আমার পরিচয় আগে দিয়েনি। আমি কলকাতার এক কলেজে পড়াশোনা করি। তাই অনেক কম সময়ের জন্য বাড়িতে ফিরি। আমি হস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম যেদিন সেদিন কার বিকেল বেলায় আমার বন্ধুর সাথে রেললাইনে দেখা হয় তারপর – –
ওইদেখ দেখেনে এই জায়গা তে অনেকে কাটা পড়েছে। শোনা যায় নাকি রাতের বেলায় তাদের নাকি দেখা পাওয়া যায়। কথাটা বলে একটা গভীর নিশ্বাস ফেললো সোম।
আমি – ধুর..এসব ভুত তুত বলে কিছু হয়না।
বুকেরপাটা থাকলে রাতের বেলায় এই রেলগেট থেকে ওই রেলগেট পর্যন্ত হেঁটে দেখাস। তারপর মানবো তুই এক বাপের ব্যাটা।
আমি – দেখ আর সব কিছু নিয়ে খিল্লি কর। কিন্তু বাব কে নিয়ে খিল্লি করিস না।
সোম – আছে বুকে দম। থাকলে আজ আয় দেখি।
আমি – আচ্ছা বল কখন আসতে হবে।
সোম – ঠিক রাত বারো টায়।
আমি – ওকে।
(মনেমনে – দাড়া একবার রেললাইন রাতে পার করে দেখাই তারপর মজা দেখাবো।)
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা রাত ১১.৫০ এর দিকে চলে এলো। আমি বাড়ির পেছনের দিকের জানলা দিয়ে পাঁচিলে নেমে। বাড়ির বাইরে চলে আসি।
দেখি সোম আর অরি দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে। ওরা আমাকে দেখেই বললো – শেষমেশ এলি তাহলে।
আমি – তো কি আমি ভীতু নাকি। চল আমরা যাওয়া শুরু করি। আচ্ছা অরি তোকে তো এতদিন দেখিনি। তুই তো কলকাতা তে চলে গেছিলি।
সোম – আমরা মানে। তোকে একলা যেতে হবে। আর অরি এইতো গত কাল রাতে কলকাতা দিয়ে বাড়ি ফিরেছে।
আমরা ওই রেলগেটের সামনের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছি। যদিও তখন শীতকাল। চায়ের দোকান ৯.০০ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে বেঞ্চ টা থাকে। তুই হেটে হেটে ওই রেলগেটের সামনে আয়।
আমি – আচ্ছা তাহলে আমি চললাম। একটু ভয় লাগছিলো। কিন্তু সাথে করে হেডফোন আর মোবাইল নিয়ে এসেছিলাম।
যাইহোক একটা বিরাট লাঠি নিয়ে নিলাম। যদি কোনো কুকুর টুকুর দেখি। এটা ওদের ভাগাতে কাজ করবে।
ধীরে ধীরে রেল লাইনের কাছে চলে এলাম। এবার সোজা এগিয়ে যাওয়ার পালা।
কানে হেডফোন দিয়ে মোবাইলে গান চালিয়ে সোজা এগোতে লাগলাম।
রেললাইনের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত দেখা যায়না। কারন রেললাইন টা বাকা চাঁদের মতন।
ধীরেধীরে আমি এগোতে লাগলাম। ডিসেম্বর মাস ছিলো বেশ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছিলো। আমি দুই নম্বর আর তিন নম্বর লাইনের মাঝ বরাবর ফাঁকা স্থান দিয়ে যাচ্ছিলাম।
– – – – পনেরো মিনিট পর – – – –
আমার কেমন জানিনা অস্বস্তি লাগুতে লাগলো। বিশাল গরম লাগছিলো। জানিনা এর কারণ কি। আমি জ্যাকেট খুলে ফেললাম। তারপর আমার গা থেকে জামা টাও খুলে ফেললাম। কিন্তু এতো গরম লাগার তো কারণ নেই কোনো। আমি এখন শুধুমাত্র একটা গেঞ্জি পরে আছি।
ধীরেধীরে আমি ওই জায়গা তে চলে এলাম যেখানে অনেক কাটা পড়েছে। রাত যতো বাড়ছে ততোই কুয়াশার পরিমাণ বাড়ছে। কেমন জানিনা অজানা ভয় মনকে গ্রাস করলো।
আমি মোবাইল টা কি মনে করে হাতে নিয়ে আমি গান চেঞ্জ করার জন্য আনলক করলাম। তারপর আমি যা দেখলাম তাতে আমার গা শিহরে উঠলো। দেখি মোবাইলের ঘড়িতে রাত তখন বারোটা বাজে।
কিন্তু আমিতো প্রায় আধাঘণ্টার উপর হাঁটছি। এখন তো সাড়ে বারোটা বাজার কথা। আমি ব্যাপার টা অতো পাত্তা দিলাম না। আমি ধীরেধীরে এগোতে লাগলাম।
আমি এবার মোবাইল দিয়ে হেডফোন খুলে পকেটে রাখলাম। ব্যাপার টা সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। ঠিক তারপর আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কারা যেন আমার পেছনে আছে।
মানে আমার পেছন পেছন আসছে।
একজন না বেশ কয়েকজন। আমি আর পেছন ফেরার সাহস দেখালাম না। একসময় দেখি চার নম্বর লাইনের পাশ টাতে কুয়াশা একটু কমে গেছে। আর লাইনের পাশে যে গাছ গুলো ছিলো ওই গাছ গুলো অস্বাভাবিক ভাবে নড়াচড়া করছে।
এইবার আমার কাছে স্পষ্ট হলো – আমার বন্ধুরা আমাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করছে।
আরে আমি ওতো সহজেই কি ভয় পাবো।
জানিনা কেন একটু মজা লাগুতে শুরু করলো।
আমি এবার ভয় পাওয়ার পরিবর্তে মজা পাচ্ছিলাম।
প্রায় হাঁটছি। এমন সময় দেখি আমার আশেপাশের সব কুয়াশা পরিস্কার হয়ে গেলো। আমি দেখলাম এক নম্বর লাইনের অনেক সামনে দিয়ে একজন দৌড়ে আসছে।
আমার কাছাকাছি আসামাত্র উনি আমার দিকে মুখ করে দৌড়ে আসে। আমি ভেবেছিলাম আমার বন্ধু গুলোর মধ্যে কেউ।
কিন্তু একি এ আমি কি দেখছি যিনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন তার কোনো মাথ নেই। ধীরেধীরে উনি আমার কাছে এসে থেমে গেলেন। এবার আমি উনাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমি এর আগে টিভিতে অনেক রকম ভুতের সিনেমা দেখেছি। তাই জানি কিভাবে গলা কাটা ভুত টিভিতে দেখায়। কিন্তু একি উনি তো সম্পুর্ণ খালি গায়ে।
আমার এবার ভয় লাগতে শুরু করলো। আমি দৌড় দিয়ে যেই পালাতে যাবো তখনি পেছন থেকে কে জানিনা আমার গলা চেপে ধরলো।
তারপর কি হলো জানিনা। আমি অবচেতন হয়ে যাই। একসময় আমার চেতন আসে ট্রেনের হর্ণ শুনে।
আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ি। মোবাইল টা বের করে দেখি রাত তখন বারোটাই বেজে আছে। আমি বুঝলাম আমার সাথে যা হচ্ছে তা স্বাভাবিক না। আমি দৌড় দেওয়া শুরু করি।
আমি সেইদিন অনেক টাই দৌড়েছিলাম। মনেমনে যতোটা পেড়েছিলাম ভগবানের নাম করছিলাম। কতটা দৌড়েছিলাম জানিনা।কিন্তু এতক্ষণে আমার রেলগেটের কাছে চলে আসার কথা। কিন্তু আমি এখনো পৌঁছালাম না কেন।
একসময় পেছন থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলে উঠলো..
পারবিনা বাবা। বৃথা চেষ্টা। আমিও পালাতে পারিনি। তোকেও মরতে হবে। কেউ পালাতে পারিনি।
চারিদিক থেকে হা..হা.. হি..হি হাসির শব্দ ভেসে আসতে থাকে। আমি আবারো দৌড় দিলাম প্রাণপণ। কিন্তু কোনো লাভ হলোনা আমি রেলগেট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একসময় আমি কাঁন্নার আওয়াজ শুনলাম। সে যে কি বিচ্ছিরি আওয়াজ ছিলো। আমি বলে বোঝাতে পারবোনা।
চারিপাশ থেকে এতো আওয়াজ আসছিলো যে আমার একসময় বুকের নিশ্বাস ভারী হয়ে যায় আমি আবারো অবচেতন হয়ে যাই।
চেতন ফেরে এক পুরুষের কন্ঠে। আমি চমকে উঠে বসে পড়ি। ওই পুরুষ টি আমাকে জিজ্ঞেস করলো যে এতো রাতে আমি কি করছি এখানে।
আমার ওনাকে বিশ্বস্ত মনে হয়েছিলো তাকে সব খুলে বললাম। সব শুনে উনি আমাকে বললেন যে তার পেছন পেছন আসতে।
আমি ওনাকে ফলো করতে লাগলাম। প্রায় এক কি দুই মিনিট হবে আমি রেলগেটের সামনে চলে এলাম। আমি যেই লাইন পার হবো উনি আমাকে চেঁচিয়ে বললেন। যাস না।
ওটা কোনো রেল লাইন না।
উনি আমার কাছে এসে একটা পাথর তুলে ওইপাশে ছুঁড়ে মাড়লেন। তখন আমি একটা আওয়াজ শুনলাম। যেই আওয়াজ টা কোনো পুকুর কিংবা নদীতে কোনো কিছু ছুঁড়ে মাড়লে হয়।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার গা কাঁপতে লাগলো। উনি আমাকে বললেন।
তুই আমার পেছন পেছন আয়। একসময় দেখি দুই নম্বর লাইন দিয়ে একটা মালগাড়ি আসছে। আর ওই লোকটি ওর মধ্য দিয়ে একনম্বর লাইনের দিকে চলে গেলেন। ওপাশ থেকে উনি চেঁচিয়ে বললেন। তুই দাঁড়া গাড়ি চলে যাক তারপর আসবি। মালগাড়ি টার কোনো বগী ছিলোনা। আমি চাইলে উঠে যেতে পাড়তাম। কিন্তু আমার ওই লোকটার প্রতি মনে বিশাল বিশ্বাস জন্মে গেছিলো।
ট্রেনটা ধীরেধীরে চলে যায়। তারপর আমি ওনার পেছন পেছন যেতে থাকি।
তারপর উনি আমাকে বলেন।
আমি জানি তোর মনে এখন অনেক প্রশ্ন। তোর সাথে এইসব কেন ঘটছে, কি ঘটছে। ভয় পাস না। আমি আছি তোকে কেউ কিছু করতে পারবেনা।
এযুগে কেউ যেচে জ্ঞান দিতে চাইনা।আর এনি আমাকে এতো দরদ দিয়ে উপকার করতে চাইছেন কেন। আমার পেছন থেকে আবারো সেইসব অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পাই।
উনি আমাকে বললেন – মনে করে দেখ। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে। খড়দা প্ল্যাটফর্মে একটা পাগল সবার কাছে টাকা চাচ্ছিলো। কেউতো টাকাই দিচ্ছিলো না। পাগলটা তিন দিন না খাওয়া ছিলোরে। তখন তুই তো দশ টাকার একটা নোট দিয়েছিলি।
আমি বললাম আমার ঠিক মনে নেই।
উনি বললেন একদিন না একদিন ঠিক মনে পড়বে।
সেই পাগল টা আমি ছিলাম।
আর এইযে তোরসাথে যে সব অপ্রাকৃত ঘটনা ঘটছে সেইগুলো কিছুই না তুই ভুতের খপ্পরে পড়েছিলিস। আমি হলাম একপ্রকার জীন। আমি এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম হঠাৎ তোকে দেখতে পাই। তাই চলে আসলাম। একসময় তুই আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলিস। আজ তার একটু হলেও ঋণ শোধ করলাম।
আসলে আমরা মানে জীনরা মানুষের কাছে বিভিন্ন রুপে যাই। সাহায্য চাইতে। যে আমাদের সাহায্য করে। তাদের আমরা পরে কোনো না কোনো ভাবে সাহায্য করেদি।
আমি – বুঝলাম না মানে সাহায্য।আবার ফিরিয়ে দেওয়া। উনি আবারো বললেন – বাড়ির আশেপাশে কোনো মিষ্টির দোকান থাকলে জিজ্ঞেস করে দেখিস।
পরীরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রুপ ধরে মিষ্টি কিনতে আসে। আর যখন ওরা চলে যায় মিষ্টি কিনে। সেই দোকানে অসম্ভব সেল বেড়ে যায়। এমন ও অবস্থা সৃষ্টি হয় যে ওই দোকানের সব মিষ্টি অতি অল্প সময়ে শেষ হয়ে যায়।
আমি – অতো বুঝিনা আমি মানুষ কে সাহায্য করা আমাদের সকলের কর্ম। কেউ করে আবার কেউ করেনা।
উনি আমাকে বললেন – এই শোন ভোর হতে চললো আমাকে যেতে হবে আমাদের দেশে। তুই সোজা চলে যা তোর বাড়ি পৌঁছে যাবি। আর হ্যাঁ যেটা বললাম মাথায় রাখিস।
আমরা বিভিন্ন রুপে মানুষের কাছে আসি। কখনো কোনো অসহায় মানুষ দেখলে ফিরিয়ে দিবিনা।
আমি বললাম – তুমি চলে যাচ্ছো। আবার কবে দেখা হবে।
উনি বললেন – হয়ত মিশে থাকবো ওইসব অসহায় মানুষ দের মাঝে।
আমি বললাম – তোমার দেশ কোথায়। আমাকে দেখাবে।
উনি বললেন – পরে একদিন সময় করে নিয়ে যাবেন।
তারপর উনি ধীরেধীরে মিলিয়ে গেলেন।
আমি দৌড় দিয়ে বাড়ি চলে আসলাম তারপর।
পরের দিন সকালে দুইখানা খবর শুনতে পেলাম আমি।
এক – কাল রাতে সোম বাড়ি ছিলোনা।
দুই – অরি তো একসপ্তাহ আগে রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে।
তাহলে কাল রাতে আমি কাদের দেখলাম..