অনেক ক্ষন ধরে সামনে বসা মানুষ টার দিকে তাকিয়ে আছেন ডঃ তাহসিনা। মাথাটা নিচু করে বসেই আছে সেই লোক।
অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে থেকে শেষে বলতে শুরু করল-
–“আমার যে সমস্যা সেটা হল আমার পেটে একটা ফোঁড়া ঊঠেছে।”
বলেই শুন্য দৃষ্টিতে ডঃ তাহসিনার দিকে তাকিয়ে থাকল। ডঃ তাহসিনা অনেক ভাল একজন সাইকায়াট্রিষ্ট।
উনি এর আগে ও অনেক মেন্টাল রুগীকে ভাল করেছেন।
কিন্তু আজকের এই রুগি এসে বসেছে তো বসেছে কথা বলার কোন নাম গন্ধ নাই।
অনেক ক্ষন মাথা নিচু করে চুপ করে থেকে শেষে বলতে শুরু করল।
–” আমার সমস্যার শুরু যখন আমি আমার স্ত্রি মাহমুদা কে খুন করি। আমার স্ত্রি কে নিয়ে আমি খুব সুখে ছিলাম।
কিন্তু আমার একটা এক্সিডেন্টের কারনে ডাক্তার আমাকে বলেন যে আমি আর কোন দিন বাবা হতে পারবোনা।
এর পর মাহমুদা আমাকে প্রথম প্রথম মেনে নিয়েছিল। আমাদের বিয়ে হবার পর ঠিক করেছিলাম ৩ বছর পর বাচ্চা নেব।
এর মাঝেই ঘটে যায় সেই এক্সিডেন্ট। এরপর মাস ছয়েক ঠিক ছিল।
কিন্তু একদিন আমি জানতে পারি মাহমুদার সাথে আমার এক আত্মীয়র অবৈধ সম্পর্ক হয়েছে।
এটা শোনার পর আমার মাথা ঠিক ছিলনা। আমি দুইবার আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি।
এর মাঝেই আমাকে মাহমুদা ওর অবৈধ সম্পর্কের কথা জানায়। আমি বিমূঢ় ছিলাম বেশ কিছু দিন।
কিন্তু এর মাঝেই জানতে পারি মাহমুদা কনসিভ করেছে। এটা শুনে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।
ওর পেটে বাচ্চা যখন ৮ মাস – তখন আমি একদিন মাহমুদা কে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলি। মেরে ফেলি পেটের বাচ্চা টাকে ও।
আমি একজন পুলিশ অফিসার ছিলাম সেই সময়। এখন আমি রিটায়ার্ড।
সেই সময় আমার ক্ষমতা বলে মাহমুদা কে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কোন রকমে দাফন করে আসি।
এর পর আমি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম।” বলেই একবার দম নিল লোকটা।
তারপর টেবিল থেকে পানির জগটা নিয়ে অদ্ভুত ভাবে পানি গ্লাসে না ঢেলে জগ থেকেই ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল অর্ধেক পানি।
তারপর আরেকটা দম নিয়ে আবার বলা শুরু করল সে –
–” এর পরের বছর আমি দেশে ফিরে আসি। চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। সেখানে আবার জয়েন করি।
কিন্তু দুই মাস আগে আমি ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাই। সেখানে ঈদের দিন রাতে আমি একাকী বসে ছিলাম আমার বাড়ির পেছনের বারান্দায়।
তখন দেখি মাহমুদার কবর থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বাবা বাবা করে ডেকে আমার দিকে দৌড়ে এসে আমার মাঝে ঢুকে গেছে।
সেদিন রাতে আমি খানিকটা নেশা করেছিলাম। তাই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সব আজগুবি মনে করে ভুলে যাই।
কিন্তু পরদিন আমার পেটে নাভীর গোড়ায় একটা ফোঁড়া ঊঠে। প্রথমে এটা ফোঁড়ার মতই ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে এটা বড় হতে থাকে।
আমি এই কয়দিন প্রায় সময় স্বপ্নে দেখছি একটা বাচ্চা ছেলে আমাকে বাবা বাবা করে ডাকছে আর বলছে আমার পেট থেকে নাকি তার জন্ম হবে।
এই যে দেখেন আমার পেটের মাঝে এটা কি”- বলে শার্টের ভাজ খুলে দেখায় ডঃ তাহসিনাকে।
তাহসিনা কিছুক্ষন দেখেন ফোঁড়াটা। বেশ বড় আকারের একটা ফোঁড়া। লালচে ভাব ধরেছে।
তারপর হেসে লোকটাকে বললেন-
–“দেখুন মি.”- বলে নামটা জানার জন্য তাকালেন উতসুক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে।
উনি বললেন “ রাকিব- মোঃ রাকিব”।
–“হুম – দেখুন রাকিব সাহেব- আপনার হ্যালুসিনেশন হয়েছিল- সেই দিন রাতে। আপনি আপনার স্ত্রীকে অনেক ভালবাসতেন।
সেই ভালবাসা আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই আপনি উনাকে এবং উনার সন্তান কে মেরে ফেলে অনেক কষ্ট পাচ্ছিলেন।
সেইদিন আপনার পিতৃসত্ত্বা আপনার মাঝে আপনার মৃত সন্তান কে ঢুকে যেতে দেখিয়েছে। এটা নিছক ই কল্পনা। আর বেশি কিছু না”।
বলে মিষ্টি করে হেসে রাকিব সাহেবের দিকে তাকালেন।
–“ কিন্তু আমার পেটের এই ফোঁড়া কিভাবে আসল?” এবার ক্ষেপে গেলেন রাকিব সাহেব।
–“এটা কো- ইন্সিডেন্স মাত্র। এটার সাথে আপনার স্বপ্ন কিনবা হ্যালুসিনেশন কে মেলালে তো চলবেনা”-বললেন ডঃ তাহসিনা।
–“ দেখেন আমি মেলাচ্ছিনা। কিন্তু ইদানিন আমার পেটের ভেতর কিছু একটা লাথি মারে।
–কিছু একটা হচ্ছে আমার পেটের ভেতর”- বলেই প্রায় কেঁদে ফেলে রাকিব সাহেব।
–“ দেখুন আপনাকে আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি।এগুলো খান। আশা করি আপনার ভাল ঘুম হবে।
এবং আপনার এই বিশাল ফোঁড়া ও কমে যাবে” বলেই খস খস করে কিছু ঔষধ লিখে প্যাড থেকে কাগজ ছিড়ে দেন রাকিব সাহেব কে।
তারপর বললেন-“ আপনার যে কোন সমস্যা হলে আমি নিজে গিয়ে আপনাকে দেখে আসব।
আপনার এখানে আসার আর দরকার নেই। এইখানে আমার ফোন নাম্বার দেয়া আছে।
সেখান থেকে আমাকে ফোনে জানাবেন কি হয়েছে”- বলেই ঊঠে পড়লেন ডঃ তাহসিনা।
“আমার একটা সেমিনার আছে- আমাকে এখন সেখানে যেতে হবে” বলে বের হয়ে গেলেন ডঃ তাহসিনা।
…………..
তিন মাস পর রাত ১টায় ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল ডঃ তাহসিনার।
উনি ফোনটা ধরেই আরেক পাশ থেকে শুনতে পেলেন- রাকিব সাহেবের কন্ঠ-
–“ আপা একটু আসবেন আমার বাসায়? প্লিজ আপা আসেন।প্লিজ আসেন।
আমার পেটে প্রচন্ড ব্যাথা করছে” বলেই বাসার ঠিকানা দিলেন ডঃ তাহসিনাকে।
সারাদিন মেডিক্যাল এ সেমিনারে ছিলেন তিনি। তাই বাসায় এসে মাত্র শুয়েছেন।
কিন্তু এই রকম কল এলে প্রায় সময় তিনি ঘুম রেখেই দৌড় মারেন রূগীর বাসায়।
নিজের জীবনের চেয়ে রোগীকে অনেক গুরুত্ব দেন তিনি।
আর এই রাকিব সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি অনেক পড়াশুনা করেছেন ইদানিন।
তাই তিনি এত রাতে ফোন পেয়ে কোন রকমে পোশাক পাল্টে গাড়ি নিয়ে বের হলেন।
রাকিব সাহেবের বাসায় বাসা গুলশানে। সেখানে পৌছে একটা সাদা রঙ এর বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে নিজেই ঢুকে পড়লেন ভেতরে।
বাড়িতে গিয়ে বেল টেপার পর খুলে দিল একজন বৃদ্ধা মহিলা।
তিনি রাকিব সাহেব কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা তাহসিনাকে নিয়ে গেলেন একটা ঘরে। সেখানে শুয়ে আছেন রাকিব সাহেব।
কিন্তু রাকিব সাহেব কে দেখেই ভয় পেয়ে যান তিনি।রাকিব সাহেবের পেটটা অস্বাভাবিক ভাবে ফোলা।
ঠিক যেন সন্তান সম্ভবা মায়ের মত। আর ঠিক সেই সময় রাকিব সাহেব চিৎকার করে ঊঠে অজ্ঞান হয়ে যান।
এবং সেই সময় তাহসিনার চোখের সামনে ঘটল এক বিষ্ম্য় কর ব্যাপার।
রাকিব সাহেবের নাভির উপরের ফোঁড়া থেকে একটা লালচে পিণ্ড বের হতে লাগল।
আস্তে আস্তে পিন্ড টার কিছু অংশ বের হয়ে চোখ আর মুখে অস্তিত্ব জানান দিল। এর পর তাহসিনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না।
তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয়া মহিলা কে গামছা আর কুসুম গরম পানি আনতে বলে নিজে কোন রকম টান দিয়ে বের করেন বাচ্চা টাকে।
অদ্ভুত সুন্দর সেই সন্তানটাকে কোলে নিয়ে হতভম্ভ হয়ে যান তিনি। বাচ্চাটা যেন ঘুমাচ্ছে।
এর মাঝে তোয়ালে নিয়ে সেই মহিলা আসলে তিনি তোয়ালে দিয়ে কোন রকম বাচ্চা টাকে মুছিয়ে দেন।
তারপর খেয়াল করেন বাচ্চাটা কাঁদছে না। তিনি অনেক চেষ্টা করছেন।
কিন্তু কোনভাবেই বাচ্চাটাকে কাঁদাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত দেখলেন বাচ্চাটা মারা গেছে।
বাচ্চাটা মারা যাবার পর তিনি রাকিব সাহেবের দিকে খেয়াল দিলেন। এতক্ষন তিনি যেন ঘোরের মাঝে ছিলেন।
মেডিক্যাল সায়েন্স কে বোকা বানিয়ে এই মাত্র এই লোকটা একটা বাচ্চা জন্ম দিল। কিন্তু বাচ্চাটাকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না।
আগে জানলে তিনি ঠিকই রাকিব সাহেবের ব্যাবস্থা করতেন। তিনি তাড়াতাড়ি রাকিব সাহেব এর নার্ভ দেখলেন।
কিন্তু হতাশ হলেন। তিনি ভেবেছিলেন রাকিব সাহেব অজ্ঞান হয়েছেন। আসলে তিনি মারা গেছেন সেই চিৎকার দিয়েই।
এবার কিছু টা মুষড়ে পড়লেন তাহসিনা। তিনি লোকটাকে বিশ্বাস করলে দুইজন কেই হয়ত বাচানো যেত।
এরপর তাহসিনা সেই বাচ্চাটাকে গোপনে সরিয়ে ফেলার ব্যাবস্থা করেন।
সেই বৃদ্ধা মহিলা কে দিয়েই বাচ্চাটাকে সেই বাড়ির এক কোনায় কবর দেবার ব্যাবস্থা করেন।
আর রাকিব সাহেব কে কবর দেয়া হয় তার গ্রামের বাড়িতে। এই সব ব্যাপার ভাল মত সারতে সারতে উনার কয়েকদিন লেগে যায়।
এর তিন দিন পর রাতে ক্লান্ত ডঃ তাহসিনা মাত্র হাসপাতাল থেকে এসে বাসায় খেয়ে দেয়ে শুয়েছেন।
এমন সময় উনার ঘরের বারান্দায় একটা আলতো টোকা দেয় কেউ একজন। তখন ও ঘুমান নি তাহসিনা।
আস্তে করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঊঠে বারান্দার দরজা খুলেই দেখেন একটা বাচ্চা ছেলে দাড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে।
মুখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আন্টি আন্টি বলে ঝাপিয়ে পরে তাহসিনার শরীরের সাথে মিশে যায়।
ব্যাপারটা এতই তাড়াতাড়ি হয়েছে যে তাহসিনা বেশ কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়লেন তিনি সেখানেই।
পরদিন জ্ঞান ফিরে নিজেকে মাটিতে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যান তিনি।তারপর রাতের ঘটনা কে নিছক স্বপ্ন ভেবে হেসে ঊড়িয়ে দিলেন তিনি।
তারপর ফ্রেশ হবার জন্য বাথরুমে গেলেন। হাত মুখ ধুয়ে বের হতে যাবেন তখন পেটে চিনচিনে একটা ব্যাথা টের পেলেন।
তাড়াতাড়ি নাইট গাঊনটা সরিয়ে পেটে হাত বুলালেন তিনি।
এবং দিনের আলোতেই পরিষ্কার টের পেলেন তিনি – উনার পেটের যেখানে নাভি- ঠিক তার উপরেই একটা ফোঁড়া ঊঠেছে।
লালচে ফোঁড়াটা দেখতে ঠিক রাকিব সাহেবের সেই ফোঁড়াটার মত।
সাদৃশ্যটা টের পেতেই আবার জ্ঞান হারালেন সাইকিয়াট্রিষ্ট ডঃ তাহসিনা……