণ দরকার। আমি উদাসীন। বেঁচে আছি। কিন্তু কেন জানি না। আমার মনে হয় আমি কারণ খুঁজে বেরাচ্ছি।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে সুরটা আর শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে শূন্যতার রাহু গ্রাস করেছে। কেন জানি গা ছমছম করছে। কালকের কথা। এক বন্ধুর সাথে মেয়ে দেখতে গেছিলাম। মেয়ে খুব সুন্দর তা বলব না। তবে পছন্দসই। বিয়ের জন্য উপযুক্ত। হয়তো বিয়ের গন্দি পর্যন্ত কথা আগাবে। কিন্তু বেঁকে বসলো মেয়ের বাবা। কারণ ছেলে লেখক। জীবিকা নির্বাহের জন্য লেখালেখি অন্যায় নয়। কাজটা সম্মানের হতে হবে। মেয়ের বাবার মতে এখনকার দিনে লেখকরা আগেকার বিখ্যাত লেখকদের মতো সম্মানীয় নয়। কারণ সমাজ বদলেছে। মানুষের রুচি পাল্টেছে। আমিও একমত তার সাথে। তবে আধুনিক হওয়া মানে বদলানো না। সামনে এগিয়ে যাওয়া। মেয়ে নাকি ইতিহাসের ছাত্রী। তার পেশা কি হতে পারে ভবিষ্যতে। সে তো আর আগেকার দিনের মতো ইতিহাস প্রেমী হয়ে ইতিহাসবিদ হতে যাচ্ছে না। অগত্যা না করেই চলে আসা। বন্ধুর বয়স বাড়ছে। বুঝা যাচ্ছে বিয়ে দেওয়া জরুরি। তবে তার লেখা গল্প আর কেইবা পড়বে। মনে যা আসে তা লিখলেই যদি লেখক হওয়া যেত তাহলে নিরক্ষর মানুষরাও শুধু বলে বলে লেখক হতো।

আমি জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বোধহয় চাকরিটা পাবো না। গত পরশু ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে ছিলাম। শার্ট প্যান্ট বৃদ্ধা নিজে ধুয়ে দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ মানুষকে দিয়ে শার্ট প্যান্ট ধুয়াতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায় যায়। তবে তার এক বাক্য। আমাকে দিয়ে তার ছেলের আসন পূরণ করাচ্ছেন। সব ঠিকঠাক ছিল। তবে আমি ওতোটা গুছালো স্বভাবের না। যারা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে তারা জানে এর কদর কতটা। আমি ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকি। কখনো আর্ট স্কুলে যায় নি। নিজের মনে যা আছে তাই এঁকেছি। কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। তবে আশপাশের মানুষদের কাছ থেকে বাহবা পেয়েছি। এখনো সেটাই করি। টাকা আসে ভালো। পার্ট টাইম। তবে এখন আর কাগজ কলম দিয়ে নয়। ব্রাশের তুলি কবে ছুঁয়েছি মনেও নেই। তবে বদলায় নি। এগিয়েছি। মানে গ্রাফিক্স ডিজাইনার। আরো ভালো করে বলতে টেকনিক্যাল আর্টিস্ট। এটা চলমান ছবির সাথে কিংবা মনিটরের সামনে বসে খেলা গেমের সাথে যথাযথ মানায়। আমার অ্যাম্নেসিয়া আছে। তবে সেরকম নয়। অনেককিছুই মনে থাকে না।

ধ্রুব দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীল লিফটের বাটন বারবার চাপছে। এই মুহূর্তে তারা হাসপাতালের আটতলায়। তার তাড়াতাড়ি নিচতলায় নামতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। বস অফিসে ফিরে তাদের না পেলে খবর আছে। বস এমনিতেই নীলের উপর চরম খ্যাপা।
ধ্রুব: বললি না তো ?
নীল: কি বলবো ?
ধ্রুব: যেটা জিজ্ঞেস করলাম।
নীল: দেখ তোর ফালতু কথা শোনার সময় নাই।
ধ্রুব: আরে বল না।
নীল: আমি জানি না।
ধ্রুব: আচ্ছা আমি যদি এই আটতলার জানালা থেকে সোজাসুজি লাফ দেয় তবে কি আমি মারা যাব ?
নীল: কিসব আবল তাবল বকছিস ?
ধ্রুব: তাহলে বল মানুষ মরে গেলে তারা হয় কিনা ?
নীল: তুই কেনো বুঝার চেষ্টা করছিস না বলতো ? যা হয়েছে সেটা কে আর বদলানো যাবে না।
ধ্রুব: সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করলাম বুঝছিস না।
নীল: তোমার সমস্যা কি বলতো ?
ধ্রুব: তুই জানিস না ?
নীল: এক কাজ করা যাক। আমরা যেহেতু এখনো হাসপাতালে আছি সেহেতু তোকে কোনো ডাক্তারকে দেখিয়ে যায়।
ধ্রুব: তোর মনে হয় আমি মানসিক রোগী ?
নীল: আরে আমি তা বলিনি।
ধ্রুব: মানসিক রোগী কখনো স্বীকার করে না যে সে মানসিক রোগী। তবে আমি স্বীকার করছি। হ্যা আমি মানসিক রোগী।
নীল: দেখ তোর মনের মধ্যে কি চলছে তা আমি জানি না। তবে এতটুকু বুঝেছি তুই বুঝতে চাইছিস না।
ধ্রুব: আমি না বরং তুই বুঝতে পারছিস না।
নীল: তুই যতোই নিজেকে দোষ দে ভাগ্য কেউ বদলাতে পারে না।
ধ্রুব: যদি যেত তবে…
নীল কিছু বলল না। লিফটের দরজা খুলে গেল। ওমনি তিনজন লোক লিফট থেকে বেরিয়ে এলো। নীল আর ধ্রুব লিফটে ঢুকে পড়ল। নীল নিচতলার বাটনে চাপ দিল। ধ্রুব নীলের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে আছে।
নীল: দেখ তোর আর তোর এই মিমির কাহিনী আমি জানি না। জানতেও চাই না। যদি সে সত্যিই কখনো থাকতো তবে হয়তো আমি বা অন্য কেউ জানতে পারত।
ধ্রুব: হয়তো তাকে আমার জীবন থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। সে একবার বলেছিল আমরা কোন কিছুকে ততক্ষণ পর্যন্ত মূল্য দেয় না যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা স্মৃতি হয়ে যায়।
নীল: তুই যদি মনে করিস তুই তোর স্মৃতিতে পড়ে থাকতে চাস তবে থাক। আমি বাধা দিব না। আর যদি বাঁচতে চাস তবে মেনে নে এসব শুধুই কল্পনা ছিল।
ধ্রুব: মানুষ নিজের জীবনে হয়তো সেভাবে বাঁচতে পারে না যেভাবে সে চায়। হয়তো এইজন্যই তার কল্পনার জগৎ তৈরি করে। সেখানে সে বাঁচে। নিজের কষ্ট কাউকে বলার সঙ্গী খুঁজে পায়। মানুষ জানে না যা তার সাথে ঘটে তা আদৌও সত্যি কিনা। তবে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকাটা জরুরি কিনা।

নীল গম্ভীর নিঃশ্বাস ফেলল। লিফট নিচতলায় এসে থেমে গেল। সে বের হয়ে বাইরে এসে রিকশা নিল। তার গন্তব্য সোজা অফিস। সন্ধ্যার আগে অন্তত পক্ষে বসের সামনে হাজিরা দিতে হবে। ধ্রুব বাড়ি যাবে না। নিজের স্বপ্নের জগতে হাঁটবে কিছুক্ষণ। হাঁটুক। স্বপ্ন দেখা খারাপ নয়। তবে সেটার সীমানা ঘুমের মধ্যে থাকায় শ্রেয়। ধ্রুব হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটছে। সে কোনদিকে যাচ্ছে তার খেয়াল নেই। ট্রাক চলে গেল তার পাশ দিয়ে। একটু হলে তার সাথে ধাক্কা লাগত সে খেয়াল নেই। ট্রাক কিছুদূর সামনে থেমে গেল। একটা লোককে চাপা দিয়েছে সে। লোকটা রিকশায় উঠে বসতেছিল। এমন সময় দূর্ঘটনা ঘটল। রিকশা দুমরে মুচড়ে একাকার। রিকশাওয়ালা আহত। তবে লোকটার অবস্থা দেখার মতো নয়। একটা বাচ্চা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বোধহয় রাস্তায় এতো হট্টগোল কিসের তা সে বুঝতে পারছে না। এতো লোকের কলরব কিসের জন্য তা বোঝা তার বাইরে। ল্যাম্প পোস্টগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। সামনে ব্রিজ। গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক। কোনটা দ্রুতগতিতে। কোনটা আবার প্যাডেলের শব্দে মচমচ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।

ছবিটা শেষ না হতেই মিমি হল থেকে বেরিয়ে এলো। আমিও তার পিছুপিছু বেরিয়ে এলাম। আমি বললাম,
: কি হয়েছে ? আর কিছুক্ষণ পরেই তো ছবিটা শেষ হয়ে যেত।
: এই ফালতু ছবি দেখাতে তুমি আমাকে নিয়ে এসেছিলে ?
: ফালতু কয়, ভালোই তো লাগলো।
: কত করে বললাম একটা রোমান্টিক ছবি দেখব দুজন মিলে তা না এসব আজগুবি কাহিনী দেখাতে নিয়ে এলে।
: আরে তুমি তো জানোই আমার এসব ধরনের জটিল কাহিনী পছন্দ। সেজন্যই নাবিলা বললো…
: নাবিলা বললো মানে ? ও বললো বলেই দেখতে এলে না। তোমার সাথে আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
এই বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরল। আমি বললাম,
: আরে বাড়ির রাস্তা তো এদিকে।
: বাড়ি যাচ্ছি না।
: তবে ?
: ট্রেনের নিচে চাঁপা পরে মরতে যাচ্ছি।
আমি জানি মিমি সত্যিই তাই করতে যাচ্ছে। কারণ সে কখনো মিথ্যে বলে না। তবে আমার এই মুহূর্তে তাকে আটকানোর ইচ্ছেও নেই। হঠাৎ করে পিছন থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে টেনে একজন জড়িয়ে ধরল। নাবিলা। আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। নাবিলা বললো,
: ভালোবাসি।
আমিও বলে ফেললাম,
: আমিও ভালোবাসি।
মেয়েটা এবার ছেলেটার দিকে চোখ তুলে তাকালো। নাহ মেয়েটা নাবিলা না। আর না ছেলেটা আমি। কল্পনা করলাম তাদের জায়গায় আমাকে আর নাবিলাকে রেখে। মন্দ লাগলো না। তবে পূর্ণতা পেলাম না। হয়তো আমি খারাপ ছেলে। হতে পারি একাধিক প্রেমে পড়ে যায়। প্রেমে পড়া খারাপ নয়। পয়সা তো আর লাগে না। একাধিক মেয়ের প্রেমে পড়তেই পারি। তবে মিমি ছাড়া আমার দিন চলে না। বোধহয় প্রেম না সে। অভ্যাস। যায় গিয়ে মিমিকে ডেকে নিয়ে বিরিয়ানি খেতে যায়।

আমি বাড়ির ভিতর পা রাখতেই কেমন জানি শীতল অনুভব করলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ছাড়াও আরো কেউ আছে। বৃদ্ধা নেই। মানে ইহজগতেই আছে। তবে ছোট ছেলের বাড়ি। ভালোই হয়েছে। যতোই হোক আমি পরের ছেলে। রক্তের টানই আলাদা। আমি ঘরের আলো জ্বালিয়ে শার্ট খুলে ফেললাম। নোংরা হয়েছে। ধুতে হবে। এই মুহূর্তে খিদে পেয়েছে প্রচুর। তবে রান্না করা নেই। এমনিতেই বৃদ্ধার সাথেই খায়। তবে তিনি যেহেতু নেই সেহেতু আমাকেই ব্যবস্থা করা লাগবে। আমি রান্নাঘরে গেলাম। দেখি বিস্কুট বা কেক তেমন কিছু পাওয়া যায় নাকি। চকচকে প্লেট। সাদা ধবধবে পোলাও। সাথে মুরগির ঠেঙের রোস্ট। গরুর মাংসের তরকারি আর মুগের ডাল। একটা গ্লাসে পুদিনা পাতায় কড়কড়ে বোরহানি। আমি তো অবাক। ঢাকনা টেবিলের উপর রাখলাম। নিশ্চয় বৃদ্ধা রান্না করে দিয়ে গিয়েছে। তবে ধোঁয়া উঠছে কেন। যেন এইমাত্র রান্না করা হয়েছে। ধুর চোখে ভুল দেখছি। চশমা নেই চোখে এমনিতেই। আমি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। নাহ এ বৃদ্ধার রান্না নয়। একয়দিনে তার হাতের রান্না চিনে গেছি। তবে কে রান্না করল এগুলো। ওহ আমার তো আবার ভুলে যাওয়ার রোগ আছে।

মিমির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। খারাপ লাগছে না। মিমির সাথে আমার বিয়ে এমনিতেও হতো না। কারণ মিমি যতই নিহালের কথা ভুলার জন্য আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করুক না কেন। সে নিহালকে কখনোই ভুলেনি। তাছাড়া নিহাল চাকরিজীবী। একটা জার্মান কোম্পানির রোবোটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার বাবা মা তো এক পায়ের উপর খাঁড়া। আর আমি সেখানে কেবল ২য় বর্ষের ইঞ্জিনিয়ারিং টপকাতে পারলাম না। বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পাশ করার থেকে নিজে থেকে শেখা অনেক ভালো। নাম্বার কখনোই তেমন ভালো ছিল না। তবে একেবারে খারাপও ছিল না। তবে মনে হলো এবার একটু গুরুত্ব দেওয়া যাক। তা-ও কাজে দিল না। ব্যাচে এক নতুন মেয়ে নজরে পড়ল। বয়সে আমার থেকে বছর দুয়েক ছোট হবে হয়তো। এমন বয়সের তফাত আমার ক্লাসে অনেকেরই আছে। তবে আমি নিয়মিত ছাত্র না হওয়ায় তেমন কাউকে চিনিও না। তবে মেয়েটাকে ভালো লাগলো। চেনা চেনা ঠেকলো কিছুটা। বোধহয় এর আগেও কোথাও দেখেছি। তবে চিনতে পারলাম না। আমার জীবনে প্রেম কখনোই ছিল না। বন্ধুত্ব নয়। শুধু সাক্ষাৎ। আমার কোনো আগ্রহও ছিল না এসবের। অধিকাংশ সময় কম্পিউটারে গেম খেলে পার হতো। মেয়েটা দেখতে কিছুটা স্বাস্থ্যবান। তবে তেমন মোটা না। মনে হলো মেয়েটার সাথে আমার অনেক মিল আছে।

CS:GO খেলতে বসেছিলাম। ম্যাচ মেকিং চলছে। এমন সময় ডিসকর্ডের একটা নোটিফিকেশন নজরে এলো। একজন মেসেজ করেছে।
: কেমন আছেন মিঃ অলস।
আমি ম্যাচ মেকিং ক্যান্সেল করে ডিসকর্ডে ঢুকলাম। লিখলাম,
: আমি কি আপনাকে চিনি ?
: সেটা কি ভীষণ জরুরী ?
: এটা আমার প্রশ্নের জবাব ?
: যদি বলি চিনেন আবার চিনেন না ?
: মানে ?
: ওই চশমিস এতো মানে জেনে কি করবে ?
আমি চশমা নাকের ডগার উপর তুলে লিখলাম,
: চশমিস মানে ?
: চশমা পরো তাই চশমিস।
আমি কিছু লিখলাম না। সেই মেসেজ দিল।
: মেসেজের রিপ্লাই দিতে এতো দেরি করো কেন ?
আমি খেয়াল করলাম এর আগেও মেসেজ দিয়েছে। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। পিসি অফ। আমি কান থেকে হেডফোন খুলে বিছানায় শুয়ে পরলাম। মনে হচ্ছে কল্পনার জগত থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছি। এমন সময় ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দ। আমি সবার মেসেজের নোটিফিকেশন অফ করে রাখি। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম একটা আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
: কারেন্ট চলে গেছে বুঝি ?
: কিরে করে বুঝলেন ?
: সব মেয়েদেরই কি আপনি বলে ডাকেন ?
বুঝলাম দুজনেই এক। আর মেয়ে। যদিও বা আগেই বুঝেছিলাম। কারণ মেয়ে মানুষ আমার সাথে খুব বেশি এড নেই। যা আছে অনেক আগে থেকে ফ্রেন্ডলিস্টে আছে সেই খাতিরে। নতুন কাউকে আর এড করি না। আইডিটা এড নেই। তার মানে আমার পূর্বপরিচিত না। তবে চেনাজানা আছে হয়তো কোনভাবে। আবার মেসেজ এলো।
: ঘুমিয়ে পরলে নাকি ?
আপনি থেকে তুমি। কাছাকাছি আসার লক্ষণ। সবাই এমনটাই করে। তবে বেশিদূর ভাবা উচিত নয়। এরকম কিছুই ঘটেনা শেষে।
: না জেগে আছি।
: তুমি তো আবার ঘুম প্রিয়। তাই জিগ্যেস করলাম আরকি।
কথা সত্যি। তবে উল্টোভাবে। আমি রাতে জেগে থাকি প্রায়। তাই অনেক বেলা করে ঘুমায়। বুঝতে পারলাম এটা আমার পছন্দ করা সেই মেয়েটা। কিভাবে বুঝলাম ? অলস অলসকে অলস বলে। সেও ঘুম প্রিয়। কারণ প্রায় ক্লাসে পিছনের সিটে ঘুমিয়ে পরে। আর আমি বেলা করে ঘুমায় বলেই নিয়মিত ক্লাসে যেতে পারিনা। তাছাড়া আগেই বলেছি মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছি। তবে মনে পরছে না। পূর্বপরিচিত না হলে আমার মতো মানুষকে কেউ কুলি মজুরের থেকে বেশি কিছু মনে করবে না। সহজভাবে টিস্যু পেপার। চোখের জল মুছো বা টমলেটে ব্যবহার করো, অন্যের নোংরা আর কষ্ট বহন করে নিয়ে বেরাতে হয়। লাভ কি ব্যবহার করতে দিয়ে ? কেন বা দূরে সরে আসি না ? টিস্যু পেপার কখনো প্রয়োজনে আপনার থেকে পালিয়েছে ? ইচ্ছে অনিচ্ছার কিছু নেই। মরা অনুভূতি আর মৃতদেহ এক বিষয়। সতেজতা না থাকলে কোনটারই মূল্য নেই।

মেয়েটা অবাক করে দিয়ে আমাকে কিছু ছবি পাঠালো। তার ছবি তবে মুখ দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে তার বুক। বুকের উপর ট্যাটু করা। ৬৬৬ লেখা ট্যাটুর মাঝে। শয়তানের পূজা করে নাকি আবার। পরক্ষনেই মেয়েটা লিখল,
: কি হলো মিস্টার, কোথায় হারিয়ে গেলেন ?
আশ্চর্য ছবি কয় গেল। মনে হচ্ছে আমি ভালো হওয়ার বদলে আরো খারাপ হচ্ছি। এখন দেখি খারাপ চিন্তা আরো বেশি ভর করছে। ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই। কারণ আজ পর্যন্ত ৬ টা ডাক্তার আমার চিকিৎসা করার চেষ্টা করেছে। উল্টো তারা নিজেরাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। প্রথম প্রথম ভাবতাম এগুলো আমার একাকীত্বের কারণে হয়। বন্ধু বানানোর চেষ্টা করলাম। অজানা কারণে কোন কেউ বন্ধু হতে চায় না। হয়েও হয় না। কেন জানি না। প্রেম করতে গেলে উল্টো নিজেই বেশি কষ্ট পায়। কারণ সেগুলো তাদের খারাপ সময় পার করার সাথী হিসেবে বানায়। তাদের উপদেশ দেওয়ার লোক মনে করে আমাকে। আমার তাতে কি লাভ। হঠাৎ ফোন এলো। স্ক্রিনে লেখা ‘মা’। আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। বিশ্বাস করা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। কারণ বিশ্বাস বলতে কোন শব্দ আমার জীবনে আর নেই। স্ক্রিনের নামটা বৃদ্ধার। মায়ের ফোন না। আজ রাতে তার বাড়ি ফেরার কথা। আমি ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে কেউ বলল,
: হ্যালো, শিরোনামহীন বলছেন ?
: ভুল নম্বর।
: দেখুন এখানে এক বৃদ্ধা মহিলার মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। উনার ফোন থেকেই আপনাকে ফোন করলাম। আসলে উনি আর…
: দুঃখিত ভুল নম্বরে ফোন দিয়েছেন।
আমি ফোন কেটে দিলাম। এমন সময় কারেন্ট চলে এলো। নিচের থেকে কেউ ডাক দিল।
: খেতে আসো বাবা।

আমি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
: মন খারাপ ?
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে। আমি আবার ঘাড় ফিরিয়ে নিলাম। আমার পছন্দ করা সেই মেয়েটা। মেয়েটা আমার পাশে এসে বলল,
: কাল রাতের মেসেজ দিলে না যে আর ?
আমি এমন ভাব করলাম যেন কিছু বুঝতে পারলাম না।
: কোন মেসেজ ?
: এমন ভাব করছে যেন কিছুই বুঝো না।
: আমি জানি কি বলছো।
: আমি সব জানি।
: কি জানো ?
: তুমি যা ভাবো।
: কি ভাবি ?
: তোমার কল্পনার জগৎ।
আমি পিছে ফিরে বললাম,
: কিভাবে জানো ?
: তুমিই বা আমাকে কি করে চিন ?
: আমি তোমাকে চিনি না।
: সত্যি বলছো ?
: স্কুলে যে‌ মেয়েটা তোমাকে আড় নজরে দেখত তাকে কখনো কেউ ভুলতে পারে।
: তুমি আড় নজরে দেখতে ? কিন্তু কেন ?
: তোমার পিছনে তাকিয়ে দেখ। কি সুন্দর লাগছে না শহরটা। নিউক্লিয়ার বোমায় তৈরি নতুন জগৎ তৈরি হতে চলেছে।
আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যি। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এমন সুন্দর দৃশ্য কখনো লাগেনি। হঠাৎ দূরে একটা নিউক্লিয়ার বোমা পড়ল। মানুষের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে। অদ্ভুত এক শান্তি। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখলাম আমি একটা পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে আছি। পিঠে ব্যাথা করছে।

আমি যখন ঘরে ঢুকলাম তখন বেলা ১২ টা বাজে। ঘরের অবস্থা একাবারে খারাপ। কালরাতে বৃদ্ধার ঘরের খালি সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো বাড়িতে আগুন লেগে গেছে। বৃদ্ধা সেই সময় ঘরে ঘুমাচ্ছিল। আমি বাড়িতে ছিলাম না। মিমির বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়ে ছিলাম। তার পুরোনো প্রেম ঠিক করে দেওয়ার জন্য আমিই দায়ী। যতই মিমি বলুক না কেন সে আমাকে ভালোবাসে, আমি জানতাম সে এখনো নীলকে ভুলতে পারেনি। অবশ্য নাবিলাও এসেছিল বিয়েতে। যাকে আমি কোন এক কালে পছন্দ করতাম। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাসার সামনে দাঁড়ালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি নাবিলা দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করছে। আমার সাথে কাল তার কথা হয়েছিল। তাকে মনের কথা বলে দিয়েছিলাম। হঠাৎ একটা ট্রাক এসে নাবিলার উপর দিয়ে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেন যেন হাসতে ইচ্ছে করছে। তবে হাসলাম না। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার পছন্দ করা ক্লাসের সেই মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হঠাৎ করে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার ঠোঁটে চুমু দিতে শুরু করলো। তারপরেই আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাম। তার আগে শুনতে পেলাম,
: আমার কল্পনার জগৎ থেকে তোমার অবসান ঘটানোর সময় এসেছে। এরকম জগতে আটকে থাকা আমার জন্য কষ্টের। পারলাম না তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
আমি খুব কষ্টে বললাম,
: তুমি কথা দিয়েছিলে আমাকে সবসময় তোমার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে।
: আমি মেনে নিয়েছি তোমার মৃত্যু। তোমাকে নিয়ে শত শত চিন্তার মিশ্রণ আমাকে আরো পাগল করে দিচ্ছে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি। এই কষ্ট আমার পক্ষে সহ্য করা আর সম্ভব নয়।

ডাক্তার লিসার চেকআপ করে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে অনাথ আশ্রমের খ্রিস্টান মহিলা সিস্টার মারিয়া। ডাক্তার তাকে বললেন,
: কোমা থেকে বেরিয়ে আসার পর গত কয়েকমাসে লিসা মানসিকভাবে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। আচ্ছা সিস্টার লিসা কি কখনো বিছানা থেকে উঠেনি ? মানে বাইরের মানুষের সাথে কখনো মেলামেশা করেনি ?
: না। কেন বলুন তো ?
: এমন কেসে সাধারণত মানুষ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে অন্য কেউ হওয়ার চেষ্টা করে। নিজের অদেখা জগতকে নিজের মতো সাজায়। একারণে লিসা অন্যরকম আচরণ করত। তবে সে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছে।
লিসা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মনে হচ্ছে সে জন্য এক নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। বিগত কয়েকমাসের কথা তার মনে নেই। শুধু মনে আছে সে তার মায়ের সাথে গাড়িতে ছিল। তারপর…

লিসার কিছু মনে নেই। তবে সে অনেক হালকা মনে করছে নিজেকে। শত শত চিন্তার মিশ্রণে সে ডুবেছিল এতদিন। সে নিজেকে এখন সুস্থ মনে করছে। মনে হচ্ছে সে এখন বাঁচতে পারবে নতুন করে। কোন বিপদ নেই আর। সিস্টার মারিয়া আড়চোখে তার দিকে তাকালো। লিসা সেটা খেয়াল করেনি। জানা নেই ভাগ্য কোনদিকে মোড় নেয়।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত