অশরীরী

অশরীরী

প্রায় প্রতি শুক্রবার সকাল ১০.১৫ এর দিকে একটা ফোন আসে। এই সময়টা একান্ত আমার। যে ফোন করে সে জেনে শুনেই করে। ধরব না ধরব না করেও ধরে ফেলি প্রতিবারই।
প্রথম যেদিন ফোন এসেছিল, সেই দিনটার কথা পরিষ্কার মনে আছে, ১২ই ডিসেম্বর । সকালের নাস্তা শেষে রাকিব বাজারে গেছে। আমি দ্বিতীয় কাপ চা নিয়ে পা তুলে সোফায় বসেছি। অল্প অল্প শীত পড়েছে। বাইরে মিষ্টি রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে। আকাশটাও কি সুন্দর, পরিষ্কার নীল। আমি এখন আকাশ দেখবো, ইচ্ছেমত গান শুনবো আর ভাবনার জগতে ডুব দেব। এইভাবে ঠিক কতক্ষণ ডুবে ছিলাম জানি না। হটাত শুনতে পেলাম বাসার ফোনটা বাজছে, বেশ অনেকক্ষণ ধরে। একদম উঠতে ইচ্ছা করছিল না। নিশ্চয়ই রাকিব। কতো টুকু টম্যাটো আনবে, বুটের ডাল দেখতে কেমন এমন সব অদ্ভুত প্রশ্ন করবে। অনেক কষ্টে আলসেমি কাটিয়ে ফোনটা ধরলাম।
‘হ্যালো’।
ওপাশে কিছুটা নিস্তব্ধতা।
আমি অধৈর্য হয়ে আবারো বললাম ‘হ্যালো’, এবার একটু জোরে।
‘কেমন আছিস চৈতি?”
গলাটা আমি চিনতে পারি নি। তাই জানতে চাইলাম ‘কে বলছেন আপনি?’
‘আমি কণা, চিনতে পারিস নি? ‘
কণা। আমার ভেতরটা থর থর করে কেঁপে উঠে। সমস্ত শরীর ভারী হয়ে আসে, কেমন যেন শীত শীত লাগছে। ‘এ কোন কণা ? ‘ আমি যেই কণাকে চিনতাম সে তো সেই কবেই হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। আর মাস দুএক আগে শুনেছি হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকেও। ওর মৃত্যুটা এক্সিডেন্ট না সুইসাইড পরিষ্কার ভাবে জানা যায় নি। আমি অতো জানতেও চাই না। কণার মৃত্যু নিয়ে আমি বা রাকিব কেউ একটা শব্দ ও উচ্চারণ করিনি। যদিও আমি জানি, রাকিব ও জানে। কিন্তু এ যেন আমাদের মাঝে এক নিষিদ্ধ অনুচ্চারিত চুক্তি। গত দুইমাসে আমরা একবারও ঢাকা যাওয়ার কথাও আর বলি নি।
‘বিশ্বাস করি না, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। কণা মারা গেছে।’
ওই পাশে সেই চির চেনা হাসি, যে হাসির শব্দে সহস্র কাঁচের চুড়ি রিনিঝিনি করে । ‘ আজ আমার জন্মদিন, একটু উইশ ও করবি না? আর শোন, রাকিব কেমন আছে?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই লাইনটা কেটে গেল।
আমি অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলাম। চায়ের কাঁপে ধূমায়িত চা ঠাণ্ডা জল হয়ে গিয়েছে। কণা, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ক্লাস ফাইভে ওর সাথে আমার পরিচয়। সেই থেকে এক সাথে বেড়ে ওঠা। আমাদের দুজনেরই কোন বোন ছিল না। কিন্তু সেই অভাব কোন দিন আমরা টের পাই নি। স্কুলে সারা দিন কাটিয়ে, বিকালে এক সাথে খেলা, একটু বড় হলে ছাদে আড্ডা মারা। ছুটির দিন গুলোতেও একজন চলে যেতাম আরেকজনের বাড়িতে। সেই কণা যখন রাকিবের প্রেমে পড়লো, সেই প্রথম আমি ওর চোখে দেখেছিলাম দূরের ডাক। কি অদ্ভুত পরিবর্তন ওর। ধীর স্থির মেয়েটা কেমন যেন এক ছটফটানিতে ভুগত। ওর চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন, দিন, রাত জুড়ে খালি রাকিব। আমি জীবনে প্রথম বারের মতো নিঃসঙ্গ হলাম। আমরা যে এক জন আরেকজনের জীবন জুড়ে কতোখানি ছিলাম তার আগে সেটা বুঝতে পারি নি।
প্রথম যেদিন রাকিবের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেদিনই রাকিবকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। অন্য রকম ভালো। নিজের ভিতরে এক ধরনের ঈর্ষা, অপরাধ বোধ সব মিলে ভীষণ অসহায় লাগছিল। আমি সেদিন পালিয়ে বেঁচেছি ।
“কি রে, রাকিবকে তোর ভালো লাগে নি? ও ভাবে চলে এলি যে?”
আমি কি বলবো কণাকে? কোন মতে বললাম ‘তোদেরকে সময় দিলাম।’
এর পরেও মাঝে মাঝে দেখা হতো রাকিবের সাথে। আমরা তখন অনার্সে, আর রাকিব ফাইনাল ইয়ারে। মাঝে মাঝে কণাকে দিয়ে ছোট খাট গিফট ও পাঠাতো। চকলেট বা বই। আমি ওকে বলেছিলাম কবিতা ভালবাসি ।
কণাটা এতো সরল, রাগ হতো আমার, কখনো করুণা। আবার নিজেকেও ধমকাতাম, ‘লজ্জা হয় না তোমার?” সে এক অদ্ভুত সময় গেছে আমার জীবনে, কিছুই ভালো লাগতো না।
রাকিব পাশ করে চট্টগ্রামে চাকরি পেল। যাওয়ার আগের দিন আমাকে খবর দিল ওর সাথে দেখা করতে, খুব জরুরি দরকার। যেন একা আসি।
এক রাশ সংশয় নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সংসদ ভবনের লেকের পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোয় আগুন ধরেছে, তার চেয়েও বেশি আগুন ছিল সেদিন ওর চোখে।
‘চৈতি আমাকে বাঁচাও, তুমিই পারবে আমাকে বাঁচাতে।’ কোন ভণিতা ছাড়া সরাসরি বলেছিল ও, একবারও না ভেবে আমার হাত দুটো ধরে মিনতি করেছিল ও।
‘আপনি কি বলছেন রাকিব ভাই? কণা আপনাকে ভালবাসে।’
‘হয়তো, কিন্তু আমি ওকে আর ভালোবাসি না, আমি ভুল করে ভেবেছিলাম ওকে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু আমাদের কোন কেমিস্ট্রিই কাজ করছে না, আসলে কোনদিনই করে নি। আর করবেই বা কিভাবে? তোমাকে দেখার পর থেকে একটু একটু করে আমার মনের মাঝে তুমি ঢুকে গেছো। তুমিও তো তাই চেয়েছ, বল চাও নি তুমি?’
ধরা পড়ে গিয়ে আমার ভিতরের জমে থাকা বরফ গুলো তখন একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে, সেই বরফ গলা নদিতে ভেসে গেল ন্যায়, অন্যায়, বন্ধুত্ব। সবার আপত্তিকে, সমালোচনাকে, সর্বোপরি কণাকে উপেক্ষা করে আমরা বিয়ে করেছিলাম। হ্যাঁ, আমরা সুখীও হয়েছিলাম।
ফোনটার কথা আমি রাকিবকে বলিনি। হয়তো কেউ আমার সাথে রসিকতা করেছে, বা ভয় দেখাতে চাইছে।
কিন্তু আমার ধারনাকে ভুল প্রমাণিত করে পরের সপ্তাহে একই সময়ে আবারো ফোন আসলো, তারপর আবারো।
‘ চৈতি, তোর বেডরুমের পাশের নিম গাছটা বেশ বড় হয়েছে, দোতালা ছাড়িয়ে তিন তালা ছুঁই ছুঁই। জানিস তো, যেই পেয়ারা গাছটা থেকে তুই আর আমি ছোট বেলায় পেয়ারা পাড়তাম, সেই গাছটা কেটে ফেলেছে করিম চাচা।’
আমি খালি শুনে যাই, কণার মুখে আমার জীবনের গল্প।
‘ রাকিবের বুকে ঘন লোমের আড়ালে একটা তিল আছে না, তুই কি সেটায় হাত বুলাস?’
সেদিন ভর দুপুরে আমি চমকে উঠি সেই অজানা তিলের সন্ধান পেয়ে।
‘ও কি তোকে চুমু খাওয়ার আগে চুইং গাম খেয়ে আসে সিগারেটের গন্ধ লুকাতে? আমি জানি তোর বেশি ভালো লাগে চুলের গোছা সরিয়ে ঘাড়ে চুমু খেলে। ‘
রাকিবকে কিছুই বলা হয় না, শুধু সেই রাতে ঘাড়ের কাছে মুখটা নিতেই দুহাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলি আমি।
‘কি হয়েছে তোমার চৈতি? শরীর খারাপ লাগছে?’ এক রাশ অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে রাকিব, আদুরে আমার এই রূপ সে কখনো দেখেনি। দুহাতের তালুতে আমার মুখটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনে ওর ঠোঁট, আমি ভয়ে কাঁপছি অল্প অল্প,
‘রাকিব, কণাকে কণাকে …… তুমি অনেকবার চুমু খেয়েছ?’
আমার প্রশ্নে থমকে যায় রাকিব, আমার চোখে পানি, ……..আমি শুধু দেখি ওর হতবিহবল মুখ।
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন আজ এতদিন পরে?’
আমাদের মাঝে দূরত্ব ব্যাড়তে থাকে…….রাতে আমার প্রায়ই এখন ঘুম হয় না……সারা সপ্তাহ নিজের অজান্তে শনিবার সকালের ফোনটার অপেক্ষায় থাকি……….. ভীষণ ভয় পাই…….. তবুও অপেক্ষা করি ………
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ট্রেনটা ছুটে চলছে ঢাকার দিকে, জানালায় মাথা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে আমার। গাছপালা, গ্রামগুলো দ্রুত সরে যাচ্ছে। রাকিবকে কিছু বলা হয় নি। আসার সময় একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছি বেড সাইড ড্রয়ারে। আমি কণাকে খুঁজতে যাচ্ছি, আমার ছোট বেলার বন্ধু কণা, যার কাছে আমার পাহাড় সম অপরাধ। ও কি আমাকে মাফ করবে না?
ট্রেনের একটানা দুলুনিতে আমার দুচোখের পাতা জড়িয়ে আসছে, আমি কতদিন ঘুমাইনি।।
লিখেছেন: তামান্না ইসলাম।
====================
প্রায় প্রতি শুক্রবার সকাল ১০১৫ এর দিকে একটা ফোন আসে। এই সময়টা একান্ত আমার। যে ফোন করে সে জেনে শুনেই করে। ধরব না ধরব না করেও ধরে ফেলি প্রতিবারই।
প্রথম যেদিন ফোন এসেছিল, সেই দিনটার কথা পরিষ্কার মনে আছে, ১২ই ডিসেম্বর । সকালের নাস্তা শেষে রাকিব বাজারে গেছে। আমি দ্বিতীয় কাপ চা নিয়ে পা তুলে সোফায় বসেছি। অল্প অল্প শীত পড়েছে। বাইরে মিষ্টি রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে। আকাশটাও কি সুন্দর, পরিষ্কার নীল। আমি এখন আকাশ দেখবো, ইচ্ছেমত গান শুনবো আর ভাবনার জগতে ডুব দেব। এইভাবে ঠিক কতক্ষণ ডুবে ছিলাম জানি না। হটাত শুনতে পেলাম বাসার ফোনটা বাজছে, বেশ অনেকক্ষণ ধরে। একদম উঠতে ইচ্ছা করছিল না। নিশ্চয়ই রাকিব। কতো টুকু টম্যাটো আনবে, বুটের ডাল দেখতে কেমন এমন সব অদ্ভুত প্রশ্ন করবে। অনেক কষ্টে আলসেমি কাটিয়ে ফোনটা ধরলাম।
‘হ্যালো’।
ওপাশে কিছুটা নিস্তব্ধতা।
আমি অধৈর্য হয়ে আবারো বললাম ‘হ্যালো’, এবার একটু জোরে।
‘কেমন আছিস চৈতি?”
গলাটা আমি চিনতে পারি নি। তাই জানতে চাইলাম ‘কে বলছেন আপনি?’
‘আমি কণা, চিনতে পারিস নি? ‘
কণা। আমার ভেতরটা থর থর করে কেঁপে উঠে। সমস্ত শরীর ভারী হয়ে আসে, কেমন যেন শীত শীত লাগছে। ‘এ কোন কণা ? ‘ আমি যেই কণাকে চিনতাম সে তো সেই কবেই হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। আর মাস দুএক আগে শুনেছি হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকেও। ওর মৃত্যুটা এক্সিডেন্ট না সুইসাইড পরিষ্কার ভাবে জানা যায় নি। আমি অতো জানতেও চাই না। কণার মৃত্যু নিয়ে আমি বা রাকিব কেউ একটা শব্দ ও উচ্চারণ করিনি। যদিও আমি জানি, রাকিব ও জানে। কিন্তু এ যেন আমাদের মাঝে এক নিষিদ্ধ অনুচ্চারিত চুক্তি। গত দুইমাসে আমরা একবারও ঢাকা যাওয়ার কথাও আর বলি নি।
‘বিশ্বাস করি না, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। কণা মারা গেছে।’
ওই পাশে সেই চির চেনা হাসি, যে হাসির শব্দে সহস্র কাঁচের চুড়ি রিনিঝিনি করে । ‘ আজ আমার জন্মদিন, একটু উইশ ও করবি না? আর শোন, রাকিব কেমন আছে?’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই লাইনটা কেটে গেল।
আমি অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলাম। চায়ের কাঁপে ধূমায়িত চা ঠাণ্ডা জল হয়ে গিয়েছে। কণা, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ক্লাস ফাইভে ওর সাথে আমার পরিচয়। সেই থেকে এক সাথে বেড়ে ওঠা। আমাদের দুজনেরই কোন বোন ছিল না। কিন্তু সেই অভাব কোন দিন আমরা টের পাই নি। স্কুলে সারা দিন কাটিয়ে, বিকালে এক সাথে খেলা, একটু বড় হলে ছাদে আড্ডা মারা। ছুটির দিন গুলোতেও একজন চলে যেতাম আরেকজনের বাড়িতে। সেই কণা যখন রাকিবের প্রেমে পড়লো, সেই প্রথম আমি ওর চোখে দেখেছিলাম দূরের ডাক। কি অদ্ভুত পরিবর্তন ওর। ধীর স্থির মেয়েটা কেমন যেন এক ছটফটানিতে ভুগত। ওর চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন, দিন, রাত জুড়ে খালি রাকিব। আমি জীবনে প্রথম বারের মতো নিঃসঙ্গ হলাম। আমরা যে এক জন আরেকজনের জীবন জুড়ে কতোখানি ছিলাম তার আগে সেটা বুঝতে পারি নি।
প্রথম যেদিন রাকিবের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেদিনই রাকিবকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। অন্য রকম ভালো। নিজের ভিতরে এক ধরনের ঈর্ষা, অপরাধ বোধ সব মিলে ভীষণ অসহায় লাগছিল। আমি সেদিন পালিয়ে বেঁচেছি ।
“কি রে, রাকিবকে তোর ভালো লাগে নি? ও ভাবে চলে এলি যে?”
আমি কি বলবো কণাকে? কোন মতে বললাম ‘তোদেরকে সময় দিলাম।’
এর পরেও মাঝে মাঝে দেখা হতো রাকিবের সাথে। আমরা তখন অনার্সে, আর রাকিব ফাইনাল ইয়ারে। মাঝে মাঝে কণাকে দিয়ে ছোট খাট গিফট ও পাঠাতো। চকলেট বা বই। আমি ওকে বলেছিলাম কবিতা ভালবাসি ।
কণাটা এতো সরল, রাগ হতো আমার, কখনো করুণা। আবার নিজেকেও ধমকাতাম, ‘লজ্জা হয় না তোমার?” সে এক অদ্ভুত সময় গেছে আমার জীবনে, কিছুই ভালো লাগতো না।
রাকিব পাশ করে চট্টগ্রামে চাকরি পেল। যাওয়ার আগের দিন আমাকে খবর দিল ওর সাথে দেখা করতে, খুব জরুরি দরকার। যেন একা আসি।
এক রাশ সংশয় নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সংসদ ভবনের লেকের পাড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোয় আগুন ধরেছে, তার চেয়েও বেশি আগুন ছিল সেদিন ওর চোখে।
‘চৈতি আমাকে বাঁচাও, তুমিই পারবে আমাকে বাঁচাতে।’ কোন ভণিতা ছাড়া সরাসরি বলেছিল ও, একবারও না ভেবে আমার হাত দুটো ধরে মিনতি করেছিল ও।
‘আপনি কি বলছেন রাকিব ভাই? কণা আপনাকে ভালবাসে।’
‘হয়তো, কিন্তু আমি ওকে আর ভালোবাসি না, আমি ভুল করে ভেবেছিলাম ওকে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু আমাদের কোন কেমিস্ট্রিই কাজ করছে না, আসলে কোনদিনই করে নি। আর করবেই বা কিভাবে? তোমাকে দেখার পর থেকে একটু একটু করে আমার মনের মাঝে তুমি ঢুকে গেছো। তুমিও তো তাই চেয়েছ, বল চাও নি তুমি?’
ধরা পড়ে গিয়ে আমার ভিতরের জমে থাকা বরফ গুলো তখন একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে, সেই বরফ গলা নদিতে ভেসে গেল ন্যায়, অন্যায়, বন্ধুত্ব। সবার আপত্তিকে, সমালোচনাকে, সর্বোপরি কণাকে উপেক্ষা করে আমরা বিয়ে করেছিলাম। হ্যাঁ, আমরা সুখীও হয়েছিলাম।
ফোনটার কথা আমি রাকিবকে বলিনি। হয়তো কেউ আমার সাথে রসিকতা করেছে, বা ভয় দেখাতে চাইছে।
কিন্তু আমার ধারনাকে ভুল প্রমাণিত করে পরের সপ্তাহে একই সময়ে আবারো ফোন আসলো, তারপর আবারো।
‘ চৈতি, তোর বেডরুমের পাশের নিম গাছটা বেশ বড় হয়েছে, দোতালা ছাড়িয়ে তিন তালা ছুঁই ছুঁই। জানিস তো, যেই পেয়ারা গাছটা থেকে তুই আর আমি ছোট বেলায় পেয়ারা পাড়তাম, সেই গাছটা কেটে ফেলেছে করিম চাচা।’
আমি খালি শুনে যাই, কণার মুখে আমার জীবনের গল্প।
‘ রাকিবের বুকে ঘন লোমের আড়ালে একটা তিল আছে না, তুই কি সেটায় হাত বুলাস?’
সেদিন ভর দুপুরে আমি চমকে উঠি সেই অজানা তিলের সন্ধান পেয়ে।
‘ও কি তোকে চুমু খাওয়ার আগে চুইং গাম খেয়ে আসে সিগারেটের গন্ধ লুকাতে? আমি জানি তোর বেশি ভালো লাগে চুলের গোছা সরিয়ে ঘাড়ে চুমু খেলে। ‘
রাকিবকে কিছুই বলা হয় না, শুধু সেই রাতে ঘাড়ের কাছে মুখটা নিতেই দুহাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলি আমি।
‘কি হয়েছে তোমার চৈতি? শরীর খারাপ লাগছে?’ এক রাশ অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে রাকিব, আদুরে আমার এই রূপ সে কখনো দেখেনি। দুহাতের তালুতে আমার মুখটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনে ওর ঠোঁট, আমি ভয়ে কাঁপছি অল্প অল্প,
‘রাকিব, কণাকে কণাকে …… তুমি অনেকবার চুমু খেয়েছ?’
আমার প্রশ্নে থমকে যায় রাকিব, আমার চোখে পানি, ……..আমি শুধু দেখি ওর হতবিহবল মুখ।
‘হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন আজ এতদিন পরে?’
আমাদের মাঝে দূরত্ব ব্যাড়তে থাকে…….রাতে আমার প্রায়ই এখন ঘুম হয় না……সারা সপ্তাহ নিজের অজান্তে শনিবার সকালের ফোনটার অপেক্ষায় থাকি……….. ভীষণ ভয় পাই…….. তবুও অপেক্ষা করি ………
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ট্রেনটা ছুটে চলছে ঢাকার দিকে, জানালায় মাথা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে আমার। গাছপালা, গ্রামগুলো দ্রুত সরে যাচ্ছে। রাকিবকে কিছু বলা হয় নি। আসার সময় একটা চিঠি লিখে রেখে এসেছি বেড সাইড ড্রয়ারে। আমি কণাকে খুঁজতে যাচ্ছি, আমার ছোট বেলার বন্ধু কণা, যার কাছে আমার পাহাড় সম অপরাধ। ও কি আমাকে মাফ করবে না?
ট্রেনের একটানা দুলুনিতে আমার দুচোখের পাতা জড়িয়ে আসছে, আমি কতদিন ঘুমাইনি।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত