প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৭

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৭

প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৭

সাত

ঠিক ঐ কথাই ভাবতে ভাবতে নয় কেমন একটু বিভ্রান্ত অবস্থায় মাঝপথে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে তাঁর পাঠিয়ে দেওয়া গালা-আঁটা খামটা নিয়ে পাঁচতারা হোটেলে যখন গিয়ে পৌঁছ্হোলাম, তখন হোটেলের বাইরে বা ভেতরে অস্বাভাবিক কোনো কিছুই কিন্তু দেখতে পেলাম না। সকালের দিকে এ ধরণের বড় হোটেলে যে একটা প্রায় নিঃশব্দ ব্যস্ততা থাকে তার বেশী সেখানে কিছুর চিহ্ন নেই। লবির কাউণ্টারে পরাশর সত্যিই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে একা নয় তার সঙ্গে আরেকজনও আছেন।আমি গিয়ে দাঁড়াতেই পরাশর পরিচয় করিয়ে দিলে। “মিঃ ভদ্র, মিঃ সেঙ্গার – হোটেলের ম্যানেজার।”
ম্যানেজার সেঙ্গার ভারতীয় কিন্তু পোষাক-আশাক চাল-চলন এমনকি চেহারা দেখেও তা বোঝা খুব সহজ নয়। বছর চল্লিশের অত্যন্ত সুঠাম, আর যাকে বলা যায় ব্যায়াম-সাধা মজবুত চেহারা। রংটা ইউরোপীয়দের মতই প্রায় ফর্সা হওয়ার দরুণ ভুলটা সহজেই হতে পারে।

তিনি একটু হেসে করমর্দনের বদলে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ইংরেজীর বদলে হিন্দীতেই বললনে, “আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি মিঃ ভদ্র। আপনার কামরা ঠিক করাই আছে। আশা করি আপনার কোনো অসুবুধে হবে না।”

আমি পরাশরের পাঠানো গাড়ি থেকে নামবার পরেই হোটেলের ইউনিফর্ম-পরা পোর্টার আমার লাগেজ বয়ে এনে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমায় অভ্যর্থনা জানাবার জানাবার পরই ম্যানেজার পরই ম্যানেজার তাকে আমার রুম নম্বর জানিয়ে সেখানে আমার লাগেজ নিয়ে যেতে বললেন। কাউণ্টারের রিসেপশন ক্লার্কের কাছ থেকে কামরার চাবি নিয়ে সে এগিয়ে যেতে তার পিছু নিতে হল। কিন্তু পরাশর ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল কেন? সে আমার সঙ্গে আসবে না? কি কারণে এমন অদ্ভুত ছুতো করে আমায় এখানে আসতে হল তা বোঝাবে তাহলে কখন। আমার পকেটে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর গালা আঁটা চিঠিটাও ত তাকে দেওয়া হল না। পরাশর আমায় পরিচয় করিয়ে দেবার সময় পকেটে হাত দিয়ে একবার সেটা বার করতে গেছলাম, কিন্তু হঠাৎ পরাশরের চোখের ইঙ্গিতটা দেখে আর এগোই নি।পরাশর তাহলে এখানে আমার সঙ্গে পর পর ভাবই রাখবে নাকি? আমার জন্যে ঘর রিজার্ভ করা টরা সব ত সে- করেছে। সে সব কি করেছে কি অজুহাত দিয়ে? ট্রাভেল এজেণ্টের ভূমিকায়? একটু দূরত্ব রাখতেই সে যে চায় তা হোটেলের লবিতে ঢুকে তার পোষাক দেখেই একটু অবশ্য মনে হয়েছে। আজ আর ধুতি পাঞ্জাবী নয়, একেবারে টাই-ফাই বাঁধা পাক্কা দামী সাহেবী স্যুট। আমার পরিচয় করিয়ে দিলেও কথাবার্তা যা বলেছে একটু ছাড়া ছাড়া ভাবেই।এটা কি ম্যানেজারের কাছে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা লুকোবার জন্যে? কিন্তু তাই বা কেন! এই অভিনয় করে কদিন এখন চালাতে হবে? ক’দিনের জন্যে আমার জন্যে কামরা বুক করা হয়েছে তাও ত কাউণ্টার থেকে জানবার সুযোগ পেলাম না। এই সব কিছুর জন্যে পরাশরের সঙ্গে একবার অন্ততঃ আলাপ করবার সুযোগ যে না পেলেই নয়।

হোটেল লিফটে পোর্টারের সঙ্গে ওপরে উঠতে উঠতে এইসব কথাই ভাবছিলাম। হোটেলের কামরগুলোর চাবি রীতিমত প্রকাণ্ড ও ভারী। বোর্ডারদের পকেটে করে চাবি বাইরে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহটা দমাবার জন্যেই এই ব্যবস্থা। এ হোটেলের চাবিও যথরীতি প্রকাণ্ড। পোর্টারের হাতে সেটার ওপর বড় বড় খোদাই করা নম্বরটা ইতিমধ্যে চোখে পড়েছে একবার। তাতে সংখ্যা লেখা ৪ ২৬। তার মানে চারতলায় আমার ছাব্বিশ নম্বর ঘর।

চারতলায় লিফট থামতে ল্যাণ্ডিং-এ পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই একটু চমকে উঠতে হল। এই ল্যাণ্ডিং-এ নিচে নামবার জন্যে লিফটের অপেক্ষায় আর কেউ নয়, এলসাই দাঁড়িয়ে। আমি তাকে চিনলেও সে এই ইউরোপীয় পোষাকে আমাকে প্রথমে ঠিক বোধ হয় চিনতে পারেনি। হঠাৎ তাকে দেখে একটু থেমে সম্ভাষণ করবার ইচ্ছে হলেও অবস্থা বুঝে তা দমন করে আমি তখন পোর্টারের পেছনে এগিয়ে যচ্ছি। একটু আড়চোখে চেয়ে বুঝলুম, প্রথমে না পারলেও তার পরেই চিনতে এলসার ভুল হয় হয়নি। তবু আরো নিশ্চিত হবার জন্যে সে আমার পিছনেই কয়েক পা এসে কিন্তু দ্বিধভরে নেমে গেল। সে দ্বিধা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা আমি আর করলাম না। হোটেল জ্যানিটর তখন চাবি কিয়ে আমার কামরার দরজা খুলে ভেতরে লাগেজ নিয়ে যচ্ছে। তার পিছু পিছু নিজের কামরায় ঢুকে দরজাটা ভেজিয়েই দিলাম যেন অন্যমনস্কভাবে।

অন্য সময় হলে শুধু কামরাটির সাজ-সজ্জা বাহার দেখে খানিক মুগ্ধ হয়ে থাকতে পারতাম। তারা চিহ্নগুলো যে অকারণে লাগান নয় ২৬নং ঘরটির সবকিছুতেই তার প্রমাণ সুস্পষ্ট। কিন্তু তখন আমার মন অস্থির হয়ে অছে অন্য চিন্তায়। পোর্টার জিনিষপত্র গুছিয়ে রাখবার পর তাকে একটু ভালো করে বখশিস দিয়ে বিদায় করে দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। এবার আমায় নিজের অবস্থাটা ঠিকমত বুঝে নিতে হবে। জ্যাকেটটা খুলে ওয়ার্ডরোবে রাখতে গিয়ে প্যাকেটে রাখা শঙ্কর মহারাজের চিঠিটা হাতে ঠেকল। আমার উপস্থিত ভেবে নেবার সমস্যার মধ্যে এটাও প্রধান একটা। পরাশরকে এ চিঠি দেওয়া যায়নি এখনো। তাকেই যে দিতে হবে এমন কোনো নির্দেশ অবশ্য চিঠির ওপর নেই! তাহলে ইচ্ছে করলে আমিও কি গালা-আঁটা খামের মধ্যে কি আছে তা খুলে পড়তে পারি? খোলবার ইচ্ছেটা প্রবল হলেও গালা-আঁটা থাকাটাই সে ইচ্ছার বাধা হয়ে দাঁড়াল। পরাশরের মত আমারও পড়বার হলে অত কষ্ট করে গালা লাগান থাকবে কেন? কিন্তু পরাশর সে চিঠি কখন কিভাবে নেবার ব্যবস্থা করবে? এই যে এলসার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে আলাপ করতে পারলাম না, এ বিষয়েও ত পরাশরের পরামর্শ দরকার। যতক্ষণ তার সঙ্গে কথাবার্তার সুযোগ না হচ্ছে ততক্ষণ আমার করণীয় কি? এই কামরার মধ্যে বন্দী হয়ে বসে থাকব নাকি! আপাততঃ তাই অন্ততঃ থাকা ছাড়া উপায় নেই বুঝে হোটেলের ক্যাণ্টিন থেকে এক পট কফি আনিয়ে নেবার জন্যে রুম সার্ভিস-এ ফোন করতে যাচ্ছিলাম।

ফোনটা তোলার আগেই যন্ত্রটার তলায় লম্বা ভাঁজ করা কাগজটা চোখে পড়ল। কাগজটার সঙ্গে তার ওপরকার বড় বড় অক্ষরে বাংলা লেখাটা – খুলে পড়ো। তাই পড়লাম। কোনো সম্বোধন নেই। নিচে স্বাক্ষরও নয়। কিন্তু কাকে লেখা কে লিখেছে বুঝতে কোন অসুবিধে হল না ভেতরের চিঠির ভাষা পড়ে। চিঠিটা এই – পাজামা পাঞ্জাবী যদি সংগে এনে থাকো ভালো। নয়তো শুধু সার্ট-প্যাণ্ট পরে দোতলায় নেমে এসো এখুনি। লিফটে নেমো না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে তেরো নম্বর কামরায় একটু দেখেশুনে ঢুকবে। করিডরে কেউ নেই দেখলে দরজায় বেল-টেল না টিপে শুধে একটু ঠেলে ঢুকবে। গালা দেওয়া খামটা সঙ্গে নিয়ে এসো। এ চিঠিটাও।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত