*****জুলাই মাস। আমার তখন মাত্র বিয়ে হয়েছে।
আমি চিটাগাং এ থাকতাম, আমার হাজব্যান্ড ইউ, এস থেকে এসছিলেন….,
তাই যতদিন থাকবে তার বোনের বাসায় থাকার ব্যাবস্থা করা হল।
আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে পরদিন দুপুরে সব বরযাত্রী সহ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ঢাকা এসে পৌছলাম রাত প্রায় ১ টা।
ছোট আপার (আমার ছোট ননাস) ফ্ল্যাট বড় মগবাজারে বেশ পুরোনো একটা বিল্ডিং এর চার তলায়।
প্রায় দশ বছর ধরে এই বিল্ডীং এই আছেন তারা।
চটচটে গরমের একটা রাত, সারাদিন এর জার্নির পর আমি পৌছেই অস্থির হয়ে গেলাম গোসলে যাওয়ার জন্য।
পুরোনো হলেও যথেষ্ট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাথরূমের শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে অনেক্ষন ভিজলাম।
গোসলের মাঝখানে হঠাৎই কাপড়ের স্ট্যান্ড থেকে কোন কারন ছাড়াই আমার শুকনো কাপড়গুলো মেঝেতে পড়ে গেল।
তাড়াতাড়ি উঠিয়ে ভাল করে গুঁজে রাখলাম যাতে আবার না পড়ে যায়।
গোসল শেষে কাপড় পড়ে দরজা খুলতে গিয়ে দেখি- ছিটকিনিটা নামানো, অর্থাৎ বাথরূমের দরজা শুধুমাত্র ভেজানো ছিল, খিল খোলা।
প্রথমে ভাবলাম, পুরোনো বাড়ীর ছিটকিনি হয়ত ঢিলে হয়ে নেমে গেছে।
তারপরও নিজের উপর ভিষন রাগ হল, এতবড় জিনিস কি করে খেয়াল করলামনা, ভেবে। লজ্জায় এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বললাম না।
ছোট আপার একটাই মেয়ে, সুজানা। প্রায় আমার সমবয়সী। তার সাথে দিন রাত অনেক মজা করে গল্প করে দিন ভালই কাটতে লাগলো।
অন্য আরেকদিনের ঘটনা। ছোট আপা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। তবে কখনো তার কাজ বা কথার শব্দ আমাদের কামরায় পেতাম না।
সেদিন সকালেই শুনি ছোট আপা কথা বলছেন জানি কার সাথে। চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে দেখেই আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
আমাদের বেডরুমের দরজা হাট করে খোলা। শুধু লক খোলা না, কপাট খুলে পুরো ঘর উন্মুক্ত, এই কারনেই বাইরের সবার আওয়াজ পাচ্ছি।
সাথে সাথে উঠে দরজা লাগিয়ে দিলাম।আমার স্পষ্ট মনে আছে, রাতে দরজা লাগিয়ে ঘুমুতে গেছি। কেমন যেন খটকা লাগলো।
ওকে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে বললাম- “এই তুমি এই ভাবে দরজা খুলে রেখেছ কেন?”
ও আধো ঘুম থেকে জাগতে জাগতে বলল- “কই আমি তো খুলিনি? তুমি না আটকে শুলে?” দরজাটা ছিটকিনির ছিল না।
সেটা ছিল আধুনিক অফিস ডোর লক যা ভেতর থেকে টিপ দিয়ে বন্ধ করতে হয়।
এখানে ছিটকিনি ঢিলে হয়ে নেমে যাওয়ার মত কিছুই নেই।
এমনকি, যদি দরজা অল্প খুলেও যায় কপাট এভাবে খুলবে যদি কেউ হাত দিয়ে ঠেলে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে।
এই ঘটনায় আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম।
ঘটনাটা আমি সুজান কে বললাম হাসির ঘটনা হিসাবে। দেখলাম, অন্য অনেক কথার মত সুজান হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়লোনা।
একটু কেমন যেন গম্ভীর হয়ে শুনলো। পরে অন্য কথায় চলে গেল।
এর মধ্যে বেশ ক’বার দুপুরে গোসলে গিয়ে হঠাৎই কোনো কারন ছাড়া শুকনো কাপড় মেঝেতে পড়েছে।
আর আরো দুইবার বাথরুমের ছিটকিনি খোলা অবস্থায় পেয়েছি, যে সময় আমি নিশ্চিত আমি ঠিক করেই ছিটকিনি তুলেছি।
ভেবেছি, পুরোনো ছিটকিনির কোনো কব্জার দোষ।
প্রতিবার ভাবি, আপাকে বলব, বা ওকে বলব একটু মেরামত করে দিতে, কিন্তু আর বলা হয়নি।
আরেক রাতের ঘটনা। ভীষন গরম পরেছে। তাও মশারী খাটিয়ে শোওয়া ছাড়া উপায় নেই।
গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে মশার উৎপাত। ভাল করে মশা দেখে নিশ্চিত হয়ে ঘুমালাম যে মশারীর ভেতর আর কোনো মশা নেই।
অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মশার কামড়ে অতিষ্ট হয়ে আমি আর আমার স্বামী দুজনেই উঠে বসলাম।
বিরক্ত হয়ে সে বলল- “তুমি কি সব মশা মারনি? এত মশা এল কোত্থেকে?”
আমি বললাম-“আমি তো মেরেইছি। আবার ঢুকেছে নিশ্চয়।” বেড সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
দেখলাম, আমার দিক কার মশারী, যা বিছানার তোষক নয়, ম্যাট্রেসের নীচে ভাল ভাবে গুঁজে আমরা শুই, পুরোটাই খোলা, মেঝেতে লুটোচ্ছে।
তাও শুধু আমার দিকের, একেবারে মাথা থেকে পা অব্ধি।
এই মশারী ম্যাট্রেসের নীচ থেকে টেনে বের করতে রীতিমত কায়দা করতে হয়, নয়ত মশারী ছিঁড়েই যাবে।
ও আমাকে বিরক্ত হয়ে বল্ল- “একি তুমি দেখছি মশারী না গুঁজে শুয়ে পড়েছো!”
এই কাজটাও আমি কোন জন্মে করবোনা, এমনকি, উঠতে হলেও অল্প একটু মশারী তুলে,
নেমে গিয়ে সাথে সাথে আবার গুঁজে দিই, এর অন্যথা কখনো হবেনা। আমি আমার স্বামীকে বলতেও সে তেমন গা করলো না।
আমার দ্বায়িত্বহীনতায় খানিকটা সন্দেহ আর বিরক্তি নিয়েই ঘুমুতে গেল।
পরের দিন সকালেই নাস্তার টেবিলে হাসতে হাসতে কাল রাতে আমার “ভুলো মনের” ঘটনাটা আমার স্বামী সবাইকে বলল।
আমি একটু স্বপক্ষে বললাম, কিন্তু কোনো যুক্তি খুঁজে না পাওয়ায় তেমন জোর পেলাম না বলায়।
সুজানা আর তার মা, মানে ছোট আপা, দেখলাম চোখাচোখি করল, অন্য কিছুর মত হাসলোনা।
এবার সেই রাতেই। আমি ঘরে বাতি নিভিয়ে শুয়ে গান শুনছি। রাত ১০টার মত হবে। ঘরের পাশে একটা লাগোয়া বারান্দা।
ঐখানের বাতি জ্বলছে শুধু। হঠাৎ আমার চোখ আপনাতেই চলে গেল সেদিকে।
আমার তীব্র ভাবে মনে হতে থাকলো, বারান্দায় কেউ আছে। অপরিচিত। একটা অদ্ভুত আতঙ্ক খামোখায় ঘিরে ধরল আমাকে।
আমি বেশীক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। ঐ ঘর থেকে বেরিয়েই এক ছুটে সুজানার ঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সুজানা কে বললাম- “সুজানা, আমি জানি এটা খুব বোকার মত শোনাবে কিন্তু আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে।
মনে হছে বারান্দায় কেউ আছে, আমার অপরিচিত, আর কম বয়স্ক একটা ছেলে। আমার এমন আগে কখনও মনে হয়নি।
কিন্তু এই ফিলিংসটা খুব রিয়েল।”
ভেবেছিলাম সুজানা ভিষন হাসবে আর ঠাট্টা করবে।
কিন্তু ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল- “মামী, তুমি একা না, এই বাড়ীতে আরো অনেকেই এইটা দেখেছে।
আমি নিজেও অনেক অদ্ভুত ঘটনার সামনে পড়েছি।
আম্মুকে বললে বলে- আমরা গল্প শুনেছি এই বাড়ী সমন্ধে, তাই এই সব মনে ছাপ ফেলে নানা কিছু দেখি, ভাবি।
কিন্তু তুমি তো এসবের কিছুই জাননা, নতুন এসছ। এখন তুমিও এই সব দেখছ। আম্মু কে আমি আজই বলব।”
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে এই বাড়ীর। সে যা বলল তা মোটামুটি এ রকম-
এই বাড়িতে ছাদে অনেকেই দূর থেকে অনেককে দেখে, যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই।
প্রায় সময় ছাদের রেলিং এ দেখা যায় একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বহু বার গভীর রাতে প্রত্যেক ফ্ল্যাট থেকে সবাই শুনে উপর তলায় কেউ মসলা পিষছে। ঘটর ঘটর করে।
কৌতুহলি হয়ে অনেক ভাড়াটে এক সাথে মিলে ছাদে গিয়ে দেখে এসছে, কেউ নেই। কিন্তু সেই অদ্ভুত আওয়াজ চলছেই।
এছাড়াও আপনা আপনি বাতি নেভানো জ্বালানো, ছিটকিনি খোলা বন্ধ হওয়া এই সব প্রায় সব বাসিন্দাই পেয়েছে।
সুজানা নিজে বহুবার বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে গিয়ে মাঝ রাতে বাতি জ্বলে উঠতে দেখেছে।
আরো একবার সে নাকি পাশ ফিরে শুয়ে ছিল, হঠাৎ ধপ করে তার বিছানার কিনারে কেউ একজন এসে বসেছে।
আর পড়তে বসে প্রায়ই তার অনুভুতি হয়, তার ঘরে আরো একজন আছে, যে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এত গল্পের সব বলতে গেলে আরো দশ পাতা লিখতে হবে।
তার চেয়ে সব চেয়ে ভয়ঙ্কর যে ঘটনাটা আমার কাছে মনে হয়েছে সেটা বলি।
এই বাড়ীর ঠিক এই ফ্ল্যাট এ থাকতো আরেকটা পরিবার। বাবা, মা ছেলে মেয়ে আর তাদের দাদী।
দাদী অনেক রাত পর্যন্ত নামাজ কালাম পরে ঘুমাতে যান।
একদিন ভোরে তার চিৎকারে সবাই সেই ঘরে এসে দেখতে পান, দাদী আলুথালু হয়ে বিছানায় বসে আছেন। অপ্রকৃতস্থ।
শুন্য দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু একটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন।
আর সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার, তার মাথার সব চুল জট পাকানো।
এমন জটা পাকানো যেন কয়েক বছর কেউ গুহা বাসী হয়ে থাকলে, জল চিরূনী স্পর্শ না করলে এমন টা হতে পারার কথা।
এক রাতের ভেতরে এই রকম জটা ধরে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব।
পরে তারা এই জট কাচি দিয়ে কেটে ধুয়ে আঁচড়ে বহু কষ্টে ঠিক করেন, কিন্তু দাদীর মাথা ঠিক হতে প্রায় কয়েক বছর লেগে যায়।
এর পরে কেউ তা জানতে চায়নি পাছে তিনি আবার পাগল হয়ে যান, এই ভয়ে।
আমার সব শেষের একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করব। আমার স্বামীর ইউ,এস চলে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসছে।
এক রাতে, হঠাৎ আবারো সেই অনুভুতি নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কেউ একজন আছে আমার ঘরে।
এবার অনুভুতিটা খুবই তীব্র। এমনই যেন আমার পাশেই আমি টের পাচ্ছি অন্য কারো অস্তিত্ত্ব।
বারান্দার হাল্কা একটা আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই ঘরে। ঐ আলোতেও তবু ঘরের ভেতরটা বেশ ভালোই দেখা যায়।
পাশে শুয়ে থাকা আমার স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে গিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ধ্বক করে উঠল হৃদপিন্ড।
ঠিক আমার স্বামীর চেহারার উপর আরেকটা ধোঁয়াটে চেহারা ভাসছে, যেটা একটা কম বয়স্ক ছেলের।
আমি শুধু দেখেছি, এই চেহারার চোখ খোলা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে,
আর আমার স্বামীর চোখ সে ধোয়াটে চোখের নীচেই, বন্ধ।
সে ঘুমুচ্ছে, কিন্তু অন্য মুখটা জেগে ঠিক আমার দিকেই তাকিয়ে আছে, আর তাই আমি এই অনুভুতি নিয়ে জেগে উঠেছি।
প্রচন্ড আতঙ্কে আমি ছিটকে সরে গেলাম এক পাশে।
তখনই ও জেগে উঠল আর সে জেগে উঠতেই ঐ ধোঁয়াটে মুখটাও অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি তাকে বললাম সব।
সে আমাকে বলল- এই সব মনের ভুল, ঘুমিয়ে পড়।
এরপর আমি চলে এলাম চিটাগাং, আপারা পরে ঐ বাসা ছেড়ে বনানীতে চলে যায়।
আজ এখনো ঐসব কথা আমার স্বামী ভাবে আমার মনের ভুল, কেউ কেউ তার যৌক্তিক ব্যাখা দেয়।
কিন্তু আমি জানি, আমি কি দেখেছি, আমি কি অনুভব করেছি, যার কোনো ব্যাখা কোনো যুক্তি আমি এখনও দাঁড় করাতে পারিনি।