অন্ধকারে রহস্য

অন্ধকারে রহস্য

মেয়েটির উপরে শুয়ে আছে মুহিত৷ মন ভরে শরীরের স্বাদ গ্রহন করছে৷ বুকে মুখ ঘষছে৷ অনেকখন হল মেয়েটির সাথে সেক্স করছে৷ তবে স্পষ্ট করে মুখ দেখতে পাচ্ছে না৷ মেয়েটি মুখ দিয়ে ‘টু’ শব্দও করছে না৷ তবুও তৃপ্তি ভরে মেয়েটিকে ভোগ করছে ও৷

হটাৎ মুহিতের ফোনে রিং বেজে উঠল৷ ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো৷ সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে৷ ১৪° সেলসিয়াসের শীতেও যে মানুষ এমন ঘামতে পারে৷ এই ধারনা আগে ছিল না ওর৷ মুহিত আজও স্বপ্নে মেয়েটির সাথে সেক্স করেছে৷ কিন্তু মুখ দেখতে পায়নি৷ কে এই মেয়েটি? নিজের মনে এই প্রশ্ন রেখেই মুহিত বালিশের পাশে থেকে মোবাইলটি হাতে তুলে নিল৷ অপরিচিত নাম্বার থেকে রিং হচ্ছে৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করলো ও, ‘হ্যালো’৷ ফোনের ওপাশে নিস্তব্ধতা৷ এরপর শুনতে পেল এক পাখির ডাক৷ এত জোরে পাখিটি ডাকলো যে, মুহিত তৎক্ষণাৎ কানের থেকে মোবাইল সরিয়ে নিল৷

এত রাতে পাখির ডাক শোনানোর জন্য কে ফোন করেছে! মুহিত সেটা ভাবতেই ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি হাসির শব্দ ভেসে এলো৷ হাসি শুনে ওর মনে হল কেউ বদ্ধ ঘরে হাসছে৷ মুহিত দ্বিতীয়বার হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো৷ ফোনের স্ক্রিনে রাত ৩টা ৩৫মিনিট বাজতে দেখে ও বলল, এত রাতে কোন মেয়ে মজা করার জন্য ফোন করেছে! হয়তো পরিচিত কেউ নতুন সিম কিনে এই মজা করছে৷ বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াল মুহিত৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ বাড়ির সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের বাতিটি বন্ধ থাকায় অন্ধকারের মাত্রাটি যেন আরো বেড়েছে৷

হীম বাতাসে ওর শরীরের ঘাম শুকিয়ে আসছে৷ ঠোঁটের মাঝে একটি সিগারেট জ্বালিয়ে মুহিত ভাবতে লাগলো, স্বপ্নের সেই মেয়েটিকে নিয়ে৷ গত চার দিন ধরে মেয়েটির সাথে ওর স্বপ্নে শারীরিক সম্পর্ক হচ্ছে৷ কিন্তু মুখ দেখতে পাচ্ছে না৷ সিগারেটে লম্বা টানে ঘন ধোঁয়া ছাড়তেই বাড়ির সামনে এক কুকুর ওর দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ শব্দ করে উঠল৷ কুকুরটি এই এলাকরই৷ কিন্তু গত মাস দেড়েক ধরে কুকুরটি মুহিতকে দেখেই কেমন তেড়ে আসছে৷ ভদ্র কুকুর তবে ওকে দেখলেই অস্বাভাবিক আচরন করছে৷ মুহিতের সিগারেট শেষ হতেই, ফোনের সেই পাখির ডাকের শব্দটি আশে পাশের কোথা থেকে যেন শুনতে পেল৷ অন্ধকারের মাঝেই চারপাশে একবারটি চোখ ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো৷

এর কিছুখন পরই আবার ফোনে রিং বেজে উঠল৷ সেই একই অপরিচিত নাম্বার৷ রিসিভ করে খানিকটা বিরক্ত স্বরেই বলল, ‘ কে আপনি?’ ফোনে ওপাশ থেকে সেই একই মেয়েলি হাসি ভেসে এলো৷ এবারের হাসিটি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো মুহিত৷ হাসিটি পরিচিত মনে হচ্ছে৷ কিন্তু বদ্ধ ঘরে হাসির কারনে শব্দটি ভারি শোনাচ্ছে৷ মুহিত বলল,‘ অাপনার পরিচয়টা দেয়া যাবে? এখন রাত ৩:৪৭মিনিট৷ এটা কি মজা করার সময়?’ মুহিত প্রথমবারের মত কন্ঠ শুনতে পেল৷

—‘ঘুমের কি খুব বিরক্ত করেছি?’

মেয়েলি কন্ঠটি মুহিতের খুব চেনা মনে হল৷ সচরাচর মেয়েদের কন্ঠস্বর যেমন পাতলা হয়৷ এই কন্ঠ খানিকটা ভারি৷ কন্ঠস্বর নিয়ে মুহিত ভাবতেই ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠল, ‘আপনার স্বপ্নের মাঝে আমার ফোন খুব জ্বালিয়েছে৷ এজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত৷’

—‘আমার স্বপ্নের মাঝে মানে! আপনি কে বলছেন?’- মুহিতের এ প্রশ্নে মেয়েটি বিভৎস হাসিতে মেতে উঠল৷ ওর মনে হল মেয়েটি একা হাসছে না৷ পাশের থেকে কোন পাখিও বিচিত্র ভাবে হাসছে৷ এবং তা চার দেয়ালে ধাক্কা লাগার ফলে মনে হচ্ছে, অনেক মেয়ে৷ অনেক পাখি একত্রে হাসছে৷ কিছুখন পর হাসি থামিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আমিই সে যার মুখ দেখার জন্য স্বপ্নে ব্যাকুল হয়েছিলেন৷ উন্মাদ হয়ে যার উপর শুয়ে নিজের তৃপ্তি মিটিয়েছেন৷’— বলে মেয়েটি আবার হাসলো৷

মুহিত স্তব্ধ হয়ে গেল মেয়েটির কথা শোনে৷ ওর বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল৷ উত্তরের দেয়ালে টানানো ঘড়ির কাটায় টিক টিক শব্দ বাদে আর কোন শব্দই শুনতে পাচ্ছে না ও৷ কয়েক সেকেন্ড পর নিরবতা ভেঙে মুহিত বলল, ‘আপনার পরিচয়টা বলুনতো৷ কে আপনি?’ ফোনের ওপাশ থেকে টোট টোট  শব্দ৷ কল লাইন কেঁটে দিয়েছে ৷ মুহূর্তেই সেই নাম্বারে কল ব্যাক করলো মুহিত৷ মোবাইল বন্ধ শোনাচ্ছে৷ মোবাইলের নাম্বারটিতে চোখ রাখতেই মুহিতের গোটা শরীরে ঝাকুনি দিল৷ তারপর কানে বাজলো ঘর কাঁপানো হাসি৷ কান একটু খাড়া করতেই বুঝতে পারলো হাসিটি ফোনের সেই মেয়েটির৷

অন্ধকার ঘরে চারপাশে মোবাইলের আলো ফেলে মুহিত খুঁজতে লাগলো সেই হাসির উৎস৷ খনিকের মধ্যেই হাসি থেমে যাওয়ায় মুহিত আবার মোবাইলেই সেই নাম্বারে চোখ রাখলো৷ নিজ মনে বলে বসলো, আশ্চর্য৷ এই নাম্বার চৈতীর৷ কিন্তু ও ফোন করবে কি করে! দেড় মাস আগেই তো ওর মৃত্যু হয়েছে৷ এই সিম নাম্বার বাতিল করা৷ তবে কি অন্য কেউ এই পুরাতন নাম্বার উঠিয়ে মজা করছে৷ কার-ই বা এত মজা করার ইচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লো মুহিত৷ ভেবেছিল বাকি রাত্রি ওর ঘুম হবে না৷ কিন্তু শুয়া মাত্রই ওর ঘুম চলে এলো৷ গভীর ঘুম৷ যে গভীর ঘুমের স্বপ্নও হয় গভীর৷ সে গভীর স্বপ্নে তলিয়ে গেল৷ আবারো সেই অদৃশ্য মুখের মেয়েটি ওর স্বপ্নে দেখা দিল৷ মেয়েটির জামা ছিড়ে খাটের ওপর শুয়ায়ে, শুরু হল তৃপ্তি ভোগ৷

দুপুর সাড়ে বারোটায় কলিংবেলের শব্দে মুহিতের ঘুম ভাঙল৷ অনবরত কে যেন কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে৷ মুহিত বিছানা ছেড়ে উঠতেই কলিং বেলের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল৷ ওর মনে হল যার দরকার ছিল, সে চলে গেছে৷ অাবার বেল বাজলে তখন গিয়ে দরজা খোলা যাবে৷ মুহিতের ঘাড় এবং মাথা ব্যাথা হয়ে আছে৷ ওর মনে হচ্ছে কেউ তাকে অজ্ঞান করে ফেলে রেখেছিল৷ নতুবা এমন গভীর ঘুম গোটা জীবনেও ঘুমায়নি ও৷

বালিশের পাশের থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে মুহিত ভাবতে লাগলো রাতের ঘটনা৷ ঐসব কি নিজ মস্তিষ্কের বানানো ঘটনা নাকি বাস্তবিক অর্থেই কোন রহস্যের স্বীকার৷ এটি নির্ধারনের জন্য সেই রং নাম্বারে চোখ রাখলো মুহিত৷ কাল রাতে যেটা চৈতীর নাম্বার ভেবেছিল৷ সেটি অাসলেই রং নাম্বার৷ দশটা সংখ্যা চৈতীর নাম্বারের সাথে মিল৷ শুধু শেষের সংখ্যাটি আলাদা৷

এতেই মুহিত ভেবে ঠিক করলো কাল রাতের সব ঘটনা, নিছকই ক্লান্ত মস্তিষ্কের সাজানো৷ আর কোন মেয়ে যদি মাঝ রাতে ফোন করে স্বপ্নের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়ে মজা করে৷ তবে এটা মোটেও অস্বাভাবিক না৷ মাঝ রাতে স্বপ্ন নিয়ে মজা করাটাই স্বাভাবিক৷ বরং স্বপ্নের সাথে কথার মিলে যাওয়াটা কাকতালীয়৷ মুহিত সাইকোলজির ছাত্র বলে রাতের সব কিছুই যুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক করে নিয়েছে৷

হাত মুখ ধুয়ে বাড়ির সামনের হোটেল থেকে খাবার আনার জন্য দরজা খুলল মুহিত৷ খুলেই দেখল সাত কি আট বছরের এক বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ওর হাতে একটি খাম ৷ মেয়েটি সেই খাম মুহিতের দিকে উচিয়ে বলল, ‘এক আফা এইটা আপনারে দিতে কইছে’— বলে মুহিতের দিকে সেটি ছুঁড়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে, মুহিতের চোখের সামনে থেকে বিদায় হল৷ মুহিত কয়েকবার ‘এই পিচ্চি, এই’ বলেও লাভ হয়নি৷

খামটি হাতে নিয়ে মুহিত ঘরে এলো৷ খামের উপর বাকা অক্ষরে লেখা, ‘মতিউর রহমান মুহিত’৷ এই লেখাটুকু দেখে চৈতীর কথা মনে পড়ল ওর৷ চৈতী এমন বাকা অক্ষরে লিখত৷ মুহিতকে বার্থ ডে উপলক্ষে, ভালোবাসার উপলক্ষে- কার্ড বা চিঠি দিলে এমন ভঙিমায় লিখে দিত৷ কিন্তু রাতের মত এখন আর মুহিতের শরীর কেপে উঠল না৷ এখন ও যুক্তি দেখালো যে, ‘এমন লেখা যে কেউই শখ করে, প্র্যাক্টিস করে লিখতে পারে৷ এটা আহামরি কিছু না৷

নিজের মনে সব ভেবে চিন্তে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক রেখে মুহিত খামটা খুলে একটি কাগজ বের করে চোখের সামনে সেটি মেলে ধরলো৷ চিঠিতে লেখা; ‘রাতে আপনাকে ফোন করে বিরক্ত করায় আমি দুঃখিত৷ আমি জানি, আপনি অধীর আগ্রহে আছেন আমার পরিচয় জানার জন্য৷ আপনার আগ্রহের পরিমান আর বাড়াব না৷ ভেবেছিলাম আর কিছুদিন আপনাকে অপেক্ষা করাব৷ কিন্তু ভাবনার পরিবর্তন এনেছি৷ অতি অপেক্ষায় আপনার আগ্রহ কমে যায়৷ সেটি কমুক আমি তা চাই না৷ কাজেই বিকাল চারটায় ধানমন্ডি লেকের ব্রিজের ওপর থাকবেন৷ আমি এসে ফোন দেব৷

ইতি, মুহিত চিঠিটা পড়া শেষ করে একটি সিগারেট ধরালো৷ চিঠিটা কোন অচেনা মেয়ের বলে ওর মনে হয়নি৷ সম্পূর্ন চিঠি পড়ার সময়টুকু ওর মনে হয়েছে যে চৈতীর লেখা৷ চৈতীর ভাষা৷ কারন, অতি অপেক্ষায় যে অাগ্রহের পরিমান কমে যায়, তা কেবল চৈতীই ভালো জানতো৷

চৈতীর সাথে মুহিতের সম্পর্কের বয়স ছিল প্রায় সাড়ে সাত মাস৷ বই মেলায় ওদের পরিচয় হয়়৷ সেখান থেকেই সম্পর্কের শুরু৷ চৈতী অনেক বুঝবান মেয়ে হলেও মুখের উপর কাউকে ‘না’ বলতে পারতো না৷ অনেক জটিল বিষয় বুঝেও সেটি প্রকাশ করতো না৷ ওর সামনে কেউ ধাপ্পাবাজি কথা বললে চোট করে সেটা বুঝতে পারতো৷ কিন্তু কখনো বুঝতে দিত না যে ও মিথ্যা ধরতে পেরেছে৷ এই স্বভাবটার কারনে লোক মুখে অবুঝ হয়ে থাকতো ও৷ চৈতী যাকে আপন ভাবতো, গোটা জীবনের জন্যই আপন করে রাখার মানষিকতা ছিল ওর৷ কাছের মানুষকে কষ্ট দেয়াটাকে নিজের কষ্ট বলে মনে হত৷ ওর এমন স্বভাবের কারনে মুহিতের অনেক, না মানার মত কথাও মেনে নিয়েছে৷

চৈতীর জীবনে মুহিত ছিল দ্বিতীয় প্রেম৷ অবুঝ বয়সে এক প্রেম করেছিল৷ সেই প্রেমকে ভুল বলেই ভাবতো ও৷ কিন্তু বুঝ হওয়ার পর, মুহিতের সাথে প্রেমের খুঁটিটি নিজের জীবনের অনেক গভীরে পুতে ফেলেছিল৷ অবশ্য মুহিতের জীবনে চৈতী কত নাম্বার প্রেম তা ও নিজেও জানে না৷ দেখতে আকর্ষিত যুবক হওয়ায় প্রেম করার বহু সুযোগ মেলেছে৷ আর সেসব সুযোগই অসৎ ব্যবহার করেছে মুহিত৷

গ্লোরি আবাসিক হোটেলে ওর চেনা শোনা ভালো৷ বেশ কয়েকবার প্রেমিকার সাথে সেই হোটেলের এক ঘরে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছে ও৷ সেই সুবাদে হোটেলের ম্যানাজার থেকে শুরু করে রুম বয়৷ সবার সাথেই সম্পর্ক ভালো৷ মুহিত সেই হোটেলে গেলেই একটি এক জানালার অন্ধকার ঘর ওর জন্য ফাঁকা রাখা হত৷ চৈতীকে নিয়েও বার দুয়েক মুহিত সেই হোটেলের অন্ধকার ঘরটিতে গিয়েছিলো৷ দু’বারই চৈতীর অনিচ্ছার মধ্যে ওদের শারীরিক সম্পর্ক ঘটে৷

মাস দেড়েক আগে আচমকাই একদিন সেই অাবাসিক হোটেলের ঘরটিতে গলায় ফাঁশ দেয়া চৈতীর লাশ আবিষ্কার করে রুম বয়৷ প্রাথমিকভাবে মুহিতকে খুনি বলা হলেও পরে পুলিশের তদন্তে জানা যাায় নিছকই আত্মহত্যা৷ সিগারেটের শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রেত গুজে বাথরুমে ঢুকলো মুহিত৷ গোসল করে তৈরি হয়ে বাইরে লাঞ্চ এবং ব্রেকফাষ্ট একসাথেই করে ধানমন্ডি লেকে যাবে৷ আধা ঘন্টা আগে গিয়ে বসে থাকলে কোন ক্ষতি নেই৷ ওর বুকের ভেতরে এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে৷

বিকেল ৩:৪০মিনিট বাজে৷ ধানমন্ডি লেকে বসে আছে মুহিত৷ উত্তেজনার কারনে একের পর এক সিগারেট ফুঁকছে ও৷ কয়দিন পর আজ আকাশে রোদের দেখা মিলেছে৷ সূর্যের আলো বেশিখন স্থায়ী হবে না বলে ওর ধারনা৷ কারন আকাশে ঘন মেঘ জমছে৷ সাদা কুয়াশার মাত্রাও বাড়ছে ক্ষনে ক্ষনে৷ সূর্যের আলো মেঘের আড়ালে গিয়ে যখন সন্ধ্যা নামিয়ে দিল৷ এর ঠিক কিছুখন পরই মুহিত শুনতে পেল— ‘অনেকখন ধরে অপেক্ষা করেছেন বুঝি?’ প্রশ্নটি শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো ও৷ সাদা রঙের জামা পরিহিত একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ মেয়েটির উচ্চতা মাঝারি৷ গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা৷ চুলে সাপের বেণী করে তা ফেলে রেখেছে বুকের ওপর৷ চোখে কাজল মাখা৷ মুহিত মেয়েটিকে দেখে খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল৷ ওর মনে হল মেয়েটি চৈতী৷

মেয়েটির সব কিছুতেই কেন যেন চৈতীর আভাস রয়েছে৷ অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে চৈতীর শরীর থেকে যেই ঘ্রাণ পেত ও৷ এখনো তেমনটি পাচ্ছে৷ মেয়েটির দিকে পলকহীন তাকিয়ে দেখলে অবিকল চৈতীর চেহারা দেখতে পাচ্ছে মুহিত৷ অাবার একটু ধ্যান সরিয়ে নিলেই অন্য মেয়েকে দেখছে৷ মেয়েটি বলল, ‘প্রশ্ন করেছিলাম অনেকখন হল এসেছেন কিনা!’

—‘ওহ! হ্যা, এইতো ঘন্টা দেড়েক হল এসেছি৷’
—‘স্যরি আমার একটু দেরি হয়ে গেল৷ একটি কাজে আটকে পড়েছিলাম৷’
—‘তুমি চৈতী ..?’

মেয়েটি হাসলো৷ কিন্তু সেই হাসির শব্দ হল না৷ কেবল শরীরখানা দুলে উঠল৷ ওর হাসি দেখে অবাক হল মুহিত৷ এ যেন অবিকল চৈতী হাসছে৷ মেয়েটি হাসি থামিয়ে বলল, ‘—আমার নাম নিশি৷ সিলেটে থাকি৷ একটি বিশেষ কাজে ঢাকা এসেছি৷ কয়দিন থাকব বলে একটি হোটেলে উঠেছি৷ কাজটি সম্পূর্ন করার জন্য আপনার একটু সাহায্যের প্রয়োজন৷

—‘তুমি আমার পরিচয় মুহিতের কথা কেড়ে নিয়ে নিশি বলল, ‘আপনার নাম্বার আসলে আপনারই এক বন্ধুর কাছে থেকে নিয়েছি৷ উনি আমাদের এলাকার বড় ভাই৷ আর কিছু মনে করবেন না৷ আপনার সাথে কাল রাতে খানিকটা ভৌতিক মজা করেছি৷’

—‘তোমার ঐ বড় ভাইয়ের নামটা কি?’
—‘উহু, নাম বলবো না৷ উনি এখন আমার হোটেল রুমেই আছে৷ চলুন সেখানে গিয়ে চা খেতে খেতে আড্ডা দেয়া যাবে৷ এবং আমার কাজের ব্যাপারেও আপনার সাথে কথা বলা হবে৷’

—‘ আমাকে তাহলে এখানে কেন আসতে বলেছো৷ তোমার হোটেলের ঠিকানা দিলে সরাসরি সেখানেই চলে আসতাম৷’
—‘বিকালে আমি কিছুটা সময় হাঁটি৷ তাই ভাবলাম আপনার সাথে এখানেই পরিচিত হওয়া যাবে৷’
—‘তোমার হোটেলটি কোথায়?’
—‘এই তো সামনেই৷ দশ মিনিটের হাঁটার পথ৷’

মুহিত আর বেশি কথা বলতে পারছে না৷ নিশির শরীর থেকে আসা ঘ্রাণ ওকে শুধু চৈতীর উপস্থিতি টের পাওয়ে দিচ্ছে৷ নিশির সাথে হোটেলের সামনে এসে মুহিতের চোখ অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে গেল৷ গ্লোরি আবাসিক হোটেল৷

—‘তুমি এখানে উঠেছো?’

‘হ্যা, কয়দিনের জন্য উঠেছি৷ কাল কিংবা পরশু কাজ শেষ হলেই চলে যাব ৷ চলুন আমার রুমে যাওয়া যাক৷’ হোটেলের ভেতর ঢুকতেই রুম বয়গুলো বিষ্ময় চোখে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মুহিত যেই রুমে প্রায় আসতো সেই ৮৭নাম্বারের রুম বয় আফজাল হোসেনের সাথে মুহিতের সম্পর্ক বেশ৷ মুহিতকে কনডম, সিগারেট, কোক সব কিছু আফজালই এনে দেয়, সেই আফজাল বিষ্ময় ভরা চোখে মুহিতকে দেখে বলে উঠলো, ‘স্যার৷’

মুহিত কোন দিকে কান দিল না৷ চোখ দিল না৷ সোঁজা নিশির সাথে উঠে গেল দু’তালার পূর্ব পাশের ৮৭ নাম্বার রুমের সামনে৷ নিশি বলল, ‘চলুন এটাই আমার রুম৷’ মুহিতের হাত পা যেন অকেজো হয়ে গেল৷ মুখ দিয়ে কথাও বন্ধ হয়ে গেছে ওর৷ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো৷ চোখের সামনে দেখল একটি টিয়া পাখি৷ খুব জোরে সেই পাখিটি ডেকে উঠল৷ মুহিতের মনে পড়েছে, এই টিয়া পাখিটি চৈতীকে উপহার দিয়েছিল৷

মুহিত তৎক্ষণাৎ এক বিভৎস হাসি শুনতে পেল৷ স্বাভাবিক ভাবে মানুষ এমন শব্দে হাসে না৷ সেই হাসির উৎসর দিকে তাকিয়ে, শরীরের শক্তি হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল মুহিত৷ ভয়ার্ত চোখে নিশির দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটি চৈতী৷ ওর নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে৷ গলায় ওড়না এত শক্ত করে পেচানো যে তা চামড়া খানিকটা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেছে৷ মুখের চামড়া উঠে যাচ্ছে৷ ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো, হাতের চামড়া নেই৷ শুধু মাংস৷

মুহিত বলল, ‘তুতুমি!’ চৈতী বিদঘুটে হেসে বলল, ‘প্রেগন্যান্ট হয়েছিলাম বলেই আমায় মেরে ফেলেছিলে৷ কিন্তু তুমি ভুলে গেছো মানুষ তার দুষ্কর্মের শাস্তি ইহকালেই পায়৷’ চোখের পলক ফেলার আগেই মুহিত দেখতে পেল চৈতীর মুখের চামড়া খসে মাংস বেরিয়ে এসেছে৷ পঁচা মাংসের গন্ধে ওর দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়৷ সেই বিভৎস চেহারা মুহিতের সামনে নিয়ে আসতেই জোরে এক চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো ও৷

রাত্রি সাড়ে এগারোটায় আফজাল হোসেন ৮৭নম্বর রুমের সামনে এলো৷ দরজায় অনেক কড়া নেড়েও কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ম্যানাজারকে দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো৷ দেখলো ফেনের সাথে ওড়না পেচানো মুহিতের ঝুলন্ত মৃত শরীর৷ গোটা রুমে পঁচা মাংসের গন্ধ ৷ পুলিশ এসে হোটেলের লোকদের জিজ্ঞাসা করতেই ওরা বলল, ‘মুহিত একাই এসেছিল৷ সঙ্গে কাউকে দেখেনি৷ একা একাই কিসব বিড়বিড় করছিলো৷’ ঘরে ঢুকলো কি করে পুলিশের এ প্রশ্নে আফজাল বলল, ‘আমিই খুলে দিয়েছিলাম দরজা৷ ভেবেছিলাম হয়তো কেউ পরে আসবে৷ কিন্তু কেউ-ই আসেনি৷’ পুলিশ সেই রুম সিলগালা করে দিল৷ এক জানালার অন্ধকার ঘরটা যেন গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেল৷ বাইরের আকাশে পূর্ন জ্যোৎস্না ফুটেছে ৷ সেই আলোতেও ঘরটির অন্ধকার দূর হল না ৷

( সমাপ্ত )

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত