যখন কেউ আমাকে পাগল বলে ।।
তার প্রতিবাদ করি আমি,
যখন তুমি আমায় পাগল বল…
তুমি আমায় পাগল বল….
ধন্য যে হয় সে পাগলামি…
ধন্য আমি ধন্য হে,
পাগল তোমার জন্য যে..
আজ প্রায় ছয় মাস পর গানটি শুনছিল নিঝুম। এক সময় খুব খুব পছন্দের ছিল গান টা, গত ছয় মাসে একবারের জন্যেও
গানটি মনে পড়েনি। কি এক ছলনার জালে যেন আটকে ছিল। আজ সন্ধ্যায় দোলার ছলনার সব জাল ছিন্নভিন্ন
হয়ে গেছে। তাইত আবার সেই গানটি মনে পড়ছিল খুব। গানের সাথে সাথে এই গানের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে থাকা মানুষটির কথাও মনে পড়ছে। তাই দু’চোখ বন্ধ করে ফুল ভলিউমে গানটি ছেড়ে দিয়ে ইজিচেয়ারে
বসে স্মৃতির পাতা হাতরে ফিরছে যেন। হাতের উপর নরম কোমল কিছু একটা এসে পড়ল। চোখ খুলতেই, চোখের
কোনে আলোর ঝলকানি সাথে বিকট আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগার। জানালার বাইরে চোখ রাখতেই
সব পরিস্কার হয়ে গেল। ট্রান্সমিটার টা গেল। সাথে সাথে তার গান শুনারও বারটা বাজল। প্রচন্ড বিরক্তি
নিয়ে তাকাল নিজের হাতের দিকে। সাথে সাথেই বিস্ফারিত নয়নে হাতের উপর পড়ে থাকা একটা হলুদ
গোলাপের পাপড়ি দেখতে লাগল। নাকেও এর সুবাস এসে লাগল। কিন্তু কি করে সম্ভব ! এটা আসল কোত্থেকে! এক
লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল । পাগলের মত ঘরের এদিক ওদিক চাইতে লাগল। কিন্তু বিদ্যুৎ বিহীন ঘরে শত
চেষ্টাতেও কিছুই নজরে এল না। শুধু সুবাস টাই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এবার কেমন অজানা আশংকায়
বুকটা কেপে উঠল। হঠাৎ মনে হল হালকা হলুদ আলোয় ঘরটা ভরে গেল। সে এক অন্যরকম পরিবেশ। নিজের ঘরটাকেই
বড্ড অচেনা লাগছে। কি হচ্ছে এসব! , ভাবতে না ভাবতেই ইজিচেয়ারটা হাল্কা দুলে উঠল। সাথে কাচের চুড়ির
রিনিঝিনি ছন্দময় মৃদু আওয়াজ ভেসে এল। কেমন একটা ভয়ে নিস্তব্দ নিঝুমের গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না।
অনেক চেষ্টায় কেমন ফ্যাসফ্যাসে সব্দে কোনক্রমে উচ্চারণ করল কে… কে ওখানে। এবার চেয়ার দোলা বন্ধ
হয়ে গেল। সেখান থেকে ভেসে এল অতি পরিচিত একটা কন্ঠ।
কেমন আছো নি?
কে কে তুমি?
নি আমায় তুমি চিনতে পারছো না? সত্যি চিনতে পারছো না! আমি যে তোমার হলুদ গোলাপের পাপড়ি গো। আজ
এতদিন পর মনে পড়ল আমায়? গলায় যেন একবুক অভিমান ঝরে পড়ল। নিঝুম চিৎকার দিয়ে উঠল। এ হতে পারে না সব ভুল, সব
মিথ্যা। তুমি বেঁচে নেই, তুমি কল্পনা।
হ্যাঁ, নি আমি সত্যি আমি, ছুঁয়ে দেখ।
নিঝুম ছিটকে সরে এল, ভয়ে শক্ত হয়ে গেল। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে পতন থেকে নিজেকে রক্ষা করল কোনরকমে।
মনে পড়ে, নি! এই গান গেয়েই তুমি আমার মন জয় করেছিলে। যখনই আমি তোমাকে পাগল বলতাম অমনি
তুমি সুরু করে দিতে গানটি। এক সময় এমন হল, গানটি শোনার জন্যই তোমাকে বেশি বেশি পাগল বলতাম। আর
তুমিও, কখনওই ক্লান্ত হতে না। তোমার সাথে সাথে এই গানটিরও প্রেমে পড়ে গেলাম। তাইত দেখ, যখন গান আর
তুমি একসাথে হলে আমিও ছুটে এসেছি তোমার কাছে।
— কি… কি চাও তুমি? কেন এসেছ ফিরে।
আমায় তুমি ভয় পাচ্ছ নি? এই আমাকে? একদিন আমিই না তোমার বেচে থাকার অবলম্বন ছিলাম। তুমি কি সব ভুলে
গেছ, আমার হলুদ গোলাপ পছন্দ ছিল বলে তুমি আমায় রোজ একটি করে হলুদ গোলাপ উপহার দিতে। এমনকি,
তুমিআমায় হলুদ গোলাপের পাপড়ি বলে ডাকতে লাগলে। তোমার দেওয়া নামের আড়ালে আমার দু’ অক্ষরের
নামটা যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তুমি সব শেষ করে দিলে! কেন নি?
— নিঝুম এবার হাটু গেড়ে দু’হাত জড়ো করে বলতে লাগল, কি চাও তুমি নিরা? কি চাও বল। নিঝুমের দু’চোখ বেয়ে
নামতে লাগল অনুতাপের অশ্রুধারা । আচ্ছা নি, বলতে পার দোলার মধ্যে কি এমন ছিল যা
আমাদের তিন বছরের সম্পর্ককে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিল। কি এমন দেখেছিলে যা আমার মধ্যে ছিল না। খুব
জানতে ইচ্ছে করে নি, খুব জানতে ইচ্ছে করে। জানো যেদিন আমি জানতে পেলাম তুমি তোমার মন থেকে
আমায় সরিয়ে সেখানে দোলা কে বসিয়েছ সেদিনি আমি নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে
ভাবলাম না তা কি করে হয়! তিন বছরের সম্পর্ক তো অতটাও ঠুনকো ছিল না যে হুট করে কেউ এসে ভেঙে দিয়ে
যাবে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, তোমার ফিরে আসার। তুমি আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলে। আমিও কম ছিলাম
না, সব সময় তোমার পিছনে লেগেই থাকতাম। একদিন তুমি খুব বকলে, তবুও আমি ক্ষান্ত হইনি।
মনে পড়ে, নি’ কলেজ থেকে ট্যুরের আয়োজন করা হল কক্সবাজার যাবে। আমি দারুন খুশি ছিলাম তোমাকে
কাছে পাব বলে, মনে ভয়ও ছিল তুমি যাবে কিনা। আমাকে অবাক করে দিয়ে তুমি আমার কাছে এসে ক্ষমা
চাইলে। বললে এমন ভুল আর হবে না। আমিও সরল মনে সব কিছু ভুলে গেলাম। কক্সবাজারে গিয়ে অনেক মজা
করলাম, একসাথে সূর্য অস্ত দেখলাম, মুক্ত কুড়োলাম। তুমি মালা বানিয়ে আমার গলায় পড়ালে। আহঃ কি দিন ছিল
তাই না? ঢাকায় ফেরার আগের দিন তুমি আমায় নিয়ে পাহাড়ে উঠলে। কি সুন্দর দৃশ্য, প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্য
ঢেলে সাজিয়েছিল আমার আর তোমার জন্য। তুমি আমার কাধে হাত রেখে শুধু বললে আমায় মাফ করে দিয়ো
নিরা। আমি অবাক হয়ে অনুভব করলাম আমি সুউচ্চ পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছি। এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে
চিৎকার পর্যন্ত দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। পড়তে পড়তেই শুনতে পেলাম তুমি একজন পাকা অভিনেতার মত চিৎকার
করে কান্না করছো আর সবাইকে ডাকছ। তুমি বলছিলে আমি নাকি পা পিছলে পড়ে গিয়েছি, আমি তখনো বেঁচে
ছিলাম জানো? আমি সব শুনতে পাচ্ছিলাম। উদ্ধার কর্মীরা যখন আমায় খুজে পেল তখন অনেক দেরি হয়ে
গিয়েছিল। আর আমার মৃত্যুর রহস্য তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানলো না।
— তুমি কি প্রতিশোধ নিতে এসেছো নিরা?
নাহ, আমি জোৎস্নাবিলাস করতে এসেছি। শুনেছিলাম তুমি আর দোলা নাকি জোৎস্নাবিলাস করতে। কই আমার
সাথে তো কখনো করনি। আমি জানিও না কিভাবে করে। দেখ আজ আকাশে রুপালি চাঁদ তার সমস্ত রুপ ঢেলে এই
অন্ধকার পৃথিবীকে অপরুপ সাজে সজ্জিত করেছে। চল যাই দু’জনে জোৎস্নাবিলাস করি।
নিঝুম যে কখন তার হলুদ গোলাপের পাপড়ির হাত ধরে ওদের পনেরতলা ভবনের ছাদের কার্নিশের ধারে এসে
দাঁড়িয়েছে তা ও নিজেও জানেনা। যখন ওর হুশ ফিরল, নিজেকে কার্নিশে আবিষ্কার করে প্রচন্ড ভয়ে স্তব্দ
হয়ে গেল। বাঁচার আকুতি নিয়ে নিরার দিকে চাইল। নিরা মুচকি হেসে ওর হাত ধরে ঝাপিয়ে পড়ল।
পাশের বাড়ি থেকে লোকজন কিছু পড়ার শব্দে ছুটে এল। রাস্তায় নিঝুমের রক্তাক্ত দেহটি পড়ে ছিল, আর
আশেপাশে ছড়ানোছিটানো ছিল অসংখ্য হলুদ গোলাপের পাপড়ি।.
…………………………………..সমাপ্তি……………………………..