প্ল্যানচেটের আত্মা

প্ল্যানচেটের আত্মা

ভেজা সন্ধ্যা,স্নিগ্ধ আমেজ নিয়ে দাড়িয়ে আছি জানালায়।সেই সন্ধ্যা থেকে ফোনে একটা গানই বাজছে,”ও আমার,,বন্ধু গো,,চিরসাথী পথ চলার,,,তোমারই

জন্যে,,গড়েছি আমি,,মঞ্জিল ভালোবাসা।।।।”
,
,
গানটা শুনছি আর দুচোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে।”বন্ধুত্ব” খুবই ছোট একটা শব্দ কিন্তু এর অর্থটা কি এতই সহজ???নাহ,আমি আর থাকতে পারছি না।যেভাবেই

হোক রুহির সাথে আমার কথা বলতেই হবে।কিন্তু রুহি তো মারা গেছে।।কি করা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ প্ল্যানচেটের কথা মাথায় আসলো।যেই ভাবা সেই কাজ।

আমার বন্ধু পরেশকে ফোন দিলাম।পরেশ আমার ছোট বেলা থেকে বন্ধু আর ও রুহির কথা জানে।পরেশের কাকা আবার তান্ত্রিক।পরেশকে বললাম যে প্ল্যানচেট

করবো,তোর কাকা কি বাসায় আছে?পরেশ বলল,”কাকা তো ইন্ডিয়াতে গেছে।”শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।ফোন রাখতেই একটু পর পরেশ আবার ফোন দিল।বলল

যে,”দোস্ত,কাকা নাই তো কি হয়েছে,আমি তো আছি।কাল তোদের বাসায় আমি আসছি,প্ল্যানচেট করবো।”বলেই ফোন রেখে দিল।ওর কথা পাত্তা দিলাম না।
,
,
পরদিন বিকালে পরেশ সত্যি সত্যি এসে হাজির।হাতে একটা বড় ব্যাগ।ব্যাগ থেকে এক এক করে প্ল্যানচেট করার জন্য জিনিসপত্র বের করছে।জানতে চাইলাম তুই

কবে থেকে এই সব শুরু করলি?আমার হাতে একটা বই ধরাই দিল।বললো যে কাকার ঘর থেকে বইটা পেলাম।এতে সব পদ্ধতি লেখা আছে।
,
,
খুশিতে মন ভরে গেল।রাত বারোটাই ঘরের দরজা জানালা দিয়ে দিলাম।পরেশ মেঝেতে প্ল্যানচেটের বোর্ড রাখলো। বোর্ডের চার কোনায় চারটা মোমবাতি জ্বেলে দিল।

রুপ-ধুনো জ্বেলে সারা ঘরে গোলাপ জল ছিটিয়ে দিল। ওর পাশে গিয়ে বসলাম।পরেশ আমাকে বললো,”মোমবাতি নিভে গেলে বুঝবি রুহির আত্মা এসেছে,তখন প্রশ্ন

করবি।ভয় পাবি না।ওর আত্মা আমার মধ্যে আসবে।ভুল করেও যেন বোর্ড থেকে হাত সরাবি না।হাত সরালে কিন্তু ওর আত্মা আর ফিরে যেতে পারবে না।”
,
,
পরেশ বই দেখে দেখে কিসব মন্ত্র পড়তে লাগলো।মন্ত্র পড়া শেষে ও চোখ বন্ধ করলো আর আমাকেও চোখ বন্ধ করে রুহির কথা ভাবতে বললো।
,
বোর্ডের উপর হাত দিয়ে এক মনে রুহির কথা ভাবছি। হঠাৎ পরেশ কেঁপে উঠলো।চোখ মেলে দেখি মোমবাতি নিভে গেছে।অন্ধকার রুম।ডাক দিলাম,রুহি।একটা

মেয়ে কন্ঠ বললো,”হ্যা,বলুন”।এটা তো রুহির কন্ঠ না।ভাবলাম মারা গেছে বলে হয়তো কন্ঠ অন্যরকম শোনাচ্ছে।বললাম,তুই কেন আমারে একা রেখে সুইসাইড

করলি?তোর আর ফিরে যেতে হবে না।থেকে যা প্লিজ।রুহি শুধু বললো,”কষ্ট”।তারপর হঠাৎ মোমবাতি নিজে নিজেই জ্বলে উঠলো।পরেশের দিকে তাকালাম।হঠাৎ

করে পরেশের চোখ খুলে গেল।কিন্তু একি???পরেশের চোখ একদম সাদা যেখানে কোনো মনি নাই।চিৎকার করে উঠে বোর্ড থেকে হাত সরালাম।পরেশ জ্ঞান হারালো।

রুমের মধ্যে প্রচণ্ড বাতাস বইছে।পরেশকে কোনো রকমে ধরে বেডে শুইয়ে দিলাম।প্রচণ্ড শব্দে জানালা খুলে গেল।তারপর একদম নিরবতা।বাতাস বন্ধ হয়ে গেল।
,
,
পরেশের পাশে শুয়ে শুয়ে রুহির কথা ভাবতে লাগলাম।রুহি আমার বেষ্টফ্রেন্ড,আমার প্রেমিকা,আমার ভালো থাকার একমাত্র মাধ্যম।ছয় বছরের রিলেশন ওর সাথে।

ছয়টা বছর কম সময় না।রুহি ছিল চিকন,লম্বা,কালো,দাঁত উঁচু।দেখতে সুন্দর না হলেও ওর ছিল একটা চমৎকার মন।এত ভালো মন যে কারো হতে পারে তা রুহিকে না

দেখলে কেও বুঝতেই পারবে না।কত সুন্দর আর মিষ্টি ছিল আমাদের সম্পর্ক।।।।আমার হাতটা ধরে বলতো,ভাবিস না,সারা জীবন তোর পাশে আছি।একদিন রুহির

উপর প্রচণ্ড রাগ হয়।রাগে একা একা পুকুর পাড়ে বসে আছি।হঠাৎ রুহি পেছন থেকে আমার চোখ বন্ধ করে ধরে।আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে,”ভালোবাসি”।

সেদিন ওর হাত ধরে খুব কেঁদে ছিলাম।বলেছিলাম,এত ভালোবাসা কি আমার কপালে সইবে???রুহি আমার কথা শুনে সেদিন খুব হেসেছিল।বলেছিলো,”ছেলেদের

কাঁদলে বোকার মতো লাগে”।হ্যাঁ,আমি বোকা।তাই তো আমারে রেখে সুইসাইড করলি।
,
,
রুহির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।পরদিন থেকে পরেশ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো।ও বাড়ি চলে গেল।সেইদিন রাতে প্রচুর কান্নার আওয়াজ পেলাম,কিন্তু পাত্তা

দিলাম না।মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।ওয়াশরুমে যাবার প্রয়োজন মনে করলাম।মুখ ধুয়ে আয়নায় তাকাতেই ভয়ে শরীর জমে গেল।আয়নাতে এ কে???কি বিভৎস

চেহারা….মুখ থেকে মাংস খসে খসে পড়ছে।আমার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো।আয়না থেকে হঠাৎ করে একটা হাত বের হয়ে আমার গলা চেপে ধরলো।

ওহ্,,,কি তীব্র যন্ত্রণা।।।।আমি মারা যাচ্ছি মনে হয়।তারপর আর কিছু মনে নাই।চোখ মেলে দেখি আমি বিছানায়।গলায় প্রচণ্ড ব্যাথা।বিছানায় আসলাম কিভাবে জানি

না।পরদিন আবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল।পানি পান করার জন্য রুমের বাইরে গেলাম।পানি পান করে রুমে আসতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল।এ কি দেখছি

আমি।।।রুহি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে।চোখ দুটো খোলা আর আমার দিকে তাকিয়ে আছে।দুচোখ দিয়ে রক্ত অশ্রু ঝরছে।।।।রুহির এরকম দৃশ্য

আমি কি করে সহ্য করবো????আমি আর সহ্য করতে পারলাম না,জ্ঞান হারালাম।।।।

জ্ঞান ফিরতে নিজেকে ছাদে আবিষ্কার করলাম|সমস্ত গায়ে নখের দাগ|ব্যাথায় শরীর নাড়াতে পারছি না|পরেশকে ফোন দিয়ে সব বললাম|পরেশ বলল,”কাকা দেশে

ফিরেছে|তুই একবার কাকার কাছে আয়|”
,
,
পরেশের তান্ত্রিক কাকা আমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠে বললেন,”অশুভ আত্মা বুঝতে পারছি”|আমার আর পরেশের কাছ থেকে প্ল্যানচেট থেকে শুরু করে সব কাহিনী

শুনলেন|পরেশকে খুব বকাঝকা করে আমাকে বললেন,”তোমরা রুহি নামের অন্য কোনো অশুভ আত্মাকে ডেকেছো এবং তাকে তুমি এই জগতে থেকে যাবার জন্য

অনুরোধ জানিয়েছো|আমি কিছু করতে পারবো না।এখন আমরা প্ল্যানচেটের মাধ্যমে তোমার আসল রুহিকে ডাকবো আর সেই এই অশুভ আত্মার বিনাশ পদ্ধতি বলে

দেবে|
,
,
আগের পদ্ধতিতেই প্ল্যানচেট করা হলো|মোমবাতি নিভে গেলে ডাক দিলাম,রুহি
চিরচেনা সেই পরিচিত কণ্ঠ বললো,”হুম বল”।বুকের মাঝে চিন চিন করে ব্যাথা করে উঠলো।
আমি : আত্মাটাকে বিনাশ করবো কিভাবে?
রুহি : ওর আত্মা খুব দুখী|ওকে এক সপ্তাহ আগে খুব কষ্ট দিয়ে খুন করা হয়েছে|বড় পুকুর পাড় থেকে একটু খুজেই একটা মেয়ের লাশ পাবি।ওর লাশটা এখন এইরাতে

এনে একটা খালি রুমে বৃত্তের মধ্যে রেখে দিবি।লাশ আনতে গিয়ে বিপদ হতে পারে।পাত্তা দিবিনা।কাল সকালে সহীহ্ ভাবে দাফন করে দিবি|

আমি : আচ্ছা তা দিলাম কিন্তু তুই কেন সুইসাইড করলি?আমিও সুইসাইড করে তোর কাছে যাব|

রুহি : আমাদের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দিব্যি তুই সুইসাইড করবি না|তুই সুইসাইড করলে আমার বস্তির অসহায় বাচ্চাদের কে দেখবে?আর আমার সুইসাইডের কারণ বলতে চাই না|আমার খুব কষ্ট হচ্ছে|আমি গেলাম|
আমি : আচ্ছা
রুহি : শোন
আমি : বল
রুহি : ভালোবাসি
আমার দুচোখ জলে ভরে উঠলো|এততত ভালোবাসিস আমায়???
রুহির কথা মতো একা একা লাশটার খোজে গেলাম।আজ বোধ হয় পূর্ণিমা।মৃদ্যু চাঁদের আলোয় শুনশান নিরবতা ভেদ করে চলছি।ভয়ে গা ছমছম করছে।রাস্তার পাশে

অসংখ্য সাদা কাপড় পরিহিত মানুষ দেখলাম।হঠাৎ দেখলাম কয়েকজন রিক্সা চালক রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কারো মাথা নাই।গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে। কোনো দিকে

খেয়াল করলাম না।কোনো সমস্যা ছাড়া অল্প খুঁজেই একটা মেয়ের পঁচা গলা লাশ পেলাম।লাশটা নিয়ে দাড়াতেই মাটির নিচ থেকে একটা হাত আমার পা টেনে ধরলো।

চিৎকার করছি কিন্তু চিৎকার শোনার মত কেউ নাই।আস্তে আস্তে হাতটা আমাকে মাটির নিচের দিকে টানতে লাগলো।অদৃশ্য কোনো মেয়ে কন্ঠ হাসতে লাগলো আর

বলতে লাগলো,”আমার লাশ আমি নিয়ে যেতে দিব না।”এমন সময় আমার হাতে চিরচেনা রুহির হাতের স্পর্শ পেলাম।অদৃশ্য রুহি আমার হাত ধরে জোরে টানতে

টানতে নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিল।লাশটা একটা ফাকা রুমে বৃত্তের মধ্যে রেখে দিলাম।
,
,
একটু পর ওই রুম থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ পাচ্ছি।কি হচ্ছে দেখার জন্য ওই রুমের জানালা দিয়ে তাকালাম।দেখলাম লাশটা শূন্যে ঘুরছে আর চিৎকার করছে।তাড়াতাড়ি

জানালা থেকে সরে আসলাম।
,
,
পরদিন রুহির কথা মতো লাশটা দাফন করে বস্তির অসহায় বাচ্চাদের কাছে গেলাম|ময়লা ছেড়া কাপড় পরিহিত নিষ্পাপ মুখের হাসিগুলোর মাঝে রুহির ছায়া খুজে

পেলাম|বাচ্চাদের সাথে দেখা করে রুহির জন্য একবুক কষ্ট আর বাচ্চাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম|আকাশের দিকে

তাকিয়ে মনে মনে রুহির উদ্দেশ্যে একটা কথাই বললাম,”আমিও ভালোবাসি”…

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত