ঘাসের উপর দুটো ঘুঘু পাখি বসে আছে। দৃশ্যটা অদ্ভুত।
ঘুঘু নির্জনতাপ্রিয় পাখি, এই ভিড়ে বসে থাকার কথা না। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড মানেতো রীতিমতো বাজার।
এই হট্টগোলে নিশ্চিন্তমনে পাখিদুটো ঘোরাফেরা করছে।
ঢাকা শহরে লোকের ভিড়ে থেকে এ দুটো পাখির সাহস বেড়ে গেছে, তাই মানুষের আসা-যাওয়া কেয়ার করছে না।
কিংবা গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে এই ব্যস্ত নগরে এসে পাল্টে যাওয়া মানুষগুলোর মতো এ পাখিগুলোরও স্বভাব পাল্টে গেছে।
কথায় বলে ভিটেয় ঘুঘু চড়ানো। এ কথা বলে হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, এমনই দুরবস্থা করা হবে যেন ভিটেমাটি খালি পড়ে থাকে।
সেখানে সকাল বিকেল ঘুঘু পাখি মচ্ছব করবে। বাংলার এ প্রবাদ থেকে বোঝা যায়, ঘুঘু পাখি নির্জনতা পছন্দ করে।
তাহলে বেলা এগারোটায় এই হৈচৈয়ের মধ্যে পাখিদুটো কী করছে?
কপাল কুঁচকে ভাবতে থাকে তন্ময়।
পাখি দুটোকে দেখে প্রিয় কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুলার একটি কবিতা মনে পড়ে গেল,
“থাকুক আমার এটুকু স্মৃতি থাকুক
একলা থাকার খুব দুপুরে
একটা ঘুঘু ডাকুক….”
এ কবিতাও কী ঘুঘুর নৈশব্দ প্রিয়তাই প্রমাণ করছে না?
টানা এক ঘন্টা ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়। এই এক ঘন্টায় চার কাপ চা আর পাঁচটি সিগারেট শেষ করেছে।
এখন বসে বসে কবিতা আউড়ানো ছাড়া আর করার কিছু নেই।
আমিনুলের দেখা নাই। কোনো অ্যাসাইনমেন্টেই সময়মতো পৌছায়না বলে বদনাম আছে আমিনুলের।
গতকাল রাতে চিফ রিপোর্টার এই অ্যাসাইনমেন্টটা আমিনুলকে দেওয়ার সময় প্রতিবাদ করেছিলো তন্ময়।
জিয়ার ডে অফ থাকায় সকালে আমিনুল ছাড়া আর কোনো ফটোগ্রাফার ফ্রি ছিল না। বাধ্য হয়ে তাকেই মেনে নিতে হয়েছে।
রাতে অফিস থেকে বেরুবার সময় বার বার করে বলেছিলো, ঠিক সকাল দশটার মধ্যে মেডিকেলে পৌছে যেতে।
তখন দাঁত কেলিয়ে আমিনুল বলেছিলো,
–ওক্কে বস, কোনো চিন্ত কইরেন না। দশটায় ঠিক পৌছায়া যামু।
এখন এগারোটা বাজতে চললো, কোনো খবর নেই। মোবাইলে ফোন করলে বলছে- সংযোগ দেওয়া সম্ভব না।
বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চক্রবৃদ্ধিহারে মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
রঞ্জুর ফ্রাস্ক থেকে আরেক কাপ লেবু চা খাবে কিনা ভাবতে ভাবতে প্যাকেট খুলে সিগারেট বের করে তন্ময়।
গত এক ঘন্টার বিরক্তিকর মুহুর্তগুলোতে কিছুটা বিনোদন যুক্ত করেছে এই রঞ্জু। দেখতে ছোটখাট হলে কি হবে, একজন পাঁকা ব্যবসায়ী।
সুযোগ পেলেই গ্রাহককে নয়-ছয় বুঝিয়ে বোকা বানাচ্ছে।
একটু আগেই ইমার্জেন্সিতে গুরুতর আহত মধ্যবয়স্ক এক লোককে নিয়ে ঢুকলো কয়েকজন।
কিছুক্ষণ পর ওই দলের তিন যুবক বাইরে এসে সিগারেট ধরায়। পাশেই ঘুরঘুর করছিলো রঞ্জু। যুবকদের দুজন কাছ থেকে চা নিয়ে খেতে থাকে।
অন্যজন সম্ভবত চা রসিক নন। চা পানের ফাঁকে ফাঁকে চলছিলো উত্তেজিত বাক্য বিনিময়।
একটু দূরে থাকায় তাদের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে না পেলেও তন্ময় বুঝতে পারে, যুবকেরা একইসঙ্গে কোনোকিছু নিয়ে উত্তেজিত এবং উদ্বিগ্ন।
কথার ফাঁকেই একজন চায়ের দাম পরিশোধের জন্য বিশ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দেয় রঞ্জুর দিকে।
আর ওই পিচ্চিও দু কাপ রং চায়ের দাম আট টাকার বদলে বার টাকা রেখে আট টাকা ফেরত দেয়।
একটু দূর থেকে পুরো বিষয়টি লক্ষ্য করে তন্ময়।
প্রথমে ভেবেছিল ছোট মানুষ, ভুল করে আট টাকা দাম রাখার বদলে আট টাকা ফেরত দিয়েছে।
কিন্তু একটু পরেই আরেকটি দলের কাছে চা বিক্রি করতে গিয়ে একই কান্ড ঘটায় রঞ্জু। এবার তার কপাল খারাপ।
টাকা গুনে বাকি টাকাটা ফেরত চাইলো গ্রাহক। ভুল হয়ে গেছে, এমন একটি ভঙ্গী করে সঙ্গে সঙ্গেই টাকা ফেরত দিলো রঞ্জু।
অন্য যে কেউ এ ঘটনায় মনে করবে ভুল করে বুঝি চা বিক্রেতা কম টাকা ফেরত দিয়েছে,
কিন্তু পর পর দুটি ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে বলেই তন্ময় জানে, এটা পিচ্চি চা ওয়ালার বিজনেস ট্রিক।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা গুরুতর আহত বা অসুস্থ্য রোগীর শঙ্কিত ও শোকাহত স্বজনদের তুচ্ছ টাকা-পয়সার হিসেব মাথায় না থাকাটাই স্বাভাবিক।
এ সুযোগে দিব্যি টু পাইস কামিয়ে নিচ্ছে রঞ্জু মিয়া। টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে যতোই ছল-চাতুরি করুক, রঞ্জুর চা টা খেতে বেশ।
আরেক কাপ খাওয়া যেতে পারে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তন্ময়।
সময় কাটানোর জন্য রঞ্জুর সঙ্গে আলাপ জুরে দেয়।
–‘কতোদিন ধইরা চা বেচস?’
–‘এই ধরেন চাইর-পাঁচ বচ্ছর’
রঞ্জর বয়স হবে বড় জোর দশ। চার-পাঁচ বছর ধরে চা বিক্রি করছে? হাসি চেপে আলাপ চালিয়ে যায় তন্ময়,
সময়তো কাটাতে হবে! আর তা ছাড়া রঞ্জুর কথা বলার ভঙ্গিটাও বেশ মজার।
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষন ভেবে নেয়;
যেন একটি ভাবগম্ভীর প্রেস কনফারেন্সে বসে ঘাঘু সাংবাদিকের জটিল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
–‘দিনে কয় টাকা লাভ হয়?’
–‘পঞ্চাশ-একশ ট্যাকা।’
এরপর আর আলাপ এগোয় না। গ্রাহক ধরতে ব্যাস্ত হাতে ছুটে যায় রঞ্জু। সেটাও একটা দৃশ্য বটে।
প্রায় নিজের সমান দৈর্ঘের ফাস্কটি কী অনায়াসে বয়ে বেড়াচ্ছে।
–‘ভাই, পাঁচশ টাকার ভাংতি হবে?’
মাধ্য বয়সী লোকটা কিছুক্ষন ধরেই এখানে-সেখানে ভাংতি খুঁজছেন। এবং যথারীতি কোনো দোকানদারই তাকে ভাংতি দিচ্ছে না।
এদিকে যে সিএনজিতে করে তিনি এসেছেন সেটা আবার যাত্রী তুলে নিয়েছে। এখন তাড়া দিচ্ছে ভাড়া পরিশোধের জন্য।
ঘটনার চাপে লোকটি ক্রমেই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। সঙ্গের কিশোরী মেয়েটিও ঘেমে-নেয়ে একাকার।
যেন পাঁচশ টাকার ভাংতি না থাকাটা মস্ত অপরাধ।
কিন্তু তন্ময়ের কাছে ভাংচি চেয়ে লাভ কী? পকেটে সাকুল্যে শ তিনেক টাকা আছে। এর মধ্যে একটি পঞ্চাশ টাকার নোটে টেপ মারা।
গত কদিন ধরে বহুবার চেষ্টা করেও চালানো যায়নি। ভাংতি দিতে না পারলেও অসহায় ভদ্রলোকের সাহায্যে এগিয়ে যায় তন্ময়।
–‘তোমার ভাড়া কতো?’ সিএনজির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে তন্ময়।
–‘আশি ট্যাকা।’
রঙ্গমঞ্চে তন্ময়ের মতো একজন তরুণের প্রবেশে কিছুটা হকচকিয়ে যায় সিএনজি চালক।
কিশোরীসমেত একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে ঝাড়ি দিয়ে কথা বলা যায়।
কিন্তু জ্বলন্ত সিগারেট হাতে, লম্বা চুলের জিন্স পরা তরুনের সঙ্গে যথেষ্ট সাবধানে কথা বলতে হবে- এটুকু বুদ্ধি তার আছে।
–‘তোমার কাছে চারশ টাকা নাই?’
–‘না স্যার।’
এবার সিএনজিতে বসে থাকা যাত্রীর দিকে তাকায় তন্ময়।
–‘আপা, আপনার কাছে পাঁচশ টাকার ভাংতি আছে? অথবা আপনি কী এই ভদ্রলোককে চারশ টাকা দিতে পারেন?
পরে সিএনজি ওয়ালার ভাড়ার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিবেন।’
তন্ময়ের অনুরোধে কাজ হয়। সহজেই মিটে যায় ভাংতির ঝামেলা।
সংক্ষিপ্ত কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ব্যস্ত পায়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে যান প্রৌঢ়। সম্ভবত কোনো রোগী দেখতে এসেছেন।
আবার হাত ঘড়ির দিকে তাকায় তন্ময়।
সাড়ে এগারোটা বাজে।
শালার আমিনুল কোথায় মরলো?
কয়েক দিন ধরে রিপোর্টের খড়া যাচ্ছে। হাতে জামানোও কিছু নাই।
এদিকে নিউজ এডিটর তারেক ভাই সমানে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন স্পেশাল স্টোরির জন্য।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করে হাসপাতাল নিয়ে একটা সিরিজ স্টোরির প্ল্যান জমা দিয়ে ছিলো তন্ময়।
সেটা যে তারেক ভাই সম্পাদকের কাছে দেবেন এবং সম্পাদক এই আইডিয়াটা এতোটা পছন্দ করবেন, সেটা কে জানতো!
পুলিশ-হাসপাতাল এ বিষয়গুলো রিপোর্টারদের আপদকালীন মজুদের মতো।
কখনো রিপোর্টের আকাল পড়লে এসব জায়গায় একটু খোঁজ-খবর করলেই স্টোরি দাঁড়িয়ে যায়।
হাসপাতাল আর পুলিশ স্টেশনতো আসলে নিউজে আখড়া।
সে কথা ভেবেই সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পরিকল্পনাটি জমা দিয়েছিল তন্ময়।
সম্পাদকের অনুমোদনের পর পিছিয়ে আসার আর কোনো পথ থাকলো না।
ফলাফল- সকাল দশটা থেকে দেড় ঘন্টা ধরে হাসপাতালের সামনে ঠায় দাঁড়ানো।
জিন্সের পকেটে মুঠোফোনরটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। হাতে নিয়ে স্ক্রিনটা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই কলটা রিসিভ করে তন্ময়।
বহুল প্রতীতি আমিনুল বাবাজির ফোন।ফোনটা হাতে নিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায় তন্ময়।
হাসপাতালের গেট থেকে দৌড়ে আসছে সাদেক সরকার।
চার ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার সাদেক সরকারের শরীরের মধ্য প্রদেশে একটা বেমামান ভাবে উঁচু, গালে চাপ দাড়ি।
মাথায় সবসময় একটা সাদা গোল টুপি।
এই চেহারার একটি লোকের এভাবে উধশ্বাসে দৌড়ানোর দৃশ্য সকাল-বিকেল দেখা যায় না।
নিশ্চই গুরুতর কিছু ঘটেছে।
আরে, সাদেক তো তন্ময়ের দিকেই ছুটে আসছে। ভ্র“ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়।
বিষয় কী?
ওদিকে ফোনের অপর প্রান্তে আমিনুল প্রাণপণে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। এতোণে খেয়াল হয়ে তন্ময়ের। জবাব দেয়,
–‘কী ব্যপার আমিনুল?’
–‘তনুভাই আপনে কই? হাসপাতালের সামনে? বিরাট গ্যাঞ্জাম লাগছে। আপনের দারুন বিপদ।
বস, আপনে যেইখানে আছেন নড়বেন না। আমি পাঁচ মিনিটে আসতাছি…।’
আমিনুলের ফোন পেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় তন্ময়। ততক্ষণে সাদেক সরকার তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে।
……..
ডিবি অফিসে ডেস্কে বসে কুৎসিত কালো রঙ্গের ধোঁয়া উঠা তরলটি গেলার চেষ্টা করছে হাফিজুর রহিম।
এক ডাক্তার বন্ধুর উপদেশ, বেশি করে রং চা খেতে হবে। সেটা নাকি শরীরের জন্য ভালো।
তার উপদেশ অরে অরে মেনে চলার চেষ্টা করে রহিম। আগেও এসব নির্দেশ মেনে উপকার পেয়েছে।
কোনোবারই ডাক্তারি উপদেশ মেনে চলতে এতোটা কষ্ট হয়নি। মনে মনে পিয়ন কাম টি বয় মোতাহারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে গাল দেয় রহিম।
শালা… পুত, চিরতা পাতা দিয়ে রং চা বানায়া আনছে।
মুখ বিকৃত করে আরেক ঢোক গরম পানীয় গলায় ঢালে রহিম।
নাহ্, চা খাওয়ার অভ্যাসটাই বাদ দিতে হবে।
চাকরির বয়স খুব বেশি দিনের না। কিন্তু ডিবি অফিসের কাজকর্ম অল্প দিনেই অভিজ্ঞ করে তুলেছে রহিমকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্বপ্নেও ভাবেনি পুলিশে যোগ দেবে। বাস্তবে সেটাই ঘটলো।
এখন দিন-রাত চোর-চোট্টা আর বদমাসদের নিয়ে সময় কাটে। অফিসের টাইম-টেবিলের কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।
এ নিয়ে মুনমুনের অভিযোগেরও অন্ত নেই। অবশ্য বেচারিকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। গত দুমাসে একদিনও ছুটি মেলেনি।
মিলবে কী করে, নতুন একটা দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়েছে।
পাশের রুমে কাঠের চেয়ারের সঙ্গে দড়ি বাঁধা নমুনাটির কথা মনে পড়তে চায়ের তিতকুটে স্বাদটা আরো বিস্বাদ লাগে।
কয়েক বছরের পুলিশের চাকরিতে অনেক কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে রহিম।
কিন্তু এখনো জিজ্ঞাসাবাদের সনতান পদ্ধতিটার সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারেনি।
অথচ অভিযুক্তদের ইন্টারোগেট করার ব্যপারে কারো কারো রয়েছে অপরিসীম আগ্রহ।
মানুষকে মারধোর করাটাওযে কারো বিনোদন হতে পারে, পুলিশে চাকরি করতে না এলে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতো না রহিম।
ধীরে-সুস্থ্যে পাশের কামড়াটায় ঢুকে রহিম।
চেয়ারে বাঁধা সাঈদের চেয়ে বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে সাব ইন্সপেক্টর একারামুল। একটা গজারির লাঠি চেয়ারের পাশে ঠেস দিয়ে রাখা।
এতোন সেই সাঈদকে জিজ্ঞাসাবাদ (!) করছিলো। কোর্ট থেকে পাঁচদিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী সাঈদকে।
আজ চারদিন পার হয়ে গেল। পরশুই তাকে আবার আদালতে হাজির করতে হবে। অথচ, পুলিশ এর পেট থেকে কিছুই বের করতে পারেনি।
শালা কঠিন চীজ। গত চারদিন দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা সাঈদের রুমে এক হাজার ওয়াটের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে।
সকাল-বিকাল দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে কঠিন মার। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি।
একে নিয়ে বেশ চিন্তিত রহিম। আদৌ কী এর পেট থেকে কোনো কথা বের করা যাবে?
অনেক কষ্ট করে নিখুঁত ফাঁদ পেতে তবেই জালে পোরা গেছে ‘ইয়াবা সম্রাট’ আবু সাঈদকে।
এর আগেও বেশ কয়েকবার সাঈদকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতেছিলো পুলিশ।
কিন্তু প্রতিবারই আগে থেকে এসব অভিযানের কথা ফাঁস হয়ে গেছে। তাই এবার রহিম কোনো ঝুঁকি নেননি।
হাতে গোনা কয়েকজন বিশ্বস্ত অফিসার নিয়ে নিজেই এ অভিযানের নেতৃত্ব দেন।
ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডে মাদকের সবচেয়ে বড় চক্রটি পরিচালনা করতো সাঈদ।
তার ব্যবসার ইনভেস্টর হিসেবে আমলা-রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে পুলিশের বড় কর্তাদের নাম রয়েছে বলে জনশ্রুতি।
যদিও এসব অভিযোগের কোনো বাস্তব প্রমাণ এখনও পায়নি রহিম।
তবে কয়েকটি সূত্র তাকে নিশ্চিত করেছে, সাঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক রাঘব-বোয়াল। ইতিমধ্যেই এর কিছুটা নমুনা টের পাচ্ছে রহিম।
সাঈদকে গ্রেপ্তারের মতো এতো বড় সাফল্যের পরও তাকে এ কেস থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু ইয়াবা ইস্যুটি ইতিমধ্যেই মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়ে উঠেছে।
ইয়াবার বিষয়টি যে হফিজুর রহিম হ্যান্ডেল করছে এটিও ফলাও করে প্রচার করেছে মিডিয়াগুলো।
এ পরিস্থিতিতে তাকে যদি এ কেস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, সেটা তার ইমেজের জন্য বড় তির কারণ হবে।
নানামুখী চাপ উপো করে তাই রহিম এই কেসটিতে লেগে আছে।
চোখের ইশারায় একরামুলকে চলে যেতে বলে রহিম। সাঈদের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে একটু সময় নিয়ে সিগারেট ধরায়।
কৌশল পাল্টে এবার একটু ভিন্ন পথে শুরু করে রহিম ।
মৃদু গলায় বলে, দেখ সাঈদ, তোমার দলের বেশিরভাগ লোকই ধরা পড়েছে, বাকিরা পালিয়ে গেছে। ইউ আর ফিনিশড।
তোমার ব্যবসা, টাকা-পয়সা, কানেকশনস সবই শেষ। এখন তোমার সামনে শুধু একটা রাস্তাই খোলা আছে; পুলিশকে সাহায্য করা।
আমরা জানি, তোমাদের এই চক্রের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, আমলা থেকে শুরু করে পুলিশের কয়েকজন বড় কর্তাও জড়িত।
তুমি শুধু আমাদের নামগুলো বলো, এর পর বাকিটা আমরা করবো। তোমার নিরাপত্তার বিষয়টিও আমরাই দেখবো।
রহিমের কথাগুলো শুনে থেতলানো ঠোট ছড়িয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে সাঈদ।
এ পরিস্থিতিতেও হাসছে! তার মনোবল দেখে অবাক না হয়ে পারেনা রহিম।
আমার নিরাপত্তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। নিজেরে নিয়া ভাবেন। নতুন বিয়ে করেছেন, এখনো বাচ্চা-কাচ্চা হয় নাই।
বউতো সারাদিন বাসায় একলাই থাকে। তার দিকে একটু খেয়াল রাইখেন।
ডিবি অফিসে বসে একজন আসামী এভাবে একজন এএসপিকে হুমকি দিতে পারে, এটা ছিল কল্পনারও অতীত।
ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় রহিম। সম্বিত ফিরে পেয়ে সজোরে একটি চড় কসায় সাঈদের গালে।
পটকা ফাটার মতো শব্দ হয়। চেয়ারসহ মাটিতে উল্টে পড়ে সাঈদ।
মেঝেতে মাথা ঠুকে কপালের এক পাশে মাথা চাড়া দেয় একটা গোলআলু। সে অবস্থাতেও রহিমের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে সাঈদ।
আরো আধা ঘন্টা নিষ্ফল চেষ্টার পর কান্ত-বিধ্বস্ত রহিম নিজের ডেস্কে এসে বসে।
হোটেল থেকে আনিয়ে রুটি আর মুরগির ঝোল দিয়ে লাঞ্চ শুরু করে। টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠে।
–হ্যালো।
–হাফিজুর রহিম বলছেন?
–বলছি। আপনি কে বলছেন?
–পরিচয় পরেও দেওয়া যাবে। আপনি এক্ষুনি পঙ্গু হাসপাতালে যান। একটি গাড়ির সঙ্গে আপনার স্ত্রীর রিক্সার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি এখন পঙ্গু হাসপাতালে আছেন।
–হ্যালো.. হ্যালো… কখন ঘটেছে এ ঘটনা? আপনি কে বলছেন? মুনমুনের অবস্থা এখন কেমন? তার কী জ্ঞান আছে?
–আহ্, আপনি শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছেন। জলদি হাসপাতালে ছুটে যান। আপনার হাতে সময় কিন্তু খুবই কম।
অচেনা কলার লাইন কেটে দেয়।
এক মুহুর্ত দেরি না করে অফিসের জিপটা নিয়েই ছুটে যায় রহিম পঙ্গু হাসপাতালের দিকে।
জীবন-মৃত্যুর মাঝে দুলতে থাকা মুনমুনের পাশ থেকে এক মুহুর্তেও জন্যও নড়েনি রহিম।
তাই সে জানতেও পারেনি গত কয়েক ঘন্টায় অনেকগুলো বড় ঘটনা ঘটেছে।
প্রেসকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ডিবির কর্মকর্তারা। রিমান্ডে আনা আসামীর মৃত্যু প্রেসের জন্যতো অনেক বড় খবর।
আর সেই আসামীটি যদি হয় আবু সাঈদের মতো তারকা অপরাধী, নামকরা মাদক ব্যবসায়ী, তাহলে তো কথাই নেই।
পুলিশের তরফ থেকে প্রেসকে বলা হয়, সর্বশেষ আবু সাঈদের সঙ্গে ছিলেন এএসপি হাফিজুর রশিদ।
লাঞ্চের আগে তিনি সাঈদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। লাঞ্চের পর স্ত্রীর দুর্ঘটনার খবর পেয়ে চলে যান তিনি।
কন্সটেবল একরামুল সাঈদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে গিয়ে দেখে মেঝেতে চোখ উল্টে পড়ে আছে সাঈদ।
দ্রুত তার সিনিয়র অফিসরকে ডাকে একরামুল। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তরত চিকিৎসক সাঈদকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে অবশ্য কিছুণের জন্য জ্ঞান ফিরে পায় সাঈদ। আর তখনই পুলিশকে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে গেছে।
তদন্তের স্বার্থে সেসব তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ প্রশাসনের এ বক্তব্য শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকদের সন্দেহের কাঁটাটা হাফিজুর রহিমের দিকে ঘুরে গেছে।
কয়েকটি টিভি চ্যানেলের রাতের খবরে হাফিজুর রহিমকে পাষন্ড, খুনি ইত্যাদি বিশেষণে অভিহিত করা হয়েছে।
পুলিশের একটি প্রেস নোটে বলা হয়েছে, সাঈদের মৃত্যুর তদন্তে পুলিশ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বারো ঘন্টার মধ্যে কমিটি রিাপোর্ট পেশ করবে। এবং এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ছাড়া ইয়াবা মামলা পরিচালনার ভার থেকে হাফিজুর রহিমকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে।
এ মামলাটি এখন থেকে ডিবি কর্মকর্তা আকবর খান পরিচালনা করবেন।
মুনমুনের মৃত্যু হলো ফজরের আজানের ঠিক আগে। সে সময় হাসপাতালের গেট দিয়ে পুলিশের একটি গাড়ি প্রবেশ করে।
হাসপাতালের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখে রহিম।
তার জানা ছিলো না, স্ত্রীর মৃত্যুতে সান্তনা জানাতে নয়, তার সহর্মীরা এসেছেন তাকে গ্রেপ্তার করতে।
সাঈদকে হত্যার অভিযোগে গত রাতেই রহিমের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী মৃত্যু শয্যায় সাঈদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরো একজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে একই সময়।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছে সাংবাদিক তন্ময় চৌধুরী।
…………..
সকালে বেড়ুবার মুখেই বিপত্তি। পুরো সিঁড়ি ঘরটি ধুলায় অন্ধকার করে দিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে শামসু মিয়া।
বাড়িওয়ালার এই কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান শামসু মিয়ার সঙ্গে সব সময়ই খটমট লেগে আছে আমিনুলের।
কথায় বলে না, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়; চায়ের চেয়ে কেটলি গরম- শামসুর অবস্থা সেরকম।
দুই টাকার কেয়ারটেকার নিজেকে বাড়ির মালিক মনে করে। মাসের ভাড়া দিতে দু-একদিন দেরি হলেই কি হম্বিতম্বি!
সকালে বেরুবার মুখে ঝাড়– দেখেই মনটা কু গাইছিলো।
বঙ্গবাজারের মোড়ে এসে মটর সাইকেলের চাকা পাংচার হতেই ঝাড়– দর্শনের মাজেজা পরিষ্কার হয়ে গেল।
ভোগান্তির যে এখানেই শেষ নয় সেটা তখনো বোঝেনি আমিনুল। চাকা বানাচ্ছে দুই পিচ্চি। সম্ভবত ওস্তাদ দোকানে নেই।
এ সুযোগে আমিনুলের মটর সাইকেলের উপর দিয়ে দুজন হাত মকশো করে নিচ্ছে।
স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ সময় নিয়েও চাকার লিক সারাতে হিমশিম খাচ্ছে দুজন। এতে তাদের উৎসাহে কোনো ছেদ পড়ছে না।
মহা উৎসাহে দুই পিচ্চি মটর সাইকেলের পেছনের চাকাটি নিয়ে কসরত করছে।
বসে বসে তাদের কান্ড কারখানা দেখা ছাড়া আমিনুলের আর কিছুই করার নেই।
তাড়াহুড়োর জন্য সকালে নাস্তা করা হয়নি। কপালের ফেড়ে যখন সময় নষ্টই হচ্ছে, তখন কিছু খেযে নেওয়া যাক।
এ ভেবে গত ত্রিশ মিনিটে আমিনুল এক হালি সিদ্ধ ডিম, দুটি সাগর কলা, চার পিস শশা এবং একটি গাজর খেয়েছে।
সব শেষে এককাপ চা খেয়ে সিগারেট ধরানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিম্নচাপ।
শশা আর ডিমের কম্বিনেশনটা যে ঠিক হয়নি এতক্ষণে বুঝতে পারে আমিনুল।
বেরুবার মুখে ঝাড়– দর্শনের আরেকটি নতিজা হাতেহাতে পেয়ে যায়।
ঢাকা মেডিকেলের সামনে তনু ভাই বসে আছে, এ চিন্তাটা এক মুহুর্তের জন্যও স্বস্তি দিচ্ছে না।
ভয়ের চোটে মোবাইল ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছে। কাজ শেষ হলেই খুলবে। এখন খোলা থাকলে খবর আছে।
এর মধ্যে নিশ্চই কয়েক হাজার বার তার ফোনে চেষ্টা করেছে তন্ময়।
একদিকে তনু ভাই খেপছেন, অন্যদিকে বকুলের সঙ্গে সম্পর্কটা বোধহয় চীরতরে ‘কাট’ হয়ে গেল।
তন্ময় ভাইয়ের সঙ্গে সকাল দশটায় ঢাকা মেডিকেলের অ্যাসাইনমেন্টটা ঠিক হওয়ার পর…..,
অনেক কষ্টে বকুল কে রাজি করিয়েছে নয়টায় টিএসসিতে দেখা করার জন্য। সহজে কী বকুল রাজি হয়!
কতো কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবেই তাকে রাজি করিয়েছে।দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এতোক্ষণে নিশ্চই বিরক্ত হয়ে ক্লাসে চলে গিয়েছে বকুল।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে তার সামনে যাওয়ার কোনো মুখ থাকলো না।
বকুলের কাছে আবার ইমেজ পুনরুদ্ধারে যে কত সময় এবং মোবাইল ফোনের ব্যালেন্স ব্যয় হবে তা একমাত্র আল্লাই বলতে পারেন।
বুক চীরে দীর্ঘশ্বাস আসে।একটি মাত্র শলার ঝাড়–র এতো পাওয়ার! শালা একদিনে কতো দিক থেকেই না প্যাঁচ খাওয়ালো।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনের সুইচ অন করে। একটু নার্ভাস। কাঁপা হাতে বকুলের নম্বরে ডায়াল করার আগেই ফোন বেজে উঠে।
আননোন নম্বর থেকে কল। আমিনুলের সোর্স ডিবি অফিসের এসআই আজহার ফোন করেছে।
এর আগেও আজহার ডিবির অনেক গোপন অপারেশনের তথ্য আগেই জানিয়েদিয়েছে আমিনুলকে।
এর ফলে পুলিশের বিভিন্ন গোপন অপারেশনের এক্সকুসিভ ছবি তুলতে পেরেছে সে। এ কারণেই এতোদিন চাকরিটা টিকে আছে।
নয়তো অ্যাসাইমেন্টে অবহেলার দায়ে কবেই তার চাকরিটা খেয়ে নিতো নিউজ এডিটর।
বোতাম টিপে ফোনটা রিসিভ করে আমিনুল।
–‘হ্যালো আজহার ভাই, বলেন, তারপর খবর কী?’
–‘খবরতো সাঙ্ঘাতিক। আপনাদের সিনিয়র রিপোর্টার তন্ময় চৌধুরীর নামে তো ওয়ারেন্ট বাইর হইছে। খবর কিছু জানেন নাকি?’
আজহারের কথা শুনে আতকে উঠে আমিনুল।
–‘ওই মিয়া, কন কী? পুরাটা খুইলা বলেন। তন্ময় ভাইয়ের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হইবো কেন। সে কী করছে?’
–‘ডিটেলস বলতে পারমু না। তবে খবর পাকা। উপর থেকে চাপ আছে। যে কুনু সময় তন্ময় ভাইকে অ্যারেস্ট করা হবে।
খুব ভোরে ডিবির একটা দল তন্ময় চৌধুরির বাড়িতে গেছিলো তারে অ্যারেস্ট করতে।
কিন্তু কাল রাতে তন্ময় চৌধুরী বাড়ি ছিলো না। তাই বাইচা গেছে।
সম্ভব হইলে তন্ময় চৌধুরিরে খবর দেন। সময় কিন্তু খুব কম। যা করনের জলদি করেন।’
এর পরই তন্ময়কে ফোন করে আমিনুল।
সকাল থেকে এ পর্যন্ত এবারই প্রথম ভাগ্য সহায়তা করে আমিনুলের।
আজহারের ফোন রাখা মাত্রই দুই পিচ্চি ইঞ্জিনিয়ার জানায়, ‘গাড়ি রেডি স্যার।’
*******************
দুজনের মধ্যে যে লম্বা, তার পরনে জিন্স আর সাদা ফুল হাতা সার্ট। অন্যজন খাকি গ্যাবার্ডিনের প্যান্টের উপর স্ট্রাইপ হাওয়াই সার্ট পরা।
দুজনের চুলই ছোট করে ছাটা। সাদা প্রোবক্স গাড়িটা হাসপাতালের সামনে থামিয়ে দ্রুত নেমে পরে দুজন। মাপা পায়ে করিডোর ধরে এগিয়ে যায়।
আপাত দৃষ্টিতে হাসপাতালে আসা আর দশজন মানুষ থেকে এ দুজনকে আলাদা ভাবার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু দুজনের হাতে দুটি এ ফোর সাইজের ছবি সাদেক সরকারের কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়।
হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট সাদেক সরকারের হাসপাতালের কোনো কাজই করতে হয় না।
বরং সে হাসপাতালের ত্রিসীমানায় না এলেই পরিচালক থেকে শুরু করে ডাক্তার ও অফিসারদের সবাই খুশি হয়।
বিশেষ কোনো স্বার্থ ছাড়া সাদেক সরকার এদিক পা বাড়ায় না। বেশিরভাগ সময় পার্টি অফিসেই ব্যস্ত থাকে।
কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে দিনে অন্তত একবার ভিআইপি কেবিনে এসে উকি দিতে হচ্ছে। শাশুড়ির অপারেশন হয়েছে।
একজন মন্ত্রীর মতো ভিআইপি মর্যাদায় হাসপাতালের সবচেয়ে বিলাসবহুল কেবিনে শুয়ে আছে বুড়ি।
এ টুকুই কী যথেষ্ট নয়? মানুষের স্বভাবটাই এমন। যতো পাবে ততোই খেতে চাইবে।
আরে, এই বুড়ির সাত কপালের ভাগ্য এমন একটা কেবিনে শুয়ে আছে। এখানে মরতে পারলেও শান্তি।
সাদেক সরকারের মতো জামাই পেয়েছে বলেই না আজ বুড়ির ভাগ্যে এই শয্যা জুটেছে।
নয়তো তার মতো কতো রোগী কেবিনের বাইরে বারান্দায় মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। এসব কথা কে কাকে বোঝাবে।
প্রতিদিন একবার করে বুড়িকে তার দেখতে আসতে হবে। নয়তো বিবি গোস্বা করবে।
আরে তোর গোস্বার ধার ধারি নাকি আমি? মনে মনে ভাবে সাদেক; স্ত্রীকে কসে একটা গাল পাড়ে।
কি দরকার সংসারে অশান্তি এনে! এ কথা ভেবেই দিনে একবার হাজিরা দিয়ে যায়।
মনে মনে স্ত্রীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে কিছুটা আরাম পায়।
আজকেও সেই ‘রুটিন হাজিরা’ দিতেই এসেছিল। পথে দেখা হয়ে যায় এ দুই মুর্তির সঙ্গে।
এদিক সেদিক উকি দিয়ে কাউকে খুঁজছে তারা।
–‘ভাইজান কী কাউরে খুঁজেন?’
উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করে সাদেক সরকার। অথচ আগুন্তক দুজন তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
যেন তার কথা শুনতেই পায়নি। তখনই তাদের হাতে ধরা ছবিটা লক্ষ্য করে সাদেক। আরে ছবিতো সাংবাদিক তন্ময় চৌধুরীর।
তন্ময়কে ভালোভাবেই চেনে সাদেক। একটা ব্যপারে দারুন সাহায্য করেছিল তন্ময়। এর পর থেকেই তন্ময়ের সঙ্গে তার খাতির।
বিভিন্ন সময় তন্ময়কে হাসপাতালের নানা বিষয়ে খবরাখবরও দেয় সাদেক।
অবশ্য যেসব খবরে তার নিজের স্বার্থ নষ্ট হয় না শুধু সেসবই জানায় সে তন্ময়কে।
সন্দেহজনক দুজনের হাতে তন্ময়ের ছবি দেখার পর থেকেই সাবধান হয়ে যায় সাদেক। একটু দুরত্ব রেখে দুজনকে ফলো করতে থাকে।
এবার আরো মনযোগ দিয়ে জরিপ করে তাদের।
দুজনের কোমরেই হোলস্টারের স্পষ্ট আভাস অভিজ্ঞ সাদেক সরকারের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না।
প্রশিক্ষিত সৈন্যের মতো মাপা পা ফেলে হেঁটে যায় দুজন। হাসপাতালের ভিড় তাদের কাজে কোনো ব্যঘাত সৃষ্টি করতে পারে না।
সিবিএ রাজনীতি করতে গিয়ে ভালো-মন্দ, টপ টেরর, গলির মাস্তান নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশতে হয় সাদেককে।
সে নিজেও সব সময় সঙ্গে একটা রিভলবার বহন করে। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা বলে দেয়, এ দুই ব্যক্তি বড় শক্ত পাল্লা।
তন্ময়ের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে সাদেক। এ সময় বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে যায়।
আরে, আজকেইতো তন্ময়ের হাসপাতালে আসার কথা। গত রাতেই সে ফোন দিয়ে ছিলো। সাদেককে অফিসে থাকতে বলেছিলো তন্ময়।
আজকে হাসপাতালে আসার কথা তন্ময়ের;
আর আজই রহস্যময় দুই ব্যক্তি হাতে তন্ময়ের ছবি নিয়ে তার খোঁজে হাসপাতাল চষে বেড়াচ্ছে, বিষয়টি কাকতাল হতে পারে না।
তার মানে তন্ময় এখানে আসবে জেনেই এ দুজন তার খোঁজে এসেছে।
এক ছুটে হাসপাতালের বাইরে চলে আসে সাদেক। ওইতো তন্ময়কে দেখা যাচ্ছে।
তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাফাতে থাকে সাদেক। হরবর করে কিছু বলতে চায়।
ডান কানে সেল ফোনটি চেপে ধরে বাঁ হাত তুলে তাকে থামায় তন্ময়। ফোনের অপর প্রান্তের কথা শুনে দুই ভ্রু কাছাকাছি চলে আসে।
নিশ্চই কোনো দু:সংবাদ, ভাবে সাদেক।
তার কাছের যে তন্ময়ের জন্য আরেকটি বড় দু:সংবাদ রয়েছে, সেটা জানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে সাদেক।
খুনে চেহারার দুজন রিভলবার কোমরে গুজে তন্ময়ের ছবি হাতে নিয়ে তার খোঁজ করছে- এটা দু:সংবাদ নয়তো কী!
ফোনটা নামিয়ে রেখে সাদেক ভুইয়ার দিকে তাকায় তন্ময়।
‘সাদেক ভাই, এক্ষনি আমার এ জায়গা থেকে সরে পড়তে হবে।
তবে কিছুক্ষণ আপনার হাসপাতালের কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। আমিনুল আসছে।’
তন্ময়ের কথা শুনে আর কথা বাড়ায় না সাদেক সরকার। অফিস ঘরের পাশে ছোট্ট গোপন কুঠুরিটাতে নিয়ে যায় তন্ময়কে।
যেতে যেতে ঘাসের উপর নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকা ঘুঘু দুটির দিকে তাকায় তন্ময়। সকালেই ঘুঘু দুটো চোখে পড়েছিলো।
আর এখন বোধ হয় ঘুঘুর ফাঁদটা দেখতে হবে।
রংচটা বিবর্ন দেয়াল আর ভুসভুসে একটা কম্বল বিছানো চৌকি ছাড়া ছোট্ট এ রুমটিতে আর কিছুই নেই।
তন্ময়কে সেখানে বসিয়ে তার ছবি হাতে সন্দেহজনক দুই ব্যক্তির কথা জানায় সাদেক।
এ কথা শুনে আরো বেশি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে তন্ময়।
আজ সকাল থেকে কী শুরু হলো? আমিনুল জানালো তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
পুলিশ হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছে অ্যারেস্ট করার জন্য। অন্যদিকে খুনে চেহারার দুজন নাকি ছবি হাতে নিয়ে তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে।
নাহ্ কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। গত ছয় মাসের মধ্যে কারো পাকা ধানে মই দিয়েছে বলেতো মনেও পড়ছে না।
সাদেকের গোপন কুঠুরিতে বসে যখন প্রচন্ড গরমে দরদর করে ঘামছে তন্ময়,
বাইরে তখন পুলিশের দুটি ব্যাটেলিয়ানের সদস্যরা তন্নতন্ন করে হাসপাতালের প্রতিটি প্রান্তে তন্ময়কে খুঁজছে।
মোবাইল ফোনের বদৌলতে সে খবরও পৌছে যায় সাদেকের কাছে। খবর শুনে নিজের ফোনটি তুলে নেয় তন্ময়।
সাদেকের বাধার কারণে ফোন করা হয় না।
‘না তন্ময় ভাই। আমার কাছে ব্যপারটা খুব সহজ মনে হইতেছে না। আপনার সেল ফোনটা এখন ব্যবহার না করাই ভালো।
আপনেতো জানেন, এখন পুলিশের কাছে মোবাইল ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র আছে।
আপনে করলেও ওরা বুঝতে পারবো আপনে কই আছেন। আপনের ফোন থেইকা নম্বর বাইর কইরা আমার মোবাইল দিয়া ফোন করেন।’
সাদেকের যুক্তি মেনে নেয় তন্ময়। তার ফোন থেকেই আমিনুলকে ফোন করে নিজের অবস্থান জানায়।
পুলিশের চোখ এড়িয়ে আমিনুল ঠিক পৌছে যাবে। ত্যাদড় আমিনুলের উপর অন্তত এটুকু ভরসা রাখতে পারে তন্ময়।
*************
বিশাল ড্রইং রুমটা গম গম করছে। বেশিরভাগ লোকই এসেছে কোনো না কোনো তদ্বিরে।
এদের মধ্যে পোশাক-পরিচ্ছদ ও চেহারায় যারা একটু সম্ভ্রান্ত তাদের জন্য আলাদা একটা ছোট কামড়ায় বসার ব্যবস্থা আছে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই কামড়ার অতিথিদেরও এর মধ্যেই দু দফা চা বিতরণ করা হয়েছে।
সুদৃশ্য পোর্সলিনের কাপে উৎকৃষ্ট মানের দার্জিলিং চা উপভোগ করেছেন অভ্যাগতরা।
বড় রুমের অপেক্ষমানদের ভাগ্য এতোটা প্রসন্ন নয়। গত দু ঘন্টায় তারা একবারও চা পায়নি। তাতে অবশ্য এদের কোনো খেদ নেই।
মন্ত্রী কখন আসবেন সেই প্রতীক্ষায় উন্মুখ সবাই। মন্ত্রী তখন দোতলায় খাস কামড়ায় বসে ঘামছেন।
ফোনের অপর প্রান্তে কারো চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। সাউন্ড প্রুফ বলে তার কথাগুলো বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে না।
নয়তো তার চিৎকার হেয়ার রোড ছাড়িয়ে…….
বেইলি রোডের নাটক সরণীতে ফুচকা খেতে আসা যুগলেরাও শুনতে পেতো এতে কোনো সন্দেহ নেই আবুল বাশার খান মজলিশের।
এই মুহুর্তে মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে ভয় ও টেনশনে কাঁপছেন তিনি। নামটা জবরদস্ত হলেও খান মজলিশ লোকটি একেবারেই হ্যাংলা-পাতলা।
অল্পতেই তার টেনশন হয়। আর তখন কড়া এক কাপ চায়ের সঙ্গে একটা বেনসন ধরাতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু এমনই কপাল মন্ত্রীর এপিএস হওয়ার কারণে সে সুযোগও বেশিরভাগ সময়ই পাওয়া যায় না।
কারণ মন্ত্রী মহোদয়ের আশপাশেই সব সময় তাকে থাকতে হয়।
মন্ত্রী মহোদয়ের স্যান্ডেলটা আলমারি থেকে বের করে আনা, পরিষ্কার রুমালটি ঠিকঠাকভাবে পকেটে পুরেছেন কিনা,
মোবাইল ফোনে চার্জ আছে কিনা, নাকি চার্জার সঙ্গে নিতে হবে-
এমনি সব জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত তাকতে হয় আবুল বাশার খান মজলিশকে। ফলে ঘন ঘন চা-সিগারেট খাওয়ার সুযোগ মেলে না তার।
এই যেমন এখন। মন্ত্রী মহোদয়ের মেজাজ যতোই চড়ছে, খান মজলিশের টেনশন ততোই বাড়ছে।
কড়া এক কাপ চা আর বেনসনের জন্য বুকটা আকুপাকু করছে। এ মুহুর্তেতো মন্ত্রী মহোদয়কে ছেড়ে বাইরে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না।
দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায় খান মজলিশ। পৌনে একটা বাজে।
প্রতিদিন এগারোটার মধ্যেই নীচে নেমে যান মন্ত্রী। সেখানে দরবার শেষে জোহরের নামাজ পড়ে সচিবালয়ে যান।
নীচতলার ড্রইং রুমে যারা সে সময় থাকেন তাদের সবাইকে নিয়েই জামাতে জোহরের নামাজ আদায় করেন তিনি।
এক একদিন মন্ত্রী নিজেই ইমামতি করেন। খান মজলিশ নামাজ পড়েন না। জোহরের নামাজের সুযোগে বাইরে গিয়ে দ্রুত সিগারেট টেনে আসেন।
মন্ত্রী মহোদয়ও যে খুব নামাজি মানুষ তা কিন্তু না। একা একা থাকলে কখনোই তিনি নামাজের ধারে কাছেও যান না।
যখন সংসদ অধিবেশন চলে তখন সংসদে এবং নামাজের ওয়াক্তে কোনো মিটিং থাকলে মিটিং বন্ধ করে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যান।
সেটা যতো গুরুত্বপূর্ণ মিটিংই হোক না কেন। আর দশটা কাজের মতো নামাজ পড়াটাও তার রাজনীতিরই অংশ।
ফোনটা প্রায় আছড়ে ক্রাডেলে রেখে বিড়বিড় করেন মন্ত্রী। শালারা একটা কাজও যদি ঠিকমতো করতে পারতো!
একটা চ্যাংড়াকে ধরতে এতো নাকানি চোবানি। পুলিশদের দিয়ে কিছু হবে না, এটাতো তিনি আগেই জানতেন।
সে জন্যই ব্যাকআপ হিসেবে শমসের আর বাচ্চুকে পাঠালেন। এই দুই বেকুবও এখন নাকি খালি হাতে ফিরছে।
…………….
প্রতিদিনের রুটিনের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দুপুর পর্যন্ত দোতলার খাস কামড়াতে বসে থাকেন মন্ত্রী।
এর মধ্যে মোবাইল ফোনে কয়েক জায়গায় ফোন করেন। বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন।
একটু পর পর চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে পাইচারি করছেন। কামড়ার বাইরে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে খান মজলিশ।
চলে যাবে, নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। এই সিদ্ধান্তহীনতা তার টেনশনকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
–বাশার..অ্যাই বাশার।
–জ্বী স্যার। মন্ত্রীর বাজখাই গলার ডাক শুনে আবুল বাশার খান মজলিশ দ্রুত কামড়ার ভেতরে যান।
–নীচে যাও। আমার কাছে দুজন লোক আসবে। দরজা থেকে সরাসরি তাদের আমার কামড়ায় নিয়ে আসবে। ক্লিয়ার?
–ওকে স্যার।
মন্ত্রীর সামনে থেকে পালাবার সুযোগ পেয়ে দ্রুত সিড়ি ভেঙ্গে নেমে যায় খান মজলিশ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে মন্ত্রীর বাড়ির সামনে থামে। গাড়ি থেকে নেমে আসা দুজন অপরিচিত নয়।
বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে এদের কাজে লাগান মন্ত্রী, খান মজলিশ সেটা জানে। এখন তাদের কী কাজ?
এখনতো বিরোধী দলের আন্দোলন চলছে না, আবার সামনে কোনো ইলেকশনও নেই।
কিংবা কোথাও বড় ধরণের কোনো গ্যাঞ্জাম লেগেছে বলেওতো জানা নেই।
তাহলে? শামসু আর মবিনকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন মন্ত্রী মহোদয়?
শামসু আর মবিন কামড়ায় ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে দেন মন্ত্রী।
–বসো।
দুটো সিঙ্গেল সোফায় গা এলিয়ে বসে দুজন।
–সেদিনের একটা ছোকরা, তাকেও বাগে আনতে পারলেনা তোমরা? এতো টাকা দিয়ে তোমাদেরকে তাহলে পুষছি কেন?
–স্যার, কাজটাতো হঠাৎ নাজিল হলো। আগে থেকে কোনো হোমওয়ার্ক করতে পারি নাই।
আর তাছাড়া ওই সাংবাদিককে আমরা চিনিও না।
শুধু ছবি সম্বল করে একজন লোককে হাসপাতালের মতো একটা বড় জায়গায় খুঁজে পাওয়া সহজ কথা না।
একটু উদ্ধতস্বরেই কথাগুলো বলে দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত খাটো শমসের।
মন্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ এ গলায় কেউ কখনো কথা বলে না। তবে শমসেরের জন্য হিসাব আলাদা।
–ঠিক আছে, আজ রাতের মধ্যেই তার পাত্তা বের করো।
–আর হ্যা, ধরার পর পুলিশে দেওয়ার আগে ওর কাছে কী কী ডকুমেন্টস আছে তার খবর বের করবে।
ওই কাগজগুালোও আমার চাই। ক্লিয়ার?
কোনো কথা না বলে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় দুজন। সাধারণত পার্টির সঙ্গে আলাপ যা করার শমসেরই করে।
মবিন কথা বলে কম। কারণ কথার চেয়ে কাজেই বেশি বিশ্বাসী সে।
ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে মন্ত্রীর কাছ থেকে টাকার বান্ডেলটা পকেটে গুজে নেয় শমসের। সামনে অনেক কাজ।
মাথার ভেতর ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে, কিন্তু দুজনের চোখে এর কোনো ছাপ নেই।
ট্রাফিক আইন মেনে নিখুঁতভাবে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা শহরের ব্যস্ত ট্রাফিকে মিশে যায় সাদা গাড়িটি।
প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী এই দুজন পেশাদার……….,
একটু নজর করলে বুঝতে পারতো নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে একটি কালো রঙ্গের বাজাজ পালসার তাদের গাড়িটি ফলো করছে।
উত্তেজনায় দু হাতের তালু ঘামতে থাকে আমিনুলের। হেয়ার রোডে গাড়িটিকে ঢুকতে দেখেই খটকা লাগে।
পরে দুই মুর্তিকে মন্ত্রীর বাড়িতে ঢুকতে দেখে রীতিমতো বোকা হয়ে যায় সে।
ঘটনার শিকড় যে এতোটা গভীরে তা কল্পনাও করতে পারেনি আমিনুল।
ষড়যন্ত্রের শিকড় যে কতোটা গভীরে সেটা টের পেয়ে বুকের ভেতরটা কাঁপতে থাকে।
হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে রোগী সেজে পালানোর আগে এ দুজনের উপর নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছিল তন্ময় ভাই।
তখন থেকেই চিনা জোঁকের মতো এদের পেছনে লেগে আছে আমিনুল। কাজের কী শেষ আছে!
এর পর আবার অফিসে যেতে হবে, তন্ময় ভাইয়ের বাসায়ও যেতে হবে এক চক্কর।
*******
স্কুল জীবনের বন্ধু ওহিদুলের মেসে ছোট্ট চৌকিতে শুয়ে ঘটনা গুলো সাজানোর চেষ্টা করছে তন্ময়।
কিন্তু পুরো চিত্রটা কিছুতেই মেলাতে পারছে না। গতকাল রাতেও এখানেই ছিল তন্ময়। আর সে জন্যই গ্রেপ্তরের হাত থেকে বেঁচে গেছে।
বিভিন্ন স্থানে ফোন করেও যেটুকু খবর জোগার করা গেছে,
তা হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তন্ময়ের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
মৃত্যু শয্যায় ইয়াবা সম্রাট আবু সাঈদের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে।
আর আবু সাঈদকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ডিবির কর্মকর্তা হাফিজুর রহিমকে।
দশ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় হাফিজুর রহিমের মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তা একটিও চোখে পড়েনি।
সাঈদ হত্যার দায়ে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। অন্যদিকে সাঈদ নাকি ইয়াবা চক্রের সঙ্গে জড়িত হিসেবে পুলিশের কাছে তন্ময়ের নাম বলেছে।
কী হাস্যকর কথা। আর সেই বক্তব্যের জের ধরে পুরো ঢাকা শহরের পুলিশ হন্যে হয়ে ঘুরছে তন্ময়কে গ্রেপ্তারের জন্য।
এর পেছনে বড় কারো হাত আছে। এ ব্যপারে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।
নইলে কী আর পুলিশ বিভাগ সহজে একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়। বোঝাই যাচ্ছে বিষয়টি খুবই সিরিয়াস।
রোগী সেজে হাসপাতালের অ্যাম্বলেন্সে চড়ে পুলিশের চোখ এড়ানো গেছে ঠিকই।
কিন্তু কতোক্ষণ পুলিশের নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
সাদেক সরকারের সাহায্য না পেলে এতোক্ষণে তন্ময় পুলিশের লকআপে থাকতো- এ কথা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।
বাংলাদেশের পুলিশ যতোই নিষ্কর্মা হোক, পুলিশ প্রশাসন আন্তরিকভাবে চাইলে যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে।
অভিজ্ঞতা থেকেই এ সত্যটা জানে তন্ময়। সেখানে তার মতো একজন চুনোপুি কে গ্রেপ্তার করাতো পুলিশের বাঁ হাতের খেল।
সাদেকের পারমর্শ মেনে সকাল থেকে এ পর্যন্ত একবারও নিজের মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করেনি তন্ময়।
আমিনুলের দেওয়া অন্য একটি সিম ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় কলগুলো করছে।
আচ্ছা, পুলিশ কীভাবে জানলো যে ওই মুহুর্তে তন্ময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকবে।
তার অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট খাতায় অবশ্য এটা লেখা আছে। তাহলে কী অফিস থেকে এই তথ্য পেয়েছে পুলিশ?
একটি প্রথম সারির দৈনিকের নিউজ রুমে গিয়ে পুলিশের লোকজন অ্যাসাইনমেন্ট খাতা ঘাটছে-
দৃশ্যটা এতোটাই বেমানান যে এই সম্ভাবনাটা তক্ষুনি বাদ দিয়ে দেয় তন্ময়। তাহলে, পুলিশকে এ তথ্য কে দিল?
হাসপাতালে খুনে চেহারার (সাদেক সরকারের ভাষায়) দুজন লোক কেন ছবি হাতে নিয়ে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো।
মন্ত্রীর সঙ্গে তাদের কী সম্পর্ক? এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কখনো কোনো রিপোর্ট করেছে বলেওতো মনে পড়ছে না।
তাহলে কেনো মন্ত্রীর পাঠানো লোক তাকে খুঁজছে?
সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্নটি হচ্ছে, আবু সাঈদ মৃত্যুর আগে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হিসেবে তার নাম বলে গেল কেন?
আদৌ কী আবু সাঈদ এ কথা বলেছে?
আর যদি সে এ কথা না-ই বলে থাকে তাহলে পুলিশ কেন তান নামে এ অপবাদ ছড়াচ্ছে? এতে পুলিশেরইবা কী লাভ?
মাথার ভেতর প্রশ্নগুলো জট পাকিয়ে যায়। তন্ময়ের অস্বিত্ব রক্ষার জন্য এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
সকাল থেকে একবারের জন্যও অফিসের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি তন্ময়।
কেন যেন তার মনে হচ্ছে, অফিসে ফোন করলে সেই সূত্র ধরে পুলিশ তার অবস্থান জেনে যাবে।
অতিরিক্ত সাবধানতা হিসেবে তাই অফিসের সঙ্গে কোনো ধরণের যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে তন্ময়।
আমিনুলের কাছ থেকে পাওয়া খবরে আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়ে তন্ময়।
আসলে বিষ্মিত হতে হতে একেবারে সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে গেছে তন্ময়।
হাসপাতালে তার সন্ধানে আসা দুই ব্যক্তি যে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে এ তথ্যও তাকে জানিয়েছে আমিনুল।
কতদিন পুলিশের কাছ থেকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। সে জন্য টাকা দরকার।
আমিনুলকে তাই বাসায় পাঠিয়েছিল তন্ময় চেক বইটা নিয়ে আসার জন্য। আমিনুল ঘরে ঢুকতেই পারেনি।
পুলিশের একজন কন্সটেবল দরজার সামনে বসা। এ দৃশ্য দেখে মানে মানে সেখান থেকে কেটে পড়েছে আমিনুল।
শুধু জানালা দিয়ে এক ঝলক উঁকি দিয়ে দেখেছে; তন্ময়কে না পেয়ে পুরো ঘরটি তছনছ করেছে পুলিশ।
তার সব বই, জরুরি কাগজপত্র, জামাকাপড়, বিছানার চাদর, বালিশ এমনকী সাধের ল্যাপটপটাও মাটিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
বিছানার তোষক গুলোও উল্টেপাল্টে রেখেছে।
এদিকে আমিনুলকে সামনে পেয়ে বেশ দু কথা শুনিয়ে দিয়েছে কেয়ারটেকার শামসু মিয়া।
এ জীবনে নাকি কখনো পুলিশি ঝামেলায় পড়েনি সে। তন্ময়ের কারণে আজকে এ বাড়িতে পুলিশ এসেছে।
অন্য ভাড়াটেরা সবাই ভয় পাচ্ছে। সামনের মাস থেকে তন্ময়কে আর এ বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে রাখা হবে না বলেও শাসিয়ে দিয়েছে সে।
হাতি যখন ফাঁদে পড়ে চামচিকাও লাথি মারে- মনে মনে ভাবে আমিনুল।
আজকে বিপদে পড়েছে বলে তন্ময় সম্পর্কে এ কথাগুলো বলার সাহস পেলো এই চামচিকা।
ডাকসাইটে সাংবাদিক তন্ময় চৌধুরীকে সামনাসামনি এ কথা বলার সাহস ওই শামসুর বাপেরও নাই।
অফিসের অবস্থাও ভয়াবহ। তাকে নিয়ে ইতিমধ্যেই এডিটর নিউজ ম্যানেজমেন্ট টিমের সঙ্গে দু-দফা মিটিং করেছে।
সিনিয়রদের ওই মিটিংয়ে কি আলোচনা হয়েছে তা অবশ্য বলতে পারেনি আমিনুল।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক খবর হচ্ছে, অফিসে কেউ একজন তন্ময়ের ডেস্কের তালা ভেঙ্গে কে যেন তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজেছে।
সব কাগজ উল্টা-পাল্টা হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে।
নিউজ এডিটর তারেক ভাইয়ের ধারণা কোনো এক ফাঁকে তন্ময় নিজেই অফিসে এসে জরুরি কিছু কাগজ নিয়ে গেছে।
কী হাস্যকর কথা। নিজের ড্রয়ার থেকে কাগজ নিতে হলে তন্ময়কে ড্রয়ার ভাংতে হবে কেন।
সে তো চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলেই প্রয়োজনীয় কাগজ নিতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে তন্ময়ের অফিসের ড্রয়ারের তালা ভাংলো?
তার ঘরের ভেতর কেন তল্লাশি চালানো হয়েছে? দরজাতেই বা কেন পুলিশকে পাহারা দিতে হচ্ছে?
সে তো আর বাংলা ভাই কিংবা শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের মতো বড় কেউ না। তাহলে? তাকে ঘিরে এসব ঘটনা কেন ঘটছে?
মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার জন্য ঠান্ডা মাথায় গত কয়েক মাসের ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে থাকে তন্ময়।
মাস ছয়েক আগে সারা দেশে ইয়াবা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
বিত্তশালী তরুণ-তরুণীর পছন্দের এই ভয়াবহ মাদকটি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে অভিজাত সমাজে। ইয়াবা নিয়ে প্রথম ব্রেকিং স্টোরিটা করে তন্ময়।
এর পরের কয়েক মাস ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে থাকে সে।
ইয়াবা নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফের আনাচে কানাচে দিনের পর দিন চষে বেড়ায় তন্ময়।
ইয়াবা ব্যবসা নিয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য জোগার করে সে। ইয়াবা চোরাচালানের পুরো চক্রটির হদিস বের করে তন্ময়।
কিন্তু পালের গোদাদের পরিচয় অজানাই থেকে যায়।
ঢাকা এসে দ্বিতীয় দফা কাজ শুরুর আগেই অন্য অ্যাসাইনমেন্টে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে ইয়াবা ইস্যুটি আপাতত চাপা পড়ে থাকে।
আর দশটি ঘটনার মতোই ইয়াবা নিয়ে মিডিয়ার হৈচৈও এক সময় থেমে যায়।
পত্রিকাগুলোর কাছে বিষয়টি পুরোনো হয়ে যায় বলে তারা এ নিয়ে নিউজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
নতুন নতুন মশলাদার খবরের পেছনে ছুটতে থাকে সাংবাদিকেরা। এ অবস্থায় গ্রেপ্তার হয় আবু সাঈদ।
আসলে সব সময়ই কিছু লোক থাকে যারা প্রচলিত সিস্টেমের বাইরে চলতে পছন্দ করে। হাফিজুর রহিমও এমনই একজন।
আর এ জন্য তার সঙ্গে দারুন সখ্যতা গড়ে উঠে তন্ময়ের।
অন্য রিপোর্টারেরা যখন ইয়াবা ইস্যু থেকে সরে পড়েছে, তন্ময় তখনো নিয়মিত এ দিকটিতে খেয়াল রাখতো।
আবু সাঈদেও গ্রেপ্তারের ঘটনাটি তাই অন্য মিডিয়াগুলো মিস করলেও তন্ময় করেনি।
যদিও এ নিয়ে লেখা তার রিপোর্টটি পত্রিকায় চোখে না পড়ার মতো করে ছাপা হয়েছিল।
বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে যায়, আবু সাঈদ গ্রেপ্তারের সময় তার উত্তরার বাসা থেকে কিছু কাগজ সরিয়ে নিয়েছিল তন্ময়।
হাফিজুর রহিমের অপার প্রশ্রয়ের জন্যই এ কান্ডটা করতে পেরেছিল তন্ময়। তার উপর রহিমের ছিলো অগাধ ভরসা।
সে জন্যই পুলিশের এই গোপন অভিযানে সঙ্গেী হতে পেরেছিল সে।
এই চাঞ্চল্যকর গ্রেপ্তার অভিযানে মিডিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তন্ময়ই সেখানে উপস্থিত ছিলো।
এটি ছিল তার জন্য এক্সক্লুসিভ নিউজ।
কিন্তু সাঈদের গ্রেপ্তারের খবরটি ভেতরের পাতায় এক কলাম ছাপা হওয়ার পর বুঝতে পারে, এ ব্যপারে পত্রিকার আর কোনো উৎসাহ নেই।
সে কারণে তন্ময়ও ইয়াবা নিয়ে আর কোন স্পেশাল স্টোরি করেনি।
সে জন্য আবু সাঈদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ডকুমেন্টগুলো খুলে দেখা হয়নি।
আচ্ছা, এ তথ্যগুলোর খোঁজেই তার বাড়ির সামনে পুলিশের পাহারা এবং অফিসে ড্রয়ার ভেঙ্গে তছনছ করা হয়নিতো!
ব্রাউন কাগজের প্যাকেটে মোড়ানো ডকুমন্টেসগুলো পাশের ডেস্কে শরীফের ড্রয়ারে রেখেছে তন্ময়।
নানা ধরণের কাগজের চাপে তার ড্রয়ারে একটা আলপিন রাখারও জায়গা নেই। সে জন্যই শরীফের ড্রয়ারে এ কাগজগুলো রেখেছে তন্ময়।
সময়-সুযোগ মতো ইয়াবা নিয়ে আরো বিস্তারিত প্রতিবেদন করার ইচ্ছে ছিল তার।
পরে কাজে লাগবে ভেবে মাদক ব্যবসার মূল্যবান তথ্যগুলো সাবধানে গুছিয়ে রেখেছিল সে।
তন্ময়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, ওই কাগজগুলোর মধ্যেই তার সকল প্রশ্নের উত্তর রয়েছে।
বাদামি প্যাকেটটা হাতে পাওয়ার জন্য অস্থিও হয়ে উঠে তন্ময়। এখন একে একে নানা ঘটনা মনে পড়ছে।
আপাত দৃষ্টিতে ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এখন সবগুলোর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পায় তন্ময়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
মেসের কামড়ার বাতি জ্বালতে ইচ্ছে করছে না তন্ময়ের। বুকের ভেতরটা জ্বালা করছে।
নিজেকে সাংঘাতিক প্রতারিত মনে হচ্ছে। স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এতোটা নীচে নামতে পারে মানুষ!
******
টকটকে লাল মেহেদির আলপনা আঁকা একটি হাত। একটু রোগাটে, ফর্সা। হাতে দুগাছি সোনার চুড়ি।
সামান্য নাড়াচারাতেই টুংটাং সেতারের সুর বাজে। যেন কোনো উস্তাদ বাজানোর আগে তার ঘসে মহড়া দিয়ে নিচ্ছেন।
হাতের চুড়ির শব্দ এতো মধুর, কই আগেতো সেভাবে বুঝতে পারেনি।
শিল্পীর তুলিতে আঁকা আঙ্গুলগুলো ধওে আগে ঝকঝকে কাচের গ্লাস, গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে।
কাজ শেষে ফেরার পর এই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি সারা দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
আজন্ম তৃষ্ণার্তেও মতো এক চুমুকে শেষ করে পুরো গ্লাস। আজ এতো দেরি হচ্ছে কেন?
বুক শুকিয়ে মরুভূমি, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, গলাটা শুকিয়ে শিরিষ কাগজের মতো খসখসে হয়ে আছে।
এক ফোটা পানির জন্য হাহাকার করছে বুকের ভেতর। কেন এতো দেরি হচ্ছে?
কালশিটে পড়া, ফুলে উঠা চোখদুটো অনেক কষ্টে মেলে তাকায় হাফিজুর রহিম। ঝাপসা চোখে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বাস্তবে ফিওে আসে।
মুনমুন আর ফিরবে না, তৃষ্ণার্ত রহিমের বুক আজন্ম শুষ্ক কওে দিয়ে চলে গেছে সে। কয়েক মু র্তেও জন্য চেতনা ফিওে এসেছিল।
বুকের উপর মাথাটি আবার ঝুকে পড়ে। খালি গা, প্যান্ট পরনে। সেটা থেকে বিকট গন্ধ বেরুচ্ছে।
নির্যাতনের এক পর্যায়ে প্যান্টের মধ্যেই পেশাব কওে দিয়েছে রহিম। এ গন্ধ ঢাকার জন্য সেখানে একবালতি পানি ঢালা হযেছে।
শরীরটা শুকনা হলেও কোমর থেকে শুরু কওে পা দুটো চুপচুপে ভেজা।
এ অবস্থাতেই আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছে হাফিজুর রহিম। সকাল থেকে একটি দানাও পেটে পড়েনি।
সারা দিনে খাদ্য বলতে পাওয়া গেছে দু বোতল দুর্গন্ধযুক্ত পানি।
পেশাদার লোকগুলো মারধোর শুরুও পর থেকেই চেষ্টা হাফিজুর রহিম জ্ঞান হারিয়ে ফেলার চেষ্টা করছিলো।
এক মাত্র সংজ্ঞাহীনতাই পাওে তাকে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে।
চার-পাঁচজন লোক মোটা গজারির লাঠি দিয়ে টানা প্রায় ২০ মিনিট পিটিয়েছে হাফিজুর রহিমকে।
এ সময় নির্যাতনকারীরা মুখ দিয়ে একটি শব্দও করেনি। কোনো প্রশ্নও নয়। শুধু পিটিয়ে গেছে।
হাফিজুর রহিম বুঝতে পারে, এভাবেই নরকের কীটগুলো তার মনোবল ভেঙ্গে দিতে চাইছে।
আচ্ছন্ন অবস্থায় হাফিজুর রহিম মনে মনে এ লোকগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করে।
অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণার সবচেয়ে ভালো দিকটি হচ্ছে, সাময়িকভাবে এটি তার মানষিক অবসাদে ভুলিয়ে দিচ্ছে।
পিয়তম স্ত্রী বিয়োগের তীব্র শোককেও দূওে ঠেলে রেখেছে শরীরের প্রতিটি রোমকূপের অসহ্য যন্ত্রণা।
ভিতু এবং নির্বোধরা সৎ হলে বুঝি এভাবেই দাম চুকাতে হয়। প্রচলিত সিস্টেমটা মেনে চলাই তাদেও জন্য মঙ্গল।
হাফিজুর রহিম কখনোই ডাকাবুকো ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখচোরা হিসেবেই ছিল তার পরিচিতি।
জীবনে একটা মাত্র সাহসের কাজ করেছে সে। সেটি হচ্ছে, মুনমুনকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া।
এর বাইওে সাহসী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মতো আর কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা হাফিজুর রহিমের জীবনে ঘটেনি।
কখনো কখনো মানুষ নিজের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরিত আচরণ কওে বসে না?
মাদক ব্যবসায়ী চক্রটিকে নিয়ে সেরকমই একটা নির্বোধ অভিযানে মেতে উঠেছিল রহিম।
এই চক্রের শেকড় কতোটা গভীরে; নিজের বুদ্ধি দিয়ে সে সম্পর্কে একটা ধারণা কওে নিয়েছিল রহিম।
বাস্তবের সঙ্গে যে তার ধারণার দূরত্ব কতোটা সেটা বোঝার দাম চুকাতে হলো মুনমুনের জীবনের বিনিময়ে।
ঘরটির দরজা-জানালা সব বন্ধ। দিন নাকি রাত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সময়ের কোনো হিসেব নেই।
কতোক্ষণ পরে জানা নেই, তিনজন লোক এসে সামনে দাঁড়ায়। মাথা তুলে তাদেও দেখার চেষ্টা কওে রহিম।
আবছা অন্ধকাওে চেহারা বোঝা যায় না। জ্বলন্ত সিগারেটটি একজন রহিমের ঘাড়ে ঘসে ঘসে নেভায়।
তার ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি দেখে মনে হবে যেন অ্যাশট্রেতে চেপে সিগারেটের গোড়ানি নিভিয়েছে।
সারা শরীর অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে।
গলা চীওে তীব্র চিৎকার বের হয়ে আসতে চায়; কিন্তু গোঙ্গানীর মতো একটু শব্দ বের হয় রহিমের গলা দিয়ে।
মুখ দিয়ে লালা গড়াতে থাকে। কয়েকটা নীল ডুমে মাছি তার মুখের সামনে উড়তে থাকে।
অতি সাহসি দু-একটা ফেটে যাওয়া ঠোটে এসে বসে। গাটা শিরশির কওে উঠে।
দু হাত বাঁধা থাকায় মাছিগুলোকে বাধা দেওয়ার উপায় নেই।
শান্ত ভঙ্গীতে সামনে রাখা চেয়ারগুলোর দখল নেয় তিনজন।
তাদের মধ্যে একজন একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,
আবু সাঈদেও বাড়ি থেকে আনা কাগজগুলোর কোনো কপি কী তোমার কাছে আছে?
অপ্রত্যাশিত এই প্রশ্নে অবাক হয় রহিম। প্রথমে সে বুঝতেই করতে পাওে না, কিসের কথা বলছে তারা।
একটু পর মনে পড়ে যায়, মাদক ব্যবসায়ী আবু সাঈদকে গ্রেপ্তারের সময় কিছু কাগজ জব্দ করেছিল পুলিশ।
সেগুলোতে সব অফিসের ফাইলেই আছে। প্রশ্নকারীদের জানায় রহিম। কথাগুলো বলতে অবর্ননীয় কষ্ট হয়।
জোরে জোরে হাঁফাতে থাকে। মাথার ভেতরটা দপদপ করে উঠে।
পুলিশের তালিকায় যেগুলো দেখানো হয়েছে সেগুলোতো বাজার ফর্দেও মতো নির্দোষ কাগজপত্র। আসল মালগুলো কোথায়?
যে গুরুত্বপূর্ণ ডক্যুমেন্টস তোমরা এনেছে সাঈদের বাড়ি থেকে সেগুলোর কোনো হদিস ফাইলে নেই।
জব্দ তালিকাতেও উল্লেখ নেই সেই কাগজগুলোর।
জনাব হাফিজুর রহিম, ওই কাগজগুলো আপনার হেফাজতেই আছে বলে আমাদেও বিশ্বাস।
এখন দয়া করিয়া আপনি কী আমাদেও বলিবেন, কোথায় ওই গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ রক্ষিত রহিয়াছে?
যেন বিরাট একটা রসিকতা করা হয়েছে; এমন দৃষ্টিতে রহিমের চোখে চোখ রাখে প্রশ্নকর্তা। শূণ্য দৃষ্টিতে দিকে তাকিয়ে থাকে রহিম।
কী জিজ্ঞাস করা হচ্ছে, এর কিছুই মাথায় ঢোকে না। ধৈর্য্য ধরে উত্তরের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে প্রশ্নকর্তা।
একটি সিগারেট ধরিয়ে নি:শব্দে টানতে থাকে। বদ্ধ ঘরে পাক খেয়ে ঘুরতে থাকে সিগারেটের নীল ধোঁয়া।
হাফিজুর রহিমের গা গুলিয়ে উঠে। হড়হড় করে বমি করে দেয়। খালি পেট থেকে পানি ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।
প্যান্ট নষ্ট হওয়ার ভয়ে তিনজনই একটু দূরে সরে বসেন।
মাথায় এক বালতি পানি ঢেলে হুস ফিরিয়ে আনা হয় হাফিজুর রহিমের। আবারও একই প্রশ্ন করা হয়। বার বার, বার বার।
এক পর্যায়ে আবছা মনে পড়ে, সাঈদের আস্তানা থেকে তন্ময় কিছু কাগজ সরিয়ে নিয়েছিলো।
এই বর্বরগুলো সম্ভবত সেগুলোই খুঁজছে। এ কথাই জানায় সে তিনজনের দলটিকে।
এবার সাফল্যেও হাসি হাসে দলের সবচেয়ে মোটা লোকটি, সম্ভবত সেই দলনেতা।
হাফিজুর রহিমের বাড়ি এবং অফিসের আলমারি তন্ন তন্ন কওে খুঁজেও কাঙ্খিত কাগজগুলোর কোনো হদিস মেলেনি।
সাংবাদিক তন্ময় চৌধুরির কাছে আছে এগুলো; এ তথ্য তাদেও কাছেও ছিল।
তথ্যটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবং যতোটুকু জানা গেছে,
এর বাইরে হাফিজুর রহিমের কাছে আর কোনো তথ্য প্রমাণ আছে কী না সেবিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই দিনভর তাকে এ নির্যাতন করা হয়েছে।
চোখের ইঙ্গিতে বাকি দুজনকে কিছু একটা ইশারা করে বাইওে চলে যায় দলের নেতা।
গুন গুন করে একটা বাজার চলতি হন্দী গানের কলি ভাজতে ভাজতে কমড়া ছেড়ে তার চলে যাওয়া দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই;
এই মাত্র হাফিজুর রশিদেও মৃত্যু পরোয়ানার সই কওে এসছে । রহিমকে কাগজে-কলমে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।
‘দুর্ঘটনায়’ স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাভিভূত পুলিশ কর্মকর্তার সুইসাইডাল নোটটি কাল সকালে বেডরুমে তার মৃতদেহের সঙ্গেই পাওয়া যাবে।
মুনমুনকে যে রহিম পাগলের মতো ভালোবাসতো এ কথা কে না যানে! এক যুগের প্রেম বলে কথা।
ইউনিভার্সিটিতে তাদের প্রেমকাহিনীতো মুখে মুখে ফিরতো।
এরকম একজন প্রেমিক তো প্রেমিকার মৃত্যুতে আত্মহত্যা করতেই পারে; এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ আছে?
আট
বাড়ি ফিরে প্রথম কাজ হচ্ছে হট শাওয়ার নেওয়া। এরপর ভাত খেয়ে সঙ্গে আনা পত্রিকার ন্যাশনাল এডিশনটি খুটিয়ে পড়া।
কোনো ভুল থাকলে ফোন করে সেটা নাইট ডিউটিতে কর্মরত ডেস্কের কাউকে জানিয়ে দিতে হয়।
সিটি এডিশন বা নগর সংস্করণে সেই ভুলগুলো শুধওে নেওয়া হয়। এই দৈনন্দিন রুটিনে ছেদ পড়েছে আজ।
অফিস থেকে ফিরে শাওয়ারে যাওয়ার সময় পাননি তারেক আহমেদ। তার সামনে বসে আছে তন্ময়।
তন্ময় সারা শহরে এসব কী ঘটছে? সকাল থেকে কোথায় ছিলে তুমি? একবারো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করোনি।
তোমার সেল ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি। কী হচ্ছে এসব? তোমার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে কেন?
কালকের সবগুলো কাগজে এ খবর ছাপা হচ্ছে সেটা জানো তুমি?
একদমে কথাগুলো বলে একটু থামেন তারেক। উঠে টয়লেটে যান। ফেরার পথে ডাইনিং রুমের ফ্রিজ খুলে দুটো বিয়ারের ক্যান বের করেন।
একটি তন্ময়ের দিকে এগিয়ে ছুড়ে দিয়ে অন্যটি খুলে ক্যান থেকেই চুমুক দিয়ে খেতে শুরু করেন। চুপচাপ কিছুক্ষণ বিয়ার পান করে দুজন।
সেন্টার টেবিলে রাখা তারেকের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরায় তন্ময়। পাশের বেডরুমে মিনা ভাবি আর ছেলে রুদ্র ঘুমাচ্ছে।
স্কুল শিক্ষিকা মিনা ভাবিকে খুব ভোরে উঠতে হয়। রুদ্রকে স্কুলে পাঠিয়ে তারপর ছুটতে হয় নিজের কর্মস্থলের দিকে।
এ কারণে রাতে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। এ বাড়ির নারী নক্ষত্র সবকিছু তন্ময়ের জানা।
মোহাম্মদপুরের দিকে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট বা কাজ থাকলে মিনা ভাবির হাতে দুপুরের খাবারটি খেয়ে যায় তন্ময়।
এ ছাড়াও পালা-পার্বনে এ বাড়িতে তন্ময়সহ আরো কয়েকজন সহকর্মী দাওয়াত বাঁধা। মিনা ভাবির হাতের রান্না যেন অমৃত।
সুযোগ পেলে সেই অমৃতরস থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে না তন্ময়।
–কি ভাবছো তন্ময়?
তারেক ভাইয়ের ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারে না।
মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। মাথাটা তুলে সরাসরি তাকায় তারেকের দিকে।
–কেন এমন করলেন তারেক ভাই?
–এ কথার মানে? তুমি কী বলতে চাচ্ছো? তন্ময়ের প্রশ্নে অবাক হন তারেক আহমেদ।
স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়। আজ সারা দিন পুরো ব্যপারটি নিয়ে ভেবেছে তন্ময়।
ভেবে ভেবে নিজের মতো করে পুরো ঘটনাটি সাজিয়েছে। এরপর বার বার উল্টেপাল্টে পুরো বিষয়টিকে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছে।
এভাবেই ছোটখাট ফাঁকফোকর গুলো ভরাট করেছে।
এক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে জোড়া লাগিয়ে পুরো ছবিটা তৈরি করেছে। কি নিখুঁত পরিকল্পনা!
তারেকের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে তন্ময়, আপনি ছিলেন আমার কাছে নেক্সট টু গড। আপনার হাতে বড় হয়েছি আমি।
হাতে কলমে রিপোর্টিং শিখিয়েছেন আপনি। বিভিন্ন সময় ঠেকা-বেঠেকায় টাকা দিয়েও সাহায্য করেছেন।
মফস্বল শহর থেকে আসা একটি ছেলে, ঢাকা শহরে যার পরিচিত কেউ নেই,
সেই আমি ঢাকা শহরে আজকে এ অবস্থানে পৌছেছি আপনারই বদৌলতে। এ জন্য আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
আপনি যখন যেটা করতে বলেছেন, কোনো প্রশ্ন না করে হুকুম তামিল করে গেছি।
আপনি চাইলে সারা জীবন আমাকে কৃতদাস করে রাখতে পারতেন। কিন্তু এটা কী করলেন আপনি?
…………
–“তুমি কী বলতে চাচ্ছো, পরিষ্কার করে বলো” বললো তারেক।
জোর গলায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করলেও কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটে গেছে। তারেকের গলায় সেই জোরটি ফুটে উঠে না।
–সব খুলে বলতে হবে? শুনুন তবে। আজকে আমি ঢাকা মেডিকেলে অ্যাসাইনমেন্ট যাবো এ তথ্য আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না।
তাহলে সেখানে পুলিশ কিভাবে আমার খোঁজে গেল? মানলাম পুলিশ পত্রিকা অফিস থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করেছে।
তাহলে সেখানে আমার ছবি হাতে ভাড়াটে দুজন গুন্ডার উপস্থিতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি?
তাদেরকে আমার ছবিটাইবা কে সাপ্লাই দিলো?
এখানেই শেষ নয়। মাদক ব্যবসায়ী চক্রের নাটের গুরু আবু সাঈদকে গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে কিছু গোপন দলিল নিয়ে এসেছিলাম।
সেই তথ্য শুধু আপনাকেই জানিয়েছি। অফিসে বা অফিসের বাইরে আর কেউই সে কথা জানেনা।
আসলে কথাটি গোপন করার জন্য নয়, এমনিতেই এ বিষয়টি আর কারো সঙ্গেই শেয়ার করিনি আমি।
মানে এ ব্যাপারে কারো সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।
তাহলে কিসের খোঁজে আমার বাসা এবং অফিসের ড্রয়ার ভেঙ্গে তছনছ করা হয়েছে?
কী এমন মূল্যবান মনিমুক্তা লুকিয়ে রেখেছি আমি অফিসের ডেস্কে?
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আরো শুনতে চান? মেডিকেল কলেজে আমাকে খুঁজে না পেয়ে ওই দুই গুন্ডা কী করেছে জানেন?
আপনার প্রিয় মন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে রুদ্ধদার বৈঠক করেছে। আর সেই বৈঠক শেষে পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছে আমার খোঁজে।
ওই মন্ত্রীর সঙ্গে আপনার সখ্যতার কথাতো সাংবাদিক মহলে রীতিমতো কিংবদন্তি।
বাড়ি গেলে মন্ত্রী নিজের হাতে আপনার জন্য শুঁটকি মাছ নিয়ে আসেন। এ দৃশ্যতো আমার নিজের চোখে দেখা।
মন্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতার নানা গল্প আপনিই আমাদের কাছে করেছেন। একদিকে পুলিশ, আর অন্যদিকে আপনার মন্ত্রীর পোষা গুন্ডা।
আজ সারা দিন ফাঁদে আটকা পশুর মতো ছটফট করেছি আমি।তিক্ততায় মনটা ভরে যায় তন্ময়ের।
এতোদিন যাকে গুরুর আসনে বসিয়ে শ্রদ্ধা করেছে তার কাছ থেকে এই আঘাত পেয়ে বুকটা ভেঙ্গে যায় তন্ময়ের।
পাথরের মুর্তির মতো মুখোমুখি সোফায় বসে আছে তারেক।
কথাগুলো বলতে বলতে কখন যে দু চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করেছে নিজেও জানেনা তন্ময়।
কতোটা নীচে নামলে একজন মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অন্যকে খুন করতে পারে!
সৎ পুলিশ অফিসার হাফিজুর রহিমকে মিথ্যা অভিযোগে ফাসাতে এতোটুকু বাঁধলো না আপনাদের!
তার স্ত্রী মুনমুনকেও তো আপনারাই হত্যা করেছেন।
এ কাজে মন্ত্রীর দুই পোষা গুন্ডাকে ব্যবহার করা হয়েছে, এ কথা আমি লিখে দিতে পারি।
আচ্ছা, আবু সাঈদকে ডিবি পুলিশের হেফাজতে খুন করলেন কিভাবে? এটা একটা প্রশ্ন বটে!
আর এই প্রশ্নের উত্তরও আমি নিজের মতো করেই খুঁজে বের করেছি।
শুধু মন্ত্রীই নয়, আপনাদের এই দুষ্টচক্রে পুলিশের বড় কর্তাও জড়িত।
এর প্রমাণ অবশ্য টেকনাফে ইয়াবা বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়া টের পাইছিলাম। তখন নামগুলো খুঁজে পাইনি।
এখন একটা একটা করে নাম সামনে আসছে। কাউকে ছাড়বো না আমি।
এখন বুঝতে পারছি, কেন হঠাৎ করে আমার ড্রাগসের স্টোরিগুলা কিল করতে শুরু করলেন।
আচ্ছা আপনার কাছে একটা শেষ প্রশ্ন, এই প্রশ্নটার জবাব আমি নিজে বের করতে পারছি না।
আপনি ছাড়া মনে হয় এই মুহুর্তে এই প্রশ্নের জবাব আর কেউ দিতে পারবে না।
প্রশ্নটা হচ্ছে, কতো টাকার বিনিময়ে আপনি নিজেকে বিক্রি করেছেন?
আমার জানামতে অন্তত দুজন মানুষের খুনের দোষে দোষী হয়েছেন?
আমার মতো একজন নিরপরাধ মানুষের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছেন। পাগলা কুত্তার মতো পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন আমার পেছনে?
এসবের দাম কতো? বলেন, কতো টাকায় নিজের বিবেক বিক্রি করেছেন?
আপনার ছেলেতো বড় হচ্ছে, একদিন যদি সেও ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ে তাহলে কী নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন?
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই তারেক আহমেদের কাছে। চুাপচাপ তন্ময়ের কথাগুলো শুনে যায়।
জবাব দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। তন্ময়ের অকাট্য যুক্তির সামনে দাঁড়াতে পারে না সে।
বেডরুমের দরজায় শব্দ হতে দুজন এক সঙ্গে চমকে সেদিকে তাকায়। দরজায় ঝোলানো পর্দা ধরে কাঁপছে মিনা ভাবি।
উত্তেজনার বশে হয়তো গলা চড়ে গিয়েছিল তন্ময়ের। আর তাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে মিনার।
কতোক্ষণ ধরে তাদের কথোপকথন শুনছে মিনা জানা নেই তন্ময় কিংবা তারেকের।
বোকার মতো মিনার দিকে তাকিয়ে থাকে দুজন। এ সময় তাদের তিনজনকে চমকে দিয়ে কল বেলটা বেজে উঠে।
চট করে দেয়ালে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকায় তন্ময়। পৌনে একটা। এতো রাতে কে এলো?
চিতার মতো খিপ্র গতিতে লাফ দিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে যায় তন্ময়। ছোট্ট ফুটোটি দিয়ে দেখে বাইরে অচেনা দুজন দাঁড়ানো।
এর আগে কখনো না দেখলেও এক নিমিষেই বুঝে যায়, তাকে ধরতে মন্ত্রীর পোষা দুই গুন্ডা এসেছে।
তন্ময় আরো বুঝতে পারে, একটু আগে টয়লেটে যাবার অযুহাতে সেখান থেকে মোবাইল ফোনে এই দুজনকে খবর দিয়েছে তারেক।
যুক্তি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তন্ময়ের মন মেনে নিতে পারছিলো না তারেকের এই কুৎসিত রূপটিকে।
দোরগোড়ায় দুজন বাড়াটে খুনিকে দেখে যুক্তি ও মনের বিভেদটা কেটে যায়। মুহুর্তেই পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নেয় তন্ময়।
ছুটে আসে তারেকের কাছে। তারেক ও তার স্ত্রী মিনাকে ঠেলে বেডরুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজাটি বন্ধ করে দেয়।
এর পর লিভিং রুমের বারান্দা থেকে এক লাফে রাস্তায় নেমে আসে। দোতলার বারান্দা থেকে লাফ দিতে কোনো কষ্টই হয় না।
একটু দূরে অন্ধকারে অপেক্ষায় থাকা আমিনুলের মোটর সাইকেল তৈরিই ছিল।
শমসের আর মবিনকে আসতে দেখেই মটর সাইকেল স্টার্ট দিয়ে রেডি হয়ে ছিল আমিনুল।
এর আগে অবশ্য আরেকটি জরুরি কাজ সেরে নিয়েছে। ফটোগ্রাফারের সহজাত রিফ্লেক্স থেকেই কাজটা করে আমিনুল।
ল্যাম্প পোস্টের আলোর নীচে শমসের ও মবিন আসা মাত্রই ক্যামেরার সাটার টেপে।
এই আবছা অন্ধকারে ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি খুব ভালো আসা কথা না;
কিন্তু আমিনুল জানে তার এ অত্যাধুনিক নাইকন ক্যামেরাটি বরাবরের মতো এবারও এর সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখাবে।
এর আগেও নানা দুর্লভ মুহুর্তে দারুন সাড়া পেয়েছে এটির কাছ থেকে।
যেন প্রয়োজন বুঝে সময় সময় সাধ্যের চেয়ে বেশি করে এই যন্ত্রটি। আমিনুলের মুখে হাসি ফোটে।
সারা দিনে এই দুই গুন্ডার পেছনে ছুটে গাড়ির নম্বর প্লেট ছাড়া কাজের কোনো ছবি তুলতে পারেনি।
দুই সন্ত্রাসীর যে কয়টা স্ন্যাপ নিয়েছে সেগুলো হয় পেছন থেকে, নয়তো সাইড থেকে এসেছে। চেহারা বোঝা যায় না।
এবারই প্রথম একেবারে সরাসরি মুখের ছবি তোলা গেছে।
মনের মতো একটা ছবি তোলার আনন্দে সশব্দে মটর সাইকেলের পিকআপ দাবায় আমিনুল।
…………….
রাত অনেক হলো।
অভিজাত পাড়া গুলশান ঘুমিয়ে। তবে ঢাকাতো চব্বিশ ঘন্টার শহর। এখানে চব্বিশ ঘন্টা সব কিছু পাওয়া যায়।
ঢাকার মেট্রোপলিটন পরিচয় রক্ষার জন্যই হয়তো রাতের নিস্তব্ধতা চীরে রাস্তা দিয়ে হুস-হাস শব্দে দ্রুত গতির গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।
শব্দনিরোধক কামড়ায় বসেও দ্রুত গতির যানের শব্দ পাচ্ছেন ডিআইজি মাসুদ ইব্রাহিম।
চিন্তাকিষ্ট মুখে একটু পর পর হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। সাধারণত তিন পেগেই নেশা হয় মাসুদের।
কিন্তু আজ যে কী হলো!
এটা চতুর্থ পেগ চলছে।
হুইস্কির কোনো আছর টের পাচ্ছেন না। মুখোমুখি বসা মন্ত্রীর হাতের জ্বলন্ত সিগারটিতে দু-একটা টান পড়েছে পড়েনি।
এর পর বোধ হয় আঙ্গুলের ফাকে ধরা বস্তুটির কথা ভুলেই গেছেন তিনি। পুড়ে পুড়ে লম্বা ছাই জমেছে সিগারের মাথায়।
কিছুটা বেঁকে গেছে। এই বুঝি কার্পেটে ছাই পড়লো! একটু টেনশন নিয়ে মন্ত্রীর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন ডিআইজি।
পদমর্যাদার বিচারে গভীর রাতে মন্ত্রীর সঙ্গে বসে সুরা পান করার কথা নয় পুলিশের একজন ডিআইজির।
মাসুদ মন্ত্রীর সঙ্গে বসে আছেন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হিসেবে।
এর বাইরেও মন্ত্রীর সঙ্গে আরেকটি বিষয়ে সম্পর্ক আছে ডিআইজির। সেটি অবশ্য বৈষয়িক সম্পর্ক।
এরা দুজনই অলিখিতভাবে একটি গোপন ব্যবসার অংশীদার। অন্য সব সম্পর্ক ছাপিয়ে এই সম্পর্কটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
একটা ছোট্ট ঝামেলা নিয়ে চিন্তিত দুজন। না, একটু ভুল হলো বোধ হয়। প্রথমে ঝামেলাটি ছোট্ট ছিল।
সমাধানও ছিলো হাতের নাগালে। কিন্তু আস্তে আস্তে কেমন করে যেন পুরো ব্যপারটি তালগোল পাকিয়ে গেছে।
যেটিকে কোনো ঝামেলাই মনে হয়নি, সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে।
প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল পুরো পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে…………
এবং পুলিশের বাইরে আন্ডারগ্রাউন্ডের শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাজে লাগিয়েও বাগে আনা যায়নি তন্ময় চৌধুরীকে।
এই দুই টাকার এক সাংবাদিক যে এতোটা ভোগাবে কে জানতো!
অথচ এই মুহুর্তে তাদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই ছোকরা।
যথেষ্ট পরিমাণ নিকোটিন এবং অ্যালকোহল এই দুই অংশীদারের দুশ্চিন্তাকে সাময়িকভাবেও দূর করতে পারছে না।
নি:শব্দে মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসে থাকে দুজন। কামড়ায় তৃতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করেন।
ডিআইজির অভ্যর্থনায় বোঝা যায়ইনিও এদের ব্যবসার আরেকজন পার্টনার।
অবশ্য ঘনিষ্ট কেউ না হলে গুলশানের এই অভিজাত গেস্ট হাউজে মন্ত্রীর গোপন বৈঠক সম্পর্কে জানার কথা না।
সম্ভবত মন্ত্রীর স্ত্রীও জানেন না তিনি এখন কোথায় কী করছেন। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যেই এখানে এসে একান্তে কিছুটা সময় কাটিয়ে যান।
বেনামে করা নিজের এই গেস্ট হাউজটিতে মন্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য সকল ব্যবস্থাই করা থাকে।
এই মাত্র যোগ দেওয়া তৃতীয় ব্যক্তিটি সংক্ষেপে একটু আগে ঘটে যাওয়া নিউজ এডিটরের বাড়ির ঘটনাটি জানায়।
সদ্য পাওয়া তথ্য গুলো মন্ত্রী এবং ডিআইজির কপালে আরো কয়েকটা ভাঁজ যুক্ত করে। আজকের দিনটাই কী দু:সংবাদের।
আবু সাঈদকে সরিয়ে দেওয়া এবং সে ঘটনায় হাফিজুর রহিমকে ফাসিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তীতে ছিলো সবাই।
তন্ময়কে কব্জা করাটাকে ভেবেছিলো দুই মিনিটের মামলা।
রাতে তাকে ঘরে না পেলেও কোনো চিন্তা হয়নি; সকালে কোথায় পাওয়া যাবে এটাতো জানাই ছিলো।
কিন্তু হাসপাতাল থেকে যেন একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তন্ময়। এর পর সারা দিনেও তার টিকির নাগাল পাওয়া যায়নি।
সব শেষে রাত একটায় তাকে দেখা গেছে তারেক আহমেদের বাড়িতে।
মন্ত্রীর মোবাইল ফোনটি কেঁপে উঠে। স্ক্রিনে শমসেরের নাম দেখে দ্রুত রিসিভ করেন।
–বলো শমসের।
–পাখি উড়ে গেছে বস্।
–মানে, তোমরা সেখানে কি.. .. ছিড়তে গিয়েছো?
সকল শিষ্ঠাচার ভুলে খিস্তি করে উঠেন মন্ত্রী। তার এই ভাষাজ্ঞানলুপ্ততা ঘটনার গুরুত্বেও বার্তা বয়ে আনে ডিআইজির কাছে।
–একটা কাজও যদি তোমরা ঠিক মতো করতে পারতে।
–তোমাদের মতো দুজন স্কিল্ড লোককে একটা আনাড়ি এভাবে একের পর এক ঘোল খাওয়াচ্ছে, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
ওই প্রান্ত থেকে একটা কিছু বলে শমসের। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে মোবইল ফোনটা দেয়ালে আছড়ে মারেন মন্ত্রী।
দরজার বাইরে খান মজলিশ তৈরিই ছিলো।
দ্রুত ঘরে ঢুকে মন্ত্রীর ভাঙ্গা মোবাইলটি কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মোবাইলে মন্ত্রীর সিম কার্ডটা ভরে দেয়।
বোঝা যায়, আগেও বেশ কয়েকবার তাকে এই কাজ করতে হয়েছে। মন্ত্রীর চোখের ইশারায় কামড়ার বাইরে চলে যান খান মজলিশ।
সুরাপাত্রে বড় একটি চুমুক দিয়ে মেজাজ বশে আনার প্রয়াস চালান মন্ত্রী। কামড়ার নতুন সদস্যের দিকে ফিরে বলেন,
–ঘটনাটা কোথায় গড়ােচ্ছ বুঝতে পারছেন?
আপনার ওই রিপোর্টার যদি কোনোভাবে তথ্যগুলো ফাঁস করে দেয় তাহলে শুধু আমি নই,
আপনি এবং এই ডিআইজিসহ কমপক্ষে দুজন সেক্রেটারি এবং আরো ডজনখানেক পুলিশের বড় কর্মকর্তা ফেসে যাবে।
আপনার সঙ্গেতো সে আছে প্রায় দশ বছর। আপনি কোনো ধারণ দিতে পারেন, কোন গর্তে লুকাতে পারে বদমাশটা।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নেন সম্পাদক আব্দুস সালাম। একটু বিব্রত বোধ করেন তিনি।
তন্ময়ের কাছে যে নাকানিচোবানি খেতে হচ্ছে, তার জন্য যেন তিনি নিজেও দায়ী।
পত্রিকায় যখন একের পর এক ইয়াবা নিয়ে স্টোরি ছাপা হতে শুরু করলো, তখন উপায় অন্তর না দেখে সম্পাদককে চক্রে টেনে নেন মন্ত্রী।
এ জন্য সম্পাদকের প্রাবাসী শালার অ্যাকাউন্টে আট অঙ্কের টাকা জমা রাখতে হয়েছে।
এর পরই হঠাৎ করে মাদক নিয়ে নিউজ করার উৎসাহ কমে যায় প্রথম সারির এই জাতীয় দৈনিকটির।
নারী নির্যাতন, চিকিৎসা সেবা, নারী ও শিশু পাচারের মতো চালু ইস্যুগুলোকে হাইলাইট করতে থাকে সুকৌশলে।
এর আড়ালে সারা দেশে ভয়াবহ থাবা বিস্তার করে নীল নেশা।
মন্ত্রী, পুলিশ, আমলা আর মিডিয়ার আশীর্বাদে মাদক ব্যবসায়ীরা হয়ে উঠে বেপরোয়া।
চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে এর সঙ্গে জড়িত রুই-কাতলাদের ব্যাংক ব্যালেন্স।
হাতের গ্লাসটিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে আব্দুস সালাম বলেন, সকাল থেকে তন্ময়ের সঙ্গে ছিল ফটোগ্রাফার আমিনুল।
সারা দিনেও তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় এটাকে ধরলে আসলটির খোঁজও পাওয়া যাবে। কান টানলেই মাথাটা কব্জায় চলে আসবে।
আমিনুল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তিনি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছেন।
এই তথ্য এতোক্ষণে দিচ্ছেন? সারা দিন ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন? খেকিয়ে উঠেন মন্ত্রী।
দ্রুত মোবাইল ফোনটা তুলে নেন। বোতাম টিপে ডায়াল করেন।
আমিনুলের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেন তার পোষা মবিন আর শমসেরকে আর ফোন নম্বরটি পুলিশ বিভাগকে জানিয়ে দেন ডিআইজি।
সুসংবাদ বয়ে আনা ফোন কলের অপেক্ষায় নি:শব্দে পান করতে থাকে তিনজন। সামনে রাখা কাজু বাদামের প্লেটটি অবহেলায় পড়ে থাকে।
*********
রাত দেড়টা।
পত্রিকার নগর সংস্করণ এই মাত্র ছাড়া হয়েছে। বহুল প্রচারিত দৈনিকগুলো প্রতিদিন দুটি সংস্করণ প্রকাশ করে।
প্রথমটি সারা দেশের জন্য, আর দ্বিতীয়টি আরো নিউজ আপডেটসহ নগর সংস্করণ।
ন্যাশনাল এডিশন, অর্থাৎ প্রথম সংস্করণটিতে কোনো ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তা দ্বিতীয় সংস্করণ বা নগর সংস্করণে শুধরে নেওয়া হয়।
তাই নগর সংস্করণটির ট্রেসিং ছাপাখানায় পাঠানোর আগ পর্যন্ত নাইট ডিউটির দায়িত্বরতদের ছুটি নেই।
নগর সংস্করণটি ছেড়ে দিয়ে নাইট ডিউটির রিপোর্টার আর ডেস্কের সাব এডিটরেরা ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিছুই হয়নি এমন একটা চেহারা করে নিউজ রুমে ঢোকে আমিনুল। একটি কম্পিউটারের সামনে বসে ইন্টারনেটে চ্যাট করতে থাকে।
ফটোগ্রাফারেরাও পালা করে রাতের ডিউটি করে। তাই এতো রাতে আমিনুলের উপস্থিতি কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না।
লোক দেখানো চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকলেও একটি হাত দিয়ে শরীফের ডেস্কের ড্রয়ারটি খোলার চেষ্টা চালাতে থাকে আমিনুল।
প্রায় বিশ মিনিট চেষ্টার পর সফল হয়। অফিসের ড্রয়ারের এই তালাগুলো আসলে খুব পলকা।
নিম্নমানের এ তালাগুলোকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় আমিনুল। ড্রয়ার খুলেই উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।
তন্ময় তাকে বলেছে, এ ড্রয়ারে কতোটা অমূল্য বিস্ফোরক রাখা আছে। এ তথ্যগুলো সামনে এলে সারা দেশে উলটপালট হয়ে যাবে।
দাবানলের মতো মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়বে তা সাধারণ মানুষের মাঝে।
বাদামি কাগজের প্যাকেটটা বের করে দ্রুত ক্যামেরার ব্যাগে ভরে ফেলে আমিনুল। গলাটা বার বার শুকিয়ে আসে।
চকিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে তরতর করে সিড়ি বেয়ে নেমে যায়।
নীচে রমিজের দোকানে বসে আয়েশ করে এক কাপ চা’র সঙ্গে সিগারেট জ্বালায়। হাতে কিছুক্ষণ সময় আছে।
তনু ভাই এখনো একরামুলের খোঁজ পান নাই। ওই শালাকে পেটানোর পর শাহজাহানপুর থেকে তনুভাইকে তুলে নিতে হবে।
আজ রাতটা পুরান ঢাকায় একটা ডেরায় কাটাতে হবে। কাধের ব্যাগটা নামিয়ে রমিজের পাশের টুলে রেখে একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে নেয়।
সারা দিন যে ধকলটা গেল! ওহ। পুরো শরীর ব্যথা হয়ে গেছে।
মালটা হাতে এসেছে। তনু ভাইয়ের ধারণা এই প্যাকেটের ভেতরের কাগজগুলোর জন্যই সারাদিন এতো জলঘোলা হয়েছে।
কী আছে এর ভেতর? খুলে দেখারও সাহস হয়না আমিনুলের। দোকানের কাউন্টারের ভেতর রাখা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ।
যাক, বিরাট একটা কাজ হয়েছে। সুখবরটা তন্ময়কে জানানোর জন্য মোবাইল ফোনের বোতাম টেপে আমিনুল।
চারজনের দলটিকে এগিয়ে আসতে দেখে মুহুর্তে একটা কিছু সন্দেহ হয়। সেকেন্ডে ভগ্নাংশে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় আমিনুল।
গত কয়েক ঘন্টায় তার বয়স এবং বুদ্ধি যেন দশগুণ বেড়ে গেছে।
এদিকে মোবাইল ফোনটি ততোক্ষণে তন্ময়কে ফোন করা শুরু করেছে। প্রথম রিংয়েই রিসিভ তন্ময়।
মুহুর্ত নষ্ট না করে আমিনুল বলে উঠে, বস্ আপনের সিমটা ভরেন।
চারজন ততোক্ষণে আমিনুলের খুব কাছে চলে এসেছে। প্রথমেই তারা হাত থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়।
দুপাশ থেকে দুজন আমিনুলের দুহাত শক্ত করে ধরে ফেলে।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা রমিজের দিকে ফিরে আমিনুল বলে, তনুভাইকে ফোন করে বলে দিস, আমার ফিরতে দেরি হবে।
তন্ময়ের সংক্ষিপ্ত নামটি এদের যেন জানা না থাকে, মনে মনে খোদার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে আমিনুল।
প্রতিদিনের চায়ের আড্ডা বসে রমিজের দোকানে। সাইড বিজনেস হিসেবে মোবাইল ফোনের ফ্যাক্সি লোড করে রমিজ।
সে সূত্রে এ অফিসের সবার মোবাইল নম্বর তার জানা।
চারজন লোক আমিনুলকে ধরে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার দৃশ্যটির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রমিজ।
অফিসের সামনে থেকে এভাবে একজন সাংবাদিককে তুলে নেওয়া সোজা কথা না!
আমিনুলের শেষ কথাটি মনে পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে রমিজ। তন্ময়ের নম্বরে ডায়াল করে। আমিনুলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা জানায়।
–আমিনুল কি তোমার দোকানে কোনো প্যাকেট রেখে গেছে?
তন্ময়ের এই প্রশ্নের পর আমিনুলের রেখে যাওয়া ব্যাগটার দিকে দৃষ্টি পড়ে রমিজের।
–হ, তনুবাই, আমিনুলবাই ক্যামরার ব্যাগ রাইখা গেছে।
তাকে সিম ভরতে বলার রহস্য এবার পরিষ্কার হয়। আমিনুলকে যারা ধরেছে তারা হয় ডিবির দুর্নীতিবাজ চক্রটি অথবা মন্ত্রীর ভাড়াটে গুন্ডা।
ধরা পড়ার মুহুর্তে আমিনুল ফোন করে তন্ময়কে নিজের সিমটা ভরতে বলেছিলো যাতেকরে রমিজ সহজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
কারণ চায়ের দোকানে রেখে যাওয়া মূল্যবান কাগজগুলোর তথ্য জানাতে রমিজকেই ব্যবহার করতে হয়েছে আমিনুলকে।
আর এ খবর জানাতে তন্ময়ের মোবাইল ফোনেই কল করবে রমিজ।
গাড়ির ভেতর ড্রাইভার ছাড়াও আরো দুজন ছিল। ড্রাইভারও এদেরই লোক। সে হিসেবে আমিনুলকে ধরতে মোট সাতজনের দল এসেছে।
নিজেকে কেউকেটা মনে হয়। রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গতিতে গাড়ি চলছে। কালো কাচের বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
তবে গাড়িটা মিরপুরের দিকে যাচ্ছে বলেই আমিনুলের ধারণা।
ফার্মগেট এসে বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে, এরপর রোকায়ে সরণী ধরে সোজা ছুটে চলছে। গন্তব্য মিরপুর, কোনো সন্দেহ নেই।
গন্তব্য জেনেই বা লাভ কী! প্রথম চোটেই মোবাইল ফোনটি হাতছাড়া হয়েছে। এখন কোথায়, কোন গর্তে নিয়ে আটকে রাখবে কে জানে!
আশ্চর্য হয়ে আমিনুল আবিষ্কার করে, এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতেও তার ততোটা ভয় করছে না। অবশ্য এখন পর্যন্ত ভয়ের কোনো কারণ ঘটেনি।
কিন্তু রাত প্রায় দুটোর সময় অচেনা একদল লোক যদি জোর করে ধরে মাইক্রোবাসে করে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তাহলেতো সেটা চিন্তারই কথা।
কই, সেরকম চিন্তা ওতো হচ্ছে না! মনে হয় সারা দিনের ধকলে নার্ভগুলো ভোতা হয়ে গেছে, ভয়, দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কোনো অনুভুতিই কাজ করছে না।
রমিজের দোকান থেকে তন্ময় ক্যামেরার ব্যাগটা সংগ্রহ করে নেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রমিজের দোকানে যদি আরেকটা দল তন্ময়ের জন্য ফাঁদ পেতে থাকে? সে ক্ষেত্রে কী হবে? চিন্তায় পড়ে যায় আমিনুল।
অবশ্য আমিনুলকে যেভাবে ধরে আনা হয়েছে, সে ঘটনার বিবরণ পেলে নিশ্চই সাবধান হয়ে যাবে তন্ময়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক তন্ময় চৌধুরীর উপস্থিত বুদ্ধিও উপর আমিনুলের ব্যপক আস্থা।
এর আগেও বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টে তন্ময় ক্ষুরধার বুদ্ধির ছাপ রেখেছে।
আর সেজন্যইতো এতো অল্প বয়সে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিকের সবচেয়ে নামকরা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছে।
সারা দিনে এই প্রথম ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার ফুরসত মিলেছে। বসে বসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করে আমিনুল।
নিউজ এডিটর মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে জড়িত এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি আমিনুল।
তারেক ভাইয়ের সঙ্গে প্রায় ১৫ বছর ধরে কাজ করছে। কই কখনো তো মনে হয়নি তিনি কোনো ধরণের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
তন্ময় চোখে আঙ্গুল দিয়ে একের পর এক যুক্তি সাজিয়ে পুরো ব্যপারটা ব্যাখ্যা দেওয়ার পরও বিশ্বাস করেনি।
পরে তারেক ভাইয়ের বাড়িতে মবিন আর শমসেরের উপস্থিতি তারেক আহমেদেও প্রতি আমিনুলের বিশ্বাসের ভিতটা পুরোপুরি ধ্বসিয়ে দিয়েছে।
এ চক্রের সঙ্গে আর কারা জড়িত, সেটা ভারতে থাকে আমিনুল। তবে ভাবনা-চিন্তার ব্যাপারটা তার খুব একটা আসে না।
বরাবরই সেটা তন্ময়ের উপর ছেড়ে দেয়। মাইক্রোবাসের সিটে বসে ঘুমে ঢলে পড়ে আমিনুল।
………………
ডিবির এসআই একরামুল গত চব্বিশ ঘন্টায় কিছু মুখে গুজার সময় পায়নি। পুরো দিনটা কেটেছে দৌড়ের উপর।
হাফিজুর রহিম পুরো ব্যপারটাকে ভীষণ ঘোড়ালো করে তুলেছিলো।
এএসপি আকবর আর সে মিলে এখন পুরো বিষয়টা নিজেদের মতো করে সাজাচ্ছে।
সারা দিন পেটে একটা দানা না পড়লেও কোনো অনুযোগ করেনি এনামুল। এর পেছনে দুটো কারণ কাজ করছে।
প্রথমটি হচ্ছে, টাকা। একরামুল জানে, এই কাজের বিনিময়ে পকেটে আসবে অনেকগুলো কড়কড়ে নোট।
খাবার না জুটলেও সারাদিনই আসন্ন টাকার গন্ধটা উপভোগ করেছে।
এই গন্ধটা তার কাছে যে কোনো সুস্বাদু খাবারের চেয়ে অনেক বেশি উপদেয়। দ্বিতীয় কারণটা হলো ঘটনার গুরুত্ব।
আবু সাঈদ এবং হাফিজুর রহিমের স্ত্রীকে হত্যা করা,
হাফিজুর রহিমের গ্রেপ্তার এবং তন্ময়ের পেছনে পুরো পুলিশ ফোর্সকে লেলিয়ে দেওয়ার বিষয়গুলোই এ ঘটনাটির গুরুত্ব নিরূপণের জন্য যথেষ্ট।
তার উপর সকাল থেকে মন্ত্রী নিজে একটু পর পর ফোন দিয়ে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইছেন।
মন্ত্রীর ফোন রিসিভ করতে করতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছে আকবর খান।
দীর্ঘ দিনের চাকরি জীবনে ছোট-বড় নানা জাতের দুর্নীতি করে বিস্তর টাকা কামিয়েছে একরামুল।
ঢাকা শহরে তার জায়গা সম্পত্তির কোনো অভাব নেই। তবে এবারের ঘটনা একেবারে আলাদা। এটা তো বিরাট দাঁও।
প্রস্তাবটি পেয়ে প্রথমে একটু চমকে উঠলেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়েছে। জীবনে উন্নতির জন্য মানুষকে তো কতো কাজই করতে হয়।
সে তুলনায় এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ না। তা ছাড়া বিবেকের কথা ভেবে সে যদি কাজটা না করে তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে এটা করানো হবে।
সে ক্ষেত্রে মোটা ইনাম থেকে বঞ্চিত হবে সে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে আবু সাঈদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি হাতে নিয়েছে।
সরাসরি খুনটি অবশ্য নিজ হাতে করতে হয়নি। মন্ত্রীর পাঠানো দুই পেশাদার খুনি নিখুঁতভাবে খুব অল্প সময়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে আবু সাঈদকে।
পুরো ব্যপারটি তত্বাবধান করে একরামুল। শমসের আর মবিনের মানুষ হত্যার দক্ষতা দেখে রীতিমতো মুগ্ধ একরামুল।
এরকম ভাবলেসহীন ভাবে অনায়াস দক্ষতায় যে মানুষ হত্যা করা সম্ভব, তা নিজের চোখে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস হতো না।
একরামুলের মতো সকাল থেকে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে আকবর খান। কাজ মানে অকাজ। দিনকে রাত বানানো।
নিখুঁত ঘটনা সাজাতে এবং ফাইলে চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি ফলানোতে সিদ্ধহস্ত এই আকবর।
এসব কাজে সে রীতিমতো একটি প্রতিভা। পাকা জহুরির মতো তাকে ঠিক ঠিক চিনে নিয়েছেন ডিআইজি।
তার নির্দেশেই আকবরকে এ কেসটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ধানমন্ডিতে একটা ফ্যাটের বুকিং দিয়ে ছিলো আকবরের স্ত্রী।
কেসটা ঠিকঠাক শেষ করতে পারলে এককালীন দাম পরিশোধ করে ফ্যাটটাতে উঠে যাওয়া যেতো।
সেখান থেকে আদনানের স্কুলটাও খুব কাছে, হেঁটেই যাওয়া যায়। এ কারণেই সুষমা তাড়া দিচ্ছে দ্রুত ওই ফ্যাটে উঠার জন্য।
ব্যাচমেট রুশোর নতুন প্রিমিওটা দেখে স্ত্রীর খায়েস হয়েছে একটা নতুন গাড়ি কেনার। এই সুযোগে সেটাও সম্ভব হবে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে টেবিলে দু পা তুলে দিয়েছে আকবর। চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে থাকে।
–স্যার..একরামুলের ডাকে সংবিত ফিরে পায়।
–কী ব্যপার?
–স্যার রাত তো অনেক হলো, বাড়ি যাবেন না?
–আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, হাতের কাজটা একটু গুছিয়ে নেই। বুঝতেই পারছো, আজকের মধ্যেই যতোটা সম্ভব কাজ গুছিয়ে ফেরতে হবে।
ব্যপারটা ক্রমেই ঘোড়ালো হয়ে উঠছে। আবু সাঈদ এবং মুনমুনের মৃত্যু নিয়ে মিডিয়া গুলো হৈচৈ শুরু করেছে।
এদিকে ওই সাংবাদিকেরও কোনো পাত্তা নাই। তার কাছে নাকি কিসব কাগজপত্র আছে। সেগুলোও উদ্ধার করা জরুরি।
সবকিছু মিলে ব্যপারটা একেবারে জট পাকিয়ে আছে। আমাদেরকে তাই খুব দ্রুত ফাইল গুছিয়ে ফেলতে হবে। ঠিক আছে?
–ঠিক আছে স্যার। বিরস বদনে উত্তর দেয় একরামুল।
কাজ শেষে একরামুল যখন বাড়ির দিকে রওনা হয় তখন ঘড়িতে রাত দুটো।
ফাকা রাস্তায় দ্রুতই শাহজাহানপুরের বাড়িতে ফিরে আসে একরামুল।
কলাপসেবল গেইটের তালায় চাবি ঢোকানো মাত্রই জমে যায় একরামুল।
ঘাড়ের উপর চেপে বসা ধাতব স্পর্শটিতে মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসে।
রিভলবারের নল দিয়ে খোচা মেরে একরামুলকে ভেতরে ঢোকায় তন্ময়।
পুরান ঢাকার টপ-টেরর বোমা লিটনের কাছ থেকে ধার করে এনেছে অস্ত্রটি।
দীর্ঘদিন ক্রাইম বিটে কাজ করার সুবাদে ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লিডারদের সঙ্গে ভালোই জানাশোনা আছে।
সেই পরিচয়ের সূত্রটিই এখন কাজে দিচ্ছে।
মবিন আর শমসেরের পরিচয়ও তন্ময় বের করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে।
রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এবং হাঙ্গামার জন্য সাধারণত মবিন আর শমসেরকে ভাড়া করা হয়।
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের হয়ে কাজ করে এই মানিকজোড়।
এক একটি পলিটিক্যাল কিলিংয়ের জন্য অবিশাস্য রকম বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকে তারা।
তাহলে তন্ময়কে ধরতে এই দুই পেশাদার খুনিকে কেন কাজে লাগিয়েছে মন্ত্রী?
তন্ময়ের কাছে এটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্ন লিটনেরও।
–’বস, আপনে কি মন্ত্রীর মাইয়ারে রেপ করছেন নি? হালায় আপনের পিছে শমু-মবুরে লাগাইছে কেলা?’
অপরাধ জগতে মবিন আর শমসের এ নামেই পরিচিত। ছোটখাট অপরাধে এদের কখনো দেখা যায়নি।
পুলিশের খাতায় এই জুটির নামে কোনো রেকর্ড নেই। কারণ সব সময়ই এরা ‘সরকারের’ হয়ে কাজ করে।
তন্ময়ও সেই কথাই ভাবছিলো। এখন আর কোনো কিছুই তাকে বিষ্মিত করছে না।
এতোসব ঘটনার মধ্যেদিয়ে যেতে হচ্ছে, কোনো কিছুকেই অপ্রত্যাশিত লাগছে না।
ডিবি অফিসে আমিনুলের সোর্স আজহারের কাছ থেকে খবর পেয়েছে, এই কেসে হাফিজুর রহিমের সহকারী হিসেবে ছিল এসআই একরামুল।
স্ত্রীর দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে রহিম অফিস ছেড়ে চলে যায়। আবু সাঈদ তখন একরামুলের তত্বাবধানে ছিল। সে অবস্থাতেই মৃত্যু হয় সাঈদের।
সাঈদ হত্যার সঙ্গে একরামুলের সংশিষ্টতা বোঝার জন্য এর চেয়ে বেশি তথ্যের প্রয়োজন নেই।
তারেক আহমেদের বাড়ি থেকে বের হয়ে তাই সোজা শাহজাহানপুরে এসেছে তন্ময়। তাকে নামিয়ে দিয়ে পাত্রিকা অফিসে গেছে আমিনুল।
সে কি পারবে শরীফের ড্রয়ার থেকে প্যাকেটটা উদ্ধার করতে? এ চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে তন্ময়।
ওই কাগজের প্যাকেটটাই এখন তার একমাত্র সম্বল। জানেনা এটার ভেতরে কী আছে।
কিন্তু সে নিশ্চত, এটি হাতে পেলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য এটি হবে একটি মোক্ষম অস্ত্র।
পঁয়তালিশ মিনিট ধরে অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে। শরীরে প্রতিটি লোমকুপে কমপক্ষে একটি করে মসা বসে আছে।
থাপ্পর দিয়ে মারতে হচ্ছে না। শরীরের যে কোনো অংশে হাত বুলালেই চাপা পড়ে আট-দশটার মৃত্যু হচ্ছে।
নিজের রক্তে চটচটে হয়ে গেছে হাতের তালু। প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যের মতো কঠোর অধ্যাবসায়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তন্ময়।
এক একটি সেকেন্ডের ব্যপ্তি বেড়ে যেন ঘন্টায় দাঁড়িয়েছে। সব রাতই ভোরে শেষ হয়।
তেমনি এক সময় তন্ময়ের অপেক্ষার পালাও শেষ হলো।একরামুলের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে দোতলার ল্যান্ডিংয়ে নিয়ে আসে।
সঙ্গে নিয়ে আসা রুমাল দিয়ে সিড়িকোঠার অন্ধকারে হাত-পা বাঁধে। মুখে গুজে দেয় রুমাল।
অমানুষিক আতঙ্কে চোখদুটো ঠিকে বের হয়ে আসে একরামুলের। মুখে গোজা রুমাল নিয়ে গোঙ্গাতে থাকে।
খুব শান্ত ভঙ্গীতে তার বাঁ হাতের কনে আঙ্গুলটি মুঠ করে ধরে তন্ময়। মট্ করে চাপ দিয়ে আঙ্গুলের হাড়টা ভেঙ্গে দেয়।
চাপা স্বরে গোঙ্গানি বেড়ে যায়। একরামুলের দু চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে।
একটা টু শব্দ করলে এভাবে সবগুলো আঙ্গুল ভেঙ্গে দেবো। এর পর কপালে ঠেকিয়ে গুলি। আমার জীবন তো এমনিতেই শেষ।
মাদক ব্যবসার সহযোগী হিসেবে পুলিশ খঁজছে। এর সঙ্গে একটা খুনের অপরাধ যুক্ত হলে আর কতোটাইবা বেশি হবে।
তন্ময়ের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় একরামুল। একটু সময় দিয়ে মুখের বাঁধন খুলে দেয় তন্ময়।
বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁপাতে থাকে একরামুল। বুকটা হাঁপড়ের মতো উঠানামা করে।
এখন ভালো মানুষের মতো এক এক করে আমার সবগুলো প্রশ্নের জবাব দাও।
–প্রথম প্রশ্ন, পুলিশের কে কে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত?
–দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারেক আহমেদ ছাড়া এই চক্রেও সঙ্গে সাংবাদিক মহলে আর কারা যুক্ত?
–তৃতীয় প্রশ্ন, মন্ত্রী ও আমলাদের মধ্যে কারা এর পেছনে আছে? চটপট উত্তর দাও।
চুপ করে থাকে একরামুল। মুখের ভেতর আবার রুমালটা গুজে দিয়ে এবার একরামুলের ডান হাতের কড়ে আঙ্গুল মুঠোয় পুরে তন্ময়।
ওঁ ওঁ করে শব্দ করে দুদিকে মাথা নাড়তে থাকে একরামুল। রুমালটা সরিয়ে নেয় তন্ময়।
এবার মুখ খোলে একরামুল। তার জানা নামগুলো একে একে বলে যায়। সবার আগে জানায় নিজের পরিচয়।
তন্ময়ের বুক পকেটে রাখা ডিজিটাল রেকর্ডারটি সক্রিয় হয়। মেমোরিতে নিয়ে নেয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো।
বিষ্ময়ের বুঝি আরো বাকি ছিলো। দু-একটি নাম শুনে মুখটা হা হয়ে যায় তন্ময়ের।
রাগে-ঘৃণায় ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। তাকে গুটি বানিয়ে কী জঘন্য খেলায় মেতেছে সম্পাদক!
একরামুলকে ছেড়ে বেরুবার আগে আছড়ে তার মোবাইল ফোনটি নষ্ট করে দিয়ে যায় তন্ময়।
কোনো বাপের সঙ্গে একরামুল যোগাযোগ করার আগে অন্তত কিছুক্ষণ সময় পেতে হবে।
বেড়িয়ে আসতে আসতে মনে মনে ভাবে তন্ময়, যে কোনো বিষয়ে এক্সপার্ট ওপিনিয়নের কোনো বিকল্প নেই।
বোমা লিটনের বাতলে দেওয়া তরিকা অ্যাপ্লাই করে এতো সহজে একরামুলের পেট থেকে সবকিছু বের করা গেছে।
লিটনের পরামর্শ ছাড়া ডিবি পুলিশের এই দুর্নীতিবাজ সদস্যটিকে কোনো ভাবেই বাগে আনতে পারতো না তন্ময়।
নীল আলো জ্বেলে নি:শব্দে বেজে উঠে মোবাইল ফোনটি। আমিনুলের ফোন। সবুজ বোতাম চেপে কলটি রিসিভ করে তন্ময়।
–বস্ আপনের সিমটা ভরেন।
কোনো রকমে কথাটা বলেই লাইন কেটে দেয় আমিনুল। বোকার মতো কিছুক্ষণ ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়।
ষষ্ঠ ইদ্রিয় সতর্ক বার্তা পাঠায়; বড় কোনো বিপদে পড়েছে আমিনুল।
দ্রুত মোবাইল ফোনে নিজের সিম কার্ডটা ভরে অপেক্ষা করতে থাকে তন্ময়।
************
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সানডিয়াগোর বিজনেস স্কুলের মাঠে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো জাফর।
সামহয়্যারইন ব্লগে এই মাত্র দেওয়া পোস্টটিতে চোখবুলিয়ে ঘাড়ের কাছে লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো তার।
চার দিকে ঝকঝকে রোদ। মেঘমুক্ত আকাশ। চীর বসন্তের শহর সানডিয়াগোতে আজকের আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম।
এসব কিছুই চোখে পড়ছে না জাফরের। বিস্ফোরিত চোখে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বন্ধু তন্ময়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে জাফরের। কেমন আছে তন্ময়?
পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে দ্রুত বোতাম টেপে।
মার্কিন মুলুকে প্রত্যেক বিদেশী ছাত্রকে প্রতিটি পাই-পয়সা হিসেব করে খরচ করতে হয়। এ মুহুর্তে হিসাবের ধার ধারেনা জাফর।
নিজের মোবাইল ফোন থেকেই আইএসডি কল করে বসে। মাস শেষে একগাদা ডলার গুনতে হবে; সেটা গ্রাহ্য করে না।
তন্ময়ের ফোন বন্ধ। জাফরের অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপ,
মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালি ব্লগারদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই পোস্টের তথ্যগুলো।
ব্লগকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাও এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে।
ভোরের আলো ঠিকভাবে ফোটার আগেই বাংলাদেশে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।
ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে তন্ময়ের। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। পশ্চিম আকাশ ফরসা হচ্ছে।
মাইকে মুয়াজজিনের সুললিত কন্ঠে ভেসে আসছে.. .. আসসালাতুল খাইরুল মিনাননাউম.. .. ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম।
ল্যাপটপের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়।
এতোদিন এই বোমগুলো অবহেলায় পড়ে ছিল! ইস্, আগে যদি একবার অন্তত কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখতো!
আবু সাঈদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ফাইলটিতে কয়েক জন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা,
পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের নামের তালিকা পাওয়া গেছে।
এদের প্রত্যেকেই মরননেশা ইয়াবার চোরাই ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সবগুলো কাগজ ঘেটে এর অকাট্য প্রমাণও মিলেছে।
কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা জমা করতো সাঈদ।
ফাইলটিতে ব্যাংকের টাকা জমার রশিদগুলোও সুন্দরভাবে মাসওয়ারি সাজানো আছে। টাকার অঙ্ক দেখে মাথা ঘুরে যায় তন্ময়ের।
যে অ্যাকাউন্টগুলোতে নিয়মিত টাকা দেওয়া হতো,
সেসব অ্যাকাউন্টধারীর নাম ভিন্ন হলেও তন্ময় নিশ্চিত খুব সহজেই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আমলা,
পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের সম্পর্ক আবিষ্কার করা যাবে।
এর বাইরে ইয়াবা চক্রের হোতাদের পরিচয় উন্মোচনের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে তন্ময়ের হাতে রয়েছে ডিবি পুলিশের এসআই একরামুলের জবানবন্দী।
তন্ময়ের জেরার মুখে তোতা পাখির মতো গড়গড়িয়ে সবকিছু স্বীকার করেছে একরামুল।
সাজানো দুর্ঘটনায় হাফিজুর রশিদের স্ত্রীকে হত্যা এবং আবু সাঈদকে হত্যার অভিযোগে রহিমকে ফাসানো,
তন্ময়কে ইয়াবা চক্রের সঙ্গে জড়ানো, গোপন দলিলের খোঁজে তন্ময়ের বাড়ি ও অফিসে তলাসী এবং
তন্ময়কে ধরার জন্য পুলিশের পাশাপাশি মন্ত্রীর পোষা সন্ত্রাসী মবিন ও শমসেরকে লেলিয়ে দেওয়া – সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা করেছে একরামুল।
আমিনুলের তোলা ছবিগুলো ব্লগের পোস্টটিকে সচিত্র করেছে। প্রায় সবগুলোই সন্ত্রাসী মবিন আর শমসেরের ছবি।
তবে রাতের বেলা মবিন ও শমসেরের নিউজ এডিটর তারেকের ঘরে প্রবেশ …
এবং মন্ত্রী পাড়ায় মন্ত্রীর বাড়িতে দিনে-দুপুরে এই মানিকজোড়ের আগমনের ছবিও তুলেছে আমিনুল।
এ ছবিগুলো ব্লগে আপলোড করে দিয়েছে। সাঈদের বাড়ি থেকে আনা ডক্যুমেন্ট গুলোও দিয়ে দিয়েছে ব্লগে।
স্ক্যান করার সুবিধা নেই বলে এ কাগজগুলোর ছবি তুলে তা পোস্টেও সঙ্গে জুরে দিয়েছে তন্ময়।
আমিনুলের অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরাটা বেশ কাজে দিয়েছে। আরো আপলোড করেছে একরামুলের রেকর্ডেড ভয়েস।
বোমা লিটানের দেওয়া একটি অপরিচ্ছন্ন একচিলতে ঘরে বসে কাজগুলো করেছে তন্ময়।
বিকট শব্দে মাথার উপর তীব্র গতিতে একটি ফ্যান ঘুরছে। সেটি মোটেও স্বস্তি দিতে পারছে না।
বরং ঘরের গরম বাতাসটিকে আরো ছড়িয়ে দিচ্ছে। বসে বসে দর দর করে ঘামছে তন্ময়। গায়ের জামাটি ভিজে চুপচুপে।
এখন ল্যাপটপের দায়িত্ব নিয়েছে বন্ধু ওহিদুল। তন্ময়ের বক্তব্য টি পেন ড্রাইভে নিয়ে নিচ্ছে।
সকালেই এটি প্রিন্ট করে সবগুলো ছবি …..
এবং একরামুলের স্বীকারোক্তির সিডির একটি সেট প্রতিটি পত্রিকা, রেডিও এবং টিভি চ্যানেলের অফিসে দিয়ে আসবে।
নোংড়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তন্ময়। এবার নিজের পরিচয়ে ফেরা যাক। মোবাইলে নিজস্ব সিমটি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটি বেজে উঠে।
নিশ্চই ব্লগে দেওয়া পোস্টের রিঅ্যাকশন। অদ্ভুত এক অভিমান ভর করে তন্ময়ের মনে।
কেন তাকে সারা দিন প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিলো তার।
হাফিজুর রহিমের মতো সৎ পুলিশ অফিসারের কেন এই করুন পরিণতি হবে?
আপন বড় ভাইয়ের মতো যাকে শ্রদ্ধা করতো সেই তারেক ভাইয়ের আসল চেহারাটি এতো কুৎসিত!
সারা দিন সিগারেট আর চা ছাড়া কিছুই জোটেনি। পেটের ভেতরটা মোচর দিচ্ছে।
পুরান ঢাকার অন্ধকার গলিতে সূর্যের প্রথম আলো আসতে শুরু করেছে। ঘুম ঘুম চোখে জানালায় তাকিয়ে থাকে তন্ময়।
আরে, কী আশ্চর্য, জানালায় দুটো ঘুঘু পাখি এসে বসেছে।