কিছুদিন আগে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাকিরা বেড়াতে গেলেও আমার প্ল্যান ছিল স্থানীয় মানুষজনের থেকে ওখানকার গাছপালা জন্তুজানোয়ার সম্বন্ধে যতটা পারি জেনে আসব আর পারলে দেখেও আসব। গিয়ে দেখি যে আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল যাবার জন্যে সে একটা মাছধরা ট্রলারের ব্যবস্থা করেছে নদীতে ঘোরার জন্যে, খাওয়া শোয়া বেড়ানো সবই তিন দিনের জন্যে ঐ ট্রলারটাতেই হবে, এক কথায় দারুণ ব্যবস্থা। উপরি পাওনা হিসাবে মাছধরাও দেখা হবে, কেউ চাইলে মাছ ধরতেও পারে। আমরা ভদ্রলোককে প্রচুর ধন্যবাদ টন্যবাদ দিয়ে লাফাতে লাফাতে ট্রলারে চড়ে পড়লাম।
ট্রলার এগিয়ে চলেছে নদীর রাস্তায়, আমরা কেউ আর ডেক ছেড়ে নড়ছিই না; কত রকমের গাছ, পাখি, হরিণ, কেউ জল খাচ্ছে, কেউ এমনিই ছুটছে, কেউ গাছে বসে গান গাইছে আরো কত কিছু করছে। এভাবেই দিনটা কেটে গেল, বাঘের ডাক শুনলাম বেশ কবার, কিন্তু বাবাজীবনকে দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যেবেলা ঐ ডেকে বসেই সবাই গল্প করছি, দেখি মাথার ওপর প্রচুর বাদুড় উড়ছে; বেশ বড় বড় বাদুড়। হঠাৎ সাগর বলল “আমি বাড়ী যাব”। আমরা খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললাম “বাড়ী যাবি কেন? আর যাবিই বা কি করে? আমরা তো প্রায় সমুদ্রের কাছে এসে গেছি, এখান থেকে হুট করে ফিরে যাওয়া ইয়ার্কির ব্যাপার না ভাই”। সাগর বলল “তা জানি না, তবে যাব; ঐ যে ওপরে দেখছিস বাদুড়গুলো ঊড়ছে, ওরা ভ্যাম্পায়ার, রাত হলেই নেমে এসে আমাদের রক্ত খাবে। তোরা যেখানে যাবি যা, আমি বাড়ী যাব”। রুদ্র পেশায় প্রাণীতত্ত্ববিদ, সে বলল “তুই কি ক্ষেপেছিস, নাকি তোর পেট গরম হয়েছে? ভ্যাম্পায়ারের খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আমাদের রক্ত খেতে আসবে, এই হরর ফিকশন পড়ে পড়ে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে”। সাগর তর্ক করে চলেছে “তুই জানিস না, বাদুড়রা রাত হলেই ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায় আর রক্ত খায়”। “ঘোড়ার ডিম খায়। কটা বাদুড়কে তুই দেখেছিস রক্ত খেতে? যত সব কুসংস্কার” রুদ্রর জবাব। আমি দেখলাম পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠছে, তাই রুদ্রকে বললাম “এক কাজ কর না, তুই তো জুলজিস্ট, এই ভ্যাম্পায়ার কেসটা ভাল করে একটু গুছিয়ে বল। আমরাও শুনি, আমিও শুনেছি বাদুড়ে নাকি রক্ত খায়, তোর থেকে জানলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে”। রুদ্র বলল “ভালো করে একটু চা দিতে বল” বলে গুছিয়ে বসে শুরু করল।
‘ভ্যাম্পায়ার’ নামটা শুনলেই যে কোন মানুষের মধ্যে একটা অপ্রাকৃতিক অনুভূতি জেগে ওঠে। গোটা পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব কমই আছে যারা এই নামটাকে ভয় পায় না। অথচ মজার ব্যাপার হল, ‘ভয় পায়’ আর ‘ভয় পায় না’, এই দু ধরনের মানুষকেই যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে ভ্যাম্পায়ার কি, কেউ বলবে ‘ড্রাকুলা’, কেউ বলবে ‘কল্পিত রক্তচোষা জীব’, কেউ বলবে ‘বাদুড়-মানুষ’, কেউ বলবে ‘ভীতুদের কল্পনা’। যদি একটু বড় আকারে সমীক্ষা করা যায় তাহলে আরো অনেক মজার গল্প শোনা যেতে পারে। যেমন ‘ভ্যাম্পায়ার কাউকে কামড়ালে সেও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়, এদের বড় বড় দাঁত থাকে, ভ্যাম্পায়ার সবসময় গলা কামড়ে রক্ত খায়’ ইত্যাদি। নাম না করে বলতে পারি, এ ধরণের ধারণা তৈরীর পেছনে সবথেকে বড় হাত আছে কিছু হলিউডি সিনেমা আর কিছু বিশ্ববিখ্যাত গল্পের বই এর। এগুলোর প্রভাব সবথেকে বেশী পড়ে কিশোর-কিশোরীদের ওপর, আর এভাবেই এই ভুল ধারণাগুলো গোটা পৃথিবীর মানুষের মনে রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে অন্ততঃ গত তিন শতাব্দীরও বেশী সময়।
ভ্যাম্পায়ার শব্দটার উৎপত্তি লিথুয়ানিয়ান ভাষার ‘ওয়েম্পটি’ থেকে যার মানে হল ‘পান করা’। জার্মান ভাষায় এর উচ্চারণ হয় ‘ওয়্যাম্পির’, সেখান থেকে ইংরেজিতে হয় ‘ভ্যাম্পায়ার’। সাধারণতঃ যে কোন রক্তপায়ী প্রাণীকেই ভ্যাম্পায়ার বলা যায়। সেক্ষেত্রে মশা, ডাঁশ মাছি, জোঁক ছারপোকা এরাও কিন্তু ভ্যাম্পায়ার। তাহলে বাদুড়েরই এই বদনামটা জোটে কেন? কারণ প্রথমতঃ মানুষের কুসংস্কার, দ্বিতীয়তঃ এগারোশ প্রজাতির বাদুড়ের মধ্যে মাত্র তিনটে প্রজাতি রক্তপায়ী বাকিরা বেশিরভাগই নিরামিষ খায়। ঐ রক্তখেকোগুলোকে ভ্যাম্পায়ার বলে, আর এদের জন্যে গোটা বাদুড় জাতিরই বদনাম হয়। তৃতীয়তঃ বাদুড় প্রাণীটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব অস্পষ্ট, এই আমাদের সাগরেরই মত। তাই বাদুড় দেখলেই সবাই ভ্যাম্পায়ার ভাবে।
আমি খুব অবাক হয়ে বললাম “মাত্র তিনটে প্রজাতি?” রুদ্র দু চুমুক চা খেয়ে বলল হ্যাঁ ভাই মাত্র তিনটে, তাও এদেশে পাওয়া যায় না। তিনটেই জাতে আমেরিকান। প্রথমটার নাম ‘কমন ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’, দ্বিতীয়টা হল ‘হেয়ারি লেগড ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’ আর শেষেরটার নাম হল ‘হোয়াইট উইং ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’। চেহারা কারোরই খুব একটা বলার মত না, মোটামুটি আমাদের দেশের ‘চামচিকে’রই সমান। ঠিকঠাক একটা চড় মারলেই মরে যায়, তবে অন্যান্য বাদুড়ের থেকে তুলনামূলক ভাবে এদের শ্বদন্ত বড় হয়। প্রথম দুটো প্রজাতি সাধারণতঃ ঘুমন্ত পাখিদের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে, ‘কমন ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’ একটু লাফঝাঁপ দিয়ে শিকারের ঘাড়ে পড়ে। ‘হোয়াইট উইং ভ্যাম্পায়ার ব্যাট’ একটু বেশী সাহসী, তাই এরা পাখির রক্ত খায়, তার সাথে গৃহপালিত পশুরও রক্ত খায়। এরা প্রত্যেকেই নিশাচর, দিনের বেলায় গাছের কোটর, গুহা, বা পুরোনো বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে লুকিয়ে থাকে। রাত হলেই রাজত্ব করতে বেরিয়ে পড়ে। তবে কোন ভ্যাম্পায়ারই মানুষের রক্ত খায় না, কারণ মানুষের গায়ে পশুপাখিদের মত পালক বা লোম নেই তাই এরা রক্ত খাবার সময় ঝুলে থাকার মত কোন অবলম্বন পায় না।
অন্যান্য বাদুড়দের মত এরাও চোখে ভাল দেখে না, সে রাত বা দিন যাই হোক না কেন; খুব বেশী হলে পাঁচফুট দূরের জিনিস পরিষ্কার দেখতে পায়। কিন্তু এদের ঘ্রাণশক্তি আর শ্রবণশক্তি খুব বেশী। এরা চলাফেরা, শিকার ধরা সবই করে কানে শুনে, তবে যে শব্দ শুনে এরা এই কাজগুলো করে সে শব্দ মানুষের কানে আসে না। একে ‘আলট্রাসোনিক শব্দ’ বলে। এই শব্দ আর তার প্রতিফলনের মাঝের সময় গণনা করে এরা সব কাজ করে, যেটা আজ আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ‘রেডার ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। দিনের বেলায় এরা দলবেঁধে কোন ঠাণ্ডা অন্ধকার জায়গায় বিশ্রাম নেয়। একএকটা দলে তিরিশ-পঁয়তিরিশটার মত বাদুড় থাকে। ছেলে-ভ্যাম্পায়াররা অনেকগুলো বিয়ে করে, সাধারণভাবে চার-পাঁচটা, কোন কোন ক্ষেত্রে দশটা অবধি বিয়ের খবর পাওয়া গেছে। তবে এতগুলো বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাইকে নেমন্তন্ন করে কি খাওয়ায় এটা জানা যায় নি। সাগর বলল “কি আর খাওয়াবে, রক্তই খাওয়ায় হয়ত”। আমি বললাম “সিনটা কিন্তু সলিড ভাই, সবাই গ্লাসে করে রক্ত হাতে নিয়ে নবদম্পতি কে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। জাস্ট অসাধারণ। আচ্ছা একটা জিনিস বল, বাচ্চাগুলোও কি রক্ত খায়?”
এদের বাচ্চা হয় বর্ষাকালে। তারপর তিনমাস তারা একেবারেই দুগ্ধপোষ্য থাকে, তিনমাস পর থেকে ভ্যাম্পায়ার গিন্নী তাদের দুধের সাথে রক্ত মিশিয়ে খেতে দেন। এভাবে ছ’মাস কাটলে বাচ্চারা মায়ের সাথে শিকার ধরতে বেরোয়। ন’মাস কেটে গেলে তারা লায়েক হয়ে যায়, তখন ‘মা’ তাদের চরতে ছেড়ে দেন। ভ্যাম্পায়ার দের একেবাএর একটাই বাচ্চা হয়, তাই তাকে মানুষ করতে মিসেস ভ্যাম্পায়ারের খুব একটা ঝামেলা হয় না। বীভারের মত এরাও খুব সামাজিক প্রাণী। বিশেষ করে মেয়ে ভ্যাম্পায়াররা খুব সহমর্মী। একজন যদি খাবার না জোগাড় করতে পারে তাহলে অন্যরা সবাই মিলে তার জন্যে খাবার জোগাড় করে আনে। এদের সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত শক্তিশালী, যদি শিকার বড় হয়, তাহলে দেখা যায় ছেলেদের আগে মেয়েরাই দলবেঁধে আক্রমণ করে শিকারকে কব্জা করে ফেলে। কখনো কোন ভ্যাম্পায়ার-মা যদি কোন কারণে মারা যায় বা অসুস্থ হয়, অথবা শিকার করতে গিয়ে মারা যায়, তাহলে অন্য কোন ভ্যাম্পায়ার-মা সাময়িকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে তার বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে নেয়, আর নিজের বাচ্চা মনে করেই তাকে বড় করে তোলে। যখন প্রাকৃতিক তাপমাত্রা অনেক নেমে যায়, তখন ভ্যাম্পায়াররা সবাই মিলে খুব কম জায়গার মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে, এতে করে তাদের শারীরিক তাপমাত্রা নেমে যেতে পারে না। আরো একটা মজার ব্যাপার এদের মধ্যে দেখা যায়, আমাদের মধ্যে যেমন মা-মাসি-কাকিমা-পিসিমারা বিকেলে গা ধুয়ে একজন অন্যজনের চুল বেঁধে দেন, তেমন মেয়ে ভ্যাম্পায়াররা শিকার করে এসে একজন অন্যজনের গা-হাত-পা চেটে পরিষ্কার করে দেয়।
এতটা বলে রুদ্র বলল “এবার বল সাগর এখানে কোথায় তোর রাতের রক্তচোষা বাদুড়?” সাগর আমতা আমতা করে বলল “কিন্তু ধর যদি কোনভাবে ভ্যাম্পায়ার কামড়ে দেয় কি হবে?” রুদ্র খুব ক্যাজুয়ালি বলল “কি আর হবে? পেটে চোদ্দটা ইনজেকশন নিতে হবে। কারণ ভ্যাম্পায়ারের কামড়ে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তিরিশটা কেস পাওয়া গেছে যাদের ‘জলাতঙ্ক’ হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই হবে না”। আমি বললাম “বেশ সুন্দর প্রাণী তো, হ্যাঁ রে পোষা যায় এদের?” রুদ্র বলল “চেষ্টা করে দেখা হয়েছে, সফল হয় নি। কারণ খাওয়ানোটাই বড় সমস্যা, বাটি করে রক্ত দিয়ে দেখা গেছে ছুঁয়েও দেখে না। কেন তুই পুষবি ভাবছিস নাকি?” আমি বললাম “না না সাগরের জন্মদিনে একজোড়া ভ্যাম্পায়ার গিফট করব ভাবছি, এরকম এক্সক্লুসিভ গিফট আর হবে?” সাগর ক্ষেপে গিয়ে কিছু একটা বলবে এমন সময় আমাদের রান্নার ঠাকুর খাবার জন্যে ডাকতে এসে গেল, আর আমরাও ভ্যাম্পায়ার ট্যাম্পায়ার ভুলে হইহই করে খেতে দৌড়োলাম।