প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ১১ (শেষ)
এগার
নাটকের যবনিকা সে রাত্রেই পড়ল। ঘুম কাটাবার জন্যে ক্যানটিন থেকে কড়া কফি আনিয়ে খেয়ে টেবিল ল্যাম্পের পাশে একটা ডিভানে শুয়ে এলসার কামরাতেই পাওয়া একটা ডিটেকটিভ নভেল পড়বার চেষ্টা করছিলাম। এ সব সময়ে পরাশরের কবিতা লেখার কথা। কিন্তু সে চেষ্টা না করে সে পাশের অন্য টেবিলে বসে এলসার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারী পাওয়া অ্যালবামটা একটু যেন অতিরিক্ত মন দিয়ে দেখছিল। রাত তখন বারোটা বাজে। এয়ারকণ্ডিশনারের মৃদু আওয়াজ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ পরাশর অ্যালবাম রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের সব কটা বাতি নিভিযে দিলে। পরাশরের কান আমার চেয়ে খাড়া। বুঝলাম সে নিশ্চয় সন্দেহজনক কোন শব্দ বাইরে পেয়েছে। সেই অনুমানটা ঠিক। কয়েক সেকেণ্ড বাদেই ঘরের দরজায় মৃদু টোকা শোনা গেল। সেই সঙ্গে দেখা গেল দরজার তলা দিয়ে লম্বা একটা চিরকুট কাগজ কে ঠেলে দিচ্ছে কাগজটা টেনে নেবার পর পরাশরের টর্চের আলোয় সেটা তার সঙ্গে পড়লাম। তাতে অত্যন্ত জড়ানো হাতে লেখা, “আমি দারুণ বিপদ মাথায় নিয়ে তোমাকে দুটো কথা জানাতে এসেছি। দরজাটা খুলে আমায় দু মিনিটের জন্যে ভেতরে যেতে দাও।”
ওপরে যেমন সম্বোধন নেই নিচে তেমনি কোনো সই নেই। এ কার হাতের লেখা! দরজার বাইরে কে? আমি রীতিমত ভাবিত হলেও পরাশর বিনা দ্বিধায় দরজাটা খুলে দিলে।আলোটা অবশ্য না জ্বেলেই। দরজা খুলে দিতে যে ঘরে ঢুকল করিডরের আলোতে তার কাঠামোটা দেখেই বারোহা বলে চিনলাম। বারোহা অন্ধকার দেখে একটু দ্বিধাভরেই ঘরে ঢুকে বললে, “ঘরটা অন্ধকার কেন এলসা? আলোটা জ্বালো।”
পরাশর আলোটা জ্বালল সেই মুহূর্তেই। এলসার বদলে আমাদের দুজনকে দেখে বারোহার অবস্থা তখন বেশ কাহিল। নিজেকে সামলাবার অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও একটু ধরা গলায় শুধু বলতে পারলে, “আপনারা! এ ঘরে?”
“হ্যাঁ, আমরাই।” পরাশর ঐ সাড়ে ছ’ফুট লম্বা মানুষটাকে যেন নাবালক হিসেবে দেখে ব্যঙ্গের সুরে বললে, “তা এ ঘরে এত রাত্রে কেন এসেছেন? এলসার সঙ্গে গোপন অভিসারের মতলবে?”
“না, না। আমায় বিশ্বাস করুন,” বারোহা কাতর প্রতিবাদ জানালে।” এলসার সঙ্গে আমার সে-রকম সম্বন্ধ নয়। আমি শুধু…”
ঐ পর্যন্ত বলে বারোহা একটু থামতেই পরাশর যেন ঠেলা দিয়ে বললে, “আমি শুধু বলে থামলেন কেন? আমি শুধু, কি বলতে যাচ্ছিলেন?”
“বলতে যচ্ছিলাম যে – আপনারা আমাকে সন্ধ্যাবেলা যা বলে এসেছিলেন তা শুনে আমি সত্যি, মিস এলসার জন্যে ভাবিত হয়ে পড়েছিলাম। তাই লুকিয়ে ওকে একটু সাবধান করে দিতে এসেছিলাম।”
“সাবধান করতে এসেছিলেন না আপনার চিরশত্রুর হদিশ পেয়ে তাকে শেষ করতে!” পরাশর কড়া গলায় বললে, “কিন্তু কি আজ আপনাকে সকালে বলে দিলাম? বলেছিলাম না যে আপনার মাথার ওপর একটা মস্ত বিপদের ফাঁড়া ঝুলছে! এমন করে এ ঘরে এসে সে বিপদ এখন ত সঙ্গীন করে তুলেছেন।”
“সঙ্গীন করে তুলেছি!” বারোহা হতাশ স্বরে বললে, “কিন্তু আপনারা থাকতে এ ঘরে আমার বিপদ হবে কেন? আপনারা আমায় রক্ষা করবেন না।”
“বিপদ আপনার যে নিজের ডাকা!” পরাশর নির্মমভাবে বললে, “তার আমরা রক্ষা করব কি করে।”
যে অ্যালবামটা খানিক আগে সে দেখছিল সেইটে বারোহার হাতে উলে দিয়ে পরাশর আবার বললে, “দেখুন দেখি এ ছবিগুলো চিনতে পারেন?”
বারোহা অ্যালবামটা খুলে ছবিগুলো তাচ্ছিল্যভাবে একটু দেখেই সেটা মুড়ে ফেলে বললে, “হ্যাঁ পারি – । এগুলো আমারই ছবি। কিন্তু তাতে কি বলতে চান কি?”
কথাটা শুনে শুধু নয় – গলার স্বরটাতেও আমি যেন চমকে উঠলাম। সেই বারোহাই আমাদের সামনে অ্যালবাম হাতে বসে আছে। কিন্তু গলার আওয়াজ থেকে মুখের ভাব ও দেহের ভঙ্গিতে এ যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
পরাশরেরও এ চমকটা লাগল কি না জানি না – কিন্তু তার কথায় সেটা প্রকাশ পেল না।
আগের মতই চাপা বিদ্রুপের সুরে সে বললে, “বলতে চাই এই যে – অতি বুদ্ধিমান হওয়ার বিপদ এক্টু বেশী। এই সেদিন দিল্লীতে চার্লস শোভরাজের দল ধরা পড়ার পরই ও জাতীয় শয়তানী আবার হওয়া সম্বন্ধে কেউ সাবধান থাকবে না ধরে নিয়ে তুমি খুব চতুর ফাঁদই এখানে পেতেছিলে। প্রথমে নিজেই যেন বিষের শিকার হয়েছে। এমনভাবে ড্রেস রিহার্সাল দিয়ে জমিটা ভালোভাবে তৈরী করে নিয়েছিলে। তোমার লক্ষ্য র্যা থবোন – এরা ছিল না। ওদের নাম আমি তোমায় একটু ধোঁকা দেবার জন্যই করেছিলাম। তোমার আসল লক্ষ্য হল মঁসিয়ে রেনোয়া। প্রচুর দামী জিনিস নিয়ে ঘোরা তার এক বদরোগ। এ হোটেলে তাঁকে বধ করাবার জন্যেই তুমি জাল পেতে বসেছিলে। একটা কথা শুধু তুমি ভুলে গেছলে যে – ডালে ডালে যারা চরে তাদের ওপরেও পাতায় পাতায় চরবার মানুষও আছে।”
“আর সেই পাতায় পাতায় যার চরে – তাদের মরণ হয়, অতিবুদ্ধির অহঙ্কারে।”
একেবারে চাবুকমারা গলায় কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে পিস্তল বার করে বারোহা ঘরের বালবের দিকে ছুঁড়ে সেটা ফাটিয়ে দিলে।
তারপর গাঢ় অন্ধকারে তার হিংস্র শাসানি শোনা গেল, “আমি এখন ঘর থেকে বেরিয়ে যচ্ছি। কেউ বাধা দিতে চেষ্টা করলে মশা মাছি মারার দ্বিধাটুকুও আমি যে করব না এইটুকু শুধু জানিয়ে যচ্ছি। যে যেখানে আছ সেখান থেকে এক পা নড়বে না।”
“এই হুকুমটা তোমার ওপরও রইল।”
হঠাৎ তীব্র একটা চোখ-ধাঁদানো জোরালো টর্চের আলো বারোহার ঠিক মুখের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে এই কথাগুলো শুনতে পেলাম। কথাগুলো একটি মেয়ের গলার – আর সে মেয়ে যে এলসা তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পরাশর কামরার অন্য একটা আলো জ্বেলে দেওয়ায় তা বুঝতে পারলাম। এলসার এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে বারোহার ঠিক কপাল লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরা পিস্তল।
এলসা শুধু একা নয় তার সামনে আর একটা যে মেয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে মঁসিয়ে রেনোয়া-র ভাগনী বলেই চিনলাম।
আলো জ্বলবার পরই আবার কড়া আদেশ শোনা গেল, “তোমার পিস্তল ফেলে দাও বারোহা। তুমি যত বড় লক্ষভেদীই হও, তুমি জানো যে তোমার হাত ঘুরিয়ে পিস্তল ছোঁড়ার আগেই তোমার মাথার ঘিলু এই কার্পেটকে নোংরা করে দেবে। ফেলো পিস্তলটা।”
বারোহা দুচোখে অগ্নি বৃষ্টি করেও পিস্তল ফেলে দিতে এবার বাধ্য হল।
জিনেৎকে টর্চ ধরা হাতে ঘৃণাভরে বারোহার দিকে ঠেলে দিয়ে এলসা এবার বললে, “এই নাও তোমার যোগ্য সহচরীকে বুড়ো লম্পট মঁসিয়ে রেনোয়াকে কাবু করবার জন্যে ভাগনী বলে সেবাদাসী করে নিজেই যাকে তুমি জুটিয়ে দিয়েছেলে।”
এ নাটক দেখতে দেখতে সত্যি তখন আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। পরাশরের কথায় আমার চমক ভাঙল। বারোহার ফেলে দেওয়া পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে সে আমায় বললে, “সাবধানের মার নেই। আর কিছু না পাও ওপর থেকে মিস এলসার স্কার্ফ টার্ফ কিছু এনে গুণধরের হাত দুটো একটু বেঁধে ফেলো দিকি।”
পাশের ঘরে বাঁধবার কিছু খোঁজবার জন্যে যেতে যেতে একটা কথা শুধু না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। “আচ্ছা মিস এলসার রহস্যটা দু কথায় একটু বলবে? উনি কি আমাদেরই আরক্ষী বাহিনীর কেউ? তুমি কি ওকে চিনতে?”
এলসা হাসল, আর সংক্ষেপেই উত্তর দিলে পরাশর, “না, উনি ইণ্টারপোল।”
বিশ্ব পুলিশ সংস্থার একজন বড় গোয়েন্দা। প্রায় দু বছর ধরে নানা দেশে নানা বেশে বারোহাকে চোখে চোখে রেখে যাকে বলে রাঙা হাতে ধরবার জন্যে পেছনে লেগে আছেন। আর তাঁকে চেনার কথা জিজ্ঞাসা করছ? ওঁকে চিনতে দেরী হয়েছে বলেই এ ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে পেরেছে।
পাঁচতারা হোটেলের সব ঝামেলা চুকে তুকে যাবার পর পরাশরের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়েই আলোচনা করতে করতে একদিন জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজের কথা জানতে চেয়েছিলাম। পরাশর হেসে বলেছিল, “আরে উনিই ত চর চরাবার চাঁই। জ্যোতিষ সেজে দেশী বিদেশীদের পেটের খবর বার করে আমাদের জন্যে জমা করে রাখেন। এরপর একটু ধোঁকায় ধাঁধায় পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আচ্ছা, তোমাদের এই আন্তর্জাতিক ঠগ ধরার ব্যাপারে আমাকে অমন ধড়াচূড়া পরিয়ে নিয়ে গেছলে কেন বলো ত? আমি তোমাদের কোন কাজে ত লাগিনি!”
“বাঃ, তোমায় না নিয়ে গেলে এ বৃত্তান্তের কথক হত কে! আমি কি আবার নিজের জবানীর দায়ে পড়ব নাকি!”
বন্ধু বাৎসল্য এরপর আর রাখা যায়!
শেষ