২০০৮, বরিশাল ক্যাডেট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর মোটামুটি সবার মুখে একটি কমন শব্দ ছিল তখন জ্বীন।
আর না থাকার কোনো কারণও ছিলনা, নিজেদের ক্লাসমেট যদি দাবি করে তার কাছে জ্বীন আসে এবং যদি রাতে তার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।
এতে বলা যায় কলেজ অথরিটি একটু শান্তিতে ছিল, কারণ রাতের বেলার শয়তানি কমে যায় ক্যাডেটদের।
তো যার কাছে তেনারা আসেন, তার নাম আমি আজ বলবোনা, ধরে নেই তার নাম “মনা ভাই”।
মনা ভাই ছিলেন খুলনার ছেলে, তো তার রুমমেটরা ক্লাস ইলেভেনে থাকতেই ক্লিয়ার হয়ে যায় যে,
মনা ভাই এর কাছে জ্বীনদের আসা যাওয়া খুবি কমন একটা ব্যাপার।
ক্লাস ১২ এ ওঠার পর এটা আরো সাংঘাতিক হয়ে যায়। তার রুমমেটরা ঘুমাতে শুরু করে আমাদের হাউজে,
তখন রাতে প্রতিদিন প্রেপ থেকে আসার পর ৩০৫ কিংবা ৩০৪ নাম্বার রুমে জ্বীন ভুত নিয়ে আলোচনা হয়, এর মাঝে উঠে আসে কারো ব্যাক্তিগত এক্সপেরিয়েন্স।
যেমন মারুফকে রাতে দূর থেকে ডাকা হয় “”এই ম্যারুফফফফফফফ””, এভাবে।
কেউ টয়লেটে গিয়ে দেখে টয়লেট খালি কিন্তু কল খোলার শব্দ। আবার অনেকের চানাচুর শেষ হয়ে যায় কিন্তু প্যাকেট থেকে যায় তার লুকানো যায়গায়।
তখন একা একা কাউকে হাউজে দেখা যায়না, ৩ জন কিংবা ৮ জনের গ্রুপ থাকেই, নিচের হাউজ এ ২/৩ টা রুম খালি
কিন্তু উপরের হাউজে ফ্লোরিং করেও ৫/৬ কিংবা তারো বেশি ক্যাডেট থাকে।
একদিন আমার মাথায় চিন্তা আসলো, সবাই যেহুতু এত সিরিয়াস এই ব্যাপারে, একটু মজা নেয়া যাক তাহলে।
ঘটনা ১: প্রেপের পর অন্যদিনের মত সেইদিন ও সবাই বসে আছে ৩০৫ নাম্বার রুমে, আমি লাস্ট বেডের একেবারে কোনায় বসে আছি। রুমে আরো ১০/১১ জন।
আমি একটু ভুতের গল্প উঠাইয়া দিলাম। জমাইয়া গল্প চলতেসে, কেউ কেউ খাটের নিচে, লকারের পাশে একটু চেক করে আরামে নিশ্বাস ছারতেসে, এমন অবস্থায় আগমন আমাদের রেজা’র।
খুব রাগ তার চোখে মুখে, কাউকে যেন খুজতেসে। আমার দিকে চোখ পড়লে সে আরো রেগে যায়, চিল্লাচিল্লি শুরু করে, আমি নাকি ওর রুমে গিয়া ওর বাপ-মা তুলে গালিগালাজ করসি।
এবং ও ছিল খুব সিরিয়াস এবং হাতে ছিল ম্যাকগাইভার নাইফ, সবাই জিজ্ঞাস করলো কখন ঘটলো এই ঘটনা।
বললো দুই মিনিট আগে, সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো, কেউ কেউ নামাজে দাড়ানোর সময় যেমন ফাকা রাখেনা সেরকম নিজেদের মাঝেও কোনো ফাক না রেখে কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রেজা তো আমাকে নাইফ দিয়ে মেরেই ফেলবে।
সবাই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে, আমি এখানে ছিলাম ১০ টা থেকে , এমনকি টয়লেট ও যাইনাই।
রেজাতো বুঝেনা, অনেক কষ্টে করে তাকে বোঝানো হইলো যাতে আমার সাথে কিছুক্ষণ ব্যাক্তিগত ভাবে কথা বলে, এবং আমি তাকে সব বুঝাইয়া বলতে পারি।
এর মাঝে অন্য হাউজেও কাহিনী চলে গেসে। বুদ্ধিজীবিরা চলে আসলো, অনেকে বললো এটা হেলুসুনেশন, কেউ বললো মনা ভাই এর কারসাজি,
কারণ মনা ভাই এর সাথে আমার সকালে কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হয়েছিল।
বলে রাখা ভালো তার সাথে কেউ বাজে ব্যাবহার করলে সেদিন কিংবা কিছুদিনের মাঝে সমস্যায় পড়ে,
এর জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের মাজহার এবং আব্দুল্লাহ,
মাজহার জোক্স করতে গিয়ে কার সাথে রসিকতা করেছে সেটা খেয়াল করেনাই,
সে মনা ভাইকে বলেছিল, ” মনা আজ তো আবহাওয়া ভালো, কয়েকটা জ্বীন ডাউনলোড করে ফেল।”
পরের ঘটনা আর কিছুইনা, মাজহার পরের দিন অনেক জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
আবদুল্লাহ কি বলেছিল বা কি করেছি তা মনে নাই।
শুধু মনে আছে যা করেছিল বা বলেছিল তা মনা ভাই এর সাথে যায়না, কথার মাঝে পর্যাপ্ত সম্মান এবং
আদবের ঘটিতি থাকার কারণে, ফুটবল খেলতে গিয়ে আবদুল্লাহ’র পা ভেঙ্গে গিয়েছিল কিংবা প্রচুর আঘাত পেয়েছিল।
তো আসল কাহিনীতে আবার ফিরে যাই।
আমাদের আজিম আবার খুলনার মনা ভাই এর আশে পাশেই থাকে। এবং পারিবারিক ভাবে তাদের সম্পর্ক ভালো।
সে আমাদের একটা কাহিনী খুলে বললো, মনা ভাইদের এই জ্বীনের ব্যাপারটা নতুন কিছুনা, এটা বেশ কয়েক যুগ ধরেই চলে আসছে,
মনা ভাই এর বর্তমান জ্বীনটি তার দাদার কাছ থেকে পেয়েছেন, এবং এনারা ক্ষতি করেননা।
ভোল্ডেমর্টকেও হোগার্টস এর বাচ্চারা এত ভয় পেতনা, যেটা তারা পাওয়া শুরু করলো মনা ভাইকে দেখে।
আমি আর রেজা একটূ পর একান্ত ভাবে কথা বলা শুরু করলাম।
রেজাঃ দোস্ত কাহিনীতো ভালো জমসে।
আমিঃ আরে সে রকম, তুই দারুণ অভিনয় করসস। এখুনি ফাস করিসনা, কালকে আরেকটা খেলা আছে সেটা খেলতে হবে।
তুই মনা ভাই এর সাথে কালকে একটু ঝামেলা করিস যেন সবাই দেখে।
হাউজে তখন বিভিন্ন কাহিনী শুরু হয়েছে, কেউ বলতেসে আমি ৩০৫ এ ছিলাম,
কিন্তু কেউ একজন আমার রূপ ধরে ৩০২ এ গিয়ে রেজাকে গালি দিল তার পর কই গেল কেউ জানেনা।
কেউ বললো রেজাকে গালি দেয়ার পরো আমার বেশ যে ধারণ করেছিল সে দাঁড়িয়ে হাওয়া হয়ে যায়। এভাবে ওইদিন রাত পার হয় অনেক ভয়ে ভয়ে।
পরের দিন ক্লাসে গিয়ে এসব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। একাডেমি শেষ হয় শেষ হয় গেমস, মাগরিব শেষে চলে আসে প্রেপ।
আর আমাদের ঘটনা দুই শুরু হয় এখান থেকেই।ঘটনা দুইঃ গতকালকের কাহনী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ৩০৫ এ।
গতকালকের ভিকটিম রেজাও সেখানে উপস্থিত। সে ডিনার এর পর সবার সামনে মনা ভাইকে ধকম দিয়ে আসে, সে যেন আর এইসব আজেবাজে জ্বীনের খেলা না দেখায়।
রেজা ওইদিন আসরের মধ্যমণি, কারণ সে রাতেও কিছু বাজে স্বপ্ন দেখে।
ওর স্বপ্নের কথা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল,
এমন সময় মামুন আসে রুমে দৌড়াতে দৌড়াতে।
মামুনঃ রেজা আমার বই দে জোক্স করিসনা, আমি পড়তেসি।
রেজাঃ মানে?? কিসের বই ? কখন নিলাম??
মামুনঃ আরে ভাই প্লীজ, বুঝছি তুই অনেক জোকার, এখন আমার বই দে। আমার পড়া বাকি।
রেজাঃ হা হা হা, ভাই কি কস এইগুলা? কি খাইসস?
মামুনের মতে ঘটনা এমন যে, একটু আগে রেজা ওর রুম থেকে ওর বই জোর করে আমাদের হাউজে চলে আসে।
তো আমি বললাম,তুই আরবী ছুইয়া বল যে, রেজা তোর কাছে থেকে বই নিসে ।
মামুন আরবী ছুইয়া বললো, এই মাত্র ৩/৪ মিনিট আগে রেজা ওর কাছ থেকে বই নিয়া আসছে।
সবাইতো অবাক, এইটা ক্যামনে সম্ভব রেজা তো এখানে বসা আমাদের সাথে আর মামুন আরবী ছুইয়া মিথ্যা কথা বলবেনা।
তাহলে!!
তাহলে কি মনা ভাই এর কাজ এটা??
মামুনকে সবাই কাহিনী খুলে বললো যে, রেজা এখানে প্রেপের পর থেকেই আমাদের সাথে বসা, কোথাও যায়নাই।
সাথে সাথে মামুনের বুকে ব্যাথা শুরু হইলো সে বেডে শুয়ে পড়লো।
শ্বাস নিতে কষ্ট হুইতেসে, নিচের হাউজ থেকে ওর রুমমেট দুজন এসে হাতে পায়ে তেল মালিশ করতেসে।
কেউ খাতা, কেউ পাতলা বই দিয়ে বাতাস দিতেসে, আর সবাই আতংকে অস্থির।
মামুন পানি চাইলো, খাওয়ার জন্য একজন পানি দিল, হঠাৎ করে ওর বমি আসলো,
বাইরে গিয়ে বমি করবে, আমি বললাম করিডর এর লাইট জ্বালাতে।
বমি করার জন্য বিন এর সামনে গিয়ে দেখে ওখানে রক্তাক্ত প্রান্তর, যেই বইটা ওর কাছ থেকে রেজা নিয়ে আসছিলো।
একেতো কাহিনী সুবিধারনা তার মাঝে আবার যে বই নিয়া কাহিনী সেটা আবার রক্তাক্ত প্রান্তর।
প্রচ্ছদে রক্তের ছবি।
সবাই ভয়ে অস্থির একি হলো, কলেজে থাকবে নাকি চলে যাবে এই অবস্থা।
তার ৫/৬ দিন পর আমি সব ক্লিয়ার করে দিলাম,
যে রেজা নামে একজন ওর কাছ থেকে বই নিয়েছে ঠিক।কিন্তু সেটা আমাদের রেজা না,
সেটা ক্লাস ৯ এর রেজা তাই মামুন আরবী ছুয়ে যা বলেছে তা সত্য। আর এই কাহিনী আমি, রেজা, মামুন এবং মুস্তাকীম জানতাম।
আমাদেরি বানানো কাহিনী। মামুন অসুস্থ হয়নাই এগুলা ওর বানানো। ও ইচ্ছা করে বমি করোতে গেসিলো কারণ বইটা আগে থেকেই ওখানে রাখা।
এরপর আমার সাথে কয়েকজন কথা বলা বন্ধ করে দিল, আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম,
মনা ভাই এর সাথে আসলে কিছু নাই সেটা বোঝানোর জন্যি এগুলা আমি করসি।
ওরা কি আর সেটা বোঝে, ওরা ভাবসে ওদের সাথে যা করসি সেটা ভূল।
পরে আমার সাথে ওরা নরমাল হলো আমাদের এক্সকারশান এর দিন থেকে, মানে প্রায় ১০ দিন পর।