গফুর ডোম

গফুর ডোম

গফুর ডোম। এক নামে সবাই চিনে। মর্গের সব লাশের খবর থাকে ওর কাছে। আমি গফুরকে চিনি ছোটবেলা থেকেই। আমাদের পাড়াতেই থাকেন। প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম। এখন আর ভয় পাই না। খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়। দেখে কখনোই স্বাভাবিক মনে হয় না গফুর ডোমকে। এই অস্বাভাবিকতার কারণেই বেশ আলাদা লাগে।

গফুর ডোমের চোখটায় আমি কখনো স্পষ্ট দৃষ্টি দেখিনি। কেমন এক ঘোর লাগা দৃষ্টি থাকে সারাক্ষণ। আমার দিকে তাকালেও যেন আমার দিকে তাকিয়ে নাই- অন্যকিছু দেখে। এমন অদ্ভুত দৃষ্টি আমি আর কারো চোখে দেখিনি। অনেকেই বলে মদ খেয়ে নেশায় ডুবে থাকতে থাকতে এই অবস্থা হয়েছে। মদ খেয়ে যারা মাতাল হয় তারাও এক সময় নেশা কেটে গেলে স্বাভাবিক হয়ে যায়। গফুর ডোমের নেশা যেন কাটছেই না।

এলাকার সবাই গফুর ডোমকে পাগল ভাবে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কি সব বলে। কি কথা বলে জিজ্ঞাস করলেই বলেন, “উনাগো লগে কথা কই। উনাগো অনেক দুখ।” উনারা কারা জানতে চাইলে হাসে। ঘোরলাগা চোখে হাসে। হাসতে হাসতে আবার বিড়বিড় করে। মাঝেমাঝে বুঝা যায় কি বলে। বেশিরভাগ সময়ই বুঝা যায় না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখলে মনেহয় হাত নেড়ে নেড়ে কার সাথে কি জরুরি কথা যেন বলছেন। কিন্তু পাশে কেউ নাই।

আমার সাথে দিন পাঁচেক আগে রাত এগাটার দিকে পলাশদের পুকুরপাড়ে দেখা। পুকুরপাড় ঠিক বলা যাবে না। পুরো পুকুর প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। সামান্য কিছু অংশে পানি দেখা যায়। সেখানে মশার ভনভন শব্দ ছাড়া আর কোন কোলাহল নেই। মোটামুটি নির্জন এই জায়গাটা। আমি সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হালকা সোডিয়াম আলো জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট থেকে। কিছু কিছু ল্যাম্পপোস্টের বাতি নষ্ট হয়ে গেছে। পুরো রাস্তাটায় একটা আলো আঁধারির পরিবেশ। আমায় ডাক দিলেন, “কেডা ওবায়েদ বাবায় নিহি?”

আমি সাইকেল ব্রেক করে নামতে নামতে বললাম, “জি কাকা। কিছু বলবেন?” একটু পাশে সরে বসে বললেন, “বও এইহানে আয়া একটু বও।”

গফুর ডোমের পাশে বসতেই ভুরভুর করে মদের গন্ধ এলো নাকে। হাতে একটা বিড়ি ধরে আছেন। বুঝতে পারলাম না মাতাল হয়েও এই আবছা আলোয় আমায় চিনলেন কি করে। কাঁপা কাঁপা হাতে বিড়ি টানছেন। আজকাল বিড়ি কেউ খুব একটা খায় না। ভিক্ষুকরাও দেখি সিগারেট খায়। শার্টের তিন চারটা বোতাম খোলা। বুকের কাছে চুলকাতে চুলকাতে কাশলেন একটু।

“আইজ বেয়ানে একক্ষাণ লাশ আইছে। আমি পরথমে দেখছি না। আমার পুলাই ছিল তহন। হেয় আমার লগে কাম শিহে।” বলে বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়লেন। গলার কাছে আঙুল ডলে দুই আঙুলের মাথায় ময়লা পাকাতে পাকাতে বললেন, “পুলায় লাশ দেইখা আমারে কইলো লাশের চেহারা ওবায়েদ ভাইয়ের লাহান। আমি দেইখা হাসলাম। দুনিয়ায় একই চেহারার সাতজন আদমি থাহে।”

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মাতাল হয়ে আছে গফুর ডোম। কিন্তু কি স্পষ্ট করেই না এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে ফেললো। শরীর একটু শিউরে উঠলো। আমার মতো দেখতে লাশটা। এক নিমিষে ভাবলাম সেই লাশের জায়গায় আমিও তো কোন কারণে থাকতে পারতাম।

আমার প্রায় কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, “একটু আগে হেই লাশের লগে আমার সামান্য বাতচিত হইছে। আফনে কাইল বেয়ানে যাইবেন নিহি আমার লগে লাশ দেখবার?”

গফুর ডোম পুরো মাতলামির পর্যায়ে আছে বুঝতে পারছি। এই তুমি, এই আপনি বলছেন। লাশের সাথেও নাকি কথা বলেছেন। এই রাতে এক মাতালের সাথে এখানে বসে কথা বলার আর কোন মানে হয় না। টিউশনি করে এই সময় বাসায় গিয়ে রাতের খাবার সেরে ফেলি আমি। পেটের ভিতরে খিদের ছুঁচো নাচিয়ে এক মাতালের সাথে ফ্যান্টাসি আবহে ডুবে যাওয়ার মতো কোন ইচ্ছে আমার নাই।

বসা থেকে উঠতে উঠতে বললাম, “কাকা, কাল সকালে আমার পরীক্ষা আছে।”
“অহ আইচ্ছা। সমুস্যা নাই। আমি লাশরে বুঝাই কমুনে।” বলে আরেকটা বিড়ি ধরালেন। হাতের তালু দিয়ে কানের পিছনে চুল ঘষতে ঘষতে বললেন, “তোমারে লাশের নাম কইছি নিহি?”
“না।”
“হের নাম ওবাইদুল।”
“আমি যাই কাকা।”

সাইকেলে উঠে প্যাডেল দাবাতেই আমার মাথায় সামান্য চক্কর দিয়ে উঠলো। চেহারার মিল, নামের মিল এসব কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু আমার ভিতরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি দানা বাঁধতে লাগলো। গফুর ডোমের কথায় পাত্তা দেওয়ার কিছু নাই। পুরো মাতাল। তার উপরে ওর মাথায়ও সমস্যা আছে। কিন্তু এমনভাবে বলল যে লাশকে বুঝিয়ে বলবে সে; শুনে ভেতরটা কেঁপে উঠেছিলো। সেদিন রাতে বাসায় ফিরে হরহর করে বমি করেছি। কিছু খেতে পারিনি আর রাতে। পরের দিন পরীক্ষাও দিতে পারিনি।

এরপরেও গফুর ডোমের সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। কিছু বলেনি আর। কেবল ঘোরলাগা একটা হাসি দিতো আর চেয়ে থাকতো এক পলকে। মাঝে মাঝে খুব ভয় লাগে এমন দৃষ্টি। সাপের শীতল দৃষ্টির কথা আমি শুনেছি কিন্তু দেখিনি কখনো। গফুর ডোমের দৃষ্টিতে মাঝেমাঝে সেই শীতলতা অনুভব করি আমি।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গফুর ডোম আসলে কোনভাবে আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন। সেদিন আমাকে এভাবে হুট করে লাশ দেখতে মর্গে যাওয়ার কথাটা এমনি হয়তো তুলেননি। ব্যাপারটা আমার মাথা থেকেও যাচ্ছে না। ইদানীং হঠাৎ কেন জানি মর্গে যেখানে লাশ রাখা হয় সেখানে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। গফুর ডোম খুব সূক্ষ্ম ভাবে আমার মনে কিছু একটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর সেটা আমি এড়িয়ে যেতে পারছি না। কিন্তু সূক্ষ্ম ব্যাপারটা কি তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।

সামনে আমার অনার্স ফাইনাল। পড়াশোনার চাপও বেড়েছে। টিউশনি তিনটা থেকে দুইটা ছেড়ে দিয়েছি। এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে পড়াশোনায় মনও বসছিলো না। আমি সব কিছুতে স্বচ্ছতা পছন্দ করি। কোন আড়াল আবডাল আমার কখনোই ভাল লাগে না। সাইকেল নিয়ে রাত আটটার দিকে গফুর ডোমের বাসায় চলে গেলাম। বাসায় উনার স্ত্রী আর দুই মেয়ে ছিলো শুধু। বাবা ছেলে তখনো মর্গে থেকে ফেরেনি। উনার স্ত্রী জানতে চাইলেন কি দরকার। উনাকে কিছু বলতে হবে কিনা। উনি চা খেয়ে যেতে বললেন। বড় মেয়েটা ওড়নার বদলে গামছা জড়িয়ে রেখেছে। আমার পিছন ঘুরে গামছা দিয়ে ছোট একটা টুল মুছে এগিয়ে দিলো বসার জন্য। আমি আর বসিনি। এমনি এসেছি বলেই চলে এলাম।

পরদিন দুপুরে ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় গলির কাছে দেখলাম গফুর ডোমের ছেলে ইয়াসিন দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে এগিয়ে এলো।

“আব্বায় আফনেরে একবার যাইতে কইছে। কাইল আব্বারে বিছরাইতে গেছিলেন।”
“কখন যেতে বলছেন?”
“আয়েন রাইত নয়টায় কইরা। বেয়ানেরথুন কাম বেশি আইজকা। চাইরটা লাশ আইছে। নয়টায় আইলে আব্বারে পাইবেন।”
“আচ্ছা দেখি।”

চলে গেলো ইয়াসিন। ওর চোখেও কেমন একটা ঝাপসা দৃষ্টি। আমাদের দেশে মর্গের ডোমদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা নাই। অন্য কোন দেশে আছে কিনা জানিনা। বংশপরম্পরায় এই পেশায় আসে ওরা। গফুর ডোমের বাবাও ডোম ছিলেন। মদ, গাজা, সিগারেট খাওয়াটা এদের কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে যায়। মদ না খেলে নাকি লাশের গন্ধ নাক থেকে যায় না।

রাত নয়টায় গেলাম গফুর ডোমের বাসায়। একতলা এই বাসায় চারিদিকে সিমেন্টের দেয়াল। উপরে টিন। আশেপাশে তেমন বাসা বাড়ি নেই। সাইকেল থেকে নামতেই দেখি গফুর ডোম উঠানের সামনে মোড়া পেতে বসে বিড়ি ফুঁকছেন। আমাকে দেখে বললেন, “আয়েন বয়েন। এইহানে বয়েন।”

ওনার পাশে একটা লম্বা টুলে বসলাম। গফুর ডোমের মুখে সাদা খোচাখোচা দাড়ি। বেশ ঘন গোফ। মাথার চুলও প্রায় সব পেকে গেছে। বাইরে একশো পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। কাচা পাকা ভ্রুর নিচে উনার চোখ দুটো কেমন যেন জ্বলছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। একটু দূরেই রান্নাঘর। উনার স্ত্রী রান্না করছেন। এখান থেকেই ভাত ফুটার গন্ধ পাচ্ছি লাকড়ির চুলার ধোঁয়ার সাথে। বড় মেয়ে শাক কুটছে। ছোট মেয়েটা ভিতরের রুমে জোরে জোরে পড়ছে সিরাজ উদ দৌলার পলাশির ইতিহাস।

সেই ছোটবেলা থেকে এই একই রকম দেখে আসছি গফুর ডোমকে। উনার বয়স যেন বাড়ছেও না। কমছেও না। একটা ঘরে এসে আটকে গেছে। এখনো বেশ শক্তসামর্থ্য। হাতের কব্জি বেশ চওয়া। বাহুর পেশিও বেশ মজবুত। মদ খাওয়া এমন পেটা শরীরের মানুষ আমি আর আগে কখনো দেখিনি। উনাকে দেখলে বয়সটা ঠিক আঁচ করা যায় না।

আমার হাটুতে একটু ধাক্কা দিয়ে বললেন, “বুঝলেননি বাবা, এই দুনিয়ায় কিছু আদমি তিনটা জেবন নিয়া আহে। এক্ষান এই আমাগো মতো চলে ফিরে। আরেক্ষান হইলো কবরের ভিতরে শুইয়া। এর মইধ্যে আফনের কিছু আদমি আহে আরেকটা জেবন নিয়া। এই দুই জেবনের মইধ্যেখানে।”

বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে দেখি পা থেকে স্পঞ্জ স্যান্ডেল খুলে হাতে নিলেন। সামনের বটুটা খুলে গেছে। বটুতে একটা ছোট পেরেক ঢুকিয়ে বটুর কাজ সারা হচ্ছে। পেরেক সরে যাওয়ায় বটুটা খুলে আসছে। ঠিকঠাক করে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “কি জানি কইতে লাগছিলাম। অহ জেবন। তিন লম্বর জেবন। হেইডা হইলো মর্গের জেবন। আমি হইলাম আফনের হেই জেবনের মালি। বাগানের মালির কাম আফনে দেখছেন নিহি। ফুল গাছের যেমুন যত্নআত্তি লয় আমিও ঐরহম। তয় মর্গের যত্নআত্তি আলাদা।”

আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো। কথার রেশটা কেমন ভাবে এগিয়ে নিতে হবে তাও ঠিক করতে পারছি না। এমন সময় দেখলাম গফুর ডোমের স্ত্রী মেয়েকে কি যেন বললেন। মেয়েটা শাক রেখে ঘরের ভিতরে চলে গেল। রান্নাঘর থেকে এদিকে ধোঁয়া আসছে অনেকটা। চোখ জালা করছে সামান্য। মেয়েটাকে আজো দেখলাম সেদিনের মতো গায়ে গামছা জড়িয়ে আছে। একটু পরেই একটা ট্রে হাতে ফিরে এসে রান্না ঘরে ঢুকলো।

গফুর ডোম বলেই চললেন, “মর্গের জেবন কেমুন এইডা আফনেরা জানেন না। জানবারও পারবেন না। দুনিয়ায় সব কিছু সবতে জানবার পারে না বইলাই খোদার কারিশমা খোদায় দেখাইতাছে।” আমি বসে বসে কথা শুনছি কেবল। গফুর ডোম খুব আয়েশ করে গল্প করার ভঙ্গিতে বসলো। দেখলাম বড় মেয়েটা ট্রে হাতে এদিকে আসছে।

টুলের উপর নাস্তার ট্রেটা রাখার সময় আড়চোখে মেয়েটা তাকালো আমার দিকে। শ্যামলা মেয়ে। চুলে তেল দিয়ে বিনি করা। গলায় কি চাবিজ বাঁধা নাকি মাদুলি বোঝা গেলো না। মিষ্টি করে হেসে চলে গেলো। চলে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম, মেয়েটা বাসার ভিতরে গিয়ে শুধু ট্রে আনেনি গামছা বদলে ওড়নাও পরে এসেছে। গফুর ডোম আমায় নাস্তার দিকে ইশারা করে খেতে বললেন। এক কাপ চা, দুইটা প্রিজে চানাচুর আর বিস্কিট। আর এক গ্লাস পানি। চায়ের কাপের হাতল একটু ভেঙে গেছে। চানাচুর নিয়ে মুখে দিলাম।

গফুর ডোম বুকের কাছে চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “আফনেরে কেন হেইদিন লাশ দেখবার যাইবার কইছিলাম জানেন নিহি?”
“জি না।”
“আফনে না যায়া ভালা কাম করছেন। বেদ্দপ একটা লাশ। কতডি মিছা কথা কইছে আমারে। আমি তো সহজ সরল আদমি বাবা। এতোকিছু বুঝবার পারছি না। যাউজ্ঞা, আফনে ক্যান আমারে কাইল বিছরাইতে আইছিলেন হেইডা কন?”

গফুর ডোমের কথা শুনে আমি বুঝে উঠতে পারছিনা আমি কি এখানে বসে থাকবো নাকি চলে যাবো। একজন মানুষ যখন মারা যায় তার সম্পর্কে আমরা কখনো খারাপ কিছু বলি না। গফুর ডোম কি সব যাতা বলে যাচ্ছে একটা লাশ সম্পর্কে। মনে হচ্ছে ভুল করেছিলাম গতকাল যেচে দেখা করতে এসে। বললাম, “এমনি আসছিলাম।”

“চা খান বাবা। ঠাণ্ডা হইয়্যা যাইবে।” বলে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, “আমার গিন্নি চা ভালো বানাইবার পারে না। চোখ মুখ খিচা খায়া ফালান। নাইলে উনার মনে কষ্ট পাইবে।”

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বুঝতে পারলাম আসলেই ভাল চা বানাতে পারেন না। চায়ের রং ভাল আসেনি। যদিও এই আলোতে এতোটা বোঝার কথা না। কিন্তু সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। চায়ের গন্ধটাও কেমন যেন। চায়ের একটা চনমনে গন্ধ থাকে। সেটা নেই।

গফুর ডোমের এই বাসাটা শহরের একেবারে এক পাশে বলা যায়। এটা পরিত্যক্ত বাসা। আগে গফুর ডোমের বাসা ছিলো কোয়াটারের পাশে। সেখানে এক রুমের বাসায় পরিবার নিয়ে থাকার সমস্যা হয় বলে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এই পরিত্যক্ত বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ইলেক্ট্রিসিটি আছে। কিন্তু গ্যাস লাইনের সুবিধা পায়নি। বাসার সামনেই একটা টিনের শেড দিয়ে রান্না ঘর বানানো হয়েছে। দুইদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া। এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি চুলার পাশ থেকে গফুর ডোমের স্ত্রী আমার দিকে চেয়ে আছেন। কেমন নির্লিপ্ত চাহনি। আগুনের শিখার প্রতিফলন পড়ছে উনার ঘর্মাক্ত মুখে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।

অসম্ভব ভালো চা। হলফ করে বলতে পারি এমন চা আমি অন্য কোথাও খাইনি। সাথে সাথে আরেকটা চুমুক দিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি উনি তাকিয়ে আমার চা খাওয়া দেখছেন। সেখান থেকেই উঁচু স্বরে বললেন, “বাবা, চায়ে চিনি ঠিক হইছেনি?”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঠোঁট হালকা চেটে বললাম, “হ্যাঁ কাকী ঠিক আছে। অনেক মজা করে চা বানান আপনি।” দেখলাম উনি আলতো করে হেসে চুলায় লাকড়ি ঠেসে দিলেন।

গফুর ডোম আবার আমার হাটুতে ধাক্কা দিয়ে বললেন, “বুঝলেননি বাবা। এই চা আমি খাইলে মনে হয় গরুর মুত খাইতাছি। সবাই কয় মজার চা। কিন্তু এই চা মজা হওনের রহইস্য আছে একটা। ঐ রহইস্য আফনেরে কওন যাইবে না। ঐ জন্যই এই চা আমার কাছে গরুর মুতের লাহান লাগে।” বলে একটা চাপা হাসি হাসলেন। যেন অনেক বড় একটা রসিকতা করলেন।

“চা তো অনেক মজা হইছে কাকা।”

গফুর ডোম আবারো হাসলেন। তিনি যে মাতাল হয়ে আছেন টের পাচ্ছি। সেই ঘোর লাগা হাসি। আরেকটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে কিছুক্ষণ কাশলেন। কাশি থামতেই বললেন, “লাশটা বেদ্দপ হইলেও। অনেক কথা আমারে সইত্য কইয়্যা গেছে। আফনে যে আমার কাছে আইবেন হেয় আমারে কইয়্যা গেছে। কেন আইবেন তাও কইয়্যা গেছে।”

“কেন আসবো। কি বলেছে?” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম গফুর ডোমের দিকে।

আমার পায়ের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে শার্টের ফাঁকে হাত দিয়ে বুকে চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “কইছে আফনে লাশের ঘর দেখবার চান বইল্যা আমার কাছে আইবেন। হেয় আপনারে দেখবার চাইছিলো একবার।”

আমি ভিতরে একটা ঝাঁকি খেলাম। এটা কি কাকতালীয় ব্যাপার নাকি গফুর ডোম অন্ধকারে ঢিল ছুড়লো আর সেটা লেগে গেলো বুঝতে পারলাম না। নাকি আমি দেখা করতে এসেছি বলেই গফুর ডোম দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বলল আমি মর্গ দেখতে চাই। একটা লাশ গফুর ডোমকে এসব বলবে এই গাঁজাখুরি কথা বিশ্বাস করার কিছু নাই। কিন্তু আমি দেখতে চাই গফুর ডোম আমায় কোন পথে হাঁটায়। আমিও ওর পথে হাঁটা শুরু করলাম।

“কেন দেখা করতে চাইছিলো?”

আমার প্রায় কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, “হেয় আফনের ভাই হয়। আফনেরে কিছু কথা কইতে চাইছিলো।”
“মানে? কি বলছেন এসব।”

আগের মতোই ফিসফিস করে বললেন, “আমি তো কিছু কই নাই বাবা। হেয় কইছে। আমি তো হইলাম লাশ কাটা ঘরের সামান্য মালি। আপনাগো গোলাম।”

“সে আমার ভাই হয় কি করে?” জিজ্ঞাস করতেই আমায় হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। চোখ নেড়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যেন আস্তে কথা বলি। উনার মেয়ে বা স্ত্রী কেউ যেন না শুনে এই কথা গুলো।

গফুর ডোম উঠে দাঁড়ালেন। বিড়িটা ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে এক চোখ বুঝে আমার দিকে তাকিয়ে লুঙ্গির গিট হালকা করে আবার ভাল করে বেঁধে নিলেন। বললেন, “আফনে একটু বয়েন আইতাছি।”

গফুর ডোম বাসার ভিতরে ঢুকতেই ছোট মেয়েটা আরো গলা চড়িয়ে পড়া শুরু করলো। মেয়েটা এখনো পলাশীর যুদ্ধের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। একই লাইন বেশ কয়েকবার পড়ে পড়ে যুদ্ধের ভিতরে প্রবেশ করছে। সেই কবে পলাশীর যুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আজো সেই ইতিহাস টেবিলে বসে দুলে দুলে এক কিশোরী জোরে জোরে পড়ে যাচ্ছে। কোথায় মীর জাফর, কোথায় সিরাজ উদ দৌলা। আর কোথায় বা ঘষেটি বেগম। অথচ তাদের এই ইতিহাস না পড়লে পরীক্ষার খাতায় দুই একটা প্রশ্ন কমন পড়বে না।

রান্না ঘর থেকে বড় মেয়েটা এসে ট্রেতে চায়ের কাপ আর বিস্কিটের প্রিজ তুলে নিলো। আর চানাচুর দিবে কিনা জিজ্ঞাস করলো। বললাম লাগবে না। সে চলে গেলো চায়ের কাপ আর বিস্কিটের প্রিজ নিয়ে। একটু পরে দেখি আরেকটা প্রিজে করে আরো চানাচুর নিয়ে এসেছে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “এই চানাচুর অনেক মজা। আফনে আরেকদিন আয়েন আফনেরে ঝাল চানাচুর বানাই খাওয়ামুনে।”

এই মেয়ে দেখি খুবই মিশুক। এই বাড়িতে আমার এই নিয়ে সাত আটবার হয়তো আসা হয়েছে। তাও কোরবানি ঈদে গোস্ত নিয়ে এসেছি। কারো সাথে তেমন একটা কথা কখনোই হয়নি। ইয়াসিন অনেক জুনিয়র আমার। এলাকাতে দেখি কেবল ঐ পর্যন্তই। কিন্তু মেয়েটা এমন আন্তরিকতা নিয়ে কথা বলছে ভালোই লেগেছে এই আতিথেয়তা। বললাম, “আচ্ছা আসবো।”

মেয়েটা আবার সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে যেতেই গফুর ডোম এলো একটা কাগজ হাতে নিয়ে। লুঙ্গিটা হাটুর উপরে তুলে নিয়ে বসলো। কাগজটার দিকে এক নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “আফনের মায়ের নাম কি রিজিয়া? রিজিয়া পারভিন?”
“জি!”
“আফনের মায়ের বাড়ি কি নড়াইলে?”
“জি!”
“এইডা থোন আফনের কাছে।”

কাগজটা আমায় দিলেন। তিন লাইনে একটা ঠিকানা লেখা। উল্টেপাল্টে দেখলাম আর কিছু লিখা নাই। এখানে কোথাও আমার মায়ের নাম বা নানাবাড়ি কোথায় সেসব কিছুই লিখা নাই।

“চলেন আফনেরে একটু আউগাই দিয়া আহি।” বলেই উঠে দাঁড়ালেন গফুর ডোম। আসার সময় উনার স্ত্রী বললেন রাতে খেয়ে যেতে। আমি আবার পরে কোনদিন আসবো বলে সাইকেল নিয়ে গফুর ডোমের সাথে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম।

হাঁটতে হাঁটতে গফুর ডোমের বাসা থেকে কিছুটা দূরে চলে এলাম। একটা বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বেশ আগে। এক পাশে পিলার পরে আছে। সেখানে বসে গফুর ডোম আমাকেও পাশে বসতে বললেন। এই জায়গাটা অনেক নির্জন। মানুষ জন খুব একটা কেউ আসে না। কাছের বাড়িটাও বেশ দূরে। শেষ ল্যাম্পপোস্টটার আলো কিছুটা এসে রাস্তাটার চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে কেবল। প্রচুর জোনাকিপোকা। আজ বাতাসটা দারুণ চনমনে।

“বাবা ওবায়েদ, এই দুনিয়ায় আদমি যা দেহে তার থেইকাও অনেক বেশি কিছু ঘটে। যা যা ঘটে তা যদি দেখোন যাইতো তাইলে পরে দুনিয়ায় রহইস্য বইল্যা আর কিছুই থাকতো না। এই যে তুমি আমি এইহানে বইয়্যা আছি। আর কিছু কি দেহো! দেহো না। সবাই সব কিছু দেহে নে। ঐ যে কুত্তাডা দেহ, এইদিকে এহন আইবো না। ঐহানে খাড়ায়া থাকবো। ঘেউঘেউও করতো না। ওয় দেখতাছে এইহানে আরো কিছু আছে।”

আমার শরীরটা শিরশির করে উঠলো কথাটা শুনে। যেখানে বসে আছি তার পিছনে ভাঙা বাড়ি। বাড়ির ওখানটায় অনেক ঝোপঝাড়। সেই ঝোপ পুরোটাই জোনাকিপোকার দখলে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কেমন একটা গা ছমছম আবছা আলো আঁধারি পরিবেশ। বাতাসটাও খুব ঠাণ্ডা লাগছে।

লুঙ্গি হাটুর উপরে তুলে গফুর ডোম বললেন, “আফনে তো সিগারেট খান দেখছি। ধরান আমি কিছু মনে নিতাম না। পুরুষ আদমি বয়স হইলে সবই খাইবার পারে।”

আমি দূরের কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছি। সে সত্যি আর এক পাও সামনে আসছে না। একই ভাবে তাকিয়ে আছে এই দিকে। যেন ইশারা পেলেই ছুটে আসবে। সিগারেট ধরালাম। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক চারিদিকে। কে বলবে এটা শহরের একটা অংশ। মনে হচ্ছে কোন এক মফস্বলে চলে এসেছি। মনটা এদিকওদিক ঘোরাতে চাইছি কিন্তু মনটা অস্বস্তিতে আটকে আছে।

গফুর ডোম আমার বাহুতে একটু ধাক্কা দিলে বললেন, “মর্গের জেবন আফনের মর্গ থেইকা কবর পর্যইন্ত। কবরে শোয়াই দিলে তার লগে আমার আর কোন বাতচিত হয় না। আইজ বেয়ানে চাইরটা লাশ আইছে। হেগোরে কাটাকাটি কইরা থুইয়্যা আইছি। হেরা এহন আমার লগে।”

“কি বলেন কাকা এসব?” শুনেই আমার কেমন যেন খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। চায়ের ঢেকুর উঠলো পেট গুলিয়ে।

“ডরাইছেন নিহি বাবা। ডরের কিছু নাই। হেরা কারো কোন ক্ষতি করতো না। আফনেরে হেরা দেখতাছে। আফনের কথাও হুনতাছে। কিন্তু আফনে হেগোরে দেখছেন না। হেরা আইছে হেগো কেইস নিয়া বাতচিত করবার। আফনের কেইস আফনেরে বুঝাই দিয়া হেগো কেইস নিয়া কথা কমু।”
“আমার কেইস মানে?”

গফুর ডোম আমার বুক পকেটে রাখা কাগজটার দিকে আঙ্গুলের ইশারা করে বললেন, “যেই ঠিহানা দিছি এইডা আফনের আসল মায়ের ঠিহানা। আফনের ভাই আমারে কইছে আফনেরে দিবার জন্যি। হের লগে আমার বাতচিত বেশি অয় নাই। হেরে গত পরশু দাফন কইরা ফালাইছে। যোগাযোগ আর হইতো না। হের দাফনের সময়ও হের লহে সামান্য বাতচিত হইছে। হেয় খালি কইছে আফনে যেন আফনের মায়েরে গিয়া একবার দেইখা আহেন।”

“কাকা আমি কিছু বুঝতেছি না আপনি কি বলছেন?”

“বাবা, মর্গে যত্তোডি লাশ আহে সবডির লগে আমার বাতচিত অয়। হেগোর দুনিয়া থাইক্কা জান চইল্লা যাওনের পরে হেরা সব জায়গায় যাইতে পারে। আফনের ভাইও সারাজীবন আফনেগোরে বিছরাইছে। পায় নাই। মর্গে আইছে বইল্যা বিছরাই পাইছে। আফনের আব্বায়রে ওবাইদুল ঘেন্না করে হের লাইগা হেরে বিছরায় নাই। আফনের হের জমজ ভাই। আফনেরে অইত্যাধিক ভালবাসা তাই আফনেরে ডাকছিলো।”

কুকুরটা একটা ছোট বৃত্ত করে ঘুরছে। থেমে থেমে একবার এদিকে তাকিয়ে আবারো ঘুরছে। মাথার ঝিমঝিমানি বাড়ছে। গলা শুকিয়ে আসছে আমার। বাসা থেকে ফোন এলো এমন সময়। বললাম আমার ফিরতে দেরি হবে। বেশি দেরি হলে যেন চিন্তা না করে। বন্ধুর বাসায় থেকে যাবো।

“বাবা, আফনে মর্গ দেখতে চাইছেন না। যাবেন নিহি? আমি অহন মর্গে যামু। আমার পোলায় আছে ঐহানে। আমি গেলে হেয় বাড়ি আইবো। রাইতে যাওনের নিয়ম নাই। পুলারে কাম শিখোন লাগতাছে হের জন্যি ডাক্তোররে কইয়্যা ইস্পিশাল ব্যাবুস্থা লইছি। আর ছয় সাত মাসেই পুলাডার হাত চইল্যা আইবো।”

আমার পা কেমন যেন টলছে। কিন্তু আমি সব আড়াল আবডাল শেষ করতে চাই আজই। গফুর ডোম বানিয়ে বানিয়ে আমার কাছে গল্প ফেঁদেছে। এছাড়া আর কিছুই না। আমরা একই এলাকায় থাকি। আমার মায়ের নাম জানাটা এমন কিছু কঠিন না। আমি রাজি হলাম মর্গে যেতে। আমরা হাঁটা শুরু করলাম।

আমি শুনেছি ডোমরা লাশের আত্মীয়দের কাছ থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নেয় নানানভাবে। গফুর ডোমও কি এমন কোন মতলব করছে কিনা বুঝতে পারছি না। গফুর ডোম একটা লাশকে আমার ভাই বলে দাবী করলেই আমার ভাই হয়ে যাবে না। কিন্তু আমাদের এলাকায় গফুর ডোম কারো সাথে এমন করেছে কিনা কখনো শুনিনি। আমি হিসাব মিলাতে পারছি না গফুর ডোম আমাকে কেন এসব বলতে আসবে।

“আফনেরা যান। আমি আফনেগো ওনায় আইতাছি।” বলে আমার দিকে ফিরে ঘোর লাগা হাসি দিয়ে বলল, “বাবা, আফনেরে কই নাই। লাশ চাইরটার আত্মারে লাশের কাছে যাইতে কইছি।”

আমরা কিছুদূর যেতেই দেখি কুকুরটা আমাদের পিছু নিয়েছে। একটু পর পর দৌড়ে সামনে গিয়ে ঘেউঘেউ করে আবার আমাদের সাথে এসে হাঁটে। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরা অনেক কিছুই টের পায়। কুকুরটাও কি কিছু টের পাচ্ছে।

মর্গে কাছাকাছি পৌঁছাতেই কুকুরটা আর এলো না। এক জায়গায় টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে কেবল লেজ নাড়লো। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দশটা পনেরো মিনিট। সারা রাস্তায় গফুর ডোমের সাথে আর কথা হয়নি। চুপচাপ থেকে বুঝার চেষ্টা করছিলাম এতক্ষণ যা বলল সেই কথা গুলো। গাঁজাখুরি কথা ছাড়া আর কিছুই না ওসব। মর্গের সামনে যেতেই কেমন গা ছমছম করে উঠলো। এক পাশে অনেক গুলো কাপড় ঝুলে আছে। গফুর ডোম বলল, “এইডি হইলো লাশের কাপড়চোপড়। কারো লাশ চেনা না গেলে আত্মীয় স্বজনরা আইস্যা কাপড়চোপড় দেইখা লাশ হের পরিচিত কিনা বুইঝা যায়। সব লাশের লগে টেগ থাহে। টেগ দেইখা আমরা লাশ দিয়া দেই।”

থমথমে পরিবেশ। কেমন একটা পেট মোচড় দেওয়া গন্ধ। গফুর ডোম কোমরে হাত দিয়ে চাবি নিয়ে মর্গের দরজা খুললো। সাথে সাথে একটা বিদঘুটে গন্ধে আমার পাকস্থলী উলটে আসতে চাইলো। ফর্মালিনের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করে উঠলো। দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পুরানো প্লাস্টার। চারিদিকে কেমন স্যাঁতস্যাঁতে গুমট ভাব। একশো পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলছে। লাইটের নিচে টেবিলে একটা লাশ। নিচে দুইটা লাশ চাটাই দিয়ে মোড়ানো। হঠাৎ খেয়াল হলো এক পাশে কে যেন বসে আছে। চোখ জ্বল জ্বল করছে। আমার বুক ধ্বক করে উঠলো। যে বসে আছে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। চিনতে পারলাম- ইয়াসিন। গফুর ডোমের ছেলে।

“যা বাড়িত যা।” বলে ছেলে বের করে দিলো। ইয়াসিনের চোখে মুখে কেমন এক আতঙ্ক। স্বাভাবিক নয় সে। কেমন যেন ফেকাসে হয়ে আছে ওর চোখ মুখ। বয়সে আমার চেয়েও পাঁচ ছয় বছরের ছোট। এই ছেলে একা একা মর্গের ভিতরে তিনটা লাশের মাঝে বসে ছিল। ভাবতেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল অনুভূতি বয়ে গেলো।

“পোলারে কাম শিখাইতাছি বাবা। লাশের লগে যদি সম্পক্ক না হয় তাইলে তো এই লাইনে ভাত জুটাইতে পারবো না। হেরে মাঝে মইধ্যে কয়েক ঘন্টা লাশের লগে রাখি। আস্তে আস্তে ডাইলভাত হই যাইবো। ডাক্তররা তো লাশ কাটবো না। কাটোন লাগে আমাগো। তরকারি কুটার চাইতে লাশ কাটা সহজ। আমার বাপে আমারে লাশের লগে কথা কওনের গায়েবী বিদ্যা শিহাইছে। খালি মরা মুরগির মতো লাশ কাটলে তো হইবো না। অনেক সাধনা লাগে। সম্পক্ক করা লাগে লাশের লগে। হেরপরেই না লাশ কথা কইবো।”

টেবলে রাখা লাশটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। পা বাইরে বের হয়ে আছে। লাশের মাথার দিকে চোখ পড়তেই দেখি লম্বা চুল নিচে ঝুলে আছে। একটা মেয়ের লাশ এভাবে মর্গে পরে আছে ভাবতেই কেমন যেমন করে উঠলো বুকটা। আমি শার্টের আস্তিন নাকে চেপে আছি। রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লাশের কাপড়ের উপর। মেয়েটার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আফনের ভাইও এইহানে আছিলো। মইরা গেছে ভালা হইছে। কেমনে মরছে জানেন নিহি?”
“না।”
“ছিনতাইকারীরা মারছে। টেকা চাইছিল দেয় নাই। চোখ মলম দিয়া গলায় ছুড়ি দিয়া পোচ দিয়া জবাই কইরা ফালাইছিলো। আমারে কইছে কোন এলাকার ছিনতাইকারী হেরা। কিন্তু হেগোরে আফনের ভাই মাফ কইরা দিছে। কেন করছে আমি কইতে পারুম না। হেয় কইছে হের মরার কথা যেন আফনেগো মায়ের কাছে না যায়। বেওয়ারিশ লাশ কইয়া দাফন হইয়্যা গেছে।”
“বার বার আমার ভাই বলছেন কেন কাকা?”

গফুর ডোম মেয়েটার মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরালো। লাশের মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল, “আমার বড় মাইয়্যার সমান বয়েস হইবো এই মাইয়্যার। দুনিয়ার কিছুই দেখছে না। ঐ যে আপনের পাশে খাড়ায়া কানতাছে অহনো।”

আমি পাশ ফিরে এদিকওদিক চাইলাম। কেউ নাই। আমি মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবো। নিচের লাশ দুইটা মনে হচ্ছে নড়াচড়া করছে। আমার কি ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হচ্ছে নাকি আসলেই নড়ছে বুঝে উঠতে পারছি না। একটু পরে বুঝতে পারলাম একশো পাওয়ারে যে বাল্ব ঝুলছে সেটা মৃদু দোল খাচ্ছে। আমি মেয়েটার লাশের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের উপরের পাতায় এখনো গাঢ় কাজল আছে। দেখে মনে হচ্ছে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। এখনই যেনো জেগে উঠবে। কি শান্ত আর নিষ্পাপ লাগছে মুখটা। যখনি খেয়াল হয় মেয়েটা একটা লাশ তখনি আবার কেমন যেন ভয় ভয় করে উঠে। দুলছি আমি একবার বাস্তবতায় একবার ঘোরে।

“মেয়েটা মারা গেলো কি করে?”
“মারা যায় নাই। মাইরা ফালাইছে। মারা গেলে এই মর্গের জেবনে আইতো না। মাইরা ফালাইছে বইলাই আইছে। কে মারছে। কেমনে মারছে সবই আমারে কইছে। কিন্তু কাউরে কওন যাইবো না। বড় দুঃখী মাইয়্যা। হেই বেয়ান বেলা থোন কানতাছে। অহনো কান্দোন থামে না। বারবার হেরে কবরে থুইয়্যা আইতে কইতাছে। মর্গের জেবন অনেক কঠিন বাবা। অনেক যন্ত্রণা।”

আমি কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম মেয়েটার। শ্যামলা গায়ের রঙ। ফ্যাকাসে হয়ে আছে ঠোঁট। গফুর ডোম ঢেকে দিলো মুখটা। এই মেয়েটা যখন চোখে কাজল দিচ্ছিলো তখনো কি সে ভাবতে পেরেছিলো ঐ কাজল মুছে যাওয়ার আগেই সে মর্গে এসে শুয়ে থাকবে! কাজল দেওয়ার সময় নিশ্চয় গুনগুন করে গানও গেয়েছিলো। অথচ এখন। আর কখনোই ঐ কাজল আঁকা চোখ দুটোর পাতা মেলে সে আর তাকাবে না। কে জানে কেউ একজন হয়তো মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলো। সেই জন কি মেয়েটার এই কাজল কালো চোখ দু’টো এখনো খুঁজে যাচ্ছে! সেকি জানে আর খুঁজে পাবে না। জীবনটা কেমন! এই আছি তো এই নাই।

“তোমার বাবার একজন মাইয়্যামানুষ আছিলো। বিয়ার পরেও হেই মাইয়্যার কাছে যাইতো। নিয়তির কিছু বিধান থাকে বাবা। আমরা কই উপর ওয়ালার লিলা খেলা। একই সময়ে হেই মাইয়্যা আর তোমার মায় পোয়াতি হইলো। তোমার বাপে হেই মাইয়্যারে আলাদা বাসায় রাখতো। খরচাপাতি দিতো। হেই মাইয়্যা জানতো তোমার বাবায় বিয়া করছে। কিন্তু বড় দুখী। যাওয়ার যায়গা আছাল না। এহন সৎ ভাইয়ের লগে থাহে।”

গফুর ডোম মেঝেতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো লুঙ্গিটা হাটুর উপরে তুলে। “একই হাসপাতালে ভর্তি হইলো হেই মাইয়্যা আর তোমার মায়। উপর ওয়ালার লিলা খেলা দেহো বাবা। এক ঘন্টা মইধ্যে দুই জনের বাইচ্চা হইলো। তোমার মায়ের হইল একটা মরা বাইচ্চা। আর হেই মাইয়্যার হইলো জমজ পোলা।”

আমার মনে হচ্ছে বস্তা পচা সস্তা কোন গল্প উপন্যাস শুনছি। একটা লাশ এতকিছু বলে গেলো গফুর ডোমকে! এটা বিশ্বাস করার মতো বোকা আমি নই। আমার শুনে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই। আমার গা ছমছম করছে মর্গের পরিবেশে। চারিদিকে কেমন এক নিস্তব্ধতা। এই লাশ কাটা ঘরে কত হাজার হাজার লাশ এসেছে। তাদের আত্মা হয়তো চারদেয়ালে গুমরে গুমরে কেঁদেছে। ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে কেমন একটা অনুভব বয়ে যায়। এখনো কি আত্মারা আমার আশেপাশে আছে। আমায় কি কিছু বলছে ওরা!

রক্তের পচা পচা গন্ধ পুরো ঘরে। বাল্বের লালচে আলোয় টেবলের উপরে মেয়েটার লাশ। মেঝেতে চাটাই মোড়া লাশ গুলো থেকে কেমন যেন একটা অস্বস্তি আমায় ঘিরে ধরছে। আমি না পারছি এখানে থাকতে না পারছি বের হয়ে যেতে। তিনটা লাশের আত্মা মনে হচ্ছে চেয়ে আছে আমার দিকে। একটু ভাল করে কান পাতলেই যেন শুনতে পাবো লাশের ফিসফিস কথা।

ইশারা করে বাইরে যাওয়ার কথা বললো গফুর ডোম। আমার পা মনে হয় কোন এক অদৃশ্য শিকলে আঁটকে আছে। নড়ার শক্তি পাচ্ছি না। চোখ বারবার লাশের দিকে চলে যাচ্ছে। কত হাজার হাজার লাশের শরীর ছিন্নভিন্ন করে কাটা হয়েছে এই লাশ কাটা ঘরে। পাশে হাতুরি বাটাল। শুনেছি মানুষের মগজ বের করার সময় ডোমরা আগে মাথার চামড়া কেটে ছিলে নেয়। চামড়া ছিলার সাথে সাথে মাথার করোটি বের হয়ে আসে। এরপর বাটাল হাতুড়ি দিয়ে করোটিতে আঘাত করলেই সেটা খুলে যায়। বের করে আনে মগজ। পাশের টেবিলের ঐ হাতুড়ি বাটাল কত কত মানুষের মাথার খুলি ভেঙ্গেছে ভাবতেই শিউরে উঠছি।

মর্গের ভিতরে পচা গন্ধই কেমন এক নেশায় আমায় সম্মোহিত করে রেখেছে। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে রক্তের কয়েক ফোটা কালচে দাগ। আমার পা যেন বেঁধে ফেলেছে। গফুর ডোম আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, “যান বাবা বাইরে যান। লাশের আত্মা গুলান আফনেরে কব্জা করতে চাইতাছে। যান বাইরে যান।”

আমার মাথার ভিতরে চেতনা অবচেতনা দুলছে। আমাকে কেন কব্জা করতে চাইবে ওরা। কি করে যে মর্গের বাইরে এসে দাঁড়ালাম জানিনা। আমার পা যেন শূন্যে ভাসছে। মর্গের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই গফুর ডোম ভিতর থেকে উচ্চস্বরে বললেন, “ডরাইয়েন না বাবা। আমি লাশ গুলান ফিরিজে উডাই আইতাছি।”

গফুর ডোমের এই কথায় আরো ভয় পেয়ে গেলাম। কেমন এক ঘন অন্ধকার বাইরে। বাল্বের মৃদু আলো যেন অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে দিয়েছে। আমার পেটের ভিতরে নাড়িভুঁড়ি গুলো কেমন গুলাচ্ছে। গফুর ডোম চাটাই মোড়ানো লাশ গুলো কি ওভাবেই ফ্রিজে ঢুকাবে কিনা জানি না। আর একা কি করে করবে ফ্রিজে ঢুকানোর কাজ। ভিতরে গিয়ে দেখার সাহস নেই আমার। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় হচ্ছে। লাশকাটা ঘর থেকে পচা গন্ধ আসছে। চাটাইয়ে মোড়া লাশ গুলো কি পচে যাচ্ছে নাকি পচা রক্তের গন্ধ বাতাসে ভাসছে বুঝতে পারছি না। ভিতরে গফুর ডোম খুটখাট শব্দ করছে। প্রতিটা শব্দে বুক কেঁপে উঠছে। কাকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলছে গফুর ডোম। সে কি লাশের সাথে কথা বলছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় আমি মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবো।

গফুর ডোম বের হতেই তালা লাগিয়ে দিলো। বাইরে রাস্তায় এসে মনে হলো স্বর্গে চলে আসছি। মুক্ত বাতাস। বুক ভরে টেনে নিলাম। বেঁচে থাকাটা যে কত আনন্দদায়ক সেটা এই মুহূর্তে আমার চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। এতক্ষণ যেন এই দুনিয়ার বাইরে আরেক দুনিয়ায় ছিলাম। পৃথিবীতে যে এমন নরক আছে জানা ছিল না আমার। বের হয়েই সিগারেট ধরালাম। নিকোটিনকে এতো আপন এর আগে কখনো লাগেনি। মনে হচ্ছে আমার সারা শরীরে প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখন বুঝতে পারছি কেন ডোমরা নেশায় ডুবে থাকে। সাইকেল নিয়ে হাঁটছি গফুর ডোমের সাথে। একটা বন্ধ টং দোকানের সামনে টুলে গিয়ে বসলাম।

গফুর ডোম বুকের কাছে চুলকাতে চুলকাতে বিড়িতে টান দিয়ে বলল, “তোমার মায়ের অবস্থা ভাল ছিল না। জমজ দুই পোলার একজনরে তোমার মায়ের কোলে তুইলা দিলো। সেইটা হইলো তুমি। আরেকজন এহন বেওয়ারিশ হইয়্যা কবরে শুইয়া আছে। তোমার আসল মায়েই তোমাগো নাম রাখছিলো। তোমার বাবার কাছে এইডাই ছিল উনার আবদার।”
“এসব কথা আপনায় কে বলেছে কাকা? ওবাইদুল না কার লাশ আসছে সে?”
“হ বাবা। আমি তো হইলাম এই লাশকাটা ঘরের মালি। সব লাশের কথা আমি জানি। কিন্তু যার কেইস তারেই কই। অন্য কাউরে কই না। আমার বাপে আমার এই বিদ্যার গুরু। উনি মানা কইরা গেছেন। কারো কথা কখনো কাউরে কওন যাইতো না।”

গাঁজাখুরি গল্পেরও আবার গুরু থাকে। হাসি আসছে। কিন্তু তা চেপে গেলাম। গফুর ডোম আমায় কোন পথে হাঁটাতে চায় আমি এর শেষ দেখতে চাই।

“কাকা চলেন হাঁটি। বাসায় যাইতে হবে।”
“হ আয়েন। আফনেরে একখান কথা কইছি নিহি?”
“কি কথা?”
“আফনের আসল মায়ের নাম?”
“না বলেন নাই।”
“উনার নাম আঞ্জুমান আরা জুলেখা। আপনের কপালে যেইহানে তিল আছে। আফনের মায়েরও আছে।”

হাঁটতে হাঁটতেই দেখি সেই কুকুর আবার ফিরে এসেছে। সে হাঁটছে আমার আর গফুর ডোমের মাঝখানে। আমি কোন কথা বলছিনা। আমি নাটাইয়ের সব সুতো ছেড়ে দিয়েছি। দেখতে চাই গফুর ডোম কতদূর উড়তে পারে। আমরা প্রায় আমাদের বাসার কাছাকাছি চলে আসছি। সামনেই দুইটা রাস্তা দুই দিকে চলে গেছে। একটা আমার বাসার দিকে। আরেকটা গফুর ডোমের বাসার দিকে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা পাঁচ মিনিট। সময় এতো তাড়াতাড়ি গেলো কি করে টের পেলাম না।

গফুর ডোমের সাথে আবার পরে কথা হবে বলে বিদায় নিলাম। আমি সাইকেলের প্যাডেল দাবিয়ে খানিকটা যেতেই পিছন থেকে আমায় ডাক দিলো গফুর ডোম। ব্রেক কষে পিছনে ফিরলাম। কুকুরটা দুই রাস্তার মাঝখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। গফুর ডোম আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “বাবা, তুমি শিক্ষিত আদমি। আমি স্কুলের দরজায় গিয়াও কখনো খাড়াই নাই। একটা কথা কইতে চাইছিলাম হুনবেন নিহি?”

“বলেন কাকা।”
“দুনিয়ায় সব রহইস্য যদি যাইন্না যাইতো আদমি তাইলে পরে হেয় আর কোন মজা পাইতো না। আদমি কম জানে বইল্যাই বেশি জানোনের চেষ্টা করে। বেশি জানলে তো আর কিছু জানোনের থাহে না। কিন্তু এই জগতে অনেক কিছুই আফনেরা বিদ্যাবুদ্ধি দিয়াও শিখতে পারতেন না। আপনাগো চোখ সব কিছু দেখছে না। কান সব কিছু শুনছে না। আফনেরে আমি কেবল আফনের আসল মায়ের কাছে যাওনের সুযোগ কইরা দিছি। কারণ হের যেমুন অধিকার আছে আফনের উপর। আফনেরও অধিকার আছে উনার উপরে। কিন্তু কেমনে কি হইলো এইসব মাথায় রাইখেন না বাবা। আফনে যেইডা ভাবছেন কথাডা সইত্য না। আমি গাঁজাখুরি কিচ্ছু কই নাই বাবা। এইডা গাঁজাখুরি কিচ্ছা না। আমার গুরু যে আমার বাবায় এইডাও মিছা কই নাই। যান বাবা, বাড়িত যান।”

এটা বলেই গফুর ডোম বিড়ি ধরাতে ধরাতে দুই রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরলো। এতদূর থেকেও বুঝতে পারছি সেই ঘোরলাগা চোখে হাসছে। গফুর ডোম উনার বাসার রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। কুকুরটা একবার আমার দিকে আরেকবার গফুর ডোমের দিকে তাকিয়ে গফুর ডোমের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

পৃথিবী অনেক আজব জায়গা। কত কি ঘটে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। গফুর ডোমের কথা গুলো যে গাঁজাখুরি ভেবেছি; এটা কি করে সে বুঝলো এর সমাধান হয়তো কখনোই পাবো না আমি। আমি স্বচ্ছতা পছন্দ করি। কিন্তু এই স্বচ্ছতা খুঁজতে এসে আরো কিছু ধোঁয়াশা আমায় ঘিরে ধরেছে। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে ভাবছি কি করবো। গফুর ডোমের কথায় কি সেই ঠিকানায় চলে যাবো। নাকি উনার কথা বিশ্বাস না করে গাঁজাখুরি গল্প বলে উড়িয়ে দিয়ে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলবো। আমার বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছে গফুর ডোম। আমি কিছু বলিনি। কেবল দেখতে চেয়েছি এর শেষ কোথায়। আমার সামনে এখন দুটো রাস্তা। ঠিকানা পকেটে নিয়ে বাসায় ফেরা। নয়তো ঠিকানা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বাসায় ফেরা।

এই পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটে আমি জানি। কিন্ত গফুর ডোম আমায় এমন একটা অবস্থার সামনে এনে দাড় করিয়ছে; আমি কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না। আমি কি যুক্তি দিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝবো। নাকি মন যা বলে তাই শুনবো। আমি কোন রহস্য রাখতে চাই না আমার জীবনে।

চারিদিকে চুপচাপ। সোডিয়াম আলোতে রাস্তার পাশের গাছ গুলো যেন সোনালী আলোয় স্নান করছে। গাছের পাতার ছায়া পড়েছে রাস্তায়। সেই আলো ছায়ার মাঝে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি। সাইকেলটা দাড় করিয়ে রেখেছি। চনমনে ঠাণ্ডা বাতাস বুক ভরে টেনে নিলে শরীর জুড়িয়ে যায়। বুক পকেট থেকে ঠিকানাটা হাতে নিয়ে সেই আবছা আলোয় দেখলাম। তিন লাইনের একটা ঠিকানা। সেই ঠিকানায় আমার জন্য হয়তো কিছু অপেক্ষা করছে। হয়তো না। সবাই সব ঠিকানায় পৌঁছাতে পারে না।

পকেট থেকে লাইটার বের করে আগুন লাগালাম কাগজে। পুড়ে যাচ্ছে তিনটা লাইন। আঞ্জুমান আরা জুলেখা, দ্বিতীয় তলা, ফ্ল্যাট নং ৭, বনরূপা হাউজিং… পুড়ে গেলো পুরো কাগজ। সব রহস্য ছাই হয়ে পরে থাকুক রাস্তায়। মিলিয়ে যাক এই শহরে। সাইকেলের প্যাডেল দাবিয়ে বাসার পথ ধরলাম।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত