” রং টার্ন ”

” রং টার্ন ”

১।
সিগারেট টা ধরিয়ে বেশ আয়েশ করে বসল নীল । দশ মিনিটের বিরতিতে আছে এখন সে । তাছাড়া দুর্বা ও আশে পাশে নেই । দুর্বার যন্ত্রনায় তার সিগারেট টাও খাওয়া হয় না ঠিকমত । আগে বারান্দায় বসে রকিং চেয়ারে গা মেলে দিয়ে গান শুনতে শুনতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ত ! দুর্বা এসে তার পুরা জীবন টাই এলোমেলো করে দিয়েছে । মেয়ে তো না যেন ঝড় একটা । এক মাস হয়েছে দুর্বার সাথে নীল এর বিয়ে হয়েছে । দেড় মাসের পরিচয় । প্রথম দেখাতেই প্রেম । দ্বিতীয় দেখাতেই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব । এবং তৃতীয় দেখার দিন বিয়ে । কোন জাঁকজমক ছাড়াই দু তিনটা বন্ধুবান্ধব নিয়ে কাজি ডাকিয়ে বিয়ে । নীলের মা মারা গেছেন জন্মের সময় । বাবা ও কিছুদিন আগে । একটা বোন আছে , স্বামী নিয়ে বিদেশে । আর খুব কাছের তেমন কোন আত্মীয় নেই তার । দুর্বার অবস্থা তো আরও খারাপ । এতিমখানায় বড় হয়েছে । নিজের যোগ্যতায় পড়াশোনা করেছে এতদূর । এত মিষ্টি একটা মেয়ে । দুর্বা যেন তার একাকী জীবনে এসেছে আশির্বাদ হয়ে । একটা মানুষ এতটা কিভাবে ভালবাসতে পারে নীল বুঝেনা । দুর্বার সম্পুর্ণ জগত জুড়েই নীল । মাস্টার্স পাশ করা একটা মেয়ে । অথচ কোন চাকরি করতে চায়না । সারাদিন ঘরে বসে থাকে , খুটুর খুটুর করে এইটা ওইটা করবে । নীলের পছন্দের খাবার বানাবে … ঘর সাজাবে । কই একটু বাইরে ঘুরবে , বন্ধুদের সাথে দেখা করবে … না , তার কোন বালাই নেই , সারাদিন নীল কে নিয়েই পড়ে থাকবে । ঘণ্টার পর ঘণ্টা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে । কোনই ক্লান্তি নেই তার। নাহ , এরকম ভালবাসা পাবার জন্য এক দুইটা জীবন খুব সহজেই বিসর্জন দেয়া যায় । নীলের জীবনের রাইট টার্ন ছিল দুর্বা । মধ্য বয়সে এসে দুর্বাকে পাওয়া ! নিঃসঙ্গ ভালবাসাহীন জীবনটা দুর্বা ভরিয়ে দিয়ে গেছে ।

এখন নীল ভীষণ ব্যস্ত । গত দেড় মাসে ঠিক মত চেম্বারে আসা হয়নি । কোন পেসেন্ট ও এটেণ্ড করা হয়নি । ঘর থেকে বের হলে দুই তিন ঘণ্টা পার হয় না , দুর্বা ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় । একলা তার ভাল লাগে না । কাজকর্ম তার শিকেয় তুলে বসে থাকতে হয় দুর্বার সাথে । গত এক সপ্তাহ ধরে সে নিয়মিত চেম্বারে আসছে । এই মুহূর্তে অনেক রাশ । মোবাইলের রিংটোনের শব্দে নীলের ধ্যানভঙ্গ হল । কাজের সময় ফোন সাধারণত তার এই হাসপাতালের এসিস্টেন্ট এর কাছেই থাকে । আজকে সে নিয়ে যায়নি । এমন ভুল সাধারণত সে করে না । পেসেন্ট দেখার সময় কেউ ফোন করলে সে খুব বিরক্ত হয় । ফোন টা হাতে নিয়ে দেখে নীল বিশেষ মানবীর ফোন । দুর্বা … তার মন টা ভাল হয়ে গেল হুট করেই ।
‘কি কর , সোনা …’
‘ক্রিকেট খেলছিলাম … তোমার ফোন পেয়ে চলে এলাম …
উফফ , সবসময় ঠাট্টা । আজ কখন আসবে ?
উমম , ৯টার মাঝে । প্রমিস ।
আজ একটু আগে আসলে কেমন হয় ?
খুব খারাপ হয় ।
কেন ?
পেশেণ্ট রা আমাকে ধরে পিটাবে ।
কেন ? ডাক্তার কে নিজেদের কোন লাইফ নেই নাকি ?
আরে তা না । এপয়েণ্টমেণ্ট নেয়া না ?
তো কি ? জরুরি কিছু হতে পারেনা ? তুমি অসুস্থ হতে পারনা ? আমি অসুস্থ হতে পারিনা ?
কি ব্যপার তুমি অসুস্থ নাকি ?
নাহ । তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিব , তাড়াতাড়ি আসো প্লিজ ।
কি করি বলতো ? রাগ করে না । ভাল না বউ আমার । ৯ টার মাঝে ঠিক আসব ।
লাগবে না যাও । কাজ ই কর । তোমার বাসায় ই আসার দরকার নেই ।
ফোনটা কেটে গেলো । এক চিলতে হাসল নীল । দুর্বার এই রাগ ভাঙ্গানোর উপায় তেমন কঠিন কিছু না । কয়টা বেলি ফুলের মালা কিংবা বকুল ফুলের মালা হলেই হবে । আবার কাজে মন লাগাল নীল ।

২।
কলিংবেলে হাত ছোঁয়াবার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল । দুর্বা সম্ভবত লুকিং গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে ছিল । নীল ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরল তাকে । হাতের ব্যগ টা মাটিতে ফেলে দিল নীল । দুহাতে সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দুর্বা কে । ভালবাসার এই অনুভূতির জন্য এমন হাজার টা জীবন পেতে ইচ্ছা করে নীলের । কয়েক মিনিট পেরিয়ে যায় , তবু দুজন এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে ।
আমার সারপ্রাইজ টা কি ??
বলব না । আমার গিফট কই ?
এনেছি তো সোনা ।
কই ? দাও নাই তো ?
আস তোমাকে পরায় দেই আমি ।
কয়েকটা বকুল ফুলের মালা পেঁচিয়ে দিল নীল দুর্বার খোপায় । আদুরে বিড়ালের মত নীলের বুকের কাছে ঘেঁষে মুখ লুকালো দূর্বা ।
কেউ আসছে ..

কে ?? কেন ?
আরে বুদ্ধু কেউ আসতে চাইছে আমাদের মাঝে …
বলেই লজ্জা পেয়ে গেল দুর্বা । এবং তখন ই পুরা ব্যপার টা বুঝতে পারল নীল । সাথে সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে দুর্বা কে । এক মুহুর্তে পৃথিবীটা কেমন সুন্দর হয়ে যায় !
আবছা আলোয় দুর্বা কে দেখে সে ।
ফিসফিস করে বলে সে , আসুক না… আসতে দাও তাকে ……

৩।
অনেক কষ্টে চোখ খুলল নীল । মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । কালকের কথা কিছু মনে পড়ছে না তার । দুর্বার সাথে কথা বলছিল … এর মাঝে ঘুমিয়ে গেল কখন সে ? মাথা নাড়াতে পারছে না । একদম ভারি লাগছে নিজেকে । চোখে প্রথমে খুব ঝাপসা দেখছিল নীল । তারপর স্পষ্ট দেখল তার শোবার ঘরের সোফায় শুয়ে আছে সে । প্রায় শেষ রাত তখন । এবং তার ই বিছানায় এক জোড়া নারী – পুরুষের অবয়ব । জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে । আবার চোখ বন্ধ করে খুলল সে । তাকিয়ে হঠাৎ করে মনে হল তার এইটা কোন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা । তার শোবার ঘরে , তারই বিছানায় তার ই স্ত্রীর সাথে অন্য কোন পুরুষ ? এইটা কিভাবে সম্ভব ?
কিছু বলতে যায় নীল । পারেনা । চিৎকার করার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা । গলা দিয়ে একটা শব্দ বের হয়না তার । উঠে বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে । দুর্বার সঙ্গীর ততক্ষনে ঘুম ভাঙ্গে । মৃদু হাসি দুচোখে তার । লোকটাকে তার খুব চেনা চেনা লাগে । কোথায় যেন দেখেছে সে ।
আমি খুব ই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব । আপনাকে সামান্য ক্লোরোফর্ম ছোঁয়ানো হয়েছিল । কিন্তু আপনি এতই নাজুক যে রাত কাটিয়ে দিলেন । আর আমরাও অপেক্ষা করতে করতে একটু আরকি …… অনেক দিন পর দুর্বা কে পেলাম তো ! নাহলে আপনার শোবার ঘর ব্যবহার করতাম না আর যাই হোক !

ওকি , উঠতে চাচ্ছেন নাকি ? তা বোধ হয় আর হচ্ছে না । আপনার এখন সম্পূর্ণ সেন্স আছে যদিও , নড়াচড়া বা কথা বলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই ভাই ।
আমার কিছু কথা শুনুন । আপনাকে না বললেও চলত । তবু বলি । আমি আবার গোপনে কোন কাজ করি না । করাটা পছন্দও করিনা । যাই হোক , দুর্বাকে খুব ভালবাসেন নাকি আপনি ? তাই তো মনে হয় । বেশি আবেগে মানুষ অন্ধ হয়ে যায় । ঠিক ভুলের হিসাব টাও মনে হয় বুঝেনা , তাই না ? দুর্বা যা বলল আপনাকে তাই ধ্রুব সত্য ? একটা খোঁজ ও নিলেন না ? ভাগ্য আমাদের ভালই ছিল … নাহলে আপনি কেন দুর্বার প্রেমে এমন পাগলের মত পড়বেন ? আবার বলেন দুর্বাকে খুঁজে পাওয়া আপনার জীবনের রাইট টার্ন ??? আপনার রং টার্ন কিংবা দুর্ভাগ্য !! হাহাহাহা …
নীল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে । যেনো কোন গল্প শুনছে … প্রচণ্ড হাসির শব্দে দুর্বার ঘুম ভেঙ্গে গেছে । সে আলতো হাসি মুখে উঠে বসলো । তার ভাঁজ ভাঙা চুলে এখনও কিছু বকুল ফুল ছিটিয়ে পড়ে আছে ।
আপনি ভয় পাবেন না । আপনাকে খুব বেশি একটা কষ্ট পেতে হবে না । আমার অবশ্য ইচ্ছা ছিল । কিন্তু দুর্বার অনুরোধ আবার আমি ফেলতে পারিনা । কি করব বলেন ??

লোকটা নীলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে । ঠিক তখনি নীল চিনতে পারে লোক টাকে । তার ছবি বেশ কয়েকদিন আগে পেপারে দেখেছিল । অনীশ আরাফাত । একজন সিরিয়াল কিলার । গত ১৫ মাসে সে ৫ টার মত খুন করেছে … প্রত্যেক টা খুন ই বীভৎস উপায়ে করে সে …… প্রথম মাসে সে শিকার খুঁজে বের করে … তারপরের মাসে সে শিকার কে টোপ ফেলে জালে এনে ভরে … তৃতীয় মাসে সে শিকার কে বিভিন্ন উপায়ে খুন করে এবং পরের মাসে নতুন শিকারকে খুঁজে …
৫টা খুন ই হয়েছে বীভৎস তম উপায়ে … পুরো লাশ টাও খুঁজে পায়নি পুলিশ । লাশের শরীরের কিছু অঙ্গ শুধু উদ্ধার করতে পেরেছিল । ৫টা কেসে এক ই কাহিনী । লাশের শুধু মাথা টা পড়ে থাকে । চোখ দুটা উপড়ে নেয়া … জিহবা কাটা … কোথাও দু একটা আঙ্গুল … আর চাপ রক্ত সারা ঘর জুড়ে … ব্যস , এতটুকই । লাশ টা কি করে , কোথায় ফেলে , কাটাকাটি কেন করে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও করতে পারে নাই পুলিশ ।
নীলের মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায় । ঢোক গিলে সে । অবাক হয়ে তাকায় দুর্বার দিকে । দুর্বা সেই আগের মতই আদুরে চোখে তাকিয়ে আছে । চোখে চঞ্চল হাসি ।

আই এম স্যরি ডক্টর নীল । তবে আপনাকে এতটুক সম্মান করছি আমরা , আপনার মৃত্যু টা হবে ব্যথা হীন । ৫০০ মিলি. ক্লোরোফর্ম ঢালা একটা রুমাল শুধু আপনার মুখের উপর রাখব … বাকি কিছু হবে আপনার মরে যাওয়ার পর । বেশি সময় লাগবে না । আপনাকে আরও একটু সম্মান করছি , আপনার মাথাটা অবিকৃত রেখে দেব একদম । ধারালো ছুরিটা একদম ই ছোয়াব না । প্রমিস । যদিও চোখ টা আমার বেশ পছন্দ ! আপনি বেগুন ভাজি যতটা পছন্দ করেন চোখ আমার তার থেকেও বেশি প্রিয় । তবু আপনার ক্ষেত্রে ছাড় দিলাম । আফটার অল , আমাদের হবু সন্তানের জন্মদাতা তো আপনিই ।
নীলের গা গুলিয়ে উঠল । লাশ গুলো খুঁজে পাওয়া যায় না তার কারণ … তার কারণ অনীশ আরাফাত এইগুলা ..????? পিশাচ !!!! তার চোখ মুখ কুঁচকে উঠল …

আবেদনময়ীর ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে দুর্বা । হাতে একটা সাদা রুমাল ? এই কি সেই ক্লোরোফর্ম দেয়া রুমাল ? কিছু ভাবার আগেই নীলের ঠোঁটে গভীর ভাবে চুমু খায় সে … বাধা দেবার শক্তিটাও নেই নীলের … বাধা দিতে ইচ্ছাও করছে না আর । সব কেমন লাগছে … এলোমেলো … দুর্বা কে রং টার্ন ভাবতে ইচ্ছা করেনা তার … চোখ বন্ধ করে সে … তারপর শূন্যতা … প্রবল শূন্যতা ।

৪।
–কাজ শেষ ?
–হুমম ।
–সব প্যাক করে নিয়েছ তো ?
–হুমম ।
–তাহলে চলো । দেরী করছ কেন ?
–ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে যাই ?
–কী পাগলের মত বলছ দুর্বা ? হাতে সময় কম । সকাল হবার আগেই বেরোতে হবে ।
–চলো …
–এঈ দুর্বা , ঠিক আছ তো ?
–হূম আছি । চলো বের হই ।
–আমি ভাবছিলাম তুমি আমার সত্যি নীলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলে নাকি !
–আরেহ না … কি যে বল না তুমি !
ভোরের অন্ধকারে দুজন মানব-মানবী (! ) বের হয়ে আসে হাত ধরে … পেছনে পড়ে থাকে নির্জন একটা ঘর … আর সারা ঘরে চাপ চাপ রক্ত …

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত