পরদিন সকালে ফেলুদা প্রথম নীলমণি সানালকে ফোন করল। হ্যালো—কে, মিস্টার সান্যাল? আপনার রহস্য সমাধান হয়ে গেছে.মূর্তি এখনও হাতে আসেনি, তবে কোথায় আছে মোটামুটি আন্দাজ পেয়েছি আপনি কি বাড়ি আছেন? অসুখ বেড়েছে? কোন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন ও, আচ্ছা! তা হলে পরে দেখা হবে ফোনটা রেখেই ফেলুদা চট করে আরেকটা নম্বর ডায়াল করল। ফিস ফিস করে কী কথা হল সেটা ভাল শুনতে পেলাম না—তবে ফেলুদা যে পুলিশে টেলিফোন করছে সেটা বুঝলাম। ফোনটা রেখেই ও আমাকে বলল, ‘এক্ষুনি বেরোতে হবে—তৈরি হয়ে নে?
একে সকালে ট্রাফিক কম, তার উপর ফেলুদা আবার ট্যাক্সির ড্রাইভারকে বলল টপ ম্পিড়ে যেতে। দেখতে দেখতে আমরা নীলমণিবাবুর বাড়ির রাস্তায় এসে পড়লাম। গেটের কাছাকাছি যখন পৌছেছি, তখন দেখি নীলমণিবাবু তাঁর কালো অ্যামব্যাসাডরে বেরিয়ে বেশ স্পিডের মাথায় আমরা যেদিকে যাচ্ছি তার উলটাে দিকে রওনা দিলেন। সামনে ড্রাইভার আর পিছনে নীলমণিবাবু ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলাম না। আউর জোরসে’—ফেলুদা চেচিয়ে উঠল। ট্যাক্সি ড্রাইভারও কীরকম এক্সাইটেড হয়ে অ্যাক্সিলারেটরে পা চেপে দিল। সামনের গাড়িটা দেখলাম বিশ্রী গোঁ গোঁ শব্দ করে ডান দিকে মোড় নিচ্ছে।
এইবার ফেলুদা যে জিনিসটা করল সেটা এর আগে কক্ষনও করেনি। কোটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হঠাৎ তার রিভলভারটা বার করে গাড়ির জানলা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে নীলমণিবাবুর গাড়ির পিছনের টায়ারের দিকে অব্যর্থ টিপ করে রিভলভারটা মারল। প্রায় একই সঙ্গে রিভলভারের আর টায়ার ফাটার শব্দে কানে তাল লেগে গেল। দেখলাম নীলমণিবাবুর গাড়িটা বিশ্রীভাবে রাস্তার একপাশে কেদরে গিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল । আমাদের গাড়িটা নীলমণিবাবুর গাড়ির পিছনে থামতেই দেখি উলটোদিক থেকে পুলিশের জিপ এসেছে। এদিকে নীলমণিবাবু গাড়ি থেকে নেমে এসে ভীষণ বিরক্ত মুখ করে এদিক ওদিক চাইছেন।
ফেলুদা আর আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে নীলমণিবাবুর দিকে এগিয়ে গেলাম। পুলিশের জিপটাও কাছাকাছি এসে থেমেছে। দেখলাম সেটা থেকে নামলেন সেই মোটা অফিসারটি। নীলমণিবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, এ সব কী হচ্ছে কী? ফেলুদা গম্ভীর গলায় বলল, আপনার সঙ্গে গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আর কে আছে জানতে পারি কি ?’ ‘কে আবার থাকবে? ভদ্রলোক চেচিয়ে উঠলেন। বললাম তো আমি আমার ভাগনেকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি।’ ফেলুদা এবার আর কিছু না বলে সোজা গিয়ে নীলমণিবাবুর গাড়ির দরজার হ্যান্ডেলটা ধরে একটানে দরজাটা খুলে ফেলল।
খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে গাড়ি থেকে তীরের মতো বেরিয়ে ফেলুদার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর টুটি টিপে ধরল। কিন্তু ফেলুদা তো শুধু যোগব্যায়াম করে না? ও রীতিমতো যুযুৎসু আর কারাটে শিখেছে। ছেলেটার কবজি দুটো ধরে উলটে তাকে অদ্ভুত কায়দায় মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আছাড় মেরে রাস্তায় ফেলল। যন্ত্রণার চোটে একটা চিৎকার ছেলেটার মুখ দিয়ে বেরোল, আর সে চিৎকার শুনে আমার রক্ত জল হয়ে গেল! কারণ সেটা মোটেই বাচ্চার গলা নয়। সেটা একটা বয়স্ক লোকের বিকট হেঁড়ে গলার চিৎকার! এই গলাই সেদিন আমি টেলিফোনে শুনেছিলাম! ইতিমধ্যে পুলিশ এসে নীলমণিবাবুর গাড়ির ড্রাইভার আর বাচ্চাটাকে ধরে ফেলল।
ফেলুদা তার জামার কলারটা ঠিক করতে করতে বলল, পাঁচিলের গায়ে হাতের ছাপ দেখেই ধরেছিলাম। অল্প বয়সের ছেলের হাতে এত লাইন থাকে না। তাদের হাত আরও অনেক মসৃণ থাকে। অথচ সাইজ যখন ছোট, তখন তার একটাই মানে হতে পারে। এটা আসলে একটা বেঁটে বামনের হাতের ছাপ। বাচ্চাটা আসলে আর কিছুই না—একটি ডোয়ার্ফ। কত বয়স হল আপনার সাকরেদের, নীলমণিবাবু? চল্লিশ! ভদ্রলোকের গলা দিয়ে ভাল করে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। খুব বুদ্ধি খাটিয়েছেন যা হোক। আগে জিনিস চুরির মিথ্যে ঘটনাটা খাড়া করে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে, তারপর নিজেই লোক লাগিয়ে পরের জিনিস চুরি করছেন। আপনার বাড়িতে কাল যাকে দেখলাম সে কি সেই ভিখারি ছেলেটি ? নীলমণিবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। ‘তার মানে আপনার ভাগনে বলে আসলে কেউ নেই। ওকে বাড়িতে এনে ধরে রেখেছেন এই চুরির ব্যাপারে হেল্প করার জন্য ? ভদ্রলোক মাথা হেঁট করে চুপ করে রইলেন।
ফেলুদা বলে চলল, ছেলেটা গান গাইত আর বামনটা খঞ্জনি বাজাত। কেবল চুরির টাইম এলে খঞ্জনিটা ভিখারির হাতে দিয়ে যেত, এবং তখন সে-ই বাজাতে থাকত। বামন বলেই তার গায়ের জোরের অভাব নেই। এক ঘুষিতে একজন জোয়ান লোককে ঘায়েল করতে পারে। ওয়ান্ডারফুল। আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না নীলমণিবাবু!’
নীলমণিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মিশরের প্রাচীন জিনিসের উপর একটা নেশা ধরে গিয়েছিল। প্রচুর পড়াশুনা করেছি এই নিয়ে। সাধে কি প্রতুল দত্তের উপর হিংসা হয়েছিল।’ ফেলুদা বলল, অতি লোভে শুধু তাঁতিই নষ্ট হয় না, বামুনও হয়। কারণ আপনার ওই বেটেটিও বামুন, আর আপনি সান্যাল—একেবারে উচ্চ শ্রেণীর বামুন!..যাকগে—এবার একটা শেষ অনুরোধ আছে।’ ‘কী ?’
আমার রিওয়ার্ডটা। নীলমণিবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে ফেলুদার দিকে চাইলেন। ‘রিওয়ার্ড!” আনুবিসের মূর্তিটা আপনার কাছেই আছে বোধহয়? ভদ্রলোক কেমন যেন বোকার মতো ডান হাতটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। হাতটা বার করতে দেখলাম তাতে রয়েছে এক বিঘত লম্বা কালো পাথরের উপর রঙিন মণিমুক্ত বসানো চার হাজার বছরের পুরনো মিশর দেশের শেয়ালমুখী দেবতা আনুবিসের মূর্তি। ফেলুদা হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।’
গল্পের বিষয়:
রহস্য