রহস্যময় পরী

রহস্যময় পরী

বেশ কিছুদিন ধরে কিছুতেই পরীর জ্বরটা কমছে না, শুধু জ্বর নয় তার সাথে রয়েছে টনসিল ফোলা আর গলা ব্যাথা। কিরন দুইজন ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গেল কিন্তু কেউ বুঝতে পারছেনা। সব রকম রক্ত পরীক্ষা করা হল কিন্তু কিছু ধরা পরলনা। তাই এখন পরী সাধারণ জ্বরের অসুধের ওপর আছে কিন্তু ওরা ভয়ে ওদের তিন বছরের মেয়ে রানীকে পরীর কাছে বেশি যেতে দিচ্ছেনা, যদি ইনফেকশান হয়ে যায়। আর পরীকেও আলাদা ঘরে রাখতে বলেছে ডাক্তার।
রাত তখন তিনটে বা তিনটের কিছু বেশি হবে, কিরন উঠেছিল জল খেতে, পাশের ঘরে পরী ঘুমাচ্ছে। জল খেয়ে ঘরে ফেরার সময় হটাৎ কিছু একটা শব্দ শুনতে পায় কিরন। পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে পরী বিছানায় বসে চোখটা এক পলকে সামনের দিকে চেয়ে কিন্তু ওর বামহাত সামনে তুলে আঙ্গুল গুলো নারাচ্ছে। কিন্তু আঙ্গুল নারাচ্ছে কেনো ভাল করে দেখতে গিয়ে কিরন দেখলো আঙ্গুল গুলো যেনো পিয়ানো বাজানোর মত করে উপর-নীচ করছে। কিরন ঘরের আলোটা জ্বালায় এবং সাথে সাথে পরী হাতটা নামিয়ে খুব অবাক হয়ে কিরনের দিকে তাকায় যেন কিছু হয়নি। কিরন জিজ্ঞাসা করে..
– কি করছিলে পরী ঐ ভাবে হাত তুলে?
– আমি কৈ? কিছু নাতো.. বলছি আমাকে তো আজ রাতে কেউ খেতে দিলোনা?
– কি বলছ পরী এখন রাত অনেক হয়েছে, তোমাকে খাবার আমি নিজে হাতে খাইয়ে দিয়ে দিলাম..
– ও তাই.. মনে নেই.. তাহলে ত এখন ঘুমানোর সময়। আমি ঘুমাই..
কিরন আলোটা নিভিয়ে দিয়ে পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে সিগারেট ধরিয়ে চিন্তা করতে থাকে পরী রাতের খাবারের কথা কিভাবে ভুলে গেল আর পিয়ানো বাজানোর মত করে কি করছিলো ওটা..
.
.
.
পরের কয়েকদিন সব স্বাভাবিক, ঐ রাতের কথা কিরন ব্যস্ততার মধ্যে ভুলে যায় কিন্তু পরীর জ্বরটা কমেওনা কিন্তু বারেওনা। হটাৎ এক দুপুরে বাড়ির কাজের বৌয়া আয়শার ফোন পায় কিরন, যে পরী অদ্ভুত কিছু আচরণ করছে বাড়িতে যেন সে এখুনি চলে আসে। কিরন ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে অফিসে ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছুটে এসে দেখে কিছু নেই, পরী ঘুমাচ্ছে কিন্তু ঘরের সামনে লাঠি আর কিরনের পুরনো হকি স্টিক পরে রয়েছে। কিরনকে দেখে যেন আয়শা ধরে প্রাণ পায়, সে বলে..
– ভাইজান আমি আমার কাজ করছিলাম হটাৎ শুনতে পাই আপা যেন কার সাথে কথা বলছে প্রথম ভাবলাম ফোনে কথা বলছে তার পর ভাল করে শুনে দেখি কাকে বলছে “এই আপনি কে? আপনাকে চিনিনা। এই ঘরে কি করে এলেন? যান বেরিয়ে যান”.. এই শুনে আমি দৌড়ে ঘরে যাই..কিন্তু….
– হ্যাঁ কিন্তু কি?? বল…
– ঘরে গিয়ে দেখি কেউ নেই আপা ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে খাটের দিকে মুখ করে হাতে ঐ লাথি নিয়ে কাকে যেন খুব শাসাচ্ছে আবার ভয়ে ভয়ে বলছে মাঝে মাঝে যে “ না আমি যাবনা আমাকে জোর করবেনা” আমি গিয়ে আপার গায়ে হাত দিয়ে জোরে ঠেলা দিতে আপা চমকে উঠে ওইগুলো হাত থেকে ফেলে কিছু না বলে আবার শুয়ে ঘুমাতে লাগল.
কিরন কিছু না বলে আয়শা কে কাজ করতে বলে আর নিজের ঘরে এসে ভাবতে শুরু করে এবং তার আগে পরীর মাকে ফোন করে জেনে নেয় যে পরী কোনোদিন পিয়ানো শিখেছে কি না, তার মা না বলে। কিরন পরীকে ছোটো থেকে চেনে সে বুঝতে পারেনা কাকে চিন্তা করে শাসাচ্ছিলো আবার আয়শার কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনা, ভাবে হয়ত এক শুনেছে আর এক রকম বলছে কিন্তু লাঠি আর হকি স্টিকটা নিয়ে একটা খটকা থেকে যায় কিরনের।
.
.
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে পরীর আরও কিছু অদ্ভুত সমস্যা দেখা যায় যেখানে পরীর ঐ পিয়ানো বাজানো ছিল। এই দেখে কিরন ঠিক করে রাতে পরীর ঘরের সোফাতে শোবে।
.
রাত প্রায় ২.৩০ নাগাত কারো ফিসফিসানিতে কিরনের ঘুমটা ভেঙে যায়। সোফাটা ছিল পরীর খাটের ডানদিকে। কিরন দেখে যে পরী বামদিকে তাকিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। ভাল করে শুনবে বলে চুপিসারে কিরন খাটের পাশে দাঁড়ায় এবং শুনতে পায় পরী বলছে..
– আপনি কে ?? এত রাতে আমার ঘরে কি করছেন? আমি কিন্তু চিৎকার করব.. ঢুকলেন কি করে আপনি??
কিছুক্ষণ সব চুপ.. এই চুপ করে থাকার সময়টা কিরনের কেমন গা ছম়্ছম়্ করে। তারপর আবার পরী বলতে শুরু করে..
– একি আপনি এখন কেন জাচ্ছেন না.. ওকি আপনার মুখটা অমন হচ্ছে কেন.. রক্ত কেনো আপনার মুখে?? কে আপনি??
আস্তে আস্তে পরীর গলার জোর বাড়তে থাকে আর কিরনের মনে হয় যেন পরী কাউকে দেখে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু রক্ত মাখা মুখ কার হবে?? পরী আবার বলতে শুরু করে..
.
– আমার দিকে আসবেন না.. রক্ত কেন? আমি রক্ত সইতে পারিনা।
এই বলেই প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে আর সঙ্গে সঙ্গে কিরন পরীকে ধরে ফেলে টেবল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়। কিরন দেখে পরী পুরো ঘামে ভিজে গেছে আর কাঁপছে। কিরন জিজ্ঞাসা করে..
– কি হয়েছে পরী তুমি এমন কেন করছো?? কাকে দেখছিলে স্বপ্নে??
– ওই দেখো ঐ দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে চলে যেতে বলো আমার ভয় করছে।
এই বলে পরী ঘরের বাম দিকে একটা কোণ দেখায়। কিরন উঠে গিয়ে বড়ো আলো জেলে ঐ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়।
– দেখো পরী এখানে কেউ নেই.. তুমি স্বপ্ন দেখেছো…
– স্বপ্ন?? কিন্তু আমি যে দেখলাম ঐ মুখটা!!
– কার মুখ??
– মুখটা রক্তে ভরা। মনে হচ্ছিলো কেউ যেনো খুব রাগ নিয়ে মুখটা পাথর দিয়ে মেরে থেৎলে দিয়েছে…
তখন কিরন দেখতে পায় যে দরজার বাইরে তাদের মেয়ে, মা এর চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁরিয়ে আছে ভয় পাওয়া মুখ নিয়ে। কিরন পরীকে ঘুম এর অসুধ দেয় আর মেয়েকে নিয়ে মেয়ের ঘরে শুয়ে পরে, কিন্তু সারারাত চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি.. পরীর ঐ গগনভেদি চিৎকার সমানে তার কানে বাজছিল..
.
.
কিরন ঠিক করে এরপর কয়েকদিন দেখবে কি হয় তারপর কিছু একটা ঠিক করবে।
এর দিন দশ পর একদিন সন্ধাবেলা আয়শা পরীকে চা দিতে যায় আর দেখে যে পরী জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে.. আয়শা চা টা পরীর সামনে টেবলে রেখে খেয়ে নিতে বলে.. কিন্তু পরী তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালে প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়ে আয়শা দেখে পরী সারা মুখে লাল লিপস্টিক মেখে আছে .. আয়শা জিজ্ঞাসা করে..
– দিদি এটা কি করেছ?? এই ভাবে লিপস্টিক কেন মেখেছ??
পরী একটা যন্ত্রের মত ঘরঘরে গলায় বলে…
– তোকে না আমি এই ঘরে আস্তে বারণ করেছিলাম… কেনো এসেছিস বল??
এই শুনে আয়শা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় এবং পিছতে সুরু করে দরজার দিকে.. তাকে পিছোতে দেখে পরী আক্রোশে এগিয়ে আসে ও বলতে থাকে ঐ রকম গলায় এবং হাত তুলে ডাকতে থাকে আয়শাকে.
.
– চলে যাচ্ছিস কেনো?? আয় এসেছিস যখন.. তোর সাথে একটু গল্প করি।
এই বলতে বলতে পরীর মুখটা যেনো পিশাচের মত হয়ে যায় আর টেবল থেকে গরম চা ভর্তি কাপটা তুলে ছুঁড়ে দেয় আয়শার দিকে। আয়শা সরে যায় আর কাপটা পরে বাইরে যেখানে রানী দাঁরিয়ে দেখছিল সব, কেউ খেয়াল করেনি আর কাঁপছিল ভয়ে। কাপটা থেকে বেশ কিছুটা গরম চা রানীর পায়ে পড়তেই জালাতে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে আর আয়শা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে হুড়কো দিয়ে দেয়।
এর সাথে সাথে দরজা যেন ভিতর থেকে পরীর ধাক্কায় ভেঙ্গে পরার মত অবস্থা হয়। আর চিৎকার করতে থাকে সেই ভয়াবহ গলায়..
.
খুলে দে দরজা.. আমি আমার মেয়েকে দেখব। ও কাঁদছে কেন?? খুলে দে বলছি।
এই বলতে বলতেই ধপ করে একটা আওয়াজ হয় আর ভিতরের সব আওয়াজ চুপ হয়ে যায়… এই ভাবে কিছু সময় থাকার পর আয়শা রানীকে কোনোমতে চুপ করিয়ে তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে পরীর ঘরের দরজা খুলে দেখে যে পরী মেঝেতে পরে আছে আর মুখ দিয়ে গাঁজলা মত বেরুচ্ছে।
এই দেখে আয়শা তাড়াতাড়ি পরীকে ধরে ধরে খাটে কোনোমতে শুইয়ে কিরনকে ফোনে ধরে। কিরন অফিস থেকে ফিরছিল এবং বাড়ির কাছাকাছি ছিল। সে পরীর অজ্ঞান হওয়ার কথা শুনে তাড়াতাড়ি ডাক্তার গাড়িতে নিয়ে একেবারে বাড়ি আসে। ডাক্তার পরী কে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে বিশ্রামে থাকতে বলে।
কিরন পরে আয়শার থেকে পুরো ঘটনা শোনে এবং ভীষণ চিন্তায় পরে যায় যে কি হচ্ছে..আয়শা একবার ভূতে ধরেছে এই ধরনের কথা বলতে গিয়ে কিরন এর ধমক খেয়ে চুপ করে যায়। কিন্তু এই ২০১৭ তে চিরকাল এইসবে অবিশ্বাস করা কিরনের মাথায় যে এই চিন্তা আসেনি তা নয়, কারণ তার কাছে পরীর এই অদ্ভুত আচরণ গুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
পরের দিন থেকে কিরন অফিসে ছুটি নেয় আর নিজের হাতে পরীকে সেবা করবে ঠিক করে। সকালে নিজে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে পরীর ঘরের দিকে যায়, কারণ আয়শা আর কাজ করবেনা বলে গেছে। পরীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কিরন পাশে বসে কথা বলতে শুরু করে।
পরী তুমি কোনদিন পিয়ানো শিখেছ??
– পিয়ানো!!!! কই না তো.. কেন গো??
– না কিছুনা.. তুমি কাকে দেখে ভয় পাচ্ছ ঘুমের মধ্যে??
– ভয়!! কই কাউকে দেখে না তো.. হ্যাঁ গো আমার কি হয়েছে?? তুমি রানী কে বাপের বাড়ি কেনো রেখে এলে কাল??
– তোমার এটা ভাইরাল জ্বর তো তাই
– ওহ!! হ্যাঁ গো এটা কবে সারবে??
– এই ত আজ দুপুরে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব তখন ই বুঝতে পারব।
– ওহ.. আচ্ছা।
.
এরপর কিরন পরীকে নিয়ে হসপিটাল যায় দুপুরে, তার আগে ওর খুব কাছের বন্ধু দীপককে কিছুটা বলে যা সমস্যা পরীর হচ্ছে। দীপক নিজে ডাক্তার সে একটা বুদ্ধি দেয় যে ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর। তাতে নাকি আয়শার কথার সত্যি মিথ্যা বোঝা যাবে। সেই মত কিরন দীপককে দায়িত্ব দিয়ে যায় যে পরীর ঘরে বিভিন্ন দিক থেকে তিনটে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর জন্য এবং অবশ্যই তা যেন সহজে চোখে না পরে। দীপক কিরনের কথা মত সব কাজ করে রাখে আর মনিটরটা কিরনের ঘরে বসায় এবং নিজে এই সময় কিরনের পাশে থাকবে বলে সেই রাত তাদের বাড়ি থাকবে ঠিক করে।
কিরন পরীকে নিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়। ডাক্তার আবার কিছু নতুন টেস্ট করায়।
রাত ৯টা নাগাদ রাতের খাওয়া সেরে পরীকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে কিরন ঘরে এসে সিগারেট ধরায় আর কিচুক্ষণের মধ্যে দীপক চলে আসে। এরপর তারা পালা করে মনিটরের দিকে চোখ রাখে। এক একটা মুহূর্ত যেন দুজনের কাছে এক এক ঘণ্টার মত মনে হয়। দীপক এই সময় কিরনের থেকে সব ঘটনা পরিষ্কার ভাবে শুনে এবং ভিতরে তার একটা শিহরণ জেগে যায়। কিন্তু দীপক নিজে একজন ডাক্তার হওয়ার সাথে সাথে ঘোর নাস্তিক তাই সে মন কে শক্ত করে..
আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে। মাঝরাত পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন দেখাচ্ছে রাত ৩.০৭, ঠিক তখন পরী বিছানায় উঠে বসে। অন্য ঘরে কিরন আর দীপকের একটু চোখ লেগে গেছিল তারা চোখ খুলে দেখল ঘড়িতে রাত ৩.৩০ আর পরী….. না পরী তো বিছানায় নেই এমন কি তাকে এই মুহূর্তে মনিটরেও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দীপক দৃঢ় গলায় জানায় যে তিনটে ক্যামেরা এমন ভাবে বসানো যাতে ঘরের প্রত্যেকটা কোণ দেখা যায়। দুজনে প্রচণ্ড চিন্তায় পরে যায় কিন্তু ঘর থেকে বেরয় না। এমন সময় বাইরের ঘরে কিছু শব্দ আসে। কিরন ঘর অন্ধকার করে দেয় আর দরজাটা হাল্কা ফাঁক করে দেখে….. দেখে পরী বাইরে!!! কিন্তু..কিন্তু পরী কি ভাবে বাইরে আসবে!!! কিরন নিজের হাতে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে তার থেকেও বড় কথা সে নিজে দরজায় হুড়কো দিয়েছে বাইরে থেকে। এই ভেবেই কিরন তার প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়, তার গায়ের রোম ভয়ে খাড়া হয়ে যায়। তবে কি যে জিনিসের অস্তিত্ব সে এতদিন অবিশ্বাস করে এসেছে তা সত্যি?? বিধাতা এই ভাবে কিরন কে বিশ্বাস করাচ্ছে তার সব থেকে কাছের মানুষ কে দিয়ে!!!!
কিরন সঙ্গে সঙ্গে দীপককে ডাকে এবং দীপক দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখে পরী ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। এই দেখে তারা অপেক্ষা করবে ঠিক করে এবং আবার তারা মনিটরের সামনে এসে বসে। এদিকে কিরন প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আছে কিন্তু দীপক তাকে সাহস দেওয়ার জন্য কফি ঢেলে দেয় তাকে এবং সোজা হয়ে বসে পরবর্তী ঘটনার অপেক্ষা করে।
এদিকে পরী ঘরের মধ্যে পাইচারি করতে থাকে, তার মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকান, খোলা চুল সামনের দিকে ঝুলে আছে। এক হাতে কিরনের হকি স্টিক যেটা সে একটু আগে বাইরের ঘর থেকে এনেছে। কিরনের কেন এইসময় পরীকে দেখে বারবার ইংরাজি সিনেমায় দেখা ভূতে ধরা কোনো মানুষ মনে হচ্ছে, কেন জানেনা এই চিন্তা সে কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারছেনা।
এরপর হটাৎ পরী কাকে যেন ধমকাতে থাকে..
– আপনি আবার এসেছেন!!! কিভাবে বাড়িতে ঢুকছেন?? এত রাতে কেনো আসছেন?? আমি আপনাকে চিনি না।
কিচ্ছুক্ষণ সব চুপ।। এই সময় কিরন আর দীপকের চোখ যেন উত্তেজনায় বিস্ফারিত হয়ে আসে। তারা কোনো মতে উত্তেজনা দমন করে বসে দেখতে থাকে।
– আমাকে নিয়ে যাবেন?? কোথায়?? আমি কোথাও যাবোনা, আপনাকে আমি চিনি না। কাছে আসবেন না আমি চিৎকার করব..
এই বলে পরীর হকি স্টিকটা সামনের দিকে চালায় যেন কাউকে মারার চেষ্টা করছে..কিন্তু সেটা হাওয়ায় ঘুরে আসে এবং দুর্বল শরীরের জন্য হাত থেকে পরে যায়। কিছু সময় চুপ করে থাকার পর হটাৎ পরীর গলা থেকে একটা গোঙ্গানি মত হতে শুরু হয়, সে যেন প্রচণ্ড ভয় পাছে বলে মনে হয়।
– একি আপনার মুখে রক্ত কেন?? রক্তে ভেসে যাচ্ছে আপনার মুখ। আপনি চলে যান আমার ভয় করছে।
এইবার পরী কাঁদতে সুরু করে ভয়ে র অদিকে কিরন আর থাকতে না পেরে পরীর ঘরে জাবে বলে উঠতে জায় কিন্তু দীপক খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কিরনকে শেষ অব্ধি অপেক্ষা করতে বলে। ওদিকে পরী কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– আপনি দয়া করে চলে যান। আমার খুব ভয় করছে.. আমি রক্ত সজ্য করতে পারিনা.. না.. না আমি আপনার মুখের দিকে তাকাব না।
এই বলে পরী কিছু পরে মুখ তুলে সামনের দিকে তাকায় আর প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর দীপক আর কিরন দৌড়ে পরীর ঘরে আসে.. দেখে পরী মাটিতে পরে আছে আর মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। দীপক কোনো রকম অপেক্ষা না করে আম্বুল্যান্সে খবর দেয় ও প্রাথমিক ভাবে পরীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু খুব অবাক হয়ে খেয়াল করে যদি পরী জ্বরের ঘোরে এগুলো করে তাহলে গায়ের তাপমাত্রা যা থাকার কথা তার থেকে অনেক কম। কিন্তু এই নিয়ে বেশি ভাবার সময় ছিল না..

.
১৫ মিনিটের মধ্যে আম্বুল্যান্স চলে আসে এবং দীপকের জোরাজুরিতে পরের দিন দীপকের পরিচিত নার্সিংহোমে এক বিখ্যাত সাইকোলজিস্টের কাছে পরীকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পরীর জন্য চারজনের এক বিশেষ ডাক্তার বোর্ড গঠন করা হয় যার মধ্যে দীপক ছিল এবং ছিল ঐ নার্সিংহোমে যোগ দেওয়া নতুন বিদেশফেরত ডক্টর অভিক ও দুজন বিশেষজ্ঞ সাইকোলজিস্ট। সেই বোর্ড থেকে সমস্ত রকম সাইকোলজিক্যাল টেস্ট করা হয়। কিন্তু এই সমস্যার এর কোনো উপায় পাওয়া যায়না।
ভর্তি হওয়ার দুদিনের মাথায় পরী দুপুরে হটাৎ পাশে থাকা নার্সকে আক্রমণ করে বসে। এরপর পরীর হাত পা নিয়ম অনুযায়ী আটকে দেওয়া হয় এবং পরী প্রচণ্ড কান্নাকাটি করতে শুরু করে। এটা কিরন বা পরীর পরিবার মেনে নিতে পারেনা কিন্তু দীপক তাদের বোঝায় এটা পরীর ভালর জন্য করা হচ্ছে। কিরন এরপর খুবই ভেঙ্গে পরে সমস্ত বিশ্বাস অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে গিয়ে ওঝা এবং পীরবাবা দুই ধর্মের মানুষের আশ্রয় নেয়, সেখানে মানত করা নিয়মিত যাওয়া শুরু করে। কারণ সে পরীর এই কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সে পরীকে কোনভাবেই হারাতে চায়না তার জন্য সব করতে প্রস্তুত।
এদিকে রাতে পরীর কেস ফাইল গুলো দেখতে দেখতে কিছু সন্দেহ হওয়ায় সকালের আক্রমণের সিসিটিভি ফুটেজটা দেখেতেগিয়ে অভিক খুব আশ্চর্য হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দীপককে ফোন করে ঐ রাতের সিসিটিভি ফুটেজটা চেয়ে পাঠায়। অভিক সারারাত ঐ ফুটেজ দেখে বিশ্লেষণ করে এবং তার বিদেশে থাকা কিছু বন্ধু ও প্রোফেসরদের ফোন করে..পরদিন সকালে অভিক পরীর কেবিনে যায় এবং দেখে পরী কাঁদছে আর বারবার নার্সকে বলছে যে, সে পাগল নয় তাকে যেন খুলে দেওয়া হয়। অভিককে দেখেও সে একই কথা বলে। অভিক নার্সকে নির্দেশ দেয় পরীর হাত পা খুলে দিতে। এরপর সে নিজে সামনে বসে পরী কে খাবার নিজে খেতে বলে.. পরী বামহাতে চামচ তুলে নেয় কিন্তু খেতে তার অসুবিধা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে। সেই দেখে অভিক নার্সকে বলে খাইয়ে দিতে। খাওয়া শেষ হলে অভিক পরীর হাতে একটি সাদা পাতা আর পেন্সিল দিয়ে ঘরে থাকা গোল ঘড়িটার ছবি আঁকতে বলে এবং প্রায় সাথে সাথে কিরন ওই ঘরে ঢোকে এবং পরীর হাত পা খোলা দেখে এত দুখহের মধ্যে কিছুটা খুশি হয়..
এরপর পরী বামহাতে পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করে এবং তার পেন্সিল ধরা দেখেই বোঝা যায় যে পরী আসলে ডান-হাতি কিন্তু অভিক কিছু না বলে আঁকা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে..আঁকা শেষ হয় এবং অভিক পাতাটা নিয়ে এক ঝলক দেখে কিরন তার ঘরে আস্তে বলে আর দীপককে ফোনে ডেকে নেয়।

দীপক আস্তেই অভিক পরীর আঁকা পাতাটা দেখায়। দীপক অবাক হয়ে দেখে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা গোল করা আর তার মধ্যে ১ থেকে ১২ সংখ্যা গুলো বামদিকে লেখা ঘড়ির মত পুরো গোল জুড়ে নয়। দীপক অভিককে জিজ্ঞাসা করে…
– এর মানে কি?? কি প্রমাণ হছে এর থেকে..
– এটা কোনো সাইকোলজিক্যাল প্রব্লেম নয় দীপক। এটা আমি একশ ভাগ নিশ্চিত যে এটা নিউরোলজিক্যাল প্রব্লেম..
– মানে?? তুমি কি করে এতটা নিশ্চিত হচ্ছো??
– আমি কাল সারারাত দুটো ফুটেজ দেখে আর আমার বিদেশে থাকা কলিগদের সাথে আলোচনা করে এই ধারণায় এসেছি..
কিরন এতক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর প্রচন্ড উতলা হয়ে পরীর কি হয়েছে যানতে চায় খুব উৎকন্ঠার সাথ। অভিক বলে..
.
– এটা একটা জটিল নিউরো প্রব্লেম যার ফলে অ্যান্টিবোডিসরা ব্রেণ আক্রমণ করে আর যে কোন একটা দিকের কিছু অংশ কাজ করা বন্ধ করে দিতে থাকে এবং পরীর বেলায় সেটা হল ডানদিক। বাংলাদেশে হয়ত পরী এই রোগ এর প্রথম রুগি বা হয়ত পরীর ফ্যামিলিতে কারো এই জিনিস হয়েছিল যাকে পাগল বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই থেকে পরীর এসেছে।
দিপক আর কিরন জানতে চায় সে কিভাবে এটা ধরতে পারল।
অভিক আবার বলতে সুরু করে..
– তোমরা কেউ পরীর আচরণ গুলো ভাল করে খেয়াল করনি। পরী প্রায় সব কাজই বাম হাতে করার চেষ্টা করে গেছে। ডান-হাতি হওয়া সত্তেও, যা একটা অবাক আচরণ যে কোনো মানুষের পক্ষে। আর ঐ রাতে তোমরা এতটাই উত্তেজিত ছিলে যে হকি স্টিকটা পরীর বাম হাতে ধরা ছিল খেয়াল করনি। এমনকি কাল নার্স কে পরী আক্রমণ করে বাম হাত দিয়ে তাও সে বাম দিকে আসার পর। আর আজকের প্রমাণ তো তোমাদের সামনে রাখা আছে এই ঘড়ির ছবি যার সব সংখ্যা বাম দিকে লেখা, কারণ পরীর বাম দিকের ব্রেণ এ কোনো সমস্যা নেই আর তাই ব্রেণ চেষ্টা করছে বেশির ভাগ কাজ বাম দিক দিয়ে করার। পারলে এখন গিয়ে একবার পরী কে দেখে এসো ওর ডান চোখের পাতা পড়ছেনা।
এই সময় কিরন ভীষণ ভয় আর উৎকণ্ঠায় কেঁদে ফেলে এবং অভিকের কথার মাঝে কথা বলে যে..
– কিন্তু সেদিন যে আমি নিজে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করলাম.. সেই দরজা কিভাবে খুললো?? আর পরী কার সাথে কথা বলত?? কাকে দেখে ভয় পেত??
অভিক কিরন ও দীপকের দিকে কম্পুউটারের মনিটর ঘুরিয়ে কিরনের দরজা আটকানোর ফুটেজটা দেখায় যেখানে পরিষ্কার দেখা যায় যে কিরন দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করলেও হয়ত ভাল করে হুড়কোটা দেয়নি যার ফলে দরজা আপনা হতে অল্প খোলা হয়ে থাকে, একটা ঠেলা দিতেই খুলে যায়। তারপর অভিক বলতে শুরু করে…
– এর সিম্পটম হচ্ছে প্রথমে হাল্কা জ্বর হবে, তারপর আস্তে আস্তে ভুল বকা শুরু হবে এবং হ্যালুসিনেসান শুরু হবে। অবচেতন মনে কোনো ঘটনা নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়ে রুগী সেটা কে সত্যি বলে বিশ্বাস করা সুরু করে।
তখন আবার কিরন অভিক কে থামিয়ে বলে..
– কিন্তু ও যে রক্তমাখা একটা মানুষ কে দেখছে তার সাথে কথা বলছে???
অভিক বলে..
– হ্যাঁ সেটা আমি আজ সকালে পরীর মা কে ফোনে করে জেনেছি যে পরীর ১০ বছর বয়সে ওর সামনে একটা রোড অ্যাক্সিডেন্ট হয় যেখানে লোকটির মুখটা থেঁৎলে যায় আর রক্তে ভরে যায় মুখটা। আসলে আমাদের ব্রেণে অনেক প্রকোষ্ঠ আছে আর তাতে আমাদের সব ঘটনার স্ম্রতি জমা থাকে। কোনো বিশেষ সময়ে কিছু স্ম্রেতি বেরিয়ে আসে যেমন এই ট্রমাটা এতদিন পর অর ব্রেণ এফেক্টে বেরিয়ে এসে ঐ রক্ত মাখা মানুষটিকে তৈরি করেছে ওর অবচেতন মন। এছাড়াও ছোট খাটো ভুলে যাওয়া, খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হওয়া, প্রত্যেকটা সিম্পট্ম মিলে জাচ্ছে এর সাথে। আর ঐ পিয়ানো বাজানোর মত আঙ্গুল নাড়ানো বা ডুয়াল পার্সোনালিটি ডিসিসের মতো অন্য গলায় কথা বলা ধরে নেওয়া যায় এটা এর ই সিম্পটম যা আগে কারোর দেখা যায়নি কারণ সারা বিশ্বে এর রুগী খুবই হাতে গোণা।
দীপক আর অভিক তখন আলোচনা শুরু করল..
– তাহলে আমাদের এখন কি করা উচিত??
– আমি কিছু স্পেশালিস্টকে এই বিষয়ে বলেছি বাংলাদেশেই আমরা অপারেশণ করব.. আসা করছি কোনো সমস্যা হবেনা..
এরপর কিরন এর দিকে অভিক তাকিয়ে বলে..
– শোনো কিরন ব্রেণ হছে মহাকাশ আর মহাকাশের মত এর অনেক রহস্য আজো আবিষ্কার হয়নি। ভয় পেয়না..
.
.
এরপর কিছুদিনের মধ্যে পরীর খুব ভাল ভাবে অপারেশণ হয়। একমাস পর পরীকে যেদিন নার্সিংহোম থেকে ছাড়া হয় সেদিন কিরন অভিক এর হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলেছিল কৃতজ্ঞতায়।
.
তারপর এক রাতে ঘড়িতে তখন রাত ৩.২০ কিরনেরর ঘুমটা ভেঙ্গে যায় এবং দেখে পরী বিছানায় বসে আছে এবং বাম দিকে হাত বাড়িয়ে কি যেন করতে যাচ্ছে। কিরন খুব ভয় পেয়ে আস্তে করে ডাকে..
– পরী?? কি করছ??
পরী কিরনের এর গলার আওয়াজ শুনে তার দিকে তাকিয়ে দেখে বেচারার মুখটা ভয়ে আর চিন্তায় সাদা হয়ে গেছে। এই দেখে পরীর খুব কষ্ট হয়। তার মনে হয় যে এই মানুষ টার উপর সব থেকে বেশি ঝড় বয়ে গেছে। তখন কিরনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে..
– আমি তো টেবল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে জল খেতে যাচ্ছিলাম। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আর চিন্তা করোনা..
বলে কিরনের কপালে একটা চুমু দেয়..
কিরন ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারে যে তার পরী আবার আগের পরী হয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে আর তার কোনো শরীরে সমস্যা নেই। কিরন এর মুখটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায় ও শান্তির ঘুম নেমে আসে চোখে…

********************************((  সমাপ্ত  ))***********************************

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত