প্রেমের প্রান্তে পরাশর – ০২
দুই
শেষ পর্যন্ত তা কিন্তু রইল না।
সেই দিনই সকালে এক সঙ্গে অতগুলো সুযোগ হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি। আচার্যদেবের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অবশ্য হয় নি। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পর আরো মিনিট পনেরো অপেক্ষা করবার পর জানা গেল, আচার্যদেব একটা জরুরী মিটিং-এ কোথায় আটকে পড়েছিলেন। বাড়ি ফিরতে তাঁর দেরী হবে। বাড়িতে ফোন করে তাই দর্শনপ্রার্থী কাউকে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে বারণ করার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির একজন ওপরের সে ফোনের সংবাদ আমাদের জানিয়ে গেলেন।
খবরটা শুনে পরাশর আর মেয়েটি রীতিমত হতাশ। এক সঙ্গেই বাইরে যেতে যেতে মেয়েটি তার সমস্যার কথা জানালে। আচার্যদেবের কাছে কয়েকটা জরুরী বিষয় জেনে না নিলে যে জন্যে সে ভারতবর্ষে এসেছে সে কাজই সে শেষ করতে পারবে না। অথচ আজ নিয়ে দুদিন নাকি তার বসবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আচার্যদেব শেষ পর্যন্ত এমনি ভাবেই অন্য কিছুতে আটকে পড়ে কথা রাখতে পারেন নি।
কথা বলতে বলতে আচার্যদেবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা তখন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। এরপর বিদায় নমস্কার জানিয়ে যে যার পথে যাবার পালা। পরাশরের এখনো পর্যন্ত এই মুহূর্তটাকে কাজে লাগাবার কোনো লক্ষণ নেই দেখে নিজেকেই গায়ে পড়া হয়ে কথাটা তুলতে হল।
“আপনি যাবেন কোন দিকে?” মেয়েটিকে বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলাম।
“আমি!” মেয়েটি যেন এ প্রশ্নে একটু বিচলিত, “আমি – আমি উত্তর দিকেই যাব।”
সেই সঙ্গে আর একটা যা প্রশ্ন করলে তা আমি তার মুখ থেকে আসতে পারে বলে ভাবিনি।
মেয়েটির জিজ্ঞাসা হল, “আচ্ছা এখান থেকে আপনাদের ঐ কি বলে মিনি বাস পাওয়া যায় না?”
“পাওয়া যাবে না কেন!” মেয়েটির মিনিবাসে যেতে চাওয়ায় অবাক হলেও বিস্ময়টা গোপন করে বললাম, “কিন্তু এখন অফিসের সময়। উত্তরমুখো কোনো বাস ট্রামই ত খালি পাওয়া যাবে না। তা আপনি যাবেন কতদূর?”
“তা যাব একটু দূর।” মেয়েটি কুণ্ঠিত ভাবে জানালে, “সেই দমদমের কাছে।”
দমদমের কাছে শুনে সত্যিই একটু দমে গিয়ে যখন এই ভিড়ের সময়ে সেখানে পৌঁছোবার একটু সুলভ ও সুবিধাজনক বাস রুটের কথা ভাবছি, পরাশর ততক্ষণে বেপরোয়া হয়ে একটা চলতি ট্যাকসি ডেকে থামিয়ে ফেলেছে।
কাজটা বীরোচিতই হয়েছে সন্দেহ নেই, সিভ্যালরির পরিচয় দিতে এটুকু না করে উপায় ছিল না। কিন্তু আমি থখন নিজের পকেটের অবস্থা জেনে দমদম পর্যন্ত ট্যাকসির মিটারের নির্দেশ অনুমান করে শঙ্কিত না হয়ে পারি নি।
যে মেয়ে দমদমে যাবার জন্যে মিনি বাসের খোঁজ করে তাকে ট্যাকসি ডেকে দেওয়াটা সত্যিই উপকার করা কি না তাও ভাববার বিষয়।
ট্যাকসি দাঁড়াতে দেখে সেই জন্যেই মেয়েটিকে কেমন একটু ইতস্ততঃ করতে বোধ হয় দেখলাম।
পরাশর অবশ্য ততক্ষণে ট্যাকসির দরজা খুলে ধরে ডাকছে, “আসুন।”
মেয়েটি একটু দ্বিধাভরে যতক্ষণে ট্যাকসিতে গিয়ে উঠল ততক্ষণ আমি পরাশর এরপর কি করবে ভেবে রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম। পরাশর কি মেয়েটিকে ট্যাকসিতে উঠিয়ে ছেড়ে দেবে?
না, তা পরাশর দিলে না। মেয়েটি ভেতরে গিয়ে ওঠবার পর আমার গড়িমসিতে যে অধৈর্য দেখিয়ে বললে, “কই, এসো কৃত্তিবাস?”
“আমি!” অকপট বিস্ময়ের সঙ্গে একটু ভীত ভাবেই পরাশরের দিকে চাইলাম, “আমায় ডাকছ কেন? আমার এখন অতদূর দমদমে যাওয়ার একটু অসুবিধে আছে।”
“অসুবিধে আবার কি?” পরাশর এবার হাত ধরেই আমায় ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে পাশে এসে বসে ড্রাইভারকে দমদম যাবার নির্দেশ দিলে।
পরাশর এমনভাবে আমাকে নিয়ে ট্যাকসিতে ওঠায়, ভাড়ার ভাবনাটা থেকে তখন মুক্তি পেয়েছি। মেয়েটির ফেরবার সমস্যা মেটাবার সঙ্গে তার ঠিকানাটাও জেনে আসার এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়াই তার পক্ষে আহাম্মকি হত।
কিন্তু যার জন্যে এত করা সে মেয়েটির প্রতিক্রিয়াটা কি সেইটেই ত বোঝা যাচ্ছে না।