প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০৬
ছয়
ফোনে একেবার তড়িঘড়ি ডাক।
“কৃত্তিবাস! শোনো এখুনি একবার আমার সঙ্গে বেরুতে হবে। তৈরী হয়ে নাও।”
“এখুনি যেতে হবে মানে? কোথায় যেতে হবে? কেন?”
সে সব কথার কোন উত্তর নেই। শুধু আগের চেয়ে আরো একটু অস্থির গলায় পরাশর জানালে, “আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমার ওখানে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।”
“শোনো শোনো!” ফোনে যথাসাধ্য চিৎকার করলাম। কিন্তু শুনবে কে? নিজের কথাটুকু বলেই পরাশর ফোন নামিয়ে দিয়েছে।
এখন আমি করি কি? কেন, কি বৃত্তান্ত কিছুই না জেনে পরাশরের্ জন্যে তৈরী হয়ে বসে থাকব? সমস্ত মন বিদ্রোহ করে উঠতে পারে কিনা এতে! মানলাম ব্যাপারটা হয়ত দারুণ জরুরী। নষ্ট করার এতটুকু সময় নেই। কিন্তু কোথায় যেতে হবে এই দুটো কথার জন্যে দু সেকেণ্ড দেরী করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয় যেত! এ রকম অন্যায় আবদারে কিছুতেই সায় দেওয়া উচিত নয়। জামা-কাপড় বদলে বেরুবার জন্যে তৈরী হতে হতেই অবশ্য এসব কথা ভাবছিলাম। পরাশরের ওপর রাগ অভিমান যতই থাক নিজের একটু কৌতূহলও ছিল। হঠাৎ কি এমন ব্যাপার হল যাতে এক্ষুণি আমাদের ছুটে যাওয়া দরকার! সত্যিই গুরুতর কিছু না হলে পরাশর অত অস্থির হয় না। সে গুরুতর ব্যাপারটা কি নিয়ে কোথায় হওয়া সম্ভব? কাল আমরা সকালে যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি ব্যাপারটা কি তাদের সঙ্গেই জড়িত? না, সম্পূর্ণ নতুন কিছু ঘটনা?
সত্যি কথা বলতে হলে স্বীকার করতেই হয় যে বেরুবার জন্যে তৈরী হতে হতে ক্রমশঃই ব্যাপারটা জানবার জন্যে আরো অধীর হয়ে উঠছিলাম। পরাশরের আসার জন্যে আর তর সইছিল না। সে আধঘণ্টার মধ্যে অসবে বলেছে। কিন্তু আধঘণ্টাটাই আমার কাছে বড় বেশী দেরী মনে হচ্ছে তখন। পরাশরের ওপর গোড়ায় রাগ অভিমান যা করেছি তা তখন সম্পূর্ণভাবেই কেটে গেছে। বরং পরাশর তার নিজমূর্তি ধরেছে বলে তখন খুশিই হয়েছি। কাল কেন কি মতলবে সে অমন চুপ মেরে ছিল এখনও জানি না। তবে সেটা তার প্রেমে গদগদ ভাব ভাবার মত আহাম্মক হবর জন্যে আমিই এখন লজ্জিত। সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লেও পরাশরের অমন অবস্থা হবে কেন? তার ঐ ভোম মেরে থাকার পেছনে অন্য কোনো একটা রহস্য নিশ্চয় আছে আর আজকের এই অস্থিরতা নিশ্চয় সেই রহস্যের সঙ্গে জড়িত। যাক হাতে পাঁজি মঙ্গলবার থাকতে মিছে এত জল্পনা কল্পনার দরকার কি? পরাশর আধঘণ্টার মধ্যে আসবে বলেছে। আধঘণ্টার পঁচিশ মিনিটই ত কেটে গেছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি!
কিন্তু কি হল কি! ঘড়ির কাঁটা পাঁচ মিনিট ছাড়িয়ে দশ মিনিটের দাগও যে পার হতে চলেছে। এখনো পরাশরের দেখা নেই কেন? পরাশর মাঝে মাঝে খেয়ালবশে ঘড়ি ধরা সময় রাখতে গাফিলতি করে বটে, কিন্তু সে রকম দরকারী কিছু হলে সে আবার সেকেণ্ডের কাঁটাকেও হার মানায়। যে উত্তেজনা আর অস্থিরতার সঙ্গে সে খানিক আগে ফোন করেছে তাতে তার ত একেবারে কাঁটায় কাঁটায় আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছোবার কথা। কি হয়েছে কি তাহলে? ব্যস্ত হয়ে তার বাসাতেই এবার ফোন করলাম। না সে বাসায় নেই। তার অনুচরের কাছে জানা গেল আধঘণ্টারও আগে সে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তার মানে আমায় ফোন করবার পর বাড়িতে সে আর এক মিনিটও সময় নষ্ট করে নি। কিন্তু তার বাসা থেকে আমার এখানে আসতে ত খুব বেশী হলে বিশ মিনিটের বেশী লাগবার কথা নয়। বিশেষ এই সকালবেলার ফাঁকা রাস্তায়। তাহলে কি গাড়ির ব্রেকডাউন? না দুর্ঘটনা কোনো! অশুভ ভাবনাটাকে দূরে ঠেলে রেখে আবার ফোন করলাম পরাশরের বাসায়।
জিজ্ঞেস করলাম তার অনুচরকে, “পরাশর কোথায় যাচ্ছে কিছু বলে গেছে কি?”
“না তা বলেন নি।” উত্তর পেলাম, “শুধু বলে গেছেন আজ দিনের বেলা আর বাড়িতে খাবেন না।”
পরশর নিজে গাড়ি রাখে না। সাধারণত দরকার হলে পাড়ার ট্যাকসি স্ট্যাণ্ড থেকে কোনো একটা গাড়ি আনিয়ে নেয়। পাড়ার গাড়ি সব তার চেনা। সেই জন্যে কার কোন ট্যাকসি নিয়েছে জানলে পরে খোঁজ-খবর নেবার সুবিধে হয়।
ফোনে এবার সেই কথাই জানতে চাইলাম, “কোন ট্যাকসি নিয়ে পরাশর বেরিয়েছে তা দেখেছ?”
“আজ্ঞে ট্যাকসিতে ত তিনি যান নি!”
“ট্যাকসিতে যান নি? তাহলে গেছেন কিসে?”
“আজ্ঞে বড় একখানা প্রাইভেট গাড়িতে। ভোরেই কাকে ফোন করে আনিয়ে রেখেছিলেন।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করলাম।
পরাশর মাঝে মাঝে তেমন দরকার হলে একটা গাড়ি ভাড়া দেওয়ার এজেন্সী থেকে ড্রাইভার সমেত প্রাইভেট ভালো গড়ি আনিয়ে ব্যবহার করে। আজও তাই করেছে। কিন্তু এই সাত সকালে ওরকম গাড়ি ভাড়া করার কারণটা কি? আর কারণ যাই হোক সে গাড়ি নিয়েও আমার কাছে এমন কথার খেলাপ করল কেন? আর কারণ যাই হোক আধঘণ্টার মধ্যে তুলে নিতে আসছে বলে আমায় তৈরী থাকতে বলাটা তার ঠাট্টা নিশ্চয় নয়!
রাস্তায় দুর্ঘটনা ছাড়া পরাশরের এই কথার খেলাপের আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না ভেবে গভীর উদ্বেগ নিয়ে আমার বাড়ি থেকে তার বাসা পর্যন্ত ট্যাকসিতে খোঁজ করে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় টেবিলের ওপর ভাঁজ করা কাগজটা চোখে পড়ল। গত কাল পরাশর এইটেই আমার পকেটে গুঁজে দিয়েছিল আর সারা দিন সারা রাত চেষ্টা করেও আমি তার ছাপা ছবি আর নামের অংশটা আগে কোথায় দেখেছি স্মরণ করতে পারি নি।
মনের গতি বড় বিচিত্র। ধীর স্থির হয়ে অত ভেবে চিন্তেও যা বার করতে পারি নি এই উদ্বেগ অস্থিরতার মাঝে সেটা যেন মাথার ভেতর ঝিলিক দিয়ে ফুটে উঠল। ঐ মুখ আর বারবারা রেচিল নাম। ও ত আমার ভালরকম জানা। ভারতবর্ষের বড় বড় সব হোটেলে ট্যুরিস্ট সেজে যে দল অনেক সরল অন্য ট্যুরিস্টদের বিষ খাইয়ে বেহুঁশ করে সর্বস্ব চুরি করেছে মেয়েটি ত সেই দলের। পুরো নাম বারবারা রেচিল স্মিথ। বৃটেনে বাড়ি। চার্লস শোভরাজ নামে এক ধুরন্ধর শয়তানের সর্দারীতে আরো দুটি মেয়ের সঙ্গে বহুদেশে এ কাজ করে বেড়াবার পর ভারতবর্ষের দিল্লী শহরে এসে প্রথম ধরা পড়েছে। এদের সকলের ছবি ও শয়তানীর বিবরণ আমি এই কিছুদিন আগে পড়েছি। ঠিক এই বিবরণ ছপা কাগজের ফালিতে আমাকে পরাশরের চিঠিটি লেখার মধ্যে কোনো অস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে নাকি?
সেইটেই বোঝবার চেষ্টা করার মধ্যে ফোনটা বেজে উঠল।
বিদেশী মেয়ের যান্ত্রিক কণ্ঠ, “মিঃ ভদ্র আছেন?”
বুঝলাম কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের টেলিফোন অপারেটর আমায় খোঁজ করছে।
কেন করছে তা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়েই বললাম, “হ্যাঁ, আছি। কোথা থেকে কে ফোন করছেন?”
“এইখানে কথা বলুন।” বলে অপারেটর ফোন ছেড়ে দিলে।
পর মুহূর্তেই পরাশরের গলা শুনলাম, কৃত্তিবাস! যা বলছি মন দিয়ে শোনো।”
পরাশরকে সুস্থ নিরাপদ জেনে তখন আমার আগেকার উদ্বেগ দুর্ভাবনাটা ক্ষোভ হয়ে উঠেছে।
“তার আগে আমার কথা শোনো!” রীতিমতো ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম, “আমাকে সাত সকালে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে এমন মিছিমিছি তৈরী থাকতে বলার মানে কি? তুমি…”
আমার ঝাঁঝালো গলার জবাবে পরাশরের একটু বেশীরকম গম্ভীর শান্ত গলা — “সব পরে জানতে পারবে। এখন ভালো করে শুনে নাও যা বলছি। খানিকক্ষণ বাদে তোমার কাছে একটা বড় গাড়ি যাচ্ছে। তুমি যেন বিদেশে কোথাও যাচ্ছ এমনভাবে সাজ পোষাক সরঞ্জাম নিয়ে সে গাড়িতে চলে আসবে। বিদেশে যাবার লাগেজ তোমার আছেই। যা হোক কিছু ভরে সেগুলো সঙ্গে নেবে। পাসপোর্ট আনতেও ভুলো না।”
“তা না হয় ভুলব না।” হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু এ গাড়িতে করে যেতে হবে কোথায়?”
“যাবে, কাল যেখানে গিয়েছিলে সেই পাঁচতারা মার্কা হোটেলে। কোনো ভাবনা নেই। তোমার ঘর রিজার্ভ করা আছে। তুমি এসে লবির কাউণ্টারে দাঁড়ালেই হবে। আমি নিজে সেখানে থাকব। আর একটা কথা। আসবার সময় জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজের বাড়ির সামনে গাড়িটা একটু দাঁড় করাবে। তোমায় নামতে হবে না। শঙ্কর মহারাজেরই অনুচরদের কেউ তোমার হাতে একটা সীলকরা খাম দিয়ে যাবে। সেইটে নিয়ে আসবে।”
“শোনো পরাশর…”
শোনবার ওদিকে কেউ নেই। পরাশর যথারীতি কথা শেষ করেই ফোন নামিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এ আমায় কি দারুণ সমস্যায় সে ফেললে। যেন বাইরে কোথাও যাচ্ছি এমন ভাবে সাজসরঞ্জাম নিয়ে পাঁচতারার হোটেলে গিয়ে ওঠা, সেখানে আবার আমার জন্যে আগে থাকতে ঘর রিজার্ভ হয়ে থাকা, তার সঙ্গে ঐ বুজরুক জ্যোতিষ চক্রবর্তীর দেওয়া গালা আঁটা এক চিঠির বাহক হওয়া, — এসব কিছুর মানে কি! কাল যাকে পরাশরের প্রেমাস্পদই বলে ভেবেছিলাম, সেই ভারতীয় পুরাতত্ত্বের ছাত্রী এলসা, এই খানদানী হোটেল, জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজ, আর – আর — এই ছেঁড়া কাগজের ছবি আর নামটার মধ্যে কোনো ভেতরের সম্পর্ক আছে কি?