শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হল সবাই মিলে ময়মনসিংহ যাব। তানভীর প্রথমে রাজি না হলেও আমাদের চাপে সে রাজি হয়। আমরা একেকজন একেক জেলায় থাকি। তাই সবার সুবিধার্থে ময়মনসিংহ নির্বাচিত করা হল। তানভীরকেকে বললাম খুলনা থেকে ঢাকায় আসতে। আর আমি ঢাকায় গিয়ে একসাথে সোজাসোজি ময়মনসিংহ যাব। আর মাহফুজ আর আভা যেহেতু একই জায়গায় থাকে, তাই বললাম তাদের সোজাসোজি ময়মনসিংহ চলে যেতে বললাম। আর থাকার জায়গা নিয়ে প্রথমে চিন্তা করলেও আভা এর সমাধান দেয়। ময়মনসিংহে তার একটা আত্মীয় থাকে। সেখানে নাকি সবাই মিলে থাকতে পারব।
যেই ভাবা সেই কাজ। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। স্টেশনে পৌছতেই দেখি তানভীর অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। একসাথে লাঞ্চ করে আবার আরেকটা ট্রেনে উঠলাম ময়মনসিংহ যাবার উদ্দেশ্যে।
.
ময়মনসিংহে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাতটা নাকি আটটা হল। আমি বেশ ক্লান্ত বোধ করছি। তবে তানভীরকেকে বেশ তরতাজা মনে হচ্ছে। সেই দুপুর থেকে বকবক করছে। মাহফুজকে ফোন দিয়ে ঠিকানাটা জেনে নিলাম। রাস্তার ওপারে দেখলাম একলাইনে অনেক গুলো বেবিট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর তানভীর রাস্তা ওপারে গেলাম। সেই ঠিকানায় কোন ট্যাক্সিচালক যেতে রাজি হলেন না। কারণ জানতে চাইলে একজন বলে, “আপনি যে ঠিকানায় যেতে চাচ্ছেন, সেখানে যাওয়ার সময় একটা রাস্তার উপর দিয়ে যেতে হয়। সেই রাস্তায় সন্ধ্যার পর কেউ চলাচল করে না।”
– কেনো?
– তা অনেক ভয়ানক জায়গা!!
আমি পরোয়া করলাম না। পেছন থেকে হঠাৎ তানভীরের ডাক শুনতে পেলাম। ফিরতেই দেখি তানভীর একটা বেবিট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
.
তানভীর তার নিজের মত করে কথা বলেই যাচ্ছে। আমার কানে আওয়াজগুলো ঢুকলেও মস্তিষ্ক এটিকে অর্থবোধক বাক্যে পরিণত করতে পারছে না। কারণ আমার মস্তিষ্ক অলরেডি আরেকটা কাজে ব্যস্ত। আমিই ব্যস্ত রেখেছি তাকে। একটা বিষয়ে আমার যেমন অবাক হচ্ছি, ঠিক সেই অবাক হবার কারণে আমার কৌতুহল বাড়ছে। অন্যান্য চালকরা এই ঠিকানায় যেতে না চাইলেও তিনি কেনো রাজি হয়েছেন? আর তারা যে রাস্তাটির কথা বলছিল, রাস্তাটা কোনটা? আর তাতে সবাই ভয় পাবার কারণটা কি? অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে ঘুরপাক খেতে লাগল আমার মাথায়। হঠাৎ চোখ পড়ল লুকিং গ্লাসে। চোখ পড়তেই আমার শিরার মধ্য দিয়ে শীতল বয়ে গেলো। লুকিং গ্লাসে চালককে দেখা যাচ্ছে না, শুধু তার সিটটা দেখা যাচ্ছে। তবে তিনি তো আমার সামনে তিনি বসে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন। আবার তাকালাম লুকিং গ্লাসে। তাকে লুকিং গ্লাসে দেখা যাচ্ছে না। ঠিক সে সময় ট্যাক্সিটা থেমে গেলো। পাশ থেকে তানভীর বলল, “হুম, আমরা মনে হয় পৌঁছে গেছি।”
আমাদের সামনে বসা চালক ট্যাক্সি থেকে নেমে গেলেন। আমরাও নেমে গেলাম। দেখলাম আমার ডানপাশে একটা বিরাট ডুপ্লেক্স ঘর। তবে ভেতরে অন্ধকার। সামনে একটা খোলা জায়গাও দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে দেখলাম ন’টা বাজে। আমি বললাম,
“কিরে, আপনি আমাদেরকে এখানে নামিয়ে দিলেন কেনো?”
চালকটা আমাদের সামনে অনড় দাঁড়িয়ে আছেন। তানভীর বলল, “ঈশান, এটা সেই জায়গা না তো, যেটার সম্পর্কে অন্যান্য ট্যাক্সিচালকরা বলাবলি করছিলেন?”
হঠাৎ দেখলাম, চালকটা হঠাৎ চৌপায়া প্রাণীর মত দু হাত-পা ভর করে আছে, এবং আমাদের দিকে দাঁত খিচিয়ে তাকিয়ে আছে। তানভীর আতংকের সাথে বলল, “কিরে, আপনি এরকম করছেন কেন?(আমার দিকে তাকিয়ে) ঈশান, এখান থেকে তাড়াতাড়ি চল। এখানে….. ”
কথা শেষ করার আগে মানুষরূপি জিনিসটা তানভীরের ওপর লাফ দিল। সেটা তানভীরের ঘাড়ে কামড় বসায়। আর তানভীর গজরাতে থাকে। আর উপায় না দেখে আমি পকেট থেকে ড্যাগার বের করলাম আর তা ঢুকিয়ে দিলাম শালার পিশাচটার পিঠে। সে তানভীরকে ছেড়ে দিল। আবার আমার দিকে দাঁত খিচিয়ে বাড়িটার ভেতর চলে গেল।
.
“কিরে, তানভীরের এই অবস্থা কেনো?” উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল মাহফুজ। আভা তানভীরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি তাদেরকে সব খুলে বললাম।
“আমি তোমাকে বলেছিলাম না আভা, তাদেরকে এই সময়ে আসতে না দিতে..”
এক বৃদ্ধ রুমে ঢুকলেন কথাটা বলতে বলতে। “দেখছো, তার কি অবস্থা? ভাগ্য ভালো ছিল সে বেঁচে গেছে।”
আভা মাথা নিচু করে বলল, “এটা হল আমার দাদু। আপন না হলেও ইনি আমার আপনের চেয়ে আপন। এরপর সে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। তবে দাদুর মেজাজ বেশ খারাপ মনে হচ্ছে। তিনি আভাকে ছাঁড়িয়ে বললেন, “আগে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা কর।”
অভিমানী আভা রুমটা থেকে চলে গেলো। তিনি সামনে বসলেন। আমি বললাম, “দাদু, আপনি আমাদের সাথে এমনটা হবার কারণটা কি?”
“সন্ধ্যার পর এই রাস্তায় কেউ চলাচল করে না। বলতে গেলে এই রাস্তাটা সন্ধ্যার পর সবার জন্যে নিষিদ্ধ”
“কারণটা কি দাদু?” চশমা মুছতে মুছতে বলল সে।
“এই যে, আজকে তার সাথে যে ঘটনাটা ঘটল..”
আভা ততক্ষনে একটা ট্রেতে করে চা-নাস্তা নিয়ে এল। তানভীরকে দেখে বড়ই মায়া লাগছে। তবে একটা জিনিসে আমার খটকা লাগল। ঐ মানুষরূপে পিশাচটা শেষ পর্যন্ত ঐ বাড়িটার দিকে চলে গেল। বাড়িটাকি তার আবাসস্থল নাকি তার মত আরো অনেকে আছে তাতে…
সকালে ঘুম ভাঙলো শালিকের ডাকে। একদম বিরক্তিকর আওয়াজ। একবার গান বাজানো শুরু করলে আর থামে না। তার চাইতে দাঁড়কাকের ডাক অনেক সুন্দর। পাশে তানভীর নেই। আমি তানভীর এক সাথে ঘুমিয়েছিলাম। তার শোয়ার জায়গাটা হালকা গরম আছে। তার মানে সে এখান থেকে উঠেছে কিছুক্ষনের মত হচ্ছে। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে সাতটা বাজে। আরেকটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম আসছে না। আর না পেরে বিছানা থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ডাইনিং রুমে দেখলাম দাদু পত্রিকা পড়ছেন। তাঁকে গুড মর্নিং বলে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম ওয়ার্ম আপ করার জন্যে। তখন দেখলাম, তানভীর বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে গিয়ে ডাক দিলাম। কোন সাড়া দিল না। খেয়াল করে দেখলাম, সে সামনে একটা বাড়ির ছাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে যেখানে একটা মেয়ে তার চুল আঁচরাচ্ছে। মাটি থেকে একটা শুকনা পাতা নিয়ে তানভীরের হা করে মুখে ঢুকিয়ে দিলাম আর তা সে মুখ নাড়িয়ে দিয়ে চাবাচ্ছে। এতক্ষন পর তার হুঁশ এলো। সে থু থু করে মুখ থেকে চাবানো পাতাটা ফেলে দিল। আমি বললাম, “কি, উপরে দৃশ্য দেখতেছিলে নাকি?”
তানভীর থতমত খেয়ে বলল, “না না, এইরকম কিছু না…”
আমি হাত দিয়ে ইশারা করে মেয়েটাকে হ্যালো জানালাম। সেও সাড়া দিল। আমি ইশারা দিয়ে বোঝালাম আমরা উপরে আসতে পারব কিনা। সে তাতে রাজি হল। এরপর তানভীরের দিকে তাকিয়ে দাঁত দেখিয়ে হাসলাম।
তার নাম হল জারিন তাসনিন। আর সেও নাকি ভৌতিক ও রহস্য গল্প লেখে। তাই তাকে আমাদের ভূত ও ভৌতিক গ্রুপে এড করে দিলাম। আর সে আজ আমাদেরকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিল। আজ নাকি তা জন্মদিন, রাতে কেক কাটা হবে।
.
সবাই একসাথে নাস্তা খেতে বসলাম। মাহফুজ দাদুকে বলে, “দাদু, আপনি কি এত বড় বাড়িতে একা থাকেন?”
“আরে না, আমার সাথে তোমাদের দাদীও থাকেন, তবে সে তার ছোট মেয়ের শশুড়বাড়ি গিয়েছে দু-দিন হচ্ছে।”
“তাহলে এতদিন আপনি একা একা কিভাবে থাকতেন?”
“একা একা থাকতে আমার ভালো লাগে। তোমাদের দাদী আমাকে তার সাথে যেতে বলেছিল, কিন্তু যায়নি।”
সবাই মজা করতে করতে নাস্তা করছে। দাদুও বেশ রসিক।
“দাদু, আপনি ঐ বাড়িটা সম্পর্কে কোন কিছু জানেন?” সকলে হাসাহাসি থামিয়ে তাকালো আমার দিকে। দাদু বললেন,
“কোন বাড়িটা?”
“ঐ যে, মানুষরা যে রাস্তাটা দিয়ে চলাচল করতে ভয় পাই, সেই রাস্তার পাশে একটা বিরাট বাড়ি দেখেছিলাম আমি।”
“হুম, বাড়িটা বেশ পুরাতন। তাতে কেউ থাকে না। তবে হঠাৎ সেই প্রশ্নটা করার কারণটা কি?”
“এমনিতে। বাড়িটা দেখে মনে কৌতুহল জেগেছিল। তাই বাড়িটার সম্পর্কে একটু জানতে ইচ্ছা হয়েছিল।”
“ও। তবে এই বাড়িটার ভেতর ঢুকবে না। ঢুকলে আর বের হতে পারবে না।”
পাশ থেকে তানভীর বলল, “কেনো দাদু?”
“এই বাড়িতে একবার যে ঢুকে সে আর সেখান থেকে বের হয় না। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একবার একদল যুবক সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ আর সেইখান থেকে ফিরে আসেনি। আর দিনের বেলায় বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করলে কিছু হয় না তবে সন্ধ্যার পর রাস্তাটা ভৌতিক হয়ে যায়।
.
একসাথে বেরিয়ে পড়লাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সাথে জারিনও আছে। ঘোরাঘুরি করতে করতে বিকালের দিকে ঐ মৃতবৎ বাড়িটার সামনে পৌছলাম। আমি বললাম, “চল, বাড়িটাতে যাই।”
আভা বলল, “দাদু কি বলেছে শুনোনি? তিনি এই বাড়িটার ভেতর ঢুকতে নিষেধ করেছেন।”
মাহফুজ বলল, “বাড়িটার ভেতরে ঢুকলে সমস্যা হতে পারে কিন্তু এর বাগানে হাঁটাহাঁটি করলে কিছু হবে না বলে মনে হয়।”
অবশেষে সবাই রাজি হল। বাগানটাকে জঙ্গলও বলা চলে। দেখেই লাগছে, বাগানটার অনেকদিন ধরে কেউ যত্ন করছে না। “এই সবাই, এটা কি দেখো”
আভার ডাকে সবাই গেলো তার কাছে। দেখলাম, গতকালের টেক্সি ড্রাইভারের লাশ। তা ঘরটার সদর দরজার সামনে পড়ে আছে।
“তানভীর, এটাকে চিনতে পারছো?”
“হুম।” এই বলে সে তার ঘাড়ে হাত দিল। যেখানে এই পিশাচটা কামড় বসিয়েছিল, সেখানে এখন ব্যান্ডেজ করা। মানুষরূপী পিশাচটির চারপাশে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। গত রাতে আমার ড্যাগারে খাওয়া চোটে সে আর থাকতে পারেনি।
পাশ থেকে জারিন বলল, “এটা মানুষ নাকি পশু? পশুর মত দাঁত আর নখ!”
.
জারিনের বাড়ি আর আভার দাদুর বাড়ি একই উঠোনে হওয়ায় তার জন্মদিনের কেক এখানে কাটা হবে। সবাই এখানে পৌছে এসে উপস্থিত। এখন শুধু জারিনের অপেক্ষায়। উঠোনে বাতিও জ্বালানো হয়নি। কারণ আজকের চাঁদটা বেশ ভালো কিরণ দিচ্ছে। পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁইন্নি পসর রাত আমার অনেক ভালো লাগে। তখন নিজেকে বড়ই রোমান্টিক বলে মনে হয়। হঠাৎ জারিনের বাড়ি থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যায়। সেখান থেকে একজন বেরিয়ে বলল, জারিনকে নাকি বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার সেই মূহুর্তেই আভা বলে বাড়িতে নাকি দাদু নেই। তাঁকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুজোনই গেলো কোথায়?
আমি মাহফুজ আর আভাকে বললাম দাদিকে খুঁজতে আর আমি-তানভীর জারিনের ব্যাপারটা।
আমি আর তানভীর জারিনের বাড়িতে চলে যাই। দেখি কান্নার রেওয়াজ চলছে। আমাদেরকে দেখে প্রথমে চিনতে না পারলে আমি তাদেরকে আমদের পরিচয় দিই আর বলি, ডিটেইলসটা বলতে। একটা মহিলা এলো আমাদের সামনে। দেখে লাগছে তিনি জারিনের মা।
“কিচ্ছুক্ষণ আগে আমরা যখন যার যার কাজে ব্যস্ত ছিলাম, তখন হঠাৎ জারিনের চিৎকার শুনতে পাই। এরপরই কাঁচ ভাঙার আওয়াজ। এরপর রুমে গিয়ে দেখি তার জানালার কাঁচ ভাঙা।”
তানভীর বলল, “তাকে কেউ খুঁজতে যায়নি?”
“হুম, আমার ভাই আর ছেলে গিয়েছে।”
আমি গেলাম জারিনের রুমে। দেখলাম বিছানার পেছনের জানালা ভাঙা। জারিনদের ঘর নিচ তলায় হওয়ায় জানালা দিয়ে সহজে বাইরে যাওয়া যায়। আমিও জানলা টপকে বাইরে এলাম। এরপর মোবাইলে ফ্লেশ লাইট জ্বালিয়ে মাটিতে আলো ফেললাম। দেখলাম, এখানে কাউকে ছেঁচরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাগ। বেশি দেরি করলে সমস্যা। তাই দাগটা অনুসরন করতে লাগলাম। অনুসরন করতে করতে ঐ নিষিদ্ধ রাস্তায় এসে পড়লাম। চাঁদের আলোতে দেখা যাচ্ছে, মানুষের মত একটা প্রাণি জারিনকে কামড়ে টেনে টেনে ঐ মৃতবৎ বাড়িটার ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি দৌঁড়ে গিয়ে সেখানে গেলাম এবং পকেট থেকে ড্যাগার বের করে পিশাচটার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। অব্যর্থ লক্ষ্য। সোজা গিয়ে পিশাচটার মাথায় গিয়ে গাঁথলো। আর সেখানেই সে শেষ। যখনই জারিনের কাছে যাব, তখনই বাড়িটা থেকে আরেকটা মানুষরূপি পিশাচ বের হয়ে জারিনকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। আমি বাড়িটার ভেতর ঢুকতে চাইলেও আর ঢুকিনি। কারণ এখন যদি কোন প্ল্যান ছাড়া বাড়িটার ভেতর যাই, তাহলে আমারও বিপদ হবে, তারও বিপদ হতে পারে। তাই সোজা আভার দাদুর বাড়ির দিকে চলে গেলাম। পৌঁছেই দেখি উঠোনে সবাই একসাথে বসে আছে। সাথে দাদুও আছেন। আমাকে দেখে তারা উঠে দাঁড়ালো। তারা প্রশ্ন করবার আগে আমি বললাম, “না, আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি। তবে পারার সম্ভাবনা আছে।”
মাহফুজ বলে, “সম্ভাবনা বলতে কিরকম?”
তার কথায় উত্তর না দিয়ে দাদুকে বললাম, “দাদু, এই এলাকায় এই পূর্ণিমার তিথিতে কি আগে কেউ এইরকম হারিয়ে গিয়েছিল?”
“আরে, এই ব্যাপারটা তো আগে বুঝিনি। হ্যা, গত মাসের আগের মাসে একজনও এরকম হারিয়ে যায়। আর তাকে এখনো খুঁজে পাইনি।”
“তখন কি তার জন্মদিন ছিল?”
“হ্যা, তবে তিনি বুঝলে কেমনে?”
“হুম এখন ব্যাপারটা পুরোই পরিষ্কার আমার কাছে। আমাদের হাতে মাত্র একমাস বা এর চাইতে কম সময়।”
“এর মানে কি?” বলল তানভীর।
আমি বললাম, “…….
আমি বললাম, “পরবর্তী পূর্ণিমা আসতে প্রায় একমাসের মত আছে। আর পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তাকে মেরে ফেলা হবে।”
তানভীর বলল, “তুমি কিভাবে বুঝেছো?”
“তানভীর, গত রাত তোমাকে যে আক্রমণ করেছিল, সেটা একজন মানুষই।”
“তাহলে সে পশুর মত আচরণ করছে কেনো?”
“এগুলোকে এনিমিজম বলে। এই সম্পর্কে আমি পড়েছি। আর্মেনিয়ায়য় খ্রিষ্টধর্মের গোড়াপত্তনের আগে ইউরোপে বিভিন্ন প্যালিওথিলিক ধর্মের প্রচলন ছিল। এর থেকেই উৎপত্তি হয় এনিমিজম। এই বিশ্বাসের উপাসকরা বিভিন্ন প্রাণির আত্মিক শক্তিতে বিশ্বাস রাখে। নিজেদের মধ্যে তা ধারণ করার জন্যে পালন করে কিছু রীতি। যার মধ্যে একটি ছিল চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে চলা। এনিমিজমের একটা বিশেষ প্রথা ছিল পূর্ণিমার সময় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই দিনটাতে তারা এই তিথিতে জন্ম নেয়া একজন মানুষ খুঁজে বের করে বলি দিত তাদের দেবতার উদ্দেশ্যে। আমার যতটুকু ধারণা, জারিনের জন্ম নিশ্চয় পূর্ণিমায়।”
মাহফুজ বলে, “সেরকম হলে তো আজকে জারিনের মৃত্যু তো অনিবার্য”
“আমি বললাম না, আমাদের হাতে একমাসের মত সময় আছে।”
“কিভাবে, তাকে যে শিকার করে নিয়ে গেছে, সে তো আজ রাতের মধ্যেই জারিনকে বলি দিয়ে দেবে।”
“শোন, জারিনকে যে শিকার করে নিয়ে গিয়েছিল, সে আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে। তবে তাকে আরেকজন ঐ বাড়িটার ভেতরে নিয়ে যায়। তাকে যেহেতু সে শিকার করেনি, তাই তাকে এই পূর্ণিমার তিথিতে বলি দেয়া হবে না, দেয়া হবে আগামীতে…”
.
আবার শালিকের ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, শালিক পাখিটা একটা গাছের ডালে বসে অনবরত ডেকেই চলছে। কানে তালা লেগে যাওয়ার মত শব্দ। পাশে তানভীর এখনো ঘুমুচ্ছে।
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ডাইনিং রুমে আসতেই দেখলাম, সেখানে দাদু পায়চারি করছেন। দাদুকে আজ একটু ফুরফুরে মনে হচ্ছে।
“কিরে দাদু, কি চিন্তা করছেন?”
আমার কথা তার কানে পৌঁছাতেই তিনি চমকে উঠলেন। বললেন, “কই, কিছুই চিন্তা করছি না।”
“তাহলে একই জায়গায় এভাবে ঘুরাঘুরি করছেন কেনো?”
হঠাৎ একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল। দাদুর সাদা পাঞ্জাবীতে ছোপ ছোপ রক্তের ডাগ।
“কিরে দাদু, আপনার পাঞ্জাবীতে রক্ত কেনো?”
পরনে থাকা পাঞ্জাবীটার দিকে তাকালেন তিনি। এরপর হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “না মানে আসলে গত রাত মুরগির দোকানে গিয়েছিলাম তো, সেইখান থেকে আরকি”
“ও, আমি ভাবলাম আপনিও ঐ এনিমিজমদের মত কাউকে বলি দিয়েছেন আজীবন বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে…”
.
আভাও রাজি হলো আমাদের সাথে যেতে। আমরা আমাদের বেকপ্যাকে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিলাম। সাথে আমি আমার ড্যাগারটাও নিতে ভুললাম না। সবাইকে বললাম একটা ওভার কোট পড়ে নিতে। এতে ঐ পিশাচগুলোর কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
ঐ মৃতবৎ বাড়িটিতে যাবার আগে প্রথমে গেলাম জেরিনদের বাড়িতে। সেখানে এখনো কান্না চলছে। আভাকে দেখে জারিনের মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আভা তার পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। আমি বললাম, “আপনি চিন্তা করিয়েন না। জারিনকে আমরা ফিরিয়ে আনবই..” বড় জোর দিয়ে বললাম আমি। আমার কথা শুনে জারিনের মায়ের চোখ চকচক করে উঠল।
“আমার ছেলেরা তাকে সব জায়াগায় খুঁজেছে, কিন্তু কোথাও পায়নি। তাহলে তোমরা তাকে খুঁজবে কোথায়?”
“আপনার অতকিছু ভাবতে হবে না। শুধু ধরে রাখেন আপনার মেয়ে আপনার কাছে ফিরে আসবে।”
.
আমাদেরকে দাদু হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলেন। আমাদের ডিসিশনে তিনিও খুশি। তবে একটু সাবধানতার অবলম্বন করতে বলেছেন। কথা বলতে বলতে ঐ ড্যথ্লি হাউজের সামনে পৌঁছে গেলাম। এরপর বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়ল, বাড়িটার দরজার সামনে একটা মৃত মানুষ পড়ে আছে। তার দাঁত-নখ অনেক সূক্ষ্ম। নিজ হাতেই তার আত্মাকে আমি আল্লাহরর কাছে পৌঁছে দিয়েছি।
“সবাই প্রস্তুত তো?” সবার উদ্দেশ্যে বললাম আমি।
সবাই আমার কথায় সাড়া দিল। দরজা খুলে সবার প্রথমে আমি ঢুকলাম। এরপর একে একে সবাই ঢুকল। বাড়ির ভেতরে সব কিছুই ওলটপালট, ভাঙাচুরা। ঠিক করা হল চারজন চার জায়াগায় গিয়ে জারিনকে খুঁজব।
পুরো বাড়িটা অনেক শান্ত। বুকের ধকধক পর্যন্ত শুনতে পারছি আমি। শিকারি শিকারের জন্যে আড়ালে বসে আছে। সুযোগ পেলেই তারা শিকারের উপর হামলা করবে। কোনখানেই জারিনকে পেলাম না। তাকে তো এই বাড়িতেই নিয়ে আসা হয়েছিল। তাহলে কোথায় রাখা হয়েছে তাকে? ফ্লোরে একটা ব্যাসলেট চোখে পড়ল আমার। সবাইকে ডাক দিলাম আমি।
“এই ব্যাসলেটটা কার জানো?”
“কার?” বলল আভা
“এটা হল জারিনের। এটা আমি জারিনের হাতে দেখেছিলাম। তানভীর, আমাকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দাও তো।”
তানভীর ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে আমাকে দিল। ব্যাসলেটটা যেখানে পেয়েছিলাম, সেখান থেকে অনুসন্ধান শুরু করলাম। এই স্থানের পর থেকে কাউকে ছেঁচরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাগ পেলাম। এটা আমি ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছাড়াও দেখতে পারছি। দাগটা অনুসরণ করতে করতে তা এক পর্যায়ে শেষ হয়ে যায়।
“ঈশান, এখন কি করবে?” বলল তানভীর
“এক কাজ করা যায়, দাগটা যেখানে গিয়ে থেমেছে সেখান থেকেই কাজ শুরু করা হোক।” বলল মাহফুজ।
“মানে?”
মাহফুজ তার বেকপ্যাক থেকে একটা হাতুড়ি বের করল এবং তা দিয়ে ফ্লোরে মারতে লাগল। কাঠের ফ্লোর হওয়ায়, তা ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখলাম, ভেতরে অনেক অন্ধকার।
আভা বলল, “আমরা এখন এর নিচে যাব?”
“হুম। সবাই যার যার টর্চলাইট হাত নাও”
সবার প্রথমে তানভীর গেলো ফ্লোরের নিচে। এরপর একে একে মাহফুজ, আভা। আমি গেলাম সবার শেষে। নিচে যেতেই আশেপাশের পরিবেশ পুরো বদলে গেলো। চলে এলাম নতুন এক জগতে।
উপরে তাকালাম। উপরে মস্ত বড় আকাশ। তবে আমরা তো ঐ বাড়ির ফ্লোর দিয়ে উপর থেকে নিচে এসেছি। বাড়ির নিচে আরেকটা জগৎ!
সামনে, ডানে, বামে ঘন সবুজ গাছপালা। আর পেছনে বড় একটা খাদ।
“এই আমরা কোথায় চলে এসেছি?” আতংকের সাথে বলল মাহফুজ।
“এটা মনে হয় এনিমিজম ধর্মের উপাসকদের জগৎ। আর জেরিনকে নিশ্চয় এখানে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।”
“হুম, তবে এখানে তাকে খুঁজতে অত সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।” গম্ভীর স্বরে বলল আভা।
“হুম, এটা আমাদের সামনে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ।”
এবার আমরা সবাই হাঁটা শুরু করলাম। চারিদিকে পিন পতনের নীরবতা। আমাদের প্রতিটি ফুট স্টেপে সৃষ্টি হওয়া শব্দ প্রতিনিয়ত শিহরিত করে তুলছে। কোনদিকে যেতে হবে তা জানা নেই।
হঠাৎ আভার চিৎকার শুনিতে পেলাম। আশেপাশে সে নেই। এতক্ষন সে আমাদের সাথেই তো ছিল। মূহুর্তেই কোথায় মিলিয়ে গেলো সে?
আমি তার নাম নিয়ে একবার চিৎকার করতেই একটা অর্থবোধক বাক্য কানে আসল, “আমাকে বাঁচাও, আমি একটা জালের ভেতর আটকিয়ে গিয়েছি।”
উপরে তাকিয়ে দেখলাম, সে বড় একটা গাছের সাথে বাঁধানো বড় একটা ফাঁদের ভেতর আটকিয়ে গিয়েছে। সেখানের ভেতর তাকে দেখেই বড় হাস্যকর লাগছে।
“এখন তাকে কিভাবে নামানো যায়?” বলল তানভীর।
“আমি থাকতে ভয় কিসের? আমি তাল গাছে পর্যন্ত উঠেছি, এই গাছটাতো কিছুই না” বড়ই উৎফুল্লের সাথে বলল মাহফুজ।
“আরে, তাড়াতাড়ি কিছু কর না তোমরা” বড়ই অসহায়ত্ব কন্ঠে বলল আভা। হঠাৎ পেছনের ঝোপঝাড় থেকে শব্দ এলো। পেছনে তাকালাম। কিছুই নেই। আবার শব্দটা হল। ঠিক তখনই সেখান থেকে একটা দুই হাত-পায়ের উপর ভর দেয়া একজন মানুষ বেরিয়ে আসল। তার চোখ দুটো টকটকে লাল। দেখেই তাকে বড়ই ক্ষুধার্ত লাগছে। সে বড়রকমের একটা গর্জন দিল। মানুষও যে এরকম গর্জন করতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। তখনই দুই পাশ থেকে আরো দুটো পশু থুক্কু পশানুষ বেরিয়ে এলো।
“এই পশানুষগুলো তো দেখি আমাদের মানুষের মতই এডভান্স। তারাও এরকম ফাঁদ বেঁধে শিকার করে এরপর দলবল নিয়ে আসে।” বললাম আমি
তানভীর বলল, “পশানুষ কি আবার?”
“পশু আর মানুষকে একত্রে করলে হয় পশানুষ।”
ততক্ষনে তিন পশানুষ আমাদের সামনে চলে এলো এবং আমাদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল। হঠাৎ তাদের মধ্যে একজন তানভীরের উপর লাফ দিল। তানভীর সাথে সাথে পড়ে গেল। সে পিশানুষটার সাথে যুদ্ধ করছে। তাকে আমিও কিছু করতে পারছি না। কারণ আমার সামনে আরেকটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডানে গেলে সে ডানে তাকায়, বামে গেলে বামে। তীক্ষ্ম দুই চোখের চাহনি। আমি আমার পকেটে হাত রাখলাম। মূহুর্তেই সে আমার উপর লাফ দিল। তার ধাক্কায় আমিও পড়ে গেলাম। কিন্তু সে আমার কিছু করতে পারেনি। কারণ আমি ততক্ষণে তার পেটে আমার ড্যাগার ঢুকিয়ে দিয়েছি। তার নিথর দেহ আমার শরীরের উপর। চোখ দুটো খোলা। পাশে দেখলাম তানভীর এখনো ঐটার সাথে যুদ্ধ করছে। আমি উঠে একটা লম্বা ডাল হাতে নিলাম। এরপর দেহের সর্বশক্তি দিয়ে মারলাম ঐ শালার পিশাচটার মাথায়। সাথে সাথে পিশাচটা উঠে দাঁড়ালো, আবার গিয়ে পড়ল তানভীরের উপর। ফইন্নি মাহফুজ এতক্ষন গাছের মগডালে বসে বাংলা সিনেমা দেখছিল। সে বলল, “আভা আর কথা বলছে না। সে মনে হয় এখানেই বেহুঁশ হয়ে গেছে।”
আমি বললাম, “আগে তাকে নিচে নামিয়ে আনো, এরপর এর ব্যবস্থা করা হবে।
.
আলো কমে এসেছে। এই জগতেও আমাদের জগতের মত সকাল-সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে এই জঙ্গলে হাঁটলে বিপদ হতে পারে। এই জঙ্গলে চলতে হলে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।
একটা খালি আর উঁচু জায়গা দেখে সেখানে ক্যাম্প করলাম। গাছের ডাল, বড় পাতা ইত্যাদি নিয়ে একটা বড়সড়, চার জন থাকা যায় মত একটা ছোটখাটো ঘর করলাম। রাত হতে হতেই তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। এই জগতের সব নিয়মধারা আমাদেত জগতের মত। নিজেকে বেয়ার গ্রিলস্ এর মত লাগছে। ক্যাম্পের সামনে আগুন জ্বালালাম। এতে মানব পশু থেকে নিরাপদে থাকা যাবে। পশুরা যদি আগুনকে ভয় পায়, তাহলে তারা পাবেনা কেনো?
বাতাসে আগুনের শিখা দুলছে। সবাই ঘুমুচ্ছে। আমাকে আগুনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে জারিনকে কোথায় পাওয়া যাবে আর এখানে কতদিনই বা থাকতে হবে..
কাকের ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। এতদিন শালিকের ডাকে ঘুম ভাঙতো। প্রবেশ পথের দিকে মুখ করে শোয়ার কারণে কাকটিকে সেখানেই দেখতে পেলাম। কুচকুচে কালো রঙের কাক। আমাদের দেশের কাকের মত মনে হচ্ছে না। আওয়াজ শুনে দাঁড়কাকও মনে হচ্ছে না। শোয়া থেকে উঠতেই এটি উড়ে চলে গেলো। রাতের প্রবল বাতাসে ঘরটা মনে কাত হয়ে গেছে। বের হলাম ছোট কুড়েঁঘর থেকে। একটা লম্বা নিশ্বাস নিলাম। এখানে যেদিকে চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। তবে পানির উৎস কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পকেট থেকে আমার নোকিয়া এগারশ মোবাইলটা বের করলাম। গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বলে দেশের সব জায়গায় থাকে। তবে এই জায়গায় এসে ব্যাপারটা আমি পুরো মিথ্যে করে দিলাম। এখানে এখনো গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক পৌঁছায়নি।
.
“ঈশান, আমরা জারিনকে খুঁজতে কোথায় যাব? এরকম উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটলে তো পরের জনমেও মনে হয় তাকে খুঁজে পাব না” ক্লান্তি স্বরে বলল মাহফুজ।
আমি বললাম, “ঐ যে পাহাড়টা দেখছো?”
আমি সবাইকে দূরে একটা পাহাড় দেখিয়ে দিলাম। পাহাড়টার চূড়ায় সাদা মেঘ জমে আছে ।
“হুম, দেখা তো যাচ্ছে”
“জারিনকে সেখানে খুঁজে পাবার সম্ভাবনা আছে”
“কিভাবে?” বলল আভা। তার মুখমন্ডলে পরিষ্কার একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দেখতে পারছি।
“পাহাড়টার মাঝ বরাবর থেকে একটা ক্ষীণ ধোয়া বের হচ্ছে। দেখতে পারছো?”
চোখ জোড়াকে সরু করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল পাহাড়টার দিকে। এরপর সবাই সাড়া দিল।
“এটাই হচ্ছে একটা ক্লু। এই ধোয়াটা আমি গতকালও দেখেছি। এটা কোন আগুনের সৃষ্ট ধোয়া হলে এতক্ষনে থাকত না। আর এনিমিজম ধর্মাবলী লোকগুলো পশুর মত আচরণ করলেও মানুষের বুদ্ধিমত্তা এদের লোপ যায়নি। এটা নিশ্চই তাদের সৃষ্ট কোন কাজ।”
“তো এসবের দ্বারা কি বোঝায়? জারিনকে তারা সেখানে রেখেছে এবং ধোয়া উড়িয়ে তার উপর এক্সপেরিমেন্ট করছে?” বলল মাহফুজ
“এরকম হতেও পারে আবার নাও হতে পারে”
“তারা জারিনকে নিয়েছে বলি দেবার জন্যে। এরকম এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে তো না” এবার মুখ খুলল তানভীর।
” আরে, আমি অতকিছু জানি নাহ। শুধু এটাই জানি, তাকে সেখানেই পাওয়া যাবে। এরপর সম্ভাবনা ৯৯%”
“বাকি এক পারসেন্ট?”
“তা দিয়ে মুড়ি খাও।”
একসাথে হাঁটতে লাগলাম আমরা। চোখ-কান সজাগ। যেকোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে। পদে পদে বিপদ। হাতে ঊনত্রিশ দিনের মত সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে জারিনকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা এমন গভীর একটা জঙ্গলের ভেতর চলে আসলাম। দিনের বেলায়ও এখানে অন্ধকার। আমরা যার যার টর্চ জ্বালালাম। ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসার মত অবস্থা। হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করলাম। পেছনে কাউকে দেখতে পেলাম না। কেবল আমার কাঁধে একটা মোটা লতানো ডাল দেখতে পেলাম। সঙ্গীদের সাথে আবার পথ ধরলাম। হঠাৎ আভার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। টর্চের আলোতে তাকে দেখতে পেলাম না। শুধু তার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমরা সবাই একসাথে তাকে ডাকতে লাগলাম। তার আওয়াজ আর পাওয়া যাচ্ছে না।
“কিরে, আভা কোথায় গেলো?” বলল তানভীর
বড়ই টেনশন হচ্ছে। আমি ঘেমে পুরোই একাকার। কিসে যেনো আমার পা প্যাচিয়ে গেলো। আমি সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলাম। হাত থেকে টর্চটিও পড়ে যায়। তানভীর আর মাহফুজ আমাকে ধরার জন্যে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। আমাকে পেছনে দ্রুত গতিতে নিয়ে যাও হচ্ছে। একসময় তারা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। শুধু তাদের একটা আর্তনাদ শুনতে পাই।
আমি একটা গাছে সাথে বাঁধা অবস্থায়য় আছি। প্রথমে ভেবেছিলাম আমি কোন পিশানুষের অর্থাৎ মানুষরূপি পশুদের ফাঁদে পড়েছি। না, এটা গাছের কাজ। এই অন্ধকার জঙ্গলে সব গাছই ভৌতিক। আমার পা দুটো গাছের সাথে শক্ত করে বাঁধা। নড়তে পারছি না। চারপাশে অন্ধকার। পিঠের দিকটাই স্যাঁতস্যাঁতে অনুভব করছি। আমার সামনে থাকা একটা গাছ থেকে একটা ডাল আমার সামনে আসে। তার অগ্রভাগটা একদম সরু। আমার বাম হাতে তার ডালিটা কিছুক্ষন স্পর্শ করিয়ে লাগল। সে কি করতে চায় কে জানে।
হঠাৎ মনে হল কেউ আমার বা হাতের বাহুতে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছি আমি। বাঁধা পায়ের জন্যে নড়তেও পারছি না। ডালটা আমার শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে গাছের কান্ডে, মূলরোমে আরো যেখানে পাঠানোর কথা সেখানে হয়ত পাঠাচ্ছে। আমি পকেট থেকে আমার লাইটার বের করলাম। লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালালাম। ঠিক তখনই আমার বা হাত থেকে ডালটা বেরিয়ে গেল। আমি লাইটারটা তার আরো কাছে নিয়ে গেলাম। ডালটা আরো দূরে সরে যাচ্ছে। এবার পেলাম তাদের উইকপয়েন্ট। সূর্যালোকে তারা থাকতে পারেনা বলে এমন অন্ধকার আলোহীক জায়গায় জন্ম নিয়েছে তারা। তাদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলাম আমি। এখন অন্যান্যদের খুঁজতে হবে। কিছুদূর এগোতেই তানভীর আর মাহফুজকে দেখতে পেলাম। কিন্তু তাদের সাথে এখনো রক্ত চোষাচোষির খেলা শুরু হয়নি। একইভাবে তাদের ছাঁড়িয়ে নিলাম।
.
অনেক্ষন ধরে আভাকে খুঁজছি, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার শরীরের রক্ত তারা সাবার করে ফেলেনি তো? ঐদিকে ঝোপের প্রচন্ড নাড়াচাড়া দেখতে পেলাম। আমরা তিনজন গেলাম সেখানে। দেখলাম আভা গাছ একটার সাথে বাঁধা অবস্থায় থাকলেও সে তার দুইহাত দিয়ে গাছগুলো সাথে যুদ্ধ করছে। তার হাতে একটা ধারালো একটা ড্যাগার। তার পায়ের সাথে অনেকগুলো কেটে যাওয়া ডালপালা দেখতে পেলাম।
.
.
কয়েকঘন্টা হেঁটে কিছুক্ষন বসলাম। বেকপ্যাক থেকে পানি বের করে একটি পান করলাম। বেশি পান করলে পানির সংকটে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
আশেপাশে ঘন গাছপালা থাকার সত্তেও অনেক গরম এখানে। শুধুই রাতেই ঠান্ডা থাকে। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য মামা হাসছে। আবার হাঁটা করলাম। কিছু পথ অতিক্রম করবার পর দেখলাম সামনে কেউ স্বাভাবিক মানুষের মত বসে আছে। আরেকটু সামনে যেতেই দেখলাম, এটা জারিন! সে আমাদের দিকে তাকালো কোণা চোখে…
আভা তার সামনে গিয়ে বলল, “কিরে, আমি জারিনকে স্পর্শ করতে পারছি না কেনো?”
“কি বল?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল তানভীর।
জারিন এখনো আমাদের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে আছে। আমিও তাকে স্পর্শ করতে পারছি না। মাহফুজ তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তার মানে জারিনকে তারা শেষ করে দিয়েছে!! যার ফলে সে এখন আত্মা…..”
বুঝলাম সে ভয় পেয়েছে। আমি বললাম, “আরে এটা কোন আত্মা-ফাত্মা না। এটা একটা হলোগ্রাম।”
“কিভাবে বুঝলে?” বলল মাহফুজ।
“আমি অনেক আত্মার সাথে ঘোরাফেরা করেছি। তাই আমার যথেষ্ট ধারণা আছে আত্মা কাকে বলে..”
এই বলে হলোগ্রামটার দিকে একটা ঘুষি মারলাম। আমার হাত জারিনের মুখ ভেদ করে চলে গেলো। তানভীর বলল, “তাহলে এর মানে কি? আমাদের সামনে জারিনের হলোগ্রাম দাঁড় করানোর কারণটা কি?”
আমি বললাম, “মনে হচ্ছে, এইসব এনিমিজম বিশ্বাসীদের একজন নেতা বা রাজা এই জাতীয় কিছু আছে। সে হয়ত বুঝে গিয়েছে যে আমরা তাকে এখানে খুঁজতে এসেছি। তাই..”
কথাটা শেষ করবার আগেই আমার মাথার উপর ভারি কি একটা পড়ল। আমি পড়ে গেলাম। আভা সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠল। খেয়াল করে দেখলাম, আমার উপর ঐ একটা মানবপশু। সে আমার হাত কামড়ে ধরলেও তেমন ব্যাথা অনুভব করছি না আমি। কারণ আমি ওভারকোট পড়েছি। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে তাকে নিচে নিয়ে তার উপর আমি উঠলাম। কিন্তু ফইন্নিটার কামড়ানো এখনো শেষ হয়নি। আমি তার মুখে জোড়ে একটা ঘুষি মারলাম। আমার হাত সে ছেড়ে দিল। কিন্তু সে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। এবার সে মানুষের মত আচরণ করল। সে তার দুই হাত দিয়ে আমার গলা চেপে ধরল। প্রচন্ড জোড় তার হাতে। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত আমি মেইন জায়গায় একটা ঘুষি মারলাম। আঘাতটা সহ্য করতে না পেরে সে সেখানে হাত দিয়ে নিচে পড়ে গেলো।
.
ঘড়িতে দেখলাম বিকাল সাড়ে চারটা। পাহাড়টা আমাদের থেকে এখনো অনেক দূরে। সেখান থেকে এখনো ক্ষীণ ধোয়া বের হচ্ছে। সেখানে যেতে হলে সামনে আরো কঠিন থেকে কঠিনতর বাঁধা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।
“আজ এখানেই থামি? আর হাঁটতে পারছি না।” ক্লান্তি স্বরে বলল আভা।
আসলে অনেক ক্লান্ত লাগছে। সারা শরীর ব্যাথা করছে।
ঐ পাহাড়টার দিকে যেতে হলে আমাদের এখন একটা জলরাশি অতিক্রম করতে হবে। সামনে একটা জলরাশি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাতেও নিশ্চিত মরণ-মৃত্যুর ফাঁদ বিছানো আছে।
.
রাত বাড়ার সাথে তাপমাত্রা কমতে লাগল। এই জগতে রাত অতিক্রান্ত রাত, অতিক্রান্ত তাপমাত্রার ব্যস্তানুপাতিক।
আজ তানভীরকে আগুনের দেখা-শোনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগুন থাকলে আমরা থাকব। আগুন যদি বাস্তব জগতে পশুদের দূরে রাখে, তাহলে এই মানব পশুদেরকে রাখবে না এর কোন মানে হয়?
আমার পাশে মাহফুজ শুয়ে আছে। আর আভা শুয়ে আছে আমাদের থেকে ৫-৬ হাত দূরে।
মনে হল কেউ আমাকে ডাকছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম। কিছুই শুনতে পেলাম না। অডিটোরি হ্যালুসিনেশন ভেবে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। তার আগে তানভীরকে একবার ডাক দিয়ে সিওর হয়ে নিলাম যে সে আগুনের খেয়াল রাখছে। চোখ বন্ধ করতেই আবার শুনলাম, “ঈশান, ঈশান বাবা…”
কন্ঠটা বড়ই পরিচিত মনে হল। মনে করতে পারছি না, কন্ঠটা কার। আবার শুনলাম, “বাবা একটু বাইরে আসো, কথা আছে।”
আমি শোয়া থেকে উঠে মিনি সাইজের কুঁড়েঘর থেকে বের হলাম। আমাকে দেখে তানভীর বলল, “কিরে, কোথায় যাচ্ছো? বাথরুম ধরেছে নাকি?”
এই বলে সে হাসতে লাগল। সামনে দেখলাম একটা বুড়ো লোক। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী। তাঁকে চিন্তে আমার মোটেও কষ্ট হলি না। মাহমুদ দাদু। তার আত্মাকে মুক্তি দেবার জন্যে ভালোই এডভেঞ্চার করতে হল ঐ বান্দরবানের কাঠের ঘরে (“কাঠের ঘর” গল্প দ্রষ্টব্য)। এতে কাঠের ঘরটাও অভিশাপমুক্ত হয়েছে।
“কিরে দাদু, আপনি এখানে?”
“হুম, তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি ভালো, আপনি?”
“আত্মার আবার ভালো থাকা না থাকা কি?”
“আপনি হঠাৎ এখানে কেনো?”
“তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। তোমাদের বন্ধুকে বাঁচাতে হলে তোমাদের অনেক অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করতে হবে।”
“হুম, তা তো দেখা যাচ্ছে।”
“সামনে মানবপশুগুলো আরো অনেক ভয়ানক রূপ ধারণ করবে। তোমরা যদি প্রস্তুতি না দিয়ে সেইসব পথে যাও, তাহলে তোমাদের মৃত্যুও হতে পারে।”
“তারা কি বুঝে গিয়েছে যে আমরা জারিনকে বাঁচাতে আসছি?”
“হুম, তারা সেই প্রথম থেকে বুঝে গিয়েছে। আর তাদের রাজাটাও অনেক…. ”
“আমরা এখন কি করতে পারি? আমরা খালি হাতে তাদের সাথে কিভাবে যুদ্ধ করব?”
“ঐ যে ঐদিকে একটা প্রাসাদ দেখছো?”
কয়েক মিটার দূরে একটা বড় প্রাসাদ দেখতে পেলাম। এটাকে তো দিনের বেলায় খেয়াল করিনি। এখন আসল কেমনে?
“ঐখানের ভেতর একটা ডায়মন্ড আছে। রেড ডায়মন্ড। এর তেজসক্রিয় রশ্মি এমন যে, তা ঐসব মানবপশুরা সহ্য করতে পারে না।”
“তাহলে কালকে সেখানে গিয়ে ডায়মন্ডটা নিয়ে আসব।”
“এই কাজটা অতটা সহজ নয়।”
“কেনো?”
“তুমি গেলে বুঝতে পারবে। আর এই প্রাসাদটা দিনের বেলায় দৃশ্যমান থাকে না। তাই ডায়মন্ড নেয়ার কাজ রাতের বেলায়ই করতে হবে। তবে তুমি যদি দিনের আলো ফুটবার আগেই যদি ঘর থেকে বেরিয়ে না আসতে পারো, তাহলে তুমি আর কখনো এর ভেতর থেকে বের হতে পারবে না।”
প্রাসাদটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। সেখানে প্রতিটা কক্ষে বাতি জ্বলছে.
সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে গতরাতের সব ঘটনা খুলে বললাম। গতরাতের প্রাসাদটা এখন এখানে নেই। মাহমুদ দাদু বলেছেন এটাকে শুধু রাতের বেলায়ই দেখা যায়।
“তাহলে আজ রাতে আমরা সেই প্রাসাদে গিয়ে ঐ রেড ডাইমন্ডটা নিয়ে আসব।” বলল তানভীর
আমি বললাম, “আমরা না, শুধু আমিই যাব।”
আমার কথা শুনে সবাই একে অপরের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। এরপর তানবভীর বলল, “তবে, সেখানে একা একা যাওয়াটা তো অনেক বিপদজনক!”
“সেই জন্যেই তো বলছি আমি একা যাই সেখানে। আমরা সবাই যদি সেই প্রাসাদটাতে একসাথে যাই, তাহলে আমাদের একসাথে সবারই ক্ষতি হতে পারে। আমাদের একসাথে যদি কোন কিছু হয়, তাহলে জারিনকে বাঁচানোর মত কেউ থাকবে না।”
আভা বিচলিত হয়ে বলল, “এইসব কি বলছো তুমি? তোমার কিছু হয়ে গেলে?”
“শুধু আমার কিছু হলে কোন কিছু যায় আসে না। আমার পর তোমরা তিনজন আছো জারিনকে বাঁচাতে।”
.
ঐ জলরাশিটার সামনে গেলাম। নীল আকাশের প্রতিফলনের কারণে পানি নীল হয়ে আছে। এপার থেকে ওপার যাওয়ার জন্যে কোন মাধ্যম নেই। তেমন বাতাস নেই। তবুও পানিতে তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে। সেখান থেকে প্রাসাদটা গতরাতে যেখানে ছিল, সেখানে গেলাম। পুরোই ফাঁকা। এখানে যে একটা প্রাসাদ ছিল এটা কাউকে বললে কেউ বিশ্বাসও করবে না। প্রাসাদের কোন চিহ্ন পর্যন্তই নেই। প্রাসাদটা আসলে আসে কোথা থেকে বা আসে কিভাবে??
.
ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা একবার দেখে নিলাম। আর ড্যাগারটা সাথে তো আছেই।
আকাশে অর্ধচাঁদ দেখা যাচ্ছে। হাতে ২৫-২৬ দিনের মত আছে সময়। এরপর পূর্ণিমা। এরপর জারিনের বলি! কিযে নিষ্ঠুর এই মানবপশুগুলো। বলি দেয়ার মাধ্যমে যে তাদের আয়ুষ্কাল বাড়বে, তারা সে চিন্তাও করল কেমন করে?
দূর থেকে আমি তাদেরকে অর্থাৎ তানভীর, আভা এবং মাহফুজকে প্রাসাদটা দেখিয়ে দিলাম। প্রাসাদটা আলোয় জলজল করছে। তাদের বিপদের কথা মাথায় রেখে তাদেরকে প্রাসাদের সামনে যেতে দিইনি।
“দোয়া করিও, যাতে ঐ রেড ডায়মন্ড নিয়ে ফিরে আসতে পারি। যদি দেখো আকাশে দিনের আলো, আমি প্রাসাদ থেকে এখনো বের হয়নি, তাহলে তোমরা আমার আশা ছেড়ে…”
“কি বল এইসব তুমি? তোমার কারণেই তো আজ আমরা এতটুকুতে পৌঁছতে পেরেছি। আর তোমার কিছু হলে….” মাহফুজ আমাকে জড়িয়ে ধরল। তার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্তনা দিলাম। এরপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রাসাদটার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
.
প্রাসাদটার দরজার সামনে পৌঁছতেই আমার প্রচন্ড শীত অনুভূত হল। আমি কাঁপছি। এর মানে নিশ্চই আমার ভয় লাগছে। তবে ভয় কেনো লাগছে? এরকম কাজ তো আমি অনেকবার করেছি।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। অনেক বড় ঘর। ভেতরে আলোতে ঝলমল করছে। আসবাব পত্র সব গুছানো। দেখে লাগছে এখানে লোকজন থাকে এবং প্রাসাদটিকে অনেক যত্ন করে। তবে আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করেই আমার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। এখন সেই নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। আমি বাড়ির প্রাসাদটির ভেতর হাঁটতে লাগলাম। ডায়মন্ডটা কোথায় থাকতে পারে? সিংহাসনের উপর একটা মুকুয় দেখতে পেলাম। আলোয় তা চকচক করছে। মনে হল আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আমি গরম নিশ্বাস অনুভব করতে পারছি। পেছনে ফিরে দেখলাম কেউ নেই।
আমি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। সিড়ির দেয়ালে অনেকগুলো ছবি। তেল রঙের ছবি। প্রতিটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন রাজা ঐ মুকুট মাথায় সিংহাসনে বসে আছে। ডায়মন্ডটা কোথায় থাকতে পারে এর কোন ক্লু পাচ্ছি না আমি। পেছন থেকে আমাকে কে যেনো টোকা দিয়ে ডাকল। পেছনে ফিরে দেখলাম একজন যুবক, ধ্যুতি-পাঞ্জাবী পড়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু ভয় পেলাম। সে আমাকে ভদ্রস্বরে বলল, “আপনি এখানে কি করছেন? একটু পর সভা শুরু হবে, রাজা আসবেন। আপনি আপনার জায়গায় গিয়ে বসেন।”
সে বলে কি? আমি নিচে তাকিয়ে দেখলাম পুরো রাজপ্রাসাদে অনেকগুলো লোক দেখা যাচ্ছে। তারা সবাই বসে আছে। সিংহাসনের সামনে রাখা ৫-৬ টা চেয়ারে কতগুলো লোক বসে আছে। মাঝখানে একটা চেয়ার খালি। লোকগুলোর মাথায় পাগড়ি। ঐ যুবক লোকটা বলেছে আমাকে আমার জায়গায় গিয়ে বসতে। তার মানে আমার নির্দিষ্ট একটা সিট আছে। ঐ খালি চেয়ারটাই বোধ হয় আমার জায়গা। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে নিচে যেতে লাগলাম। এতক্ষনে আমি খেয়াল করলাম, আমারও পরনে পাগড়ি আর ধ্যুতি। এসব কবে এলো আমার শরীরে?
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে ঐ খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। কিচ্ছুক্ষণ পর একজন জোড়ে রাজকীয় সূরে বাঁশি বাজালো। এটা মনে হয় রাজা আসবার সংকেত। দেখছি সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তাদের দেখাদেখি করে আমিও দাঁড়ালাম। লাল শেরওয়ানী পড়া, মাথায় পাগড়ি দেয়া, মুখে ভরা সাদা গোফ নিয়ে একজন লোক তার সিংহাসনে বসল। তার সাথে সাথে আমরাও বসে গেলাম। এরপর তিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে বললেন, “আমার স্ত্রীর খুনীর শাস্তির দিন চলে এসেছে আজ।” সবাই আবার আমর দিকে তাকালো।
“কিছুক্ষনের মধ্যে তার ফাঁসি সংঘটিত হবে।” হাত দিয়ে কাকে জানি ইশারা করে বলল, “যাও, তোমরা তাকে ধরে কারাগারে নিয়ে যাও। আর আমি যখন বলব, তখনই ফাঁসি হবে।”
দুটো লোক, তাদেরও পরনে ধ্যুতি। আমি অধীর আগ্রহের সাথে চেয়ে থাকলাম কাকে নিয়ে যাচ্ছে তারা? কে সেই হতভাগা?
হঠাৎ লোক দুটো আমার আমার দুহাত ধরল। আমাকে বসা থেকে উঠিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগল…
আমাকে এক জেলে বন্দি করে রাখল। জেলখানাটার এক কোণায় দুটো কঙ্কাল পড়ে আছে। যে দুজন আমাকে ধরে নিয়ে এসেছিল, তারা জেলের সামনে দাঁড়য়ে পাহারা দিচ্ছে। এইসব কি হচ্ছে এখানে? আমাকে কেনোই বা অপরাধী বলে গণ্য করা হল?
আমি চিৎকার করে বললাম, “আমাকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে কেনো? আমি তো আপনাদের রাজার স্ত্রী-পূত্রকে হত্যা করিনি।”
বামে থাকা লোকটা আমার দিকে ফিরল। তাকে দেখেই আমি চমকে উঠলাম। তার চোখ দুটো টকটকে লাল। মুখ দুটো পুরোই সাদা। তার শরীরে যেন একফোটাও রক্ত নেই। কড়া গলায় বলল, “একই প্রশ্ন কতক্ষণ ধরে করছো? রাজা মশাই তোমাকে কত বিশ্বাস করে তাঁর নিজস্ব গোয়েন্দা বানিয়েছেন, আর তুমিই তার সাথে বিশ্বাস ঘতকতা করেছো।”
দেখলাম রাগের চোটে কাঁপছে। ঠিক সেই সময়ই আসলেন রাজা মশাই। তার চোখ দুটিও রক্তাক্ত লাল। পুরো শরীরটাই সাদা। জেলের দরজা খুলে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। সাথে সাথে আমাকে এক ধাক্কা মেরে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারলেন। এরপর আমার গলা চেপে ধরলেন। তার হাত ছিল বরফের মত ঠান্ডা। আর অশুরের মত শক্তি তার গায়ে। আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল।
“তুই কি এখনো স্বীকার করবি না যে তুই আমার স্ত্রী-পূত্রকে হত্যা করেছিস?”
আমি থেমে থেমে বললাম, “আমি তো এই প্রাসাদে এই প্রথম এসেছি। আর আমি কেনো আপনার স্ত্রী-পূত্রকে হত্যা করতে যাব?”
সে আমার গলা ছেড়ে দিল। এরপর বলল, “গত এক সপ্তাহ ধরে সে একই কথা বলছে। আজ ভোর হবার আগেই তাকে আমি ফাঁসির দঁড়িতে দেখতে চাই।”
আরে শালাটা বলে কি? আমাকে নাকি ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলাবে। আমি শালাটাকে অর্থাৎ রাজা মশাইকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম। এরপর জেল থেকে বেরিয়ে এক দৌড় মারলাম। কোনদিকে যাচ্ছি তা আমার খেয়ালে নেই। পেছনে দুইজনের জায়গায় এখন ছয়জন হই হই করে আসছে। বড় একটা দেয়ালের পেছনে গিয়ে লুকালাম আমি। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অন্য জায়গায় চলে গেলো তারা। ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টার মত। হাতে মাত্র কয়েকঘন্টার মত সময় আছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে ঐ রেড ডায়মন্ডটা খুঁজে বের করতেই হবে। এখন যদি এই অবস্থায় বাইরে যাই, তাহলে আবার তাদের হাতে ধরা পড়ব। কি করা যায় এই নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। দেয়ালের এক কোণায়একটা পাঞ্জাবী আরেকটা ধ্যুতি পেলাম। আমি সাথে সাথে পাঞ্জাবীটা পড়ে নিলাম। আর ধ্যুতিটাকে মাথায় এবং মুখে এমনভাবে পেঁচালাম যে, কেউ আমাকে চিনতেই পারবে না।
.
পুরো প্রাসাদে হই চই লেগে গেলো। সবাই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। খুনি নাকি পালিয়ে গিয়েছে। তাদের সাথে সাথে আমিও একই কান্ড করতে লাগলাম। তবে আমার লক্ষ্য রেড ডায়মন্ড।
প্রাসাদের উপর-নিচে, আসবাবপত্রের ভেতরে বাইরে এমনকি দেয়ালে টোকা মেরে, ঘুষি মেরে ডায়মন্ডের খোঁজ লাগালাম। তবে কোথাও পেলাম না। হঠাৎ লোক একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। তখনই আমার মাথা থেকে ধ্যুতিটা পড়ে গেল। যার সাথে ধাক্কা খেলাম সে আমার দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপরই “এই তো খুঁজে পেয়েছি” বলে চেঁচাতে লাগল। আমি উঠে দিলাম এক ভো দৌঁড়। সামনে কে আছে, কি করছে কিছুই দেখছি না।
আমার মাথায় হঠাৎ রাজার পাগরীটার কথা মাথায় এলো। সেখানেই তো সেই রেড ডায়মন্ডটা। পাগড়িটা প্রথম যখন দেখি, তখনই চোখে পড়ল চকচক করা লাল একটা বস্তু। এটাই ডায়মন্ড।
ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে তিনটার মত। হাতে আর বেশি সময় ননেই। এখন বাথরুম একটাতে লুকিয়ে আছি। আমার চারপাশে বড় বড় কয়েকটা মাকড়শা ঝুলে আছে। যা করার সরাসরি করতে হবে। বাথরুমের দরজা খুলতেই যখনই দৌঁড় মারতে যাব, তখনই মাথায় প্রচন্ড একটা আঘাত পেলাম যেন শক্ত কিছু একটা দিয়ে কেউ আমার মাথায় মেরেছে। পেছনে তাকাতে পারলাম না। মুখ থুবরে পড়ে গেলাম।
.
জ্ঞান ফিরতেই দেখি একটা খোলা জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক সেইরকম না, আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। পেছন থেকে কেউ আমাকে ধরে রেখেছে। সামনে গোল করে বাঁধা দড়ি ঝুলছে। পাশে রাজা মশায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখেই পেছনে ধরে থাকা লোকটা আমাকে ছেড়ে দিল। সেই সুযোগে আমি রাজার মশায়ের মাথা থেকে পাগড়িটা নিয়ে আবার এক দৌঁড় দিলাম। পেছনে সবাই একসাথে দৌঁড়াচ্ছে আমার পেছনে। ঘড়িতে দেখলাম পাঁচটা বাজার জন্যে ৫ মিনিটের মত বাকি। আমার হাতে রেড ডায়মন্ড ওয়ালা পাগরী। প্রাসাদটা এতই বড় যে মূল ফটকে এখনো পৌঁছাতে পারতেছি না।
প্রাসাদের হঠাৎ জোড়ে বাতাস বইতে লাগল। একে একে সব বাতি বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। ঘড়িতে দেখলাম এক মিনিটও নেই। ফটক আমার সামনে থেকে তেমন দূরে নয়।
প্রাসাদের মূল ফটকটা নিচে থেকে গায়াব হয়ে যেতে লাগল। পুরো প্রাসাদ এখন অন্ধকার। পেছনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু ভয়ংকর সব গর্জন শোনা যাচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণ পর দরজার নকবলটাও গায়াব হয়ে যাবে। আমি গতি বাড়ালাম। সাথে সাথেই টান মেরে দরজাটা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। হাত থেকে পাগড়িটা পড়ে ঐদিকে পড়ে গিয়েছে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম প্রাসাদটা নেই। আকাশে আবছা আলো দেখা যাচ্ছে।
.
আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছেই দেখি তানভীর আর আভা গম্ভীরভাবে বসে আছে। তবে মাহফুজকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভাবত ভেতরে রেস্ট নিচ্ছে। আমাকে দেখেই তাদের মুখে হাসি ফুটল। আমার হাতে রেড ডায়মন্ড। তেমন বড় না। তা পাগরীটা থেকে খুলে নিয়েছি আমি। আমাকে দেখে তারা দুজনেই জড়িয়ে ধরল।
-মাহফুজ কোথায়?
কেউ কোন কথা বলে না।
– কিরে, বল
তার দুজনেই আমাকে সামনের জলরাশিটার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল।
তাদের হাতের ইশারানুযায়ী জলশায়ের দিকে তাকালাম। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি বললাম, “তোমরা কি বলতে চাচ্ছো?”
আভা তার মুখ নিচু করে বলল, “তুমি আসার কিছুক্ষণ আগে মাহফুজ কি যেন ভেবে ঐ জলায়শয়ের সামনে গিয়েছিল। হঠাৎ তাকে জলায়শয়ের ভেতর থেকে কে যেন তাকে ধিরে পানির ভেতরে নিয়ে যায়। আমরা শুধু এতটুকুই দেখেছি।”
এবার তানভীর বলে, “সাথে সাথেই আমি যায় জলাশয়ের সামনে, কিন্তু ততক্ষণে তাকে পানির ভেতর নিয়ে যায়।”
তাদের কথা শুনে আমি জলাশয়ের দিকে দৌড়ে গেলাম। জলাশয়ের পানি পুরোই স্থির। একটা বিপদ শেষ হতে আরেকটা বিপদ। তাকে কারা পানির ভেতর নিয়ে গিয়েছে সেই সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে। এখন তাকে কিভাবে বাঁচানো যায় এটাই চিন্তা। বেশি দেরিও করা যাবে না।
আমার কাঁধে হঠাৎ কেউ হাত রাখায় আমি চমকে পেছনে ফিরি। তানভীর বলল, “তাকে বাঁচানোটা অত কঠিন বলে আমার মনে হয়না।”
“কিভাবে?”
“তুমি ডায়মন্ডটা তো পেয়েই গেছো।”
এতক্ষণে ডায়মন্ডটার কথা মাথায় এলো আমার। ডায়মন্ডটা আমি এখনো ডান হাতে ধরে আছি। শিল পাথরের সমান ডায়মন্ডটা। সূর্যের আলোতে তা চকচক করছে। মাহমুদ দাদু বলেছেন ডায়মন্ডটা হাতে থাকলে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আমিবার কিছু না বলে সাথে সাথেই জলাশয়ের পানিতে লাফ দিলাম।
.
ভেতরে পুরোই সবুজ। চোখের সামনে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারই দেখা যাচ্ছে। শ্বাস আর ধরে রাখতে পারছি না। পানির থেকে মুখ বের করে বেশ কিছুক্ষণ শ্বাস নিলাম। এরপর বড় একটা শ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিলাম। এবার একটু গভীরে গেলাম আমি। ভাগ্যক্রমে সেখানে মাহফুজকেও দেখতে পেলাম। তবে সে অনেকগুলো লতা-পাতা দ্বারা প্যাচানো। দেখে মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান। আমি পকেট থেকে ড্যাগার বের করলাম এবং লতাগুলো কাটতে লাগলাম। হঠাৎ আমার পা ধরে নিচের দিকে টান অনুভব করলাম। নিচের দিকে তাকিয়্র দেখলাম একটা মানুষ, পেছনে কুমিরের মিত কাটা, সে আমার পা ধরে টেনে নিচের দিকে মিয়ে যেতে লাগল। তাদের শক্তি সাধারণ মানুষের মত নয়। এক এক দুই-তিনটা এসে আমার পা ধরে টানতে লাগল। তারা আমাকে টানতে টানতে মাহফুজ থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে এসেছে আমাকে। আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। এদিকে আমি আর শ্বাস আটকিয়ে রাখতে পারছিনা। ঐ পিশানুষগুলোর সাথেও আর লড়তে পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত পকেটে রাখা ডায়মন্ডটিতে হাত রাখলাম। তারা আমার কাছ থেকে ছিটকে গেলো, যেন তারা শক খেয়েছে। আমাকে আবার ধরতে চাইলেও আর পারছে না। শেষ পর্যন্ত তারা চলে যায়। আমি ড্যাগার দিয়ে লতাগুলো কেটে মাহফুজকে ছাড়িয়ে পানির উপরে উঠলাম।
.
মাহফুজ ক্যাম্পের ভেতর রেস্ট নিচ্ছে। ত্র জ্ঞান ফিরলেও শারীরিক শক্তি হারিয়েছে। ততক্ষণে আমি, আভা আর তানভীর মিলে একটা ছোট-খাটো ভেলা বানিয়ে নিলাম। মাহফুজ ঠিক সময়ে ক্যাম্প থেকে বের হয়েছে। সে এখন সুস্থ বোধ করছে।
ভেলাটা জলাশয়ে ভাসিয়ে দিলাম। হুম, ভালোই ভাসছে। জলাশয়ের এপার থেকে ওপার যেতে কোন অসুবিধাই হয়নি।
.
ঘড়িতে দেখলাম বিকাল চারটা। আমাদের লক্ষ্য ঐ পাহাড়টা। বিভিন্ন কথা বলতে বলতে, মজা করতে হাঁটাতে লাগলাম আমরা। চারপাশে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ মনে হল আমাদের সামনে দিয়ে কেউ তাড়াতাড়ি দৌঁড়ে গেল।
“কি ছিল এটা?” বলল আভা
“এত না ভেবে জলদি পা চালাও।”
আমরা দ্রত পা চালাতে লাগলাম। হঠাৎ আভার চিৎকার পেলাম আমি। পেছনে তাকাতেই মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেলাম। শক্ত কিছু দিয়ে কেউ মেরেছে আমার মাথায়। এরপরই শুনতে পেলাম মাহফুজের চিৎকার। আমার পাশে তানভীর থাকায় আমি তার হাত ধরে ফেলি এবং আমি আমার পকেটে ডায়মন্ডটা ধরে রাখি। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছিনা আর। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তানভীর আমাকে পাশ থেকে ডাকতে লাগল। ঐদিকে আভা আর মাহফুজের চিৎকার দূরে মিলিয়ে গেলো।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমার পাশে তানভীর হাতে পানির ফ্লাস্ক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মুখে নিশ্চয়ই পানির ছিটানো হয়েছে। দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
“তানভীর, আভা আর মাহফুজকে তারা কোথায় নিয়ে গেছে?”
“তাদেরকে টেনে-হিঁচরে নিয়ে যেতে যেতে ঐদিকে চলে যায়।”
তার হাতের ইশারানুযায়ী দেখলাম, তাদেরকেকে আমরা যে পথ ধরে হাঁটছিলাম অর্থাৎ পাহাড়ের পথটার দিকে। তাদেরকেও ঐ পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছে। আজ আশেপাশে অন্ধকার। আজকের আকাশের চাঁদটা গতরাত থেকে একটু ছোট। কয়েকদিন পর মনে হয় আমাবস্যা। এই জগৎটাতে আমরা এসেছি চার নিয়ে। আর এখন আছি শুধু দুইজন। এই মিশনটা গেমের লেভেলের মত। সামনে যতই যাব, লেভেল ততই বাড়বে অর্থাৎ পথ ততই দূর্গম হবে।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা রওনা দিলাম। তানভীরকে বললাম আমার সাথে সাথে হাঁটতে। পাহাড়টা দূরত্ব এখনো সমানই মনে হচ্ছে। সেখানে পৌঁছতে আরো কয়দিন লাগবে আল্লাহই জানেন। আজ আকাশে মেঘ জমেছে। মনে হয় বৃষ্টি হবে। আমি তানভীরকে বললাম, “আমরা এই পথে যদি পাহাড়টার দিকে যেতে থাকি, তাহলে পরের জনমেও পৌঁছব না আমরা।”
“তাহলে কি করা যায়?”
“আমাদেরকে সরণের পথ ধরে হাঁটতে হবে।”
“মানে?”
“মানে পাহাড়টার দিকে এমন প্যাঁচানো রাস্তায় না গিয়ে সরাসরি জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যাব। এতে করে আমরা পাহাড়টাতে পূর্ণিমার আগে পৌঁছে যাব।”
“জঙ্গলের রাস্তায় তো পদে পদে বিপদ।”
“দোস্ত, নো রিস্ক, নো গেইন।”
.
বৃষ্টি পড়ছে। জঙ্গলে ঘন ঝোপ-ঝাড় থাকার সত্তেও আমরা ভিজে একাকার। আজ যেভাবে ভিজেছি, নিশ্চিত যে নিউমনিয়ায় আক্রান্ত হব আমি। সামনে কিছু পিশানুষের দল দেখা যাচ্ছে। দলবদ্ধ হয়ে আছে তারা। তারা মনে হয় আমাদের ঘ্রাণ পাচ্ছে। এনিমিজমের ধর্ম যেহেতু চর্চা করেছে, সেহেতু পশুদের মত ক্ষমতা থাকবে তাদের। তারা আমাদের দিকে প্রথমে আস্তে আস্তে এরপর চার হাতপায়ে দৌঁড়ে আসছে। আমরাও দৌঁড়াচ্ছি প্রাণের ভয়ে। তারা আমাদের প্রায় কাছে চলে এসেছে। আমি আমার ওভারকোটটা খুলে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। তারা তা শুকতে লাগল। সেই সুযোগে হাতে যতটুকু সময় পেলাম, আমি আর তানভীর দৌঁড়ে এসে নিরাপদ স্থানে চলে এলাম। এমন বুদ্ধির জন্যে ধন্যবাদ জানায় বেয়ার গ্রিলসকে..
.
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। ঘড়িতে দেখি বিকাল পাঁচটা। পাহাড়টাকে লক্ষ্য রেখে আমরা হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ তানভীর কাঁপা কন্ঠে বলল, “ঈশান, উপরে তাকিয়ে দেখো।”
“কেনো, কি হয়েছে?”
সে উপরে তাকিয়ে আছে। আমিও তাকালাম। দেখলাম, প্রতিটা গাছের ডালে কঙ্কাল ঝুলানো। মনে হচ্ছে তাদেরকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কঙ্কালের গায়ের রঙ দেখে লাগছে অনেকদিন ধরে ঝুলে আছে এখানে। প্রতিটা গাছের সাথে একটা একটা কঙ্কাল। আমর সামনে দিকে এগোতে লাগলাম। আমাদের চলার পথে সামনে পড়ল একটা পুরাতন ঝুরঝুরে কুড়েঁঘর। আমি বললাম, “যাক, শেষ পর্যন্ত আশ্রয়ের জন্যে একটা জায়গা পেলাম।”
“ভেতরে কোন বিপদ হবে না তো?”
“আরেহ, আমার ডায়মন্ড আছে না?”
.
ভেতরে মেঝেটা ভালো করে পরিষ্কার করে ডাল-পাতা দিয়ে একটা সুন্দর বিছানা করলাম। তানভীর ঘুমিয়ে পড়লেও আমার ঘুম আসছে না। আন্তাজ করতে পারছি রাত একটা-দেড়টার মত হবে। কেনো জানি মনে হচ্ছে, এখানে আমরা ছাড়া আরো একজন আছে। বড়ই আস্থির লাগছে আমার। হঠাৎ একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম…
আমি উঠে বসলাম। এরপর তানভীরকে ঝাঁকাতে লাগলাম উঠবার জন্যে।
“কিরে, কি হয়েছে?”
“কারো কান্নার আওয়াজ শুনতে পারছো?”
তানভীর তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে বসল। সে কাঁপা গলায় বলল, “কিরে, শব্দটা আসছে কোথা থেকে?”
“ঐখান থেকে।”
তাকে আমি দরজার দিকে ইশারা করে দেখালাম। সেখানে একটা মেয়ে হাঁটুতে তার মাথা লুকিয়ে কাঁদছে। অন্ধকারেও তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি বললাম, “কে আপনি?”
সে এখনো কাঁদছে। আমি উঠলাম তার কাছে যাওয়ার জন্যে। সাথে সাথে তানভীর আমার হাত ধরে ফেলে।
“কিরে, তুমি ওর কাছে যাচ্ছো নাকি?”
আমি হাত ছাঁড়িয়ে ঐটার সামনে গেলাম। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কে?”
এবার সে তার মুখ তুলল। তার চেহারা দেখেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। এমন সুন্দর চেহারার চেহারার মেয়ে আমি কখনো দেখিনি। মায়া হরিণের মত দুচোখ। সে আমার সামনে উঠে দাঁড়ালো। তার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। চুল ঘন কালো, তার কোমর পর্যন্ত। তা দেখে আমার মুখে নিজের অজান্তেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার কয়েকটা লাইন চলে এলো-
“চুল তার
কবেকার
অন্ধকার বিধিশার নেশা”
সে হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। পেছন থেকে তানভীর বলল, “এসবের মানে কি ছিল?”
“এই মেয়েটার মৃত্যু নিশ্চয়ই স্বাভাবিকভাবে হয়নি। যার ফলে তার আত্মা মুক্তি পায়নি। তবে এর পেছনের রহস্যটা কি?”
“এটার রহস্য বের করতে গিয়ে পূর্ণিমা ভরা চাঁদ চলে আসবে আকাশে। তখন সেই চাঁদের আলোতে জারিনকে বলি দেয়া দেখিও।”
“এমনটা বলিও না। আসলে রহস্য আমায় চুম্বকের মত টানে…”
.
আমাদের কারোর ফ্লাস্কে পানি নেই। পানি ছাড়া বেশিদিন থাকা যাবেনা। এখন শুধু জারিনকে না, আভা এবং মাহফুজকে বাঁচাতে হবে। এখন সবচেয়ে বেশি ভয় লাগছে তাদের দুইজনকে নিয়ে। এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেনো তাদেরকে ঐ মানবপশুগুলো ডিনার বা লাঞ্চ হিসেবে না করে..
“ঈশান, সামনে কতগুলো মানুষ দেখতে পারছি” একসময় বলল তানভীর।
তার কথানুযায়ী সামনে তাকালাম। যাদেরকে দেখলাম তাদেরকে মানুষই মনে হচ্ছে। তারা চারপায়ে হাঁটছে না। সাধারণ মানুষের মত আচরণ করছে। তানভীর বলল, “সাধারণ মানুষ হলে তারা এখানে কি করছে?”
আমি বললাম, “তা তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞাস করি?”
আমরা তাদেরকে এইখান থেকেই ডাক দিলাম। আমাদেরকে দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করছিল। এরপর তারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসল।
তারাও আমাদের মত তাদের এক সঙ্গীকে খুঁজতে এসেছে। যাকে খুঁজতে এসেছে, তাকেও নাকি ঐ মানবুশুগুলো নিয়ে গিয়েছে।
.
নতুনদের মধ্যে মোট চারজনের মত ছিল। তাদেরকে আমার কেমন জানি সন্দেহ লাগছে। তানভীর তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। তারা কেমন জানি হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যাচ্ছে। আমি হাঁটা থামিয়ে দিলাম। আমাকে দেখে সবাই থেমে গেলো।
“কিরে, কি হয়েছে? থেমে গেছো কেনো? কিছুক্ষন পড়ে সন্ধ্যা হয়ে আসবে।”
আমি নতুনদের মধ্যে একজনের সামনে গেলাম। তার মুখের সামনে আমার ডান হাত উঠিয়ে নাড়াতে লাগলাম। সে আমার হাতের সাথে সাথে তার মুখটাও এদিক-ওদিক নাড়াচ্ছে। একসময় সে আমার হাত কামড়ানোর চেষ্টা করে। আমি সাথে আমার হাতটা সরিয়ে নিই। আমার ধারণাই ঠিক। “তানভীর, চল ভাগো..” বলে আমি এক দৌঁড় দিলাম। আমাকে দেখে তানভীরও দৌঁড় দিল। সে বলল, “কিরে, দৌঁড়াচ্ছ কেনো?”
“পেছনে দেখো।”
পেছনে তারাও দৌঁড়ে আসছে। কিন্তু চার হাত-পায়ে।
.
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নিরাপদ স্থানে এসে পৌঁছলাম। পেছনে তাদেরকে আর দেখা যাচ্ছে না। বুঝলাম তারা পুরোই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে আমাদেরকে ধরার জন্যে।
পাহাড়টাকে এখন আগে থেকে একটু কাছে লাগছে। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে পাঁচটা। এখানেই আজকের মত যাত্রা শেষ করে দিতে পারতাম। তবে সামনে একটা টানেলের মত গর্ত চোখে পড়ে। ভেতরে অন্ধকার। তাছাড়া আশেপাশে আর পথ নেই শুধু ফিরে যাওয়া ছাড়া। ভেতরে পুরোই অন্ধকার। টর্চও জ্বালানো যাচ্ছে না। চার্জ শেষ। এখন একমাত্র সম্বল রেড ডায়মন্ডটা। তানভীরকে বললাম আমাকে ধরে রাখতে। আর আমি রেড ডায়মন্ডটা ধরে রাখব।
একসাথে গর্তের ভেতর হাঁটতে লাগলাম। সেখানে খাঁটি মাটির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তানভীর হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিল এবং হোঁচট খাওয়ার মত একটা শব্দ পেলাম। আমি তার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম।
“ঈশান ঈশান, আমাকে বাঁচাও, আমি মাটির ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। আশেপাশে পুরোই অন্ধকার। আসার সময় মশাল জ্বালিয়ে আনলে ভালো হত। আমি পকেট থেকে ডায়মন্ডটা বের করতেই চারিদিকে লাল আভা বিচ্ছুরিত হল। আশেপাশে এখন প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবে আমরা একটা কবরস্থানের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। আর তানভীর একটা কবর ভেতর পড়ে গিয়েছে আর সে আস্তে আস্তে এর ভেতর ঢুকে যাচ্ছে যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে আমার হাতে কেউ শক্ত কিছু দিয়ে সজোড়ে আঘাত করল। এতে আমার হাত থেকে ডায়মন্ডটা পড়ে যায়। চারপাশ আবার অন্ধকার হয়ে গেলো। তানভীরের ক্রন্দন ধ্বনি আরো বেড়ে গেলো “ঈশান, আমাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বাঁচাও…”
আশেপাশে অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাঁধে জোড়ে আঘাত অনুভব করলাম। কেউ আমাকে পেছন থেকে মারছে। তানভীরকে আদ্র ধরে রাখতে পারছি না। ডায়মন্ডটাও কোথায় আছে কে জানে। হঠাৎ একটা সাদা আলোকরশ্মি এলো এবং আমার চারপাশে ঘুরতে লাগল। কিছুক্ষন পর আলোকরশ্মিটা আমার সামনে এসে স্থির হল। আস্তে আস্তে তা মানুষের দেহের রূপ ধারণ করল। এটা আর কেউ নয়, মাহমুদ দাদু। তিননি জ্বলজ্বল করছেন। তার পাশে তানভীরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি আমার হাতে রেড ডায়মন্ডটা ধরিয়ে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। ধন্যবাদটুকু বলার সুযোগও পেলাম না। ডায়মন্ডের লাল আলো মাটিতে ফেলতেই দেখলাম, একটা প্রাণি, দেখতে মানুষের মত, মাটিতে পড়ে আছে। গায়ে ছেড়া কাপড়। আর পাশে লম্বা একটা গাছের ডাল।
.
গতরাতে একটুও ঘুমাইনি আমরা। মাটির এপার থেকে ওপার আসতে পুরো রাতই কেটে গেছে। আমরা পাহাড়টার প্রায় কাছে চলে এসেছি। সেখানে পৌঁছতে আর ৩-৪ দিনের মত লাগবে। এর চেয়ে বেশিও লাগতে পারে।
আমি আর তানভীর একটা গাছের নিচে বসলাম। পানির বড় তৃষ্ণা পেয়েছে। তবে আমাদের ফ্লাস্কও খালি। তার উপর ভুকও লেগেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই।
আমি আর তানভীর আবার চলা শুরু করলাম। সামনে হঠাৎ কোথা থেকে একটা বিশাল শরীরের মানবপশু চলে এলো। সে আমাদের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি সাথে সাথে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ডায়মন্ডটা চেপে ধরলাম এবং আরেক হাত দিয়ে তানভীরের একটা হাত ধরলাম। ঐ মানবপশুটা আমার দিকে না, চোখের দৃষ্টি তানভীরের দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ তানভীর তার হাত দিয়ে এক ঝাঁকাতে আমার হাতটা তার থেকে ছাঁড়িয়ে নিল। এরপর একটা ঘুষি মারল আমার মুখে।
“কিরে তানভীর, কি করছো এটা?”
আমি তাকে শক্ত করে ধরে আছে। সে এতেই আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এরপর পাশ থেকে একটা ডাল নিয়ে আমার মাথায় সজোড়ে একটা আঘাত করল। তখন আমার মাথায় ঐ মানব পশুটার বলা একটা কথার লাইন ঘুরপাক খাচ্ছিল, “সে এখন আমার বশে। আমি যা চাইব, তাই করবে সে এখন”।
.
তীব্র আমার চোখ খুলতে একটু কষ্ট হল। মাথাটা ব্যাথা করছে। শোয়া থেকে উঠে দেখলাম আমি একটা বড় রুমে। চেয়ার-টেবিল, লাইট-এসি সব আছে। আমি দরজা খুলে রুমটা থেকে বের হলাম। ঘরটা অনেক বড়। আশেপাশে বড় বড় সব মেশিন। পকেটে হাত ঢুকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। পকেটে ডায়মন্ডটা নেই।
আশেপাশে কেউ নেই। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগলাম আমি। সামনে দেখলাম একজন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। এটা সেই মানবপশুটা, যে তানভীরকে হিপনোটাইজ করেছে। আমি তার কাছে গেলাম।
“ঐ জানোয়ার, আমার বন্ধু তানভীর কোথায়? আর আমাদেরকে এখানে কেনো এনেছিস?”
“আমার কন্ট্রোল হাউজে স্বাগতম”
“কন্ট্রোল হাউজ” নামটা শুনে কেমন জানি লাগল আমার।
“যেটা জিজ্ঞাসা করেছি, সেটার উত্তর দে।”
“এখানে তোমাদেরকে
এনিমিজম ধর্মের চর্চা করানো হবে। আর তোমার মত বুদ্ধি-সাহসীওয়ালা লোকই খুঁজছিকাম।”
সে হো হো কিরে হেসে উঠল।
তার কথা শুনে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। এরপর মারলাম ঘুষি তার মুখের দিকে। তবে আমার হাত তার মুখের অপর পাশে বেড়িয়ে গেলো।
“কিরে, কি বুঝলে?”
“তুমিও একটা হলোগ্রাম…”
“হুম। এখন জমবে খেলা।”
আমি নিজেকে সামলে বললাম, “তানভীর কোথায়?”
আমাকে ইশারা করে পেছনে তাকাতে বলল। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, তানভীর ফিটফাট দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় একটা সবুজ রঙের লোহার টুপি। আমি তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু সে নড়ছে না। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে ঝাঁকালাম। তানভীর আমাকে তার থেকে ছাঁড়িয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আমি মানবপশুটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুই এর কি করেছিস?”
“তুমি এর মাথায় সবুজ রঙের যে টুপিটা দেখিছো, তা হল ব্রেইন কন্ট্রোলার। তার মানে একমাত্র আমিই তাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারব।”
হলোগ্রামের একটা সিদ্ধান্তে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। তার অ্যান্টারটেইমেন্টের জন্যে নাকি আমার আর তানভীরের মধ্যে লড়াই লাগতে হবে। রেগে তার পেটে একটা কিক মারলাম। তবে ব্যর্থ। হলোগ্রাম হওয়ায়, তাকে মারা তো দূরের কথা স্পর্শ পর্যন্ত যায় না করা।
তানভীরের দেহে এখন অনেক বল। তাকে দূর থেকে এসে ধাক্কা মারলেও সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার কাছে এখন ডায়মন্ডটা নেই। ঐ শালাটা ডায়মন্ডটা নিয়ে কোথায় রেখেছে কে জানে?
ডায়মন্ডটা নিশ্চয়ই তানভীর সরিয়েছে আমার পকেট থেকে ঐ ফইন্নিটার নির্দেশে। তানভীরের এক ঘুষিতে আমি পড়ে গেলাম। মুখ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। তাকে আমি আগের কথাগুলো বলে স্মৃতি ফেরানোর চেষ্টা করছি। কোম লাভই হচ্ছে না। আমি মাটিতে পড়ে আছি দেখে সে কিছু করছে না। হয়ত সে আমার উঠার অপেক্ষা করছে। একটা বিষয় আমার মাথায় এলো। আমি এই মানবপশুটাকে স্পর্শ করতে পারি না, কারণ তা হল হলোগ্রাম। হলোগ্রামটা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তার একমাত্র অস্ত্র হল হিপনোটাইজিং।
এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম। তানভীরও আমার দিকে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। আমার থেকে ৬-৭ হাত বায়ে ঐ অধমটা পায়ের উপর পা তুলে আমাদের বাংলা সিনেমার মারপিট দেখছে। আমার ড্যাগারটা ভাগ্যিস সে নেয়নি। আমি পকেট থেকে ড্যাগারটা বের করে সজোড়ে তানভীরের মাথার দিকে তাক করে ছুঁড়ে মারলাম। আমার ড্যাগারের ঢাক্কায় তানভীরের মাথা থেকে সবুজ লোহার টুপিটা পেছনে পড়ে গেল। সাথে সাথেই তানভীরের হুঁশ ফিরে এলো। সে আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। আমি তাকে বাঁধা দিলাম।
“এইসব কি হচ্ছে, এটা তো খেলার অংশ নয়”
এরপর সে তার ডান হাতটা তানভীরের দিকে তাক করল। হঠাৎ তানভীর আমার গলা চেপে ধরল সজোড়ে। আমি সাথে সাথে তার চোখে হাত দিয়ে দিলাম যাতে সে বিশেষ করে এই গরুটাকে দেখতে না পারে। তানভীর আমার গলা ছেড়ে দিল। “তানভীর, তুমি তোমার চোখ বন্ধ রাখ এবং যতক্ষন পর্যন্ত বলব না, ততক্ষন চোখ খুলবে না। সে আমার কথায় সায় দিল। হঠাৎ আমাদের সামনে দিয়ে একটা লাল রশ্মি গেল। দেখলাম, হলোগ্রামটার হাতে লেজারগান। শালার ফইন্নিটার কাছে দেখি সব আধুনিক অস্ত্র। তবে একটা জিনিস রেখে আমার মন ভালো হয়ে গেলো। হলোগ্রামটার পাশের টেবিলে আমার রেড ডায়মন্ড। সেটা চকচক করছে। আমি তার দিকে একটা ছুটে গেলাম। হলোগ্রামটা আমাকে লক্ষ্য করে লেজার গান থেকে লেজার ছুঁড়ছে। সবই ব্যর্থ লক্ষ্য। আমি টেবিলটার কাছে পৌঁছতেই ডায়মন্ডটা। তা আমি হলোগ্রামটার সামনে তাক করলাম। সেখান থেকে লাল একটা তীব্র আলোকরশ্মি এসে হলোগ্রামটার উপর পড়ল। এতে তার কিছু না হলেও তার হাতে থাকা লেজারগানটা পুড়ে ছায় হয়ে গেল। ঐদিক থেকে তানভীর বলল, “ঈশান, চোখ খুলব এখন? আর বন্ধ রাখতে পারছি না”
“চোখের পাতা দুই হাত দিয়ে চেপে রাখো।”
হলোগ্রামটা আমার সামনে এসে আমার মুখের দিকে একটা ঘুষি মারতে চাইল। তবে হাতটা আমার মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে গেল। সে আমাকে স্পর্শ করতে পারছে না। সে তার পাশে থাকা মেশিনের একটা বাটনে চাপ দিল। এরপর বলল, এখন দেখি কিভাবে পালাতে পারো..”
সারা ঘরের বাতি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। আমি তানভীরের হাত ধরে দৌঁড়াতে লাগলাম।
“আমি চোখ খুলব? দৌঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে”
আমি তার কথার কোন উত্তর দিলাম না। সারা ঘর হঠাৎ কাঁপতে শুরু করল। উপরের ছাদ ভেঙে নিচে পড়ছে। সামনে বেরুনোর খোলা দরজা দেখা যাচ্ছে। সেটাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে পুরো ঘরটায়ই ভেঙে যাচ্ছে। পেছনে হলোগ্রামটার অট্টহাসি শোনা যাচ্ছে। দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। তবে তানভীর আঃ বলে একটা চিৎকার দিল। দেখলাম তার পা দরজার সাথে আটিকিয়ে গিয়েছে। খেয়াল করলাম, এটা একটা কয়েকশ তলার উঁচু দালান। এটা ভেঙে পড়লে আমাদের উপরই পড়বে। আমি।তানভীরকে টানতে লাগলাম। হঠাৎ দেয়াল ভাঙতে শুরু করল। এতে একটা সুবিধা হল দেয়াল ভেঙে যাওয়ারে দরজার ধারটাও আলাদা হয়ে গেল। যার ফলে তানভীরের পাও বের করতে পারি। এরপর দৌঁড় দিই আমরা। হঠাৎ ধুমমম!!!!
দালানটা পড়ে গেল। তবে আমরা নিরাপদ স্থানে চলে আসতে পারি।
আকাশের চাঁদটা আজ প্রায়ই অদৃশ্য। আমরা পাহাড়টার প্রায় কাছে চলে এসেছি। হয়ত আগামীকালই পাহাড়টাতে পৌঁছে যাব। আমরা হাঁটতে লাগলাম বিশ্রাম নেয়া যায় সেরকম কোন এক জায়গার। গত রাত তো ঘুমাতে পারিনি তার ওপর আজকে যা অবস্থা। হঠাৎ শেয়ালের ডাকের মত একটা ডাক শুনলাম। মানুষ শেয়ালের ডাককে নকল করলে যেরকম আওয়াজ হয়, ঠিক সেই রকমই। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, সংখ্যাই ১০-১২ টার মত চার হাত-পায়ে দাঁড়ানো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমি পকেট থেকে ডায়মন্ডটা বের করে তাদের দিক তাক করলাম। কিছুই হল না। আমি এতে অবাক হলাম। কয়েকবার ঝাঁকালাম।
“কিরে ঈশান, এর চার্জ শেষ নাকি?”
” হয়ত”
আমি আর তানভীর দিলাম একটা দৌঁড়। পেছনে তারাও আসছে। তার যখন আমাদের কাছাকাছি চলে আসে আমি ভাবলাম, এই আমরা শেষ। তবে, তারা আর কাছে আসে না। সেইখান থেকেই দৌঁড়ে চলে যায়।
“এইসবের মানে কি? আমাদের এতক্ষন তাড়িয়ে নিজেরাই চলে গেলো। ”
তানভীর কাঁপা গলায় বলল, “পেছনে তাকিয়ে দেখো, এরপর কারণটা বুঝবে”
আমি পেছনে তাকালাম, দেখেই আমি নিজেই সাদা হয়ে গেলাম…
এটা ছিল একটা স্বাস্থ্যবান মানবপশু। তার এক থাপ্পরে আমাদের মুখের হাড় গুড়ো হয়ে যাবে। আমাদের দিকে সে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। সে আমাদের দিকে এগোচ্ছে, আর আমরা পিছুচ্ছি। এক সময় পেছনের দিকে বাঁধা অনুভব করলাম। দেখলাম পেছনে বড় একটা গাছ। সে আমাদের দিকে এগোচ্ছে আর তার ডান হাতটা আমাদের দিকে এগোচ্ছে। এতক্ষন পর একটা জিনিস আমি খেয়াল করলাম। এইটার গায়ে কোন কাপড় নেই। এবার তার উইকপইন্টটা দেখতে পেলাম। আমি মাটি থেকে একটা বড় থেকে পাথর নিলাম। সে আমাদের সামনে আসতেই পাথরটা তার খোলা মানচিত্রের দিকে জোড়ে ছুড়ে মারলাম। সাথে সে এক চিৎকার দিল। সেই চিৎকারে পুরো মাটি কেঁপে উঠলো। এরপর সে সেখানে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
.
আজ মন ভরে ঘুমিয়ে নিলাম। আর কিচ্ছুক্ষণ হাঁটলেই পাহাড়টাতে পৌঁছে যাব। তানভীর হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “ঈশান,এদিকে কি দেখো?”
আমি গেলাম সেখানে। দেখেই মন ভালো হয়ে গেলো। একটা বিশাল জলরাশি। আমাদের ক্যাম্প থেকে কয়েকহাত দূরে মাত্র। আমি সেখানে দৌঁড়ে গিয়ে পানি দিয়ে মুখ ধুলাম। দেখলাম তানভীর তার কাপড়-প্যান্ট খুলে (আন্ডারওয়্যার বাদে) জলরাশিটিতে লাফ দিল। অনেকদিন পর পানি মুখে দিলাম আমি। মিষ্টি পানি।
.
পাহাড়ের কাছে পৌঁছতে পাঁচ মিনিটের মত লাগল মাত্র। সেখানে দেখলাম, আমিরা যে রাস্ত দিয়ে পাহাড়টায় উঠব, সেখানে দুজোন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। গার্ড বলার কারণ তাদের হাব-ভাব দেখে এমনই মনে হচ্ছে। দুজোনের হাতেই লম্বা তীক্ষ্ম বর্শা। তাদের সামনে এখন এভাবে গেলে তেমন সুবিধার হবে না। তাই আমি তানভীরকে বললাম, দুইজন দুইদিক থেকে অ্যাটাক করব। সে আমার কথা মত পকেট থেকে তার ড্যাগার বের করল। আমারটা হাতেই নিলাম। আমি ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে একজন গার্ডের পাশে এলাম। আমার থেকে সে তেমন দূরে না। তানভীর আরেকটা গার্ডের পাশে। প্ল্যান ছিল তাদের সামনে গিয়ে মুখ চেপে ধরে গলা কেটে দেয়া যাতে চিৎকার করতে না পারে। যে ভাবা সেই কাজ। আমি আমার লক্ষে্্যর সামনে যেতেই তার মুখ চেপে ধরলাম এবং সাথে সাথে তার গলায় আমার ড্যাগারটা চালিয়ে দিলাম। তানভীরও তাই করল। নিথর দেহ পড়ে গেল মাটিতে।
পাহাড়ের নিচ থেকে ধোয়াটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে একটা বড় একটা ল্যাবটরির মত দেখতে পেলাম। আর সেখানের উপর থেকেই ধোয়াটা বের হচ্ছে। আমি আর তানভীর অতি সতর্কতার সাথে গেলাম সেখানে। উঁকি মারতেই দেখি ভেতরে অনেকগুলো গার্ড। তাদের গায়ে আবার ইউনিফর্মও আছে। ভেতরে অনেকরকমের মেশিন। কয়েকজন সেখানে কম্পিউটারে কিসব যেন করছে। কয়েকজন টেস্ট টিউব নিয়ে কাজ করছে। তাদের হাব-ভাব দেখে সাধারণ মানুষ মনে হলেও মুখ বিশেষ করে দাঁত গুলো অনেক ভয়ানক। আমি আর তানভীর আড়ালে ল্যাবটরির দিকে ঢুকলাম। বড় দুইটা ড্রামের পেছনে আমরা লুকালাম। তাদের ভাষাও আবার আরেকরকম। বোঝা যাচ্ছে না। আভা, মাহফুজ আর জারিনকে তারা কোথায় রেখেছে কে জানে। প্রথমে আভা আর মাহফুজকে খুঁজতে হবে। এইখান থেকে কিভাবে এগোবো বুঝতে পারছি না। তানভীর তখন বলল, “কাজটা আমার উপরে ছেড়ে দাও।”
সে তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট বাক্স বের করল। কাগজের বাক্স। বাক্সটা খুলতেই দেখলাম অনেকগুলো চকলেট বাজি এতে।
“কিরে, এইসব কোথা থেকে পেয়েছো?”
“আসলে জারিনের জন্মদিনের দিন কিনছিলাম। ভাবলাম সেইদিন রাতে ফুটাব।”
এরপর সে তার পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করল। একটা বাজিতে আগুন ধরিয়ে সাথে সাথে সামনে দূরে ছুড়ে মারল সে। কিছুক্ষন পর ধাম! করে ফুটলো এটি। কি হয়েছে দেখার জন্যে সবাই যখন ব্যস্ত ছিল, তখন আমরা পাশের একটা রুমে চলে যাই। রুমটাও অনেক বড়। সেখানেও অনেক মেশিন আর এই জাতীয় জিনিস। তবে সেখানে দেখলাম, আভা আর মাহফুজ একটা চিকন লোহার চেয়ারে অজ্ঞান অবস্থায় বসে আছে। তাদের দুজনেরই মাথায় একটা টুপির মত আর সেখান থেকে কতগুলো তার পাশে একটা মেশিনের সাথে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। মেশিনটাও একটা কম্পিউটারের মত। আসলে তাদের উদ্দেশ্যটা কি? আমি ভেবেছিলাম আভা আর মাহফুজকে লাঞ্চ বা ডিনার হিসেবে করার জন্যে তারা নিয়ে গিয়েছে। তবে এখানে দেখছি, তাদের উপর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। আমি সামনে গিয়ে আভা আর মাহফুজের মাথা থেকে টুপিটা সরালাম। তখনই পেছন থেকে একজন কর্কশ কন্ঠে বলল, “এই, তোমরা কারা?”
পেছনে ফিরে দেখলাম তাদের দলেরই একজন, সাদা রঙের এপ্রোন পড়া, চোখে প্রোটেকশন গ্লাস। আর তার মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। আবার বলল, “তোমরক কারা, আর কি করছো এখানে?”
আমি বললাম, “স্লামালিকুম দাদু, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
“আমার জন্যে মানে?”
” হুম, আপনার মত এমন প্রতিভাবান সায়েন্সটিস্টদেরই খুঁজছিলাম আমি।” পাম্প দেয়ার চেষ্টা করলাম আমি। তার বুক গর্বে ফুলে উঠল। আমি বললাম, “আসুন না, বসে বসে কথা বলি..”
আমার কথায় সে সম্মতি জানালো। এমন বোকা মানুষ অর্থাৎ পিশানুষ যে থাকবে তা জানতাম নাহ। আমি অজ্ঞান মাহফুজকে তার চেয়ার থেকে উঠিয়ে দিলাম। সায়েন্টিস্টটাটা বলল, “কিরে, কি করছো এসব?”
“না, তেমন কিছু না। আপনার মত প্রতিভাবান লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, দেখতে কেমন লাগে….”
সে আর কিছু না বলে চেয়ারটাতে বসে গেলো। আমার পাম্পে সে যথেষ্ট ফুলেছে। এবার ফুটানোর সময়। আমি চেয়ারটার লাল রঙের বাটন একটাতে টিপ দিলাম। এতেই তার হাত এবং পা চেয়ারটার সাথে আটকিয়ে যায়। সে এবার চিৎকার করে বলতে লাগল, “এই তোমরা কি করছো এসব? তোমাদের কিন্তু ভালো হবে না।”
আমি তার মাথায় ঐ টুপিটা বসিয়ে দিলাম। এরপর মেশিন একটার সামনে গেলাম। সে এখনো চিৎকার করছে। মেশিনটার একটা বিদ্যুতের চিহ্নযুক্ত বাটন দেখলাম। আমি সেখানে চাপ দিতে ঐ সাইয়েন্সটিস্টটা কাঁপতে লাগল। তার মুখ দিয়ে আর আওয়াজ বের হচ্ছে না। বুঝলাম, শকটা তার ব্রেইনে গিয়ে লাগছে। ঐদিকে দেখলাম আভা আর মাহফুজের জ্ঞান ফিরে আসছে। এতে ভালোই হল। নাহলে যাতায়াতে ব্যাঘাত দেখা যেত। আমাদেরকে দেখেই তাদের দুজনের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। তবে ঐদিকে দরজার সামনে ভীড় হয়ে গেছে। তাদেরকে যথেষ্ট রাগান্বিত মনে হচ্ছে। তারা আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। আমি সামনে দেয়ালে স্ট্যান্ডে কতগুলো লাল রঙের পিস্তলের মত দেখতে সাজানো দেখলাম। তানভীরকে ইশারা দিয়ে সেখানে দেখিয়ে দিলাম। তানভীর আমাদেরকে একটা পাস দিতে লাগল। ঐদিকে দেখলাম, তাদের হাতেও আমাদেরটার মত দেখতে পিস্তল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ আভার দিকে শুট করল। ব্যর্থ লক্ষ্য। আভা সরে যাওয়ায় লেজারটা তাকে কিছুই করতে পারেনি। আমরাও আক্রমন শুরু করলাম। তাদেরকে নিস্তেজ করতে বেশিক্ষন লাগল না। তারা শেষ পর্যন্ত সারেন্ডার করে। আমি তখন বললাম, “তোমরা আভা আর মাহফুজকে কি করছিলে?”
তাদের কেউ কথা বলে না। আমি তখন তাদের দিকে আমার লেজার গানটা তাক করলাম।
“আমি বলছি, আমি বলছি” সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, “আসলে আমরা আমাদের ডিএনএ ট্রান্সফার করছিলাম তাদের ব্রেইনে।”
“হোয়াট!” বলল তানভীর
“এর কারণটা কি?” বললাম আমি
“বুঝতেই তো পারছেন, ডিএনএ ট্রান্সফারের মাধ্যমে তারাও আমাদের মত হয়ে যাবে। এরপর বংশবিস্তারের মাধ্যমে একসময় সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে”
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “এনিমিজম তো একটা ধর্ম। এর জন্যে ডিএনএ কেনো ট্রান্সফার করতে হচ্ছে?” বড়ই কৌতুহল দেখা যাচ্ছিল আমার মাঝে।
“এখনকার লোকেরা এইসব পৌরণিক ধর্মের উপর বিশ্বাস রাখে না। তাই…. ”
তার মুখের মধ্যে স্পষ্ট রাগ দেখা যাচ্ছে। সে এই সবকিছু বলছে বাধ্য হয়ে।
“এখন বল জারিন কোথায়?”
তারা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করল। তাদের মাঝে গুণগুণ কথা-বার্তা শোনা যাচ্ছে।
“কার কথা বলতে চাচ্ছো?” আগের মানবপশুটায়ই বলল।
আমি বললাম, “ঐ যে গত পূর্ণিমাতে একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল এখানে”
“ও, তার কথা বলছো? সে তো আমাদের রাজার কাছে। এটা আমাদের রাজার জন্যেই নিয়ে আসা হয়েছে। আর তাকে এই পূর্ণিমাকে বলি দেয়া হবে। আর আমাদের রাজা আরো দীর্ঘ হায়াত লাভ করবেন। আর তোমরা কখনো এমনটা হতে বাঁধা দিতে পারবে না” বলে সে হাসতে লাগল। তার হাসি দেখেই অন্যান্য সবাই হাসতে লাগল।
“চুপ সবাই” সবাইকে ধমক দিলাম আমি। সবাই এখন চুপ। এরপর বললাম, “তোমাদের রাজা কোথায় থাকে?”
“ঐ পাহাড়টাতে থাকেন” আঙুল দেখিয়ে একটা পাহাড় দেখিয়ে দিল সে। দেখলাম, পাহাড়টা এইখান থেকে যথেষ্ট দূরে। পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ত পূর্ণিমা হবে।”
.
আজ আমাবস্যার রাত। চারদিকে অন্ধকার। আগের পাহাড়টা থেকে আমরা যথেষ্ট দূরে চলে এসেছি। সেখান থেকে আর ধোয়া বের হচ্ছে না। আমরা চারজন আবার একসাথে। এখন লক্ষ্য সামনে পাহাড়টা। যেহেতু রাজার বাসস্থান, সেহেতু সামনের বিপদগুলো আরো বিপদজনক হবে। ডায়মন্ডটারও চার্জ নেই। তা আর কাজ করছে না। বড় চিন্তার বিষয়।
.
বড় থেকে একটা ক্যাম্প বানিয়ে সবাই ঘুমুচ্ছে। আমি ক্যাম্প ফায়ারের দেখভাল করছি। হঠাৎ কানের পাশ দিয়ে একটা বাতাস বসে গেলো। সামনে হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা মেয়ে, সাদা জুব্বার মত কাপড় পড়া, পেছনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।
“কে, কে তুমি”
সে আমার দিকে ফিরল। দেখলাম, এইটা সেই আত্মাটা যাকে ঐ কুড়েঁঘরে দেখেছিলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আমি তার কাছে গেলাম। সে আমাকে বলল, “তোমাদের সাহসিকতা দেখে আমি মুগ্ধ। তোমাদেরকে প্রথমবার যখন দেখেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম তোমরা ব্যর্থ চিন্তা করছো। এখন বুঝতে পারছি, তোমরাই তোমাদের বন্ধুকে বাঁচাতে পারবে।”
“তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমরা এখানে একজনকে বাঁচাতে এসেছি?”
“অশরীরিরা সব বুঝতে পারে। আর তোমরা যদি এই রাজাটাকে শেষ করতে পার, তাহলে আমার আত্মা মুক্তি পাবে।”
“মানে? তোমার মৃত্যুর সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে?”
“আমার বাবা-মাকে সে বাধ্য করে এনিমিজম ধর্ম গ্রহণ করিয়েছে। আর আমি করছিনা বলে, শেষ পর্যন্ত আমাকে খুন করে। যারা এই ধর্মটা গ্রহণ করতে চাইনি, তাদেরকে ঐদিকের জঙ্গলটার গাছের সাথে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।”
কথা শেষ হতেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
আজকের আকাশটা যথেষ্ট মেঘলা। ঠান্ডা বাতাস বয়ছে। অনেকদিন আবার আমরা চারজন একসাথে হলাম। এবার আমরা একসাথে হাঁটছি, অনেক সাবধানে। বাতাসের তালে নেচে ওঠা ডাল-পালার শব্দ শোনা যাচ্ছে। গায়ে একটু একটু বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। আমাদের লক্ষ্য এখন রাজা যে পাহাড়টাতে থাকেন, সেই পাহাড়টা। পাহাড়টা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। তবে সেখানে পৌঁছতে আমাদের ৩-৪ দিন সময় লাগতে পারে। উঁচুনিচু রাস্তা।
মনে হল সামনে দিয়ে কেউ দৌঁড়ে গিয়েছে। তার শুধু কালো অবয়বটা দেখতে পেরেছি। আমি সবার কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করলাম সেরকম কিছু দেখেছে কিনা। না, তারা দেখেনি। তবে আমি ব্যাপারটা গুরুত্বের সাথে নিলাম। এই জগতে সবকিছুই সম্ভব। বলতে হবে, এখানকার প্রাণিগুলো অনেক বুদ্ধিমান। হঠাৎ উপর থেকে এক ঝাক পশুমানবগুলো লাফ দিয়ে সামনে হাজির হল। তারা আমাদের পথ আটকিয়ে সামনে আসছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে বর্শা। সুক্ষ্ম বর্শা। চলার পথে এমন যে বিপদ আসবে তা আমি জানতাম। তাই সবাই আমার কথা মতে লেজার গান নিয়ে এসেছিল ঐ ল্যাবরেটরি থেকে।
আমাদের সামনে তারা বেশিক্ষন টিকতে পারল না। অনেকেই এখানে নিহত হল, কেউ পালিয়ে গেলো আবার কেউ এখানেই সারেন্ডার করে ফেলল।
.
চলতে চলতে আমরা একটা ঘন জঙ্গলের ভেতর চলে আসি। সেখানে তাপমত্রা আরো কম। আশেপাশের গাছপালাগুলো হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। এমন কিছু একটা ঘটবে, তা আমার ধারণার বাইরে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পা চালাতে লাগলাম। গাছগুলো আগুনে পুড়ে পড়ে যাচ্ছে। আশেপাশে সব ধোয়া। হঠাৎ জ্বলন্ত গাছ একটা পড়ল আমাদের সামনে। একটুর জন্যে বেঁচে গেলাম আমরা। তা পাশ কাটিয়ে আমরা যত দ্রুত সম্ভব পা চালাতে লাগলাম। আশেপাশের গাছগুলো একটা একটা করে পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আভার চিৎকার শুনতে পেলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম, তার পায়ের উপর শক্ত বড় একটা গাছের গুড়ি পড়েছে। গুড়িটার গোড়ায় আগুন জ্বলছে। আভা নড়তে পারছে না। সবাই আভাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গুড়িটা সরানো যাচ্ছে না। অনেক ভারি তা। ঐদিকে জঙ্গলটার শেষ পথ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শেষ মাথা অব্ধি আগুন জ্বলছে গাছপালায়। কতগুলো ভেঙে পড়ে যাচ্ছে।
“তোমরা এখান থেকে যাও। জঙ্গলটার শেষ মাথার দেখা যাচ্ছে। তোমরা এখান থেকে বেরিয়ে যাও। আমি আভাকে নিয়ে আসছি” বললাম আমি।
তখন মাহফুজ বলল, “তুমি একা একা কিভাবে সরাবে তা। অসুবিধা নেই। আমরা সবাই আছি”
আমি রেগে গিয়ে বললাম, “আমি বলছি তোমরা যাও। ঐদিকে গাছপালা গুলো ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। দেরি করলে পথ বন্ধ হয়ে যাবে। যার ফলে এখানে আটকে থাকতে হবে। ফিরে যাবারও পথ নেই।”
.
আভাকে টানতে লাগলাম, গুড়িটা ধাক্কা মেরে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। তবে ব্যর্থ।
“ঈশান, উপরে দেখো..” করুণ কন্ঠে বলল আভা। আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম একটা গাছ হেলে পড়েছে। তাতে মশালের মত আগুন জ্বলছে। তা পড়লে সোজা আমাদের মাথার উপর পড়বে। কি করা যায় চিন্তা করতে লাগলাম। গাছটা থেকে মড়মড় শব্দ আসতে লাগল। কিছুক্ষন পর গাছটা আমাদের উপর ভেঙে পড়বে।
একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার। গুড়িটা একটা পাথরের উপর ভর দিয়ে আছে। তা সরাতে পারলে গুড়িটা নিশ্চিতভাবে সরে যাবে। পাশ থেকে একটা লম্বা শক্ত গাছে ঢাল নিলাম। পাথরটা সরানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। গাছটা এখন প্রায় আমাদের দিকে হেলে পড়েছে। ঐদিকে দেখলাম আভা কাঁদছে। শেষ পর্যন্ত পাথরটা সরাতে পারলাম। গুড়িটাও সরে গেলো। আমি আভার হাত ধরে তাকে উঠিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে নিলাম। ঠিক সেই সময় জ্বলন্ত গাছটা আমাদের সামনে মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। সাথে সাথে সেখানে দাউ দাউ করে আরো জ্বলে উঠল।
এবার আমরা একসাথে দৌঁড়াতে লাগলাম। বের হবার পথটা দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট তানভীর আর মাহফুজকে দেখতে পেলাম সেখানে। দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। বের হবার পথে একটা বড় মোটা গাছ প্রায় পড়ে যাবার মত অবস্থা। আভার হাত ধরে গতি বাড়ালাম। একটু পরই গাছটা পড়ে যাবে। সামনে পৌঁছতেই মাহফুজ আমার হাত ধরে এক হেচকা টান দিল। আমি আভার হাত ধরে থাকায় সেও টান খেল। জঙ্গলটা থেকে বেরুতেই গাছটা পড়ে গেল। দাউ করে জ্বলে উঠল। জঙ্গলটার উপরের দিকে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা এটা…
.
আজ আকাশে এক টুকরো চিকন চাঁদ দেখা যাচ্ছে। পূর্ণিমার জন্যে হাতে আর বেশিদিন নেই। রাজার রাজ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে।
সবাই এখন ক্যাম্পে ঘুমুচ্ছে। আগুন সামলানোর কাজটা আমাকে দেয়া হয়েছে। বাইরে মোটামোটি ঠান্ডা। মনে হল কেউ আমাকে ডাকছে… “ঈশান…এই ঈশান”
মেয়ের কন্ঠে কেউ ডাকছে আমাকে। ক্যাম্পে ঢুকে দেখলাম আভা ঘুমাচ্ছে। তাহলে ডাকল কে?
আবার শুনলাম, “ঈশান, এই ঈশান” ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখলাম আগুন থেকে কিছু সামনে পা পর্যন্ত সাদা কাপড় পড়া পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার চুল কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত। ভাবলাম এটা ঐ কুড়েঁঘরের অতৃপ্ত আত্মাটা। তার সামনে গেলাম আমি। ঠিক সেই মূহুর্তেই পেছন থেকে মাথায় আমাকে অনেক জোড়ে কে যেন আঘাত করল। সাথে সাথে পড়ে গেলাম। এরপর আমাকে এলোপাথাড়িভাবে মারতে লাগল। কে বা কারা মারছে তা দেখতে পারছি না। দুচোখে অন্ধকার দেখছি।
.
চোখ খুলতেই মাথাটা ব্যাথা করে উঠল। দেখলাম একটা ছোট ঘরে বন্দি আমি। সেখানে থাকা একটা ছোট জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। চাঁদটার দিকে তাকিয়েই অবাক হলাম। পূর্ণিমার চাঁদ!
তার মানে আমি এতদিন বেহুঁশ ছিলাম! আভা, তানভীর, মাহফুজ এরা কোথায়? তাদেরকেও নিশ্চয়ই বন্দি করে রাখা হয়েছে। আজকে যেহেতু পূর্ণিমা, সেহেতু আজ জারিনকে বলি দেয়া হবে। যে করেই হোক, আমাকে এইখান থেকে বেরুতে হবে। জানলা দিয়ে তাকালাম। জমি বেশি নিচে নয়। জানলাটার কোন গ্রিল নেই। ছোট হলেও আমি পাতলা হওয়ায় সহসা বেরিয়ে যেতে পারব।
ছোট জানালা দিয়ে সহজেই বেরিয়ে এলাম। মাথার উপর বড় পূর্ণিমার চাঁদ। আলোয় চারপাশটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। মৃদু বাতাস। জারিনের জন্যে অনেক চিন্তা হচ্ছে। আজ তাকে বাঁচাতে না পারলে আজকের রাতটা তার জন্যে শেষ রাত হয়ে দাঁড়াবে। তার আগে আমাকে আভা, মাহফুজ আর তানভীরকে খুঁজে বের করতে হবে। তাদেরকেও নিশ্চয়ই বন্দি করে রেখেছে। পকেটে হাত দিতেই ডায়মন্ডটার স্পর্শ অনুভব করলাম। ঐ কুড়েঘরের অশরীরিটা বলেছিল ডায়মন্ডটাকে চাঁদের আলোতে রাখলে এর চার্জ হবে। তাই আমি রেড ডায়মন্ডটা হাতে নিলাম। এখানে কেউ আসছে বলে মনে হয়। আমি সাথে সাথে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। দেখলাম একটা মানবপশু এখানে এসে জানলাটার দিকে উঁকি মারছে। নিশ্চয়ই আমাকে চ্যাক করার জন্যে এখানে এসেছে সে। পাশে একটা রডের মত লোহার খন্ড পড়ে ছিল। সেটা দিয়ে আঘাত করলাম তার মাথায়। যাতে সে চিৎকার করতে না পারে, তার মুখটা আমি চেপে ধরলাম। বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলো। ঘর ফাঁকা দেখলে সে নিশ্চয়ই খবরটা রাজার কানে পৌঁছিয়ে দিত। আর এতে আরো ঝামেলা দেখা যেত। যাকে মেরেছি, তার পরনে কাপড়টা আমি পড়ে নিলাম যাতে ভেতরে গেলে কেউ আমাকে চিনতে না পারে। পকেট থেকে আমি আমার রুমালটা বের করে তা দিয়ে মুখ ঢাকলাম। কারণ সাধারণ মানুষের চেহারা আর এই মানবপশুগুলোর চেহারা একই হবে না। তার হাতে একটা বর্শা ছিল। তাও আমি হাতে নিলাম। এরপর আমি সে যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল, সেই রাস্তায় গেলাম আমি। দেখলাম সামনে বড় একটা রাজপ্রাসাদ। তাদের জন্যেও যে রাজপ্রাসাদ থাকবে তা আমার ধারণার বাইরে। দেখতে তাজমহলের মত লাগছে। মার্বেল পাথরের তৈরি। চাদের আলোতে চিকচিক করছে। রাজপ্রাসাদটা বিভিন্ন আলোতে ঝলমল করছে। আস্তে আস্তে হেঁটে গেলাম রাজপ্রাসাদটাতে। সেখানে যেতেই দেখলাম এনিমিজমিয়ান একজন টেনে হিচরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে তারাও বলল আসতে। ঝামেলা হবে ভেবে মানা করলাম না। যাকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে দেখে সাধারণ মানুষই মনে হচ্ছে।
“আমাকে ছেঁড়ে দাও” বলে বলে কাতরাচ্ছে সে। খোলা একটা মাঠে তাকে নিয়ে আসা হল। এরপর তাকে মাটিতে শোয়ানো হল। কোথা থেকে একজন এলো যার শরীরকে সিক্স প্যাক বলা যেতে পারে। তার হাতে বড় একটা রাম দা। সে সাথে সাথেই লোকটার মাথাকে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলল। এরকম দৃশ্য আমি প্রথম দেখলাম। গল গল করে রক্ত বেরুচ্ছে। জল্লাদটা কাটা মাথাটা নিল। এরপর কয়েক কোপে মাথার ভেতর থেকে মগজ বের করে নিল। পাশে আগুন জ্বালানো ছিল। মগজটাকে সে আগুনে পুড়তে দিল।
“মগজটা খেতে অনেক মজা হবে। বড়ই লোভ লাগছে।” একজন মানবপশু বলল আমার দিকে তাকিয়ে।
তারা তাকে মগজটা খাওয়ার জন্যে এমনটা করেছে??
আভা, তানভীর আর মাহফুজের প্রতি চিন্তা আরো বেরে গেলো। জারিনের চিন্তা তো আছেই…
.
বাইরে রাজপ্রাসাদ যত সুন্দর, ভেতরে তার চাইতেও অনেক সুন্দর। ভেতরে সবার গায়ে খানদানী কাপড়। শুধু কর্মচারীদের গায়ে আমার মত ড্রেস অর্থাৎ ছেঁড়া পাঞ্জাবী। সকলে দুই পায়ে হাঁটলেও সাধারণ মানুষের মত হাঁটতে পারছে না। জাম্বিদের মত হাঁটছে তারা। আমিও তাদের মত হাঁটতে লাগলাম যাতে কেউ সন্দেহ না করে। সিংহাসনে রাজা সাহেব বসে আছে। দূর থেকে চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সাদা রঙের দাঁড়িটা দেখা যাচ্ছে। রাজার সাথে কিছু ডিল করতে হবে আমার। রাজার সামনে যেতেই আমি যেন 200X10^678 ভোল্ডের শক খেলাম। এই রাজাটাকে তো আমি চিনি। এটা হচ্ছে আভার দাদা। সেও এনিমিজম ধর্ম চর্চা করেছে??
তার মানে এইসব কারসাজি সব তার। জারিনকে সে বলি দিতে চাই দীর্ঘজীবন লাভ করার জন্যে..
“রাজা সাহেব একটা কথা ছিল।”
“আমাকে হঠাৎ রাজা সাহেব বলে ডাকছো কেনো? জানো না সবাই আমাকে স্যার বলে ডাকে..” হালকা রেগে বললেন তিনি। স্যার হবার খুব শখ তার। তার ব্যবস্থা পড়ে করব। আগে মূল কাজটা শেষ করি।
“আইচ্ছা স্যার, সেদিন যে চারজনকে আটক করেছিলেন তাদের ব্রেইনকে ফ্রাই করার কথা ছিল না??” চোখ বন্ধ করে একটা ঢিল মারলাম আমি।
“তাদেরকে এখনো হত্যা করা হয়নি?” রেগে গেলেন তিনি। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ঢিলটা ঠিক জায়াগায় পড়ল। আমি বললাম, “আচ্ছা, আমি গিয়ে নিজ হাতে তাদের কাম চালাই দিচ্ছি।”
“হুম, যাও। আচ্ছা তুমি একা পারবে না। সাথে ওকে নিয়ে যাও।” একজনকে দেখিয়ে দিলেন ডেভিল দাদু। এতে ভালোই হল। কারণ তারা কোথায় বন্দি আছে তা আমার জানা নেই।
“আর শুনো, যে ছেলেটাকে বাইরের ঘরটাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে, তার ব্রেইনটা আমি কাঁচা খাব। শালার মাথায় ভীষন বুদ্ধি।”
সে নিশ্চয়ই আমার কথায় বলছে। শাল্লার ফইন্নি, তোর নিজের ব্রেইন লইয়া কুত্তারে খাবাই দিব। কুত্তাও খাবে কিনা সন্দেহ…
.
যার সাথে যাওয়ার কথা ছিল, তাকে অনুসরণ করতে করতে একটা ঘরে চলে এলাম, যেখানে সবগুলোই জেল। একটা জেলে দেখতে পেলাম আভা, তানভীর আর মাহফুজ একসাথে বসে আছে। আমাদের দেখে তাদের চোখগুলো ছলছল করতে লাগল। ভেবে নিয়েছে এই বুঝি আমরা শেষ।
সে জেলের দরজা খুলল। তিনজনকে বের করল সে। এইসময় আমি পকেট থেকে আমার ড্যাগারটা বের করে কর্মচারীটার গলায় ধরলাম। তার দুহাত শক্ত করে ধরে বললাম, “চিৎকার করবি না। নাহলে গলা কেটে দেব। বল জারিনকে কোথায় রাখা হয়েছে?”
সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আভা, তানভীর এবং মাহফুজ আমার কন্ঠ চিনতে পেরে তাদের মুখে হাসি দেখা গেলো।
“তুমি কে?” জিজ্ঞাসা করল কর্মচারীটা।। আমি মুখ থেকে রুমালটা সরালাম। আমার আসল চেহারা দেখে সে আরো অবাক হল।
“এবার বল কোথায় জারিন?”
“সে এখন প্রাসাদের পাশের খোলা মাঠটাতে আছে। বারটা বাজতেই তাকে বলি দেয়া হবে জবাই করে।”
আমি ঘড়িতে দেখলাম ১১:৫০ এর মত। হাতে মাত্র দশ মিনিট সময় আছে।
ঐদিক থেকে হৈ-হুল্লোর শোনা যাচ্ছে। কি বলে ছেলেটা বাইরে জেল থেকে পালিয়ে গেছে। খাইছে আমারে। আমাকেই খুঁজছে। আমি কর্মচারীটাকে ছেঁড়ে দিলাম এবং বললাম দৌঁড় মারতে। আমরা চারজন একসাথে দৌঁড়াতে লাগলাম। পকেটে কখন ডায়মন্ডটা ঢুকিয়ে ফেলেছি খেয়ালও করলাম না। চার্জ নিশ্চয়ই ভালো করে হয়নি। সভা কক্ষে যখনই পৌঁছলাম, সবাই আমাদেরকে ঘিরে ধরল। সবার হাতে বর্শা। ঐদিকে রাজাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। আমি পকেট থেকে ডায়মন্ডটা বের করে তাদের দিকে তাক করলাম। লাল রঙের রশ্মি বের হয়ে একে একে সবাইকে শেষ করে দিল। আমরা আবার দৌঁড়াতে লাগলাম। হাতে মাত্র তিন-চার মিনিটের মত সময় আছে। রাজপ্রাসাদের পাশে শুধু একটাই খোলা মাঠ আছে, যেখানে ঐ সাধারণ লোকটাকে হত্যা করা হয়। মাঠে পৌঁছতেই দেখলাম জারিন একটা গাছের সাথে বাঁধা আছে। আমাদেরকে দেখেই তার মুখে হাসি ফুটেছে। পাশেই আভার দাদু মানে রাজাটা। তার হাতে একটা তলোয়ার। চাঁদের আলোয় তা চকচক করছে। আমার ডায়মন্ডটা সাথে সাথেই তার দিকে তাক করলাম। ঠিক সেই মুহুর্তেই কোথা থেকে একটা তীর এসে বিধলো আমার ডান বাহুতে। ডায়মন্ডটা আমার হাত থেকে পড়ে গেলো। পাশে দেখি আমার অন্যান্য সঙ্গীরাও আটকা পড়েছে সৈন্যদের হাতে।
“কি ঈশান, একবার বলেছিলাম না, আমি যা বলি তাই করে থাকি… জারিনকে বলি দেবার মাধ্যমে আমার আয়ু দীর্ঘ হবে। আরো একশ বছর বেঁচে থাকব আমি” এই বলে রাজাটা হা হা করে হাসতে লাগল। ডান দিকে আমার অসহ্য ব্যাথা করছে। বাহু থেকে তীরটা সরিয়ে ছুটলাম তার দিকে। আবার একটা তীর এসে বিঁধলো আমার পায়ে। সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলাম।
“তোমরা আমাকে বাঁচানোর জন্যে কেনো এসেছো? কেনো নিজেদের জীবনকে রিস্কে ফেলেছো??” এই বলে জারিন কাঁদতে লাগল।
“তোমররা এসেছো ভালোই হইছে। আজকের ডিনারটা খুব ভালোভাবে যাবে। তবে একটা বিষয়ে তোমাদের প্রশংসা করতে হয়, পথে এত বাঁধা আমি দেবার পরেও তোমরা এই অব্ধি পৌছেছো…”
এই বলে সে জারিনকে মাটিতে শোয়ায় দিল। বুঝলাম, বারোটা বেজে গিয়েছে। এখন আর কিছুই করার নেই। এখানেই আমদের সবার মৃত্যু হবে। জল্লাদের রাজা তার তলোয়ারটা জারিনের গলার দিকে ধরল। ঠিক তখনই তিনি আঃ! করে উঠলেন। সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেল। দেখলাম ঐদিকে আভা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এতক্ষন খেয়ালও করিনি। তার হাতে একটা ছুরি, তাতে রক্ত লেগে আছে। সে তার দাদুর পাশে বসে কাঁদতে লাগল। খেয়াল করলাম, আশেপাশের সব সৈন্যরা আমাদের সামনে মাথা নিচু করে সারেন্ডার করেছে।
.
মাহমুদ দাদু আসলেন আলোর একটা ঝলক দিয়ে। তার মুখে হাসি। আভা তখনো তার দাদুর পাশে বসে কাঁদছে। শত হলেও তার দাদু তো।
“তোমরা আজ একটা মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি একটা অতৃপ্ত আত্মার প্রাণও বাঁচিয়েছো।”
তানভীর বলল, “কোম অতৃপ্ত আত্মা?”
মাহমুদ দাদু তখন আকাশের দিকে দেখিয়ে দিলেন। কুঁড়েঘরের সেই অতৃপ্ত আত্মাটা আকাশের দিকে উড়ে চলে যাচ্ছে। আজ তার অনেক খুশির দিন। সবাই যখন কথা বলার মধ্যে ব্যস্ত, আমি গেলাম আভার কাছে শান্তনা দেবার জন্যে। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। এখনো কাঁদছে সে। আমি বললাম, “যা হওয়ার হয়ে গেছে। দাদুকে আমাদের জগতে নিয়ে কবর দেয়া হবে।”
তখন মাহমুদ দাদু গলা উঁচিয়ে এইখান যেতে হবে এখন আমাদের। সবাই আমার হাত ধর। আমরা সবাই তাকে ধরলাম। আভা মাহমুদ দাদুর হাত ধরার পাশাপাশি তার দাদুর হাতও ধরল। মূহুর্তের মধ্যেই পৌছে গেলাম সেই ঘরে, দ্য ডেথ্লি হাউজে……
.
দাদুকে কবর দিয়ে জানাজা পড়লাম। জারিনকে ফিরে পেয়ে তাদের ফ্যামিলি মেম্বার বিশেষ করে তার মা অনেক খুশি। পোলাও ভাতের দাওয়াত দিয়েছেন তিনি আমাদের জন্যে। আর আমি খাওয়ার দাওয়াতের ক্ষেত্রে কখনো না করি না। পেট পুরে খাইলাম।
আজ আমরা সবাই চলে যাব ময়মনসিংহ থেকে। পুরো একমাস কাটিয়েছি এখানে। করেছি আরেকটা নতুন ভূতুড়ে এডভেঞ্চার।
………………………………………….সমাপ্ত………………………………..