রাত ১২টা। আফসার আলী এক যাত্রা মঞ্চ নাটক দেখে পাশের গ্রাম থেকে বাসায় ফিরছেন। যাত্রার অভিনয়টা ভাল লাগছে না তাই চলে আসলেন।
একটা বিস্তৃর্ণ প্রশস্ত মাঠ পাড়ি দিতে হবে। তারপরই ওনার গ্রাম এবং ওনার বাসা। অন্যদিক দিয়ে ঘুরে অন্যগ্রাম দিয়েও বাসায় যাওয়া যেত, কিন্তু
তাতে সময় অনেক বেশি নিতো। তাই সময় লাঘব করার জন্য এদিক দিয়ে আসা। মাঠটা পাড়ি দিতে ত্রিশ মিনিট লাগবে। এখন ওনার পরিচয়টা দিই।
আফসার আলীর বয়স ৪৭ বছর বয়স। কিন্তু দেখে মনে হবে এখনও অবিবাহিত বা সদ্যবিবাহিত। এখনও খুব সুস্থ, সবল আছেন যুবকদের মতো।
গ্রামে ওনার অনেক নামডাক আছে। ওনার ২/৩টা আড়ত আছে চাল, ডাল, মসলার। এককথায় গ্রামের মধ্যে ওনি খুব সচ্ছল। শুধু সচ্ছর বল্লে ভুল হবে।
ধনী বলা যায়। ওনার একটামাত্র ছেলেই আছেন, যার নাম ফয়সাল। ছেলেকে বিএ পর্যন্ত পড়িয়েছেন। যদিও ওনার ছেলের বয়স এখন পঁচিশ তারপরও
এখনি তাকে বিয়ে করিয়ে নিতে চান। কারন ওনার সময় তো ১৭/১৮ বয়সেই ওনার বাবা ওনাকে বিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। তাছাড়া আফসার আলী খুব
তাড়াতাড়ি ওনার নাতি/নাতনীর মুখ দেখতে চান তাই ওনার ছেলেকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করানোর চিন্তা। ওনার ছেলের জন্য মেয়ে ঠিকও হয়ে গেছে।
কয়েকদিনের মধ্যে বিয়ে করিয়ে পুত্রবধূ ঘরে তুলবেন। ওনি একটা মস্তবড় চওড়া রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। রাস্তার বামপাশে সম্পূর্ণটা মাঠ, আর ডানপাশে বিল।
বিল হলে কি হবে এই শুষ্ক মৌসুমে বিল শুকিয়ে গেছে প্রায়। ওনি ভয় কি জিনিস জানেন না। তারপরও কেমন যেন একটা ভয় লাগছে, ঘা টা একটু
ছমছম করছে। কারন ওনি যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন তার থেকে বামপাশে কিছুটা দূরে বড় একটা কৃষ্ণচূরা গাছ আছে। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছেন
ঐগাছে নাকি পরীরা থাকে। মাঝরাতে কেউ এদিক দিয়ে গেলে দেখতে পায়, মাঝে মাঝে গান শুনতে পায় বা নূপুরের আওয়াজ। ওনি যদিও এসব আগে
বিশ্বাস করতেন না, কারন ওনি এ রাস্তা দিয়ে যাননি রাতেরবেলা কখনো। হঠাৎ আজ যাচ্ছেন তো তাই এসব কথা মনে পড়াতে কিছুটা ভয় ভয় লাগছে,
তারপরও ওনি আবার একা। তাছাড়া ওনি
ছোট থেকে শুনে এসেছেন যে সুন্দর ছেলেদের প্রতি নাকি পরীদের আকর্ষন বেশি থাকে। মাসাল্লাহ ওনি তো অনেক সুন্দর। এসব ভাবছে আর ভয় করছে।
ওনি এখন নিজেকে মন মনে গালি দিতে লাগলেন কেন ওনি এ রাস্তা দিয়ে এসেছেন? ঐ রাস্তা দিয়েই যেতেন গ্রাম ঘুরে, হোক সময় কিছুটা বেশি লাগত।
নাহয় যেখানে গিয়েছেন সেখানেই বসে থাকতেন, সকালে বাসায় আসতেন। ওনি এসব ভাবছেন হঠাৎ তখনি নূপুরের আওয়াজ শুনলেন।
খুব মিষ্টি আওয়াজ, ভিন্ন তাল। ওনি ওনার চারপাশে তাকালেন। কিন্তু কেউ নেই তো। হঠাৎ একটা মেয়েলি মিষ্টি গানের গলা শুনলেন। মনেহয় ঐ
কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকেই হয়তো ভেসে আসছে। ওনি ওদিকে তাকালেন।
ভয় পেয়ে গেলেন কিছুটা। দেখলেন গাছের আগাতে মগডালে একটা মেয়ে বসা সাদা কাপড় পরা। চোখ নামিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটা দিলেন।
কি মনে করে যেন আবার ঐদিকে চোখ চলে গেল। দেখল মেয়েটি নৃত্য করতেছে গাছের আগার ছোট ছোট ডালগুলোর উপরই। ভয় পেয়ে গেলেন।
ওনি জোরে দৌড় দিলেন। দৌড় দিয়ে সামনে কিছুটা গভীর একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেলেন। ওনি উঠার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারতেছেন না তেমন।
কারন খুব ভয় পেয়েছিলেন তো তাই এখনও ওনার হাত-পা কাঁপতেছে। এমনিতেও গর্তটা ওনার বুক পর্যন্ত গভীর। ওনি খুব চেষ্টা করে হাতের নখ দিয়ে
মাটি আছড়িয়ে ধরে কিছুটা উপরে উঠার চেষ্টা করছেন, এবং খুব
ঘামতেছেন। হঠাৎ কে যেন একটা হাত বাড়িয়েদিল ওনাকে। খুব সুন্দর সে হাত। দুধের মতো ফর্সা। কিন্তু ওনার এসব খেয়াল নেই কে হাত বাড়িয়ে দিল
এবং এত সুন্দর কেন? এমনকি ওনি ঐ হাতের ব্যাক্তিটির মুখের দিকে তাকাননি। কারন ওনার এতকিছু মাথায় কাজ করছেনা। ওনার শুধু উপরে উঠে
আসা আগে জরুরি। ওনি হাতটা ধরলেন। হাতের ব্যক্তিটিই ওনাকে টান দিয়ে উপরে তুলে নিয়ে আসলেন। ওনি উপরে উঠে ধন্যবাদ দিয়ে ব্যক্তিটির
মুখের দিকে তাকালেন। মনেহয় কারেন্টের শক খেলেন। দুধের মতো ফর্সা মুখটা, মুখের গড়ন খুবই সুন্দর। মানুষ এত সুন্দর হয় নাকি? সম্ভব না।
ভয় পেয়ে গেলেন এবং খুব ঘামতে শুরু করলেন। ঘামে ওনার শার্ট ভিজে গেল
সম্পূর্ণ। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল—-
: কে আপনি? আর আমাকে টেনে তুললেন কেন?
: আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার পরী। তুমি বিপদে পড়েছ আর আমি তোমাকে সাহায্য করবো না? তোমাকে দেখেই যে ভালবেসে ফেলেছি।
: প..প..পরী….? (ভয়ে ভয়ে বল্লো)
বলেই একটা দৌড় দিল আফসার আলী। পেছন থেকে শুনতে পেলেন ঐ মেয়েলী কণ্ঠটি ভেসে
আসছে——যেয়ো না… যেয়ো না। দাঁড়াও। দাড়াও একটু।
আফসার আলী আরো জোরে দৌড়ানো শুরু করলো। ২০ মিনিটের রাস্তা যেন ১০ মিনিটেই দৌড়ে শেষ করে ফেল্লেন।
বাসায় এসে জোরে শরিফা নাম নিয়ে জোরে ডাক দিয়েই মাটিতে পড়ে যান। ওনার স্ত্রী ও সন্তান ফয়সাল দৌড়ে বাহিরে আসলেন। বাহিরে এসে ওনার
স্বামীর এই অবস্থা দেখে শরিফা বেগম জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? প্রত্যুত্তরে আফসার শুধু
বল্লো—- প..প..পরী।
এটা বলেই অজ্ঞান হয়ে যান। ওনার ছেলে এবং স্ত্রী ওনাকে ধরে ঘরে নিয়ে যান। ওনার স্ত্রী ওনার শার্ট টা খুলে অন্য একটা শার্ট পরিয়ে দিলেন।
আর সবাই ওনার জ্ঞান ফিরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ফিরছে না। খুব জ্বর আসলো। জ্বর এবং ঘুমের ঘোরে কি যেন প্রলাশ
বকছিলেন মাঝে মাঝে।
পরেরদিন সকাল হয়ে গেল কিন্তু আফসার আলীর জ্ঞান ফিরছে না, জ্বরও কমতেছে না। একবারের জন্যও চোখ খুলেননি।
চোখ বন্ধ রেখেই মাঝে মাঝে অস্পষ্টভাবে কি যেন প্রলাপ বকছেন। সকালে ডাক্তার বাসায় আনা হল। ডাক্তার ইনজেকশন দিলেন কিন্তু
জ্বরের কোন পরিবর্তন নেই। তারপর কয়েক ঘণ্টাপর আবার স্যালাইন লাগালেন কিন্তু কোনভাবেই জ্বর কমছে না। ডাক্তারের যা যা ব্যবস্থা
নেওয়ার জ্বর কমানোর এবং জ্ঞান ফিরানোর সব চেষ্টায় করলেন। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছেনা। পাড়ার মসজিদের ইমামকে এনে
ঝাড়-ফুক করালো কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। দুপুর প্রায় শেষ। সবার টেনশন বেড়ে গেল। আফসার আলীর আরেক ভাই আজিজ ঢাকা থাকেন
ওনিও এই খবর শুনে চলে আসলেন তার ছোট ভাইকে দেখার জন্য। হঠাৎ শরিফা বেগমের স্মরণ হলো– আরে হ্যা। একজন তো আছে যে
হয়তো ওনার স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন। তাদের গ্রামের শেষের দিকে একটা মাজার আছে। হাজী করিমুল্লাহ শাহ- এর মাজার।
ওনার শ্বশুর থাকতে শুনতেন ঐ হাজী নাকি অনেক কামেল ছিল। কিন্তু ঐ মাজার এখন মানুষের কতটা কাজ দেয় তা ওনি জানেন না।
কিন্তু ঐ মাজারে একজন খাদেম আছে ওনি নাকি কোরআনের হাফেজ। নাম শহিবুল্লাহ। অবিবাহিত। ওনার ছেলের দুবছরের বড় হবে।
ঐ ছেলে জ্বীন, পরী এসব নাকি তাড়াতে পারে। অনেকেই যায়। আর ঐ খাদেম যেহেতু কোরআনের
হাফেজ এবং কিছুটা তর্জমাও জানে কোরআনের তাই অনেক কিছুই করতে পারেন। ঐ ছেলে এতকিছু জানে তারপরও কেন জানি কোন
মসজিদ বা মাদ্রাসায় ইমামতি বা বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ নেয় না। এই মাজারের খাদেমের কাজ করে। কেন করে কেউ তা জানেনা।
তবে খাদেম নাকি খুব ভালো, মনপ্রাণ দিয়ে মানুষদেরকে সাহায্য করে। ওর কথা মনে হওয়ার ওর কাছে একবার নিয়ে দেখার কথা ভাবলেন
শরিফা বেগম। বিকাল হয়ে গেছে। শরিফা বেগম তার ছেলে ফয়সাল এবং ফয়সালের জেঠোকে নিয়ে ওনার স্বামিকে নিয়ে ঐ মাজারের উদ্দেশ্যে
রওনা দিল। মাজারটা অনেকটা নিরব জায়গায়। পরিবেশটা অনেক নিরব, তবে মনোরম। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মনেহয় ঐ খাদেমই পরিষ্কার
করে রাখেন। কারন এখানে অতিরিক্ত কেউ নেই এসব কাজ করার জন্য। মাজারের এরিয়াটা মেডিয়াম কিছুটা বড়। মাজারের চারেপাশে বাঁশের
বেড়া দেওয়া। মাজারের বামপাশে একটা বড় ও খুবই পুরনো একটা বটগাছ। মাজারের পিছন সাইড এবং বাম সাইডটা সম্পূর্ণ টিনের বেড়া।
মাজারের সামনে বাঁশের বেত দিয়ে বানানো একটা গেইট আছে। প্রত্যেক বাঁশের বেড়ায় বিভিন্ন কালারের রং দিয়ে সুন্দর করে আড়াআড়িভাবে রং দেওয়া।
ওদের রিক্সা মাজারের গেইট দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। খাদেম তাদেরকে দেখে বল্লেন—-
: কি সমস্যা?
: কি সমস্যা সেটা আপনি দেখেই বলেন? আর ওনাকে দয়া করে ভাল করে তুলেন। যত টাকা লাগবে দিবো… ( কাঁদতে কাঁদতে বল্লো শরিফা)
: টাকা দিয়ে সব হয়না মা। আর আমার এত টাকার দরকার নেই। যেমনটা আছি তেমনটায় ভালো।
এক কাজ করেন আপনারা এই শীতলপাটিটাতে শুইয়ে দিন ওনাকে। তারপর আমি দেখছি। তারা শুইয়ে দিল।
খাদেম আফসার আলীকে খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর
বল্লেন—
: আপনার স্বামীকে তো পরীয়ে ধরেছে।
: কি? পরী! (সবাই অবাক হয়ে গেলেন এবং সমস্বরে বলে উঠলেন)
: হুম। এবং খুব ভাল করেই ধরেছে। তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুবই কঠিন।
: প্লিজ বাবা, তুমি আমার স্বামীকে ভাল করে দেও। চিরকৃতজ্ঞ থাকবো তোমার প্রতি।
(কান্নাভেজা কণ্ঠে এসব বলতে বলতে খাদেমের পায়ে ধরার উপক্রম হচ্ছিলেন শরিফা বেগম।)
: ছিঃ ছিঃ কাকিমা কি করছেন আপনি? আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
কাদেম কি যেন পড়ে আফসার আলীকে ফুঁ দিলেন এবং পানি পড়ে তা আফসার আলীর শরীরে
এবং চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিলেন। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরতে লাগল আফসার আলীর। ওনি
চোখ মেলে তাকালেন। কিন্তু তখনও কিছু বলছেন না। খাদেম ছেলেটি বল্লো—
: কাকিমা, আপনার স্বামীর জ্ঞান ঠিকই ফিরেছে। কিন্তু কথা বলতে একটু সময় নেবে। ওনি
এখনও প্রচন্ড ঘোরের মধ্যে আছে। আস্তে আস্তে সময় যাবে আর ওনার ঘোর কমতে থাকবে। ঠিক
তিনদিন পর সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত হয়ে যাবে।
: ওহ আচ্ছা।
: তবে আরেকটা সমস্যা আছে।
: কি?
: পরপর তিন রাত আপনার স্বামীকে সাবধানে রাখবেন। এখন তো পূর্ণিমা রাত। আর পূর্ণমার রাতেই পরীদের আনাগোনা বেশিই থাকে।
আর আপনার স্বামীর প্রতি যে পরীর দৃষ্টি পড়েছে সে এসে আপনার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এই তিনদিন যদি না নিয়ে যেতে
পারে তো আর পারবেও না। তাই এ তিন রাত জেগে হলেও ওনাকে পাহাড়া দিবেন। ভুল করে হলেও যেন ওনি রাতেরবেলা বাহিরে না বের হয়।
রাত ১০ টার পরই থেকেই দেবেন না ফজরের আজানের পূর্ব পর্যন্ত। ওনাকে কিন্তু যেকোনভাবে বাহিরে বের করাতে চাইবে। আর দরজা,
জানালা বন্ধ রাখবেন রাতেরবেলা।
: আচ্ছা।
খাদেমকে যা দেওয়ার তা দিয়ে ওরা চলে আসলো। শরিফা বেগম রাত জেগে ওনার স্বামীকে পাহারা দেন। প্রথমদিনের রাতেরবেলা ফয়সালও
পাশে ছিল। কিন্তু ২য় দিন শরিফা একাই ওনার স্বামীকে পাহাড়া দেন। ৩য় দিনও ওনি একায় ছিলেন। আগের দুরাতে নির্ঘুম ছিল তো তাই কিছুটা
ঘুমিয়ে পড়লেন বসা অবস্থায়ই। রাত তখন ১টা। হঠাৎ আফসার আলী যেন শুনতে পারলেন কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন। তাকিয়ে দেখলেন
ওনার স্ত্রী ঘুমে। তাই ওনি ভাবলেন ওনিই গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়ে আসুক, তার স্ত্রীকে জাগাতে হবেনা। ওনি নিচে নেমে আসলেন। ওনি ভাবলেন
হয়তো ওনার ভাই এসেছে। ওনার ভাই মাঝে মাঝে এতরাতেই আসে। দরজা খুল্লেন। সাথে সাথে ছুঁ মেরে ওনাকে নিয়ে উড়ে চলে যেতে লাগল পরী।
এদিকে ওনার স্ত্রী ঘুম ভেঙ্গে যায়। রুমে ওনাকে না পেয়ে নিচে চলে আসেন। দরজা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখেন ওনার স্বামীকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
ওনি চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।
ফয়সাল শরিফা বেগমকে ঘরে নিয়ে যায়। তারপর পানি ছিটা দেই। তারপর ওনার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফেরার পর ওনার স্বামীর কথা মনে
হতেই আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। সকাল হতেই পাড়ার সব মানুষ ঝড়ো হয়ে গেল ওনার কান্নাকাটিতে। সবাই ওনাকে সান্ত্বনা
দেওয়ার চেস্টা করলেন কোন লাভ হচ্ছেনা। বার বার ওনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। অবশেষে দুপুর গড়াতেই ওনি ওনার ছেলেকে নিয়ে সেই মাজারের
খাদেমের কাছে গেলেন। খাদেম ছেলেটি সবকিছু শুনে খুব রাগারাগি শুরু করল প্রথমে। কিন্তু পরে মায়ের বয়সী মহিলার কান্নাকাটি দেকে
মনটা গলে গেল। তারপর বল্লেন—-
: আমি আপনার স্বামীকে ফিরিয়ে আনবো। তবে ওনার ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র লাগবে আমার।
: কি কি জিনিস লাগবে, বাবা? বল আমাকে সব আনবো।
: ওনার সর্বশেষ ব্যবহার করা কাপড়, যেটা ধোয়া হয়নি এখনও। মানে যেটাতে এখনও ওনার
ঘামের দাগ লেগে আছে। আর ওনার খুব প্রিয় ব্যবহৃত কিছু কাপড়।
: হুম সবকিছুরর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওনি ঐদিন রাতে বাসায় ফেরার দিন যে শার্টটা পড়েছিল
সেটা এখনও ধোয়া হয়নি। আর ওনার প্রিয় জিনিসগুলোও আনতে পারবো।
: আচ্ছা। তবে আরেকটা সমস্যা আছে।
: কি?
: ওনাকে ফেরত পেতে হলে আপনার পরিবারের কাউকে তার জীবনের রিস্ক নিতে হবে। হয়তো
সাথে সাথে কোন ক্ষতি হবেনা, তবে পরবর্তীতে হতে পারে।
: আমি নিবো। আমার বাবাকে ফেরত পেতে আমিই নিবো রিস্ক। (ফয়সাল)
: না আমি নিবো। তোর জীবন পুরাটায় বাকি আছে। বরং আমি তো অনেকটা বৃদ্ধ হয়েই গেছি।
(শরিফা)
: আচ্ছা তো আমাকে ১দিন সময় দেন। আমাকেও একটু গুছিয়ে নিতে হবে সবকিছু। অনেক কিছু
আয়ত্ব করতে হবে আমাকে এই একদিনের মধ্যেই।
: একদিনে পারবে তো? নাকি আরো সময় নেবে?
: না কাকি মা। এতে কাকুর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সময় নিলে। কারন পরীরা কাউকে নিলে
তাকে বিয়ে করে ফেলে অনেকক্ষেত্রে, যদি তাদের খুব পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে। আর যদি
বিয়ে করে নেয় তো আর কখনো ফেরত আনা সম্ভব না।
: না এমনটা হতে পারেনা। আমি আমার স্বামীকে ফেরত পেতে চাই যেকোন মূল্যে। তুমি
তাড়াতাড়িই করো সবকিছু তাহলে।
: আচ্ছা। তো আপনারা আগামিকালকের পরেরদিন রাতে চলে আসবেন সবকিছু নিয়ে।
: আচ্ছা।
: তবে হ্যা। জীবনের বাজি নিতে হবে কিন্তু। ভয় পেলে কিন্তু হবেনা।
: না আমি ভয় পাবোনা। আমার স্বামীর জন্য সব পারবো। ওর ভালবাসায় আমাকে অভয় দিবে।
আচ্ছা তো এখন আসি?
: আচ্ছা আসেন।
।
ঐদিন সন্ধ্যায় ফয়সাল, ফয়সালের মা, ফয়সালের জেঠো এবং আরো অনেকে গেল ঐ মাজারে মহিবুল্লাহ খাদেমের কাছে।
খাদেম বল্লো আপনারা অপেক্ষা করুন গভীর রাত হলেই আমি আমার কাজ শুরু করতে পারবো। এর আগে সবকিছু আমি গুছিয়ে
নিতে হবে। ফয়সালকে বল্লো একব্যাগ ময়দা আনতে এবং একটা কাঠের চেয়ার জোগাড় করে আনতে। ফয়সাল আনলো। ময়দা দিয়ে
প্রথমে একটা বড় বৃত্ত বানালো। তার থেকে ৬/৭ ফুট দূরে প্রথম বৃত্তের সামনে আরেকটা বৃত্ত বানালো। প্রথম বৃত্তটার চেয়ে অনেকটা
ছোট বৃত্ত। ছোট বৃত্তটার মাঝখানে চেয়ারটা বসিয়ে দিল। প্রথম বৃত্তটার সামনে একটা আগুনের কুন্ডলি বানালো। কিছু কাঠের রেখে
তাতে আগুন ধরিয়া দিল। আগুন কিছুটা উপরে একটা ছোট মাচা বানিয়ে সেখানে আফসার আলীর শার্ট এবং তার প্রিয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র
রেখা দিল। তারপর প্রথম বৃত্তটাতে শরিফা
বেগমকে বসতে বল্লো। কিন্তু তার আগে কিছু কথা বলে নিলো—-
: কাকিমা আপনি যে এখানে বসবেন আপনার প্রতি আপনার স্বামীর প্রর্যাপ্ত মনের টান এবং
ভালবাসা আছে তো?
: হুম অবশ্যই আছে। আমি ওকে যতোটা ভালবাসি সে আমাকে তারচেয়ে বেশি ভালবাসে।
: আর একটা কথা। আপনি এি বৃত্ত থেকে কোনভাবেই বের হবেননা কাজ মেষ হওয়ার আগে,মানে আপনার স্বামীকে ফেরত পাওয়ার পূর্বে।
আপনি যদি এই বৃত্তের বাহিরে চলে যান তোআপনি তো মরবেনই, আমিও মরবো, সবাই মরবে এমনকি আপনার স্বামীকে আর ফেরতও পাবেন
না। আমি যতোক্ষণ না বলবো উঠবেন না।
: আচ্ছা।
: আপনাকে কেউ ডাকলেও না। আপনার কাছের কেউ ডাকলেও না।
: আচ্ছা।
: আপনি কিন্তু ভয় পাবেন না। আমি তো আছিই।
: আচ্ছা।
শরিফা বেগমকে প্রথম বৃত্তটাতে বসিয়ে দিল। ওনাকে একটা আরবি লাইন বলে দিল। বল্লোচোখ বন্ধ করে শুধু এটায জপে যেতে।
ওনি তাি করতে শুরু করলেন। আর অন্যদের বল্লো সরেপড়তে, কোথাও লুকিয়ে পড়তে। অন্যদের ক্ষতি করতে পারে। সবাই চলে গেল। ফয়সাল
মহিবুল্লাহকে বল্লো—-
: আপনার কি হবে? যদি আপনার ক্ষতি করে দেই?
: না পারবে না। এইযে আমার হাতের এই লাঠিটা দেখেছ? এটা আমার কাছে থাকলে কিছু
করতে পারবে না। এটা হচ্ছে এই হাজী পীরের লাঠি। এটা যে কারোর সাথে থাকলে কোন
অশুভ শক্তি কোন ক্ষতি করবে না।
: আর এই আগুনের উপর যে বাবার জিনিসপত্র রেখেছেন?
: আগুনের উত্তাপ যত এসবে লাগবে ঐখানে তোমার বাবাও তেমনি ঘামতে থাকবে এবং শরীরে
জ্বালাপোড়া শুরু হবে।
: তাহলে বাবার কষ্ট হবেনা?
: এটায় ব্যবস্থা তোমার বাবাকে আনার। কারন এখন তোমার বাবার ঐখানে হুশ নেই। তাই সে
এখানে ফিরে আসার। কথা বলবেও না। যখন ওনার শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হবে, চিৎকার শুরু
করবে তখন বাধ্য হয়ে পরী তাকে নিয়ে আসবে।
: সত্যি বলছেন?
: হুম।
ফয়সালও অন্যদের সাথে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আর খাদেম নিজেও একটা চেয়ার নিয়ে শরিফা বেগমের বামপাশে
একটু দূরে বসে পড়লেন।
এভাবে ৩০ মিনিট কেটে গেল। ১২:৩০ বাজে। হঠাৎ তখনি হঠাৎ করে সেই ছোট বৃত্ততে রাখা চেয়ারটায় আফসার আলী বসে পড়লেন।
পরীই এনে ওনাকে সেটাতে বসালেন এবং চেয়ারের পেছনে পরী দাঁড়িয়ে রইল। এখনও আফসার আলীর হুশ নেই। মাথা নিচু করে বসেই আছেন।
হঠাৎ পরীই শরিফা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠল—-
: এই বুড়ি দেখ আমি তোর স্বামীকে নিয়ে এসেছি। নে তোর স্বামীকে নিয়ে যা।
এই কথা শুনে শরিফা চোখ খুলে দেখে তার স্বামী সামনের চেয়ারে বসা। ওনি আনন্দে উঠে
দাঁড়ালেন তার স্বামীর কাছে যাবে হলে। ঠিক তখনি খাদেম বলে উঠলেন—-
: কি করছেন কাকিমা? ভুলে গেছেন? ইচ্ছে করে মরতে যায় কেউ?
শরিফা বেগম বসে পড়ল। তখনি পরী খাদেমের দিকে ঘুরে তাকালো। তারপর তাকে বল্লো—
: ওহ তুই তাহলে সব নষ্টের মূল? তোর জন্যই আমাদেরকে আসতে হয়েছে। তোকে তো ছাড়বো না।
আমাদের বিয়ের আয়োজন থেকে আমাদেরকে আনানোর জন্য তোকে ছাড়বো না।
: আমাকে তুই কি করবি তা পরেই দেখা যাবে। তার আগে বল দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে ওনাকে
কেন ধরলি?
: ওকে ভাল লেগেছে তাই। আর ওকে আমি বিয়ে করবো।
: ওকে ছেড়ে দে। নাহয় তোকেই এখানে আটকিয়ে রাখবো এই বৃত্তের মধ্যেই।
: না। আমি ওকে ছাড়বো না। আর তুই আমাকে আটকাতে পারবি না। কারন আমি পরীর রাজ্যের
রাজকন্যা। তাই তুই আটকালে আমার রাজ্যের সবাই চলে আসবে আমাকে বাঁচাতে।
: কিন্তু তোকে ওকে ছেড়ে দিতে হবে। নাহয় আমি তোকে আপাতত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা
আমার জানা আছে।
: না আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। ওকে আমি বিয়ে করবো।
: আর কথা বাড়াস না। তুই এখন যা। নাহয় আমি কিন্তু তোকে এখন ছাড়ছি না। (এটা বলেই একটা ছোট ব্যাগ থেকে ওনি কিসের ছোট
একটা পলিথিন ব্যাগ থেকে বালু টাইপের কিছু বের করলো। এটা দেখেই পরী কিছুটা ভীত হয়ে গেল। কারন ঐ মাটি পরীর দিকে
ছোড়ে দিলে পরী অন্ধ হয়ে যাবে এখন)
: আচ্ছা তো আমি এখন চলে যাচ্ছি। তাই বলে চিরদিনের জন্য যাচ্ছিনা। আমি আবার আসবো।
বার বার আসবো। আমার ভালবাসায় মানুষটাকে আমার করে পেতে যা যা করার সব করবো।
আমি আরো বেশি শক্তি নিয়ে আসবো পরে আসলে। তখন তুই কিছুই করতে পারবি না।
: ওকে তুই কখনো তোর নিজের করে পাবিনা।
: না পেলে সব ধ্বংস করে দেবো। একে একে সবার জীবন ছিনিয়ে নিবো। ওর বংশ নির্বংশ
করে দিবো। আমি এখন থেকে সব সময় আসবো। আমাকে স্মরণ করলেও আসবো, না করলেও
আসবো, আমার নাম নিয়ে স্মরণ করলেও আসবো।, প্রতি বছর এ সময়ে আসবো। আর ওকে না পেলে
ওর কাছ থেকে আমি সবকিছু কেড়ে নিবো। ( চিৎকার করে এসব বলছিল পরী।) তারপর চলে গেল
পরী। খাদেম বল্লো—-
: এখন আপনার স্বামী বিপদমুক্ত। কিন্তু সম্পূর্ণ না। পরীর শেষ কথাগুলো তো শুনেছেনই।
: হুম।
আফসার আলীর তখনও জ্ঞান ফিরেনি। ফয়সাল এবং সবাই মিলে ওনাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে
গেলেন। শরিফা বেগমকে খাদেম একটু থাকতে বল্লেন। খাদেম একটা তাবিজ বানিয়ে দিয়ে
ওনার হাতে দিয়ে বল্লেন—-
: কাকিমা এই তাবিজটা কাকুর বাম হাতে বেঁধে দিবেন। দেখবেন পরী কাকুকে নেওয়া তো
দূরের কথা কাকুকে স্পর্শও করতে পারবে না।
: আচ্ছা।
: আর শুনেন।
: হুম। বলো বাবা।
: আপনারা খুব সাবধানে থাকবেন। ও আপনাদের অনেক ক্ষতি করার চেষ্টায় থাকবে। আর একটা
কথা, আপনারা কখনোই পূর্ণিমা রাতে ঘরের বাহিরে যাবেন না, পরিচিতি এবং অপরিচিত
কেউ ডাকলেও না। আর আপনারা প্রত্যেক পূর্ণিমাতে রাত ১০টার পরই দরজা জানালা বন্ধ
করে রাখবেন।
: আচ্ছা বাবা। তুমি আমাদের অনেক বড় উপকার করেছ। তাই আমরা খুব কৃতজ্ঞ। আর তুমি
সাবধানে থেকো। কারন সে তোমারও ক্ষতি করতে পারে।
: হুম আন্টি। আমি সাবধানেই থাকবো।
: আচ্ছা বাবা। পরীটাকে কি কোনভাবেই রুখা যায় না।
: না কাকিমা। ওর জায়গায় যদি অন্যকোন পরী হতো তাহলে কিছু করা যেত। তারন আমার কাছে
কিছু শক্তিশালী পরী আছে। ওরা কিছু করতে পারতো। কিন্তু ও তো পরীর দেশের রাজকুমারী
তাই ওকে কেউ কিছু করার সাহস নেই। শুধু আপনারা সাবধানে থেকেন। আর যা বল্লাম মেনে
চলবেন।
: আচ্ছা।
শরীফা বেগম বাসায় চলে গেল। কিছুদিন লেগে গেল আফসার আলীকে সুস্থ হতে। গ্রামের সবাই এসে ভীড় জমায় প্রতিদিন পরীর
দেশের গল্প শুনতে, ওনি কি কি দেখেছে ঐসব শুনতে, পরীর ঐখানে ওনাকে কিভাবে রেখেছিল এবং কি কি খেতে দিয়েছিল এসব
জানতে। ওনাকে ঘিরে যেন গল্পের আসর বসে যেত। ওনি তখন ওনার প্রত্যক্ষ দেখা পরীর দেশের গল্প শুনাতেন। ওনি অল্প সময়ই
তো ছিলেন সেখানে। তারপরও এই স্বল্প সময়ে যা যা দেখেছেন তাই বলতেন। বলতেন—- ওনাকে যখন পরী কিভাবে কি করে নিয়েছিল
তা ওনি জানেন না। কারন তখন ওনার কোন হুশ ছিল না। ওনাকে যখন বাহির থেকে শুধু ছোঁ মেরে নিয়েছিল ততোটুকুই মনে আছে। ওনার
যখন জ্ঞান আসলো তখন ওনি নিজেকে আবিষ্কার করলো তুলোর মত এক নরম বিছানায়। চারেপাশে অনেক পরীরা অবাক হয়ে ওনাকে
দেখছিল। হঠাৎ ওনার মাথার পাশে একটা পরীকে দেখল যে কিনা ওনার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। এই পরীটা অন্যান্য
পরীগুলোর চেয়ে বেশি সুন্দরী ছিল। ওনার সামনে একটা সুন্দর কারুকাজ করা সুন্দর একটা চেয়ারে একটা বয়স্ক পরী বসা ছিল। তার
মাথার পাশে বসা পরীটার সাথে হেসে হেসে বয়স্ক পরীটা কি যেন বলছিল। কো বলতেছিল সেগুলো যেন ওনার মাথায় ডুকতেছেই না। মনে
হচ্ছে ওনি বধির হয়ে গেছে। অন্যান্য পরীরা এই বয়স্ক পরীটাকে বাতাস করছিলেন। শুধু বয়স্ক পরীটাকে না, ওনাকে এবং ওনার পাশে বসা
পরীটাকেও বাতাস করছিলেন। কিন্তু ওনি নিজে কে? কি নাম তার? এখানে কেন? কিভাবে এখানে আসলেন? এসব কিছুই মনে পড়তেছে না।
কেমন যেন জ্ঞানহীন, আনভুলা মন হচ্ছিল নিজেকে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। কিছুই ওনার মন পড়ছিল না। ওনি যেন কোন
কথাও বলতে পারতেছিলেন না, বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। কিভাবে কথা বলতে হয় সেটায যেন ওনার মনে পড়ছিল না। হঠাৎ ওনার মাথার কাছে
বসা সেই সবচেয়ে বেশি সুন্দরি পরীটি ওনার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে গেলেন। আহ! কি শীতল মনোরম স্পর্শ! প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যায়! পরীটা
তাকে সুন্দর একটা ফুল বাগানে নিয়ে গেল। কি সুন্দর রং-বেরংয়ের ফুল সেখানে। ওনি শুধু অবাক নয়নে দেখছিলেন। পরীটা যেন আরো কি কি
বলছিল ওনার সাথে কিছুই যেন ওনি শুনতে পাচ্ছেন না। পরীটা অনেকগুলো ফুল পেড়ে আমার হাতে দিল। আমি হাতে নিলাম। কেন নিলাম,
আর এই ফুল দিয়ে কি করবো? কিছুই মাথায় আসছিল না, আমি স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পরীটা আমাকে হাতে ধরে টান দিয়ে নিয়ে একটা
দোলনায় বসালো। দোলনাটার চারিপাশেও ফুল দিয়ে সাজানো। পরীটা আমাকে নিয়ে দোল খাচ্ছিল। হালকা বাতাস বইছিল। পরীর ঘন কালো কেশ
আমার চোখেমুখে এসে পড়ছিল। সত্যিই খুব ভাল লাগছিল। তারপর পরীটা আমাকে একটা ফলের বাগানে নিয়ে গেল। সব ধরনের ফলের গাছই ছিল
সেখানে। খুব ভাল লাগছিল। পরী কিছু ফল পেড়েও আমাকে খেতে দিল। কিন্তু কিভাবে খাব বা কি করে ফল দিয়ে তাযেন ভুলে গেছি। হঠাৎ পরীই
কিছু আঙ্গুর হাতে নিয়ে জোর করে আমার মুখে দিয়ে দিল। অসাধারণ মিষ্টি ছিল সেগুলো। সে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিল আর নিজেও খাচ্ছিল মনের
আনন্দে। তারপর আমাকে পরী একটা নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। নদীর পাড়ে পাথরের উপর বসল আমাকে নিয়েই। স্বচ্ছ পানির ঢেউ আসছিল। কিছু
পানির ঢেউ যেন আমাদের পা ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে অনেক কিছুই দেখাচ্ছিল। পূর্নিমার চাঁদ এবং আকাশও দেখছিল আসাকে নিয়ে। আমি
একটা কথাও বলিনি। ও সারাক্ষণই কি যেন বকবক করে গিয়েছে, হেসে হেসে কথা বলছিল আমার সাথে। কিন্তু ওর কোন কথায় আমার কান পর্যন্ত
পৌঁছায়নি। রাতে যখন আমার ঘুম পেতো সে আমাকে সেই নরম তুলোর বিছানায় নিয়ে যেতো আমি ঘুমানোর জন্য। সে আমার মাথায় আলতো করে
হাত বুলিয়ে দিত আর সাথে সাথে আমার ঘুম চলে আসতো। আমি যে রাতে এখানে চলে আসি সেদিন দিনেরবেলা যেন কিসের আয়োজন চোখে পড়ল।
পরীই আমাকে নিয়ে যায় বাহিরে। কিন্তু যেখানেই যায় কিসের যেন আয়োজন মনে হয়। কোন জায়গায় বাদ নেই। সেদিন বিকালে খুব সুন্দর একটা ড্রেস
এনে দেই আমাকে পরীটা। আমি যেহেতু তাদের কথা শুনতে পায়না তাই পরীটা আকার-ইঙ্গিতে বলে গেল এটা আমার। এটা আমাকে পড়তে হবে রাতে।
খুবই সুন্দর ছিল ড্রেসটা। পাথরের বিভিন্ন কারুকাজ ছিল ড্রেসটাতে। মনে হয় হীরা বসানো ছিল। মনে হয় ড্রেসটা কোন কালো মানুষ পড়লেও এসব
পাথরের ঝিলিকে জ্বলজ্বল করবে তার চোখমুখ, খুব সুন্দর দেখাবে তাকে। গভীর হওয়ার পর পরীটা এসে আমাকে হযতো ড্রেসটা পড়িয়ে দিবে, এমনটা
ভেবে ড্রেসটা হাতে নিয়ে দেখল আমি যেন বিছানায় ছটপট করতেছি, খুব জ্বালাপোড়া করছিল আমার সারা শরীর। খুব ঘাম হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি
যেন গোছল করলাম মাত্র। পরীটা কান্নাকাটি, চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করলো, যেসব পরীরা আমার সেবাই নিয়যিত ছিল তাদের খুব শাসাচ্ছিল। তখন
পরীটা দৌঁড়ে গিয়ে সেই বয়স্ক পরীটাকে নিয়ে
আসল। বয়স্ক পরীটা আমাকে এই অবস্থায় দেখে কিছু যেন বুঝতে পারলেন, সাথে সাথেই যেন ওনার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। সে ঐ পরীটাকে কি
যেন বল্লো। সাথে সাথে ঐ পরীটার চোখ- মুখ রাগে লাল হয়ে যায়। তারপর ও যেন কি করলো আবার জ্ঞান হারালাম। তারপর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো
নিজের বাসায় নিজেকে আবিস্কার করলাম। এখন মনে পড়ছে আরে হ্যা সেই পরীর দেশের সেই সুন্দর পরীটিই তো সেই কৃষ্ণচূরা গাছের পরী। প্রথম
প্রথম এসব গল্প যখন আফসার অন্য মানুষদেরকে শুনাতেন তখন শরিফাও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ওনারও শুনতে ভালো লাগতো পরীর দেশের
কাহিনী শুনতে। কিন্তু আস্তে আস্তে ওনার
মনে হিংসা হতে লাগে ওনার স্বামীর মুখে পরী সম্পর্কে এসব শুনে। ওনি ভাবতে লাগলেন তাহলে কি ওনার স্বামীও সেই পরীর প্রেমেই পড়লো? পরী
কি ওনার স্বামীকে ওনার চেয়ে বেশি ভালবাসে? ওনার স্বামীর কাছে কি ওনার থেকে পরীর ভালবাসার মূল্যই বেশি? এই দু’এক দিনে কি পরী ওনার স্বামীর
মনে জায়গা করে নিলো? যেখানে ওনার অবস্থান ছিল এত বছর? তাই আজকাল ওনার এখন খুব রাগ হয় ওনার স্বামী যখন পরীকে নিয়ে এসব গল্প করে
অন্যের সাথে। ওনি ভাবলেন না এভাবে আর হয়না। মনের মধ্যে সংশয় রেখে থাকা যায় না। সরাসরি ওনার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতেই হবেই যে ওনি
কাকে এখন বেশি ভালবাসে? ওনাকে? নাকি ঐ পরীকে। যদি পরীকেই ভালবাসে তাহলে পরীর কাছেই দিয়ে দিবেন।
সেদিন রাতে ঘুমানোর সময় আফসার আলীকে শরিফা বেগম বল্লেন—–
: আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?
: কি প্রশ্ন?
: সত্য উত্তর দিবে কি?
: তোমার সাথে কখনো মিথ্যা বলেছি?
: আচ্ছা তুমি কি পরীর প্রতি কোনভাবেই দূর্বল? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমিও হয়তো
পরীর প্রেমে পড়েছ।
: ছিঃ শরিফা। তুমি এমনটা ভাবলে কিভাবে? আমি সজ্ঞানে শুধু তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারিনা। ভালবেসেছি শুধু তোমাকে এবং
বাসবোও। পরীর প্রতি আমি মোটেও দূর্বলতা না। আর পরী তো মানুষও না। মানুষ পরীর সম্পর্ক হয় কিভাবে? আমি এসব বিশ্বাস করিনা। আর আমার
খুব খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে তুমি আমাকে এমনটা ভাবলে
কিভাবে? তুমি এতদিনেও আমাকে চিনতে পারোনি? আমার চরিত্রে কি এমনকিছু দেখেছিলে
কখনো?
: আসলে আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দেও।
: আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর ওনি ওনার স্ত্রীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বল্লেন—-
: পাগলী বউ আমার। তোমাকে ছাড়া কি আমি অন্য কাউকে ভালবাসতে পারি? তোমার সাথে
যে আমার জনম জনমের বন্ধন। তুমি যখন বুড়ো হয়ে থুরথুরে হয়ে যাবে, চামড়ায় ভাজ পড়ে যাবে তখনও তোমাকেই ভালবাসবো।
শরিফা বেগমও জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেল্লেন। হঠাৎ এমন সময় ওনার রুমের জানালায় শব্দ শুনলেন। কে যেন জানালায় বাহির থেকে
জোরে থাপড়াচ্ছে। একটু পর আবার বারান্দায় যাওয়ার দরজায় শব্দ শুনতে পেল। কে হতে পারে শরিফা এবং আফসার কারোরই বুঝার
বাকি নেই। কারন এখন ভরা পূর্ণিমা। তাই হঠাৎ করে ওরা দুজনেই ভয়ে আতংকে
উঠল। হঠাৎ করে সেই মেয়েলি মিষ্টি কন্ঠটি ভেসে আসছে—-
: আফসার জানালাটা একবার খুলো। একবার খুলো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।
আফসার দৌড় দিয়ে ফয়সালের রুমে চলে গেল। আফসার যা ভেবেছে তাই। ফয়সাল রুমেই আছে, কিন্তু ওর রুমের বারান্দায় যাওয়ার
দরজাটা খোলা এবং দক্ষিণের একটা জানালাও খোলা। তাড়াতাড়ি আফসার গিয়ে সেগুলো বন্ধ করে দিল। ফয়সাল কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো—-
: বাবা কি হয়েছে?
: তোকে না বলেছি রাতেরবেলা দরজা, জানালা খোলা রাখবি না?
: সরি বাবা। ভুলে গিয়েছিলাম।
হঠাৎ এমন সময় ফয়সালের দরজায়ও আওয়াজ পাওয়া গেল। আবার সেই কণ্ঠটা ভেসে আসলো—
: দরজা খোল। দরজা খোল বলছি। আমার থেকে এভাবে দরজা বন্ধ করে পালিয়ে কয়দিন থাকতে
পারবে তোমরা? আমি এক এক করে সবার জীবন ছিনিয়ে নিবো যতক্ষণ পর্যন্ত আফসারকে না
পায়।
।।
কয়েক মাস পরের কথা। আজ ফয়সালের বিয়ে। ফয়সালের বাবা চেয়েছিল কোন এক আমাবশ্যার সময়েই বিয়েটা করাতে।
কিন্তু মেয়ে পক্ষের বিভিন্ন কারনে হয়নি। পূর্ণিমাতেই বিয়ে ঠিক হয়। যাইহোক আফসার আলী ভাবলো বিয়ের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার
আগেই ফিরে আসবে তাহলে আর কোন সমস্যা হবেনা। কিন্তু তা আর পারেনি। বিয়ের কাজ বল্লেই কি তাড়াতাড়ি হয়ে যায়? বিয়ের কাজ
শেষ করতে করতে ১০টা বেঁজে যায়। আফসার আলী বার বার মেয়ে পক্ষকে তাদের মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিদায়ের কাজ শেষ করে তাদের
হাতে তোলে দেওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু মেয়ে পক্ষরা বলতেছে বেশি দূরে না তো। মাত্র তিনটা গ্রাম পরেই তো ছেলের বাড়ি।
তো এত তাড়ার কি আছে? রাত এগারটার দিকে বিদায় দিল। কিন্তু মাইক্রো গাড়িতে ওঠার সময় সমস্যা বাধে। কারন ফয়সালের বাবা
মাইক্রোতে উঠতে চাচ্ছেন। অন্যরা বলতেছে বরের গাড়িতে বাবা উঠবে কেন? ফয়সাল ব্যাপারটা বুঝে গেল। তাই ফয়সাল বল্লো— বাবা এ
গাড়িতেই যাবে। ফয়সালের কথা শুনে কেউ আর কিছু বলতে পারেনি। আফসার আলী আসলে এই গাড়ি দিয়ে যেতে চাচ্ছেন কারন ওনি
থাকলে হয়তো পরী কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নাহয় হয়তো এমনও হতে পারে যে পরী তার ছেলের ক্ষতি করার জন্য সম্পূর্ণ গাড়িটায়
কোন খাদে ফেলে দিতে পারে। ওনি থাকলে তো শুধুমাত্র ওনার কথা ভেবে হলেও পরী এমনটা করবে না। তাই এই গাড়িতে উঠা। গাড়িটা হঠাৎ
একটা নির্জন জায়গায় যাওয়ার পর হঠাৎ সবাই দেখতে পেল রাস্তার মাঝখানে কেউ একজন মহিলা বা মেয়ে টাইপেরই কেউ পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
পরনে সাদা লং ড্রেস। সামনের দিকে মুখ করা এবং ফয়সালদের গাড়ি যেদিক থেকে যাচ্ছে সেদিকে পিট করানো। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিতে চাচ্ছিল,
কিন্তু আফসার আলী বল্লো গাড়ি আরো জোরে চালাতে। ড্রাইভার গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিল। যতই গাড়ি সেই সাদা ড্রেস পড়া মানবীটির দিকে
যাচ্ছে গাড়ির সবাই ততোই ভয়ে আতংকে উঠতেছে। যারা যারা ফয়সালদের বাড়ির সেই পরীর ঘটনা জানে তারা ঠিকই বুঝতে পারতেছে এটা সেই
পরীরই কাজ। ফয়সাল তার স্ত্রী প্রিয়ার চোখ ঢেকে রাখল নিজের হাত দিয়ে। যাতে প্রিয়া না দেখতে পারে এসবকিছু। প্রিয়া মাত্র এইচএসসি পাস করেছে।
তাই ছোটই, ভয় পেতেও পারে। তাই তাকে দেখতে দিচ্ছে না ফয়সাল। যদিও প্রিয়া বার বার ফয়সালের হাত সরিয়ে দেখতে চাচ্ছে। কিন্তু ফয়সালই দিচ্ছেনা।
তাদের গাড়িটা পরীর কাছাকাছিই চলে আসল। কিন্তু সে নড়তেছে না। যেই মুহূর্তে গাড়িটা তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে পরী যেই অবস্থানে
ছিল সেই অবস্থানে থেকেই সোজা উপড়ে উঠে গেল। তারপর কোথায় যেন নিঃশেষ হয়ে গেল। এটা দেখে সবার ভয়ে যেন ভেতরের পানি শুকিয়ে গেল।
সবাই নিশ্চুপ হয়ে রইল। গাড়ি আরো তাড়াতাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসে বাড়িতে। বাড়িতে আসার পরই সবার ভয়ে, আতংকে ভরা মুখটা দেখেই ফয়সালের
মা কিছু বুঝে ফেলেন। তাড়াতাড়ি ছেলে এবং ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে নিয়ে গেলেন ওনি। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন সবাইকে ঘরে
তাড়াতাড়ি ডুকিয়ে। রাত ২টা। ফয়সাল তার নববিবাহিতা স্ত্রীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেছে। হঠাৎ প্রিয়া
বল্লো—-
: আচ্ছা তখন ঐটা কি ছিল? আর আপনি আমার চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন কেন?
: ঐটা পরী ছিল। যদি তুমি ভয় পাও তাই তোমাকে দেখতে দেইনি।
: পরী!! পরী এলো কোথায় থেকে?
: আছে। একটা পরী আমাদের পরিবারের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ। যে কোন সময় যে কারোর ক্ষতি করে দিতে পারে।
আর তোমাকেও বলছি তুমি রাতে কখনো ঘরের বাহিরে যাবেনা আমরাও যায়না। আর দরজা, জানালা খোলা রাখবে না।
: ওয়াও পরী! আমার তো দেখা উচিত। কখনো দেখিনি। দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
: মজা করবে না। যা বলছি সিরিয়াসভাবে নিবে। আর যা বলছি মনে রাখবে এবং মেনে চলবে।
: আচ্ছা। কিন্তু আপনাদের বাড়ির উপর পরীর নজর পড়লো কিভাবে? কার উপর পড়েছে? আপনার
উপর?
: না বাবার উপর।
: বাবার উপর!! বাবা তো কিছুটা বৃদ্ধই। তো এত এক জোয়ান মানুষ থাকতে বাবার উপর পরীর
দৃষ্টি গেল কিভাবে?
: জানিনা তো। যার যাকে ভাল লাগে এটায় আরকি।
: ওহ আচ্ছা।
হঠাৎ এমন সময় ফয়সালের রুমের জানালায় আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল। কেউ বাহির থেকে খুব
জোরে থাপড়াচ্ছে। তাই প্রিয়া বল্লো—
: কে জানালায় থাপড়াচ্ছে এত জোরে? জানালা খোলে দেখবো কি?
: না। এমন কাজ কখনো করবে না। তাহলে প্রাণও যেতে পারে। এটা পরীর কাজ।
: ওহ পরী? আমি দেখবো।
: না।
: শুধু জানালাটা একটু খোলে দেখি? বেশি খুলবো না। সাথে সাথে আবার লাগিয়ে দিবো।
: না। এমনটা সম্ভব না। নিজে তো মরবেই, সাথে সবাইকে নিয়ে মরবে। মরার পর পরী দেখার সাধ
মিটবে মনেহয়। এমন দুঃসাহস কখনো করবে না।
: আচ্ছা জানালা খোলবো না। তবে জানালার ছিদ্র দিয়ে তো দেখতে পারি নাকি? তাহলে
তো আর পরী আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না তাইতো?
: আচ্ছা তোমার যখন এত সখ তো এটা করতে পারো।
: আচ্ছা।
প্রিয়া জানালার ছোট ছিদ্রের সামনে গিয়ে বাহিরে তাকালো। প্রথম পরীর হাত দুটা চোখে পড়লো। ওয়াও কি সুন্দর। সাদা দুধের চেয়েও
বেশি সাদা মনে হচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে পরীর মুখের দিকে তাকালো। ভয় পেয়ে গেল। কারন পরীও মনেহয় ওকে দেখে ফেলেছে।
পরী বাহির থেকেই হা করলো বড় করে, যেন প্রিয়াকে গিলে ফেলবে। প্রিয়া ভয় পেয়ে দৌঁড়ে এসে ফয়সালকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে প্রিয়ার
হৃদস্পন্দন মনেহয় হাজার গুণ বেড়ে গেছে। ফয়সাল
জিজ্ঞেস করলো—-
: কি হয়েছে প্রিয়া? ভয় পেয়েছ? কিভাবে?
: পরী যেন হা করে গিলে ফেলবে আমাকে।
: আগেই বলেছিলাম ভয় পাবে। এখন পরী দেখার সাধ ঘুচিয়েছে?
: হুম। আচ্ছা পরী জানলো কিভাবে যে আমি জানালার কাছে গিয়েছি ওকে দেখতে?
: ও অনুভব করে সব বুঝে নিতে পারে। আর এমন করবে না।
: আচ্ছা।
ফয়সাল গিয়ে জানালার উপর ভারি পর্দাটা সম্পূর্ণ টেনে দিয়েছে। যাতে পরী কোন ছিদ্র
দিয়েও ভেতরের কোনকিছু দেখতে না পায়।
আফসার আলীর সংসার ভালই চলছে। কারন ওনারা রাতেরবেলা বাহিরে বের হয়না, বিশেষত চাঁদনী রাতে। তাই পরী ওদের কোন
ক্ষতিই করতে পারেনা। তাছাড়া আজকাল পরী এসে এতটা ডিসট্রাবও করেনা। এখন আর দরজা, জানালায় আওয়ার শুনা যায় না তেমন।
তাই তারা ভেবে নিয়েছে হয়তো পরী আসেই না হয়তো নিয়মিত। তাই মাঝে মাঝে ২/১ মিনিটের জন্য গিয়ে বাহির থেকে কিছু আনার হলে
এনে ফেলে দৌঁড় দিয়ে। তবে বেশি রাতে না। ৮/৯ মাস পরের ঘটনা। রাত ১০:৩০। চাঁদনি আছেই। তারপরও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনেহয়
রাতে খুব বৃষ্টিও হতে পারে। হঠাৎ শরিফা বেগমের মনে হলো আরে হ্যা ছাদে তো কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু আনতে মনে নেই দিনেরবেলা। এখন তো সব ভিজবে। তাই ভাবলেন আজকাল তো পরীর তেমন আনাগোনা নেই, তাই তাড়াতাড়ি
করে গিয়ে কাপড়গুলো নিয়ে আসবেন। অল্পঅল্প গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। তাই তিনি তাদের বাড়িতে একটা কাজের মেয়ে আছে ওকে
নিয়ে গেল। ছাদের দরজা খোলার আগে বল্ল——
: শুন আমরা তাড়াতাড়ি দুজনে গিয়ে ছাদ থেকে কাপড়গুলো এনে দৌঁড় দিয়ে চলে আসবো।
আসার পর সাথে সাথে দরজাটা লাগিয়ে দিবি।
: আইচ্ছা।
: এখন দৌড় দিয়ে চল।
দরজা খুলে দুজনেই দৌঁড় দিয়ে ছাদে গেল। দুজনে দুদিকের কাপড়গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ
এমন সময় শরিফাকে ছুঁ মেরে নিয়ে গেল আকাশে। তারপর তাকে পরী বলতে লাগল—–
: কি ভেবেছিলি তোদের বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি? ছাড়িনি। তোদের একটু সুযোগ দিয়ে আমি বড়
সুযোগের অপেক্ষা করছিলাম। আজ পেলাম বড় সুযোগটা। তোরা যে বাহিরে বের হস তা দেখতাম। কিন্তু কিছু করিনি। আজকের দিনটার
জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মনে পড়ে একবছর আগে এ দিনটাতেই তোরা আফসারকে ছিনিয়ে এনেছিলিস আমার থেকে। ঐদিন রাতেই
আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। শুধু তোর জন্য হলনা।
: আমাকে এনেছ কেন? আমাকে ছেড়ে দেও।
: ছেড়ে দিবো? এখান থেকে ছেড়ে দিলেও জমের বাড়ি যাবি। দেখেছিস কত উপরে আছিস? এখান থেকে তোকে ছাড়লে আগে গাছে
পড়বি, গাছের বিভিন্ন ডালায় ধাক্কা খেতে খেতে নিচে মাটিতে পড়বি। মৃত্যু তো তোর অবশ্যই হবে। শরিফা বেগম নিচে তাকালো। সত্যিই
তো, তিনি তো অনেক উপরে আছে। যেখানে আছেন সেখানে বাতাসই কম পাচ্ছেন। তাছাড়া নিচে তাকালো তাদের বাড়িটাও ছোট দেখা যায়।
তাি তিনি কিছুটা বিনয়ের সুরে বল্লেন—-
: দয়াকরে আমাকে নিচে নামিয়ে দেও।
: হাহাহাহা নিচে নামিয়ে দিবো? এজন্য এখানে এনেছি?
: (ভয়ে কিছু বলতে পারতেছে না শরিফা।)
: আচ্ছা তোর মাঝে কি আছে বলতো যে তোর স্বামী তোকে এত ভালবাসে? আমি দেখ, কতো সুন্দর, অনেক সুন্দর করে গান গাইতে পারি,
নাচতেও পারি, কি পারিনা সেটায় বল? ও আমাকে ভালবাসলে সম্পূর্ণ পরীস্থান ওর হয়ে যেত, এত ক্ষমতা ওর হতো।
আর আমি ওকে এত ভালবাসি সে পাত্তাই দিচ্ছেনা?
এবার শরিফা মনে সাহস নিয়ে গর্বের সাথে বলে উঠলেন–
: তার কারন হচ্ছে আমার প্রতি তার ভালবাসা। আর সে ভালবাসা সে কখনো কাউকে দিতে
পারবে না। তারচেয়ে বড় কথা বল তুই তো পরী, মানুষ না। তো তোর প্রতি ভালবাসা আসবে
কোথায় থেকে? কারন মানুষ মানুষকেই ভালবাসে।
: তো তুই যখন না থাকবি তখন তোর ভালবাসা তোর স্বামী কাকে দিবে? তোর কবরে?
: (খুব ভয় পেয়ে গেল শরিফা। তাই চুপ হয়ে গেলেন। ভয়ে সড়সড় হয়ে গেল।)
: আচ্ছা তোকে যে এত কষ্ট করে সম্মান দিয়ে আনলাম। তোকে তো কিছু পুরস্কার এবং স্মৃতি
দিয়ে দিতে হয়। যাতে সবাই দেখে বুঝতে পারে পরীর সাথে অন্যায় করলে কেমন হয়? পরী তার দাঁড়ালো নখ দিয়ে শরিফার
সারাটা মুখ আঁছড়িয়ে দাগ করে দিল। ব্যাথায় সে চিৎকার করতে লাগল। তারপর তার বামগালে জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল পরী।
ঐদিকে কাজের ছোট মেয়েটা দৌড়ে নিচে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল— দাদাজান, কাকাজান, কে কোথায় আছেন? দেখে যান দাদিজানরে
পরীয়ে উপরে নিয়ে গেছে। আফসার, ফয়সাল এবং ফয়সালের জেঠাতো ভাইয়েরা এবং ফয়সালের জেঠিমা দৌঁড়ে বের হয়ে এলেন। সবাই কাজের
মেয়েটির সাথে দৌড়ে ছাদে গেল। ছাদে গিয়ে দেখা ফয়সালের মাকে নিয়ে পরী আকাশে। আফসার আলী জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন—-
ওকে ছেড়ে দেও। পরী, তুমি ওকে ছেড়ে দেও। নামিয়ে দিয়ে যাও। বলতে বলতে কান্না করে দিলেন। এমন সময় পরীও নিচে তাকিয়ে দেখল সবাই ছাদে
দাঁড়ানো। পরী শরিফা বেগমকে ঐ আকাশ থেকেই, এত উপর থেকেই ছেড়ে দিলেন। শরিফা বেগম ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। তারপরও নিজের
মৃত্যুটা চোখের সামনে উপলব্দি করতে পারতেছেন। শরিফা বেগম আসলেই তাদের বাগানের একটা গাছের উপরই আগে পড়লেন। তারপর গাছের
বিভিন্ন ডালার সাথে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়লেন। সবাই তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে দুতলার সিড়ি বেয়ে বাগানে দৌড়ে গেলেন।
বাগানের ঐখানে গিয়ে দেখলেন শরিয়া বেগম হালকা ভেজা মাটি এবং ঘাসের মধ্যে মুখ থুবলে পড়ে আছেন। মুখ উপরে তুলে সবাই কিছুটা ভয় পেয়ে গেল।
কারন সারা মুখ নখের আঁছড়ে লাল দাগ পড়ে গেছে, মনে হয় রক্তো বের হয়েছিল হয়তো। আরেকটা গালে দাগের উপরেই পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসানোও আছে।
মনে হয় জোরে থাপ্পড়ে এমন হয়েছে। আফসার আলী নিঃশ্বাস চেক করলেন দেখলেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। জোরে চিৎকারে ওনি ভেঙ্গে পড়লেন।
ওনার সাথে অন্যরাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। পরীটা আকাশে দাঁড়িয়েই দেখছিল সবকিছু। তারপর উড়ে চলে গেল নিজ গন্তব্যে।
।।
একবছর পরের কথা। ফয়সাল এবং প্রিয়ার কোর জুরে একটা মেয়ে সন্তান। প্রিয়া যতটা সুন্দর তার মেয়েটি দেখতে তারচেয়ে অনেক বেশি সুন্দর,
চোখ ফেরানো যায়না। ফয়সাল এবং প্রিয়ার নামানুসারে সেই ছোট্ট মেয়েটির নাম রাখা হয় “ফারিয়া জান্নাত পলি”। তার কিছুদিন পরের কথা।
প্রিয়া রান্নাঘরে রান্না করতেছে আর ফয়সাল অন্যরুমে কি যেন কাজ করতেছে। পলিকে আফসার আলী কোলে নিয়ে খেলা করতেছে, তার ছোট নাতনীর সাথে
বিভিন্ন কথা বলতেছে। হঠাৎ তিনি কথা কথায় বলে উঠলেন—-
: আমার দাদুভাইটা দেখতে খুবই সুন্দর, ঠিক যেন পরীর মত।
হঠাৎ এ কথা বলে ওনি পলির দিকে তাকালেন। হঠাৎ ওনি দেখলের ছোট্ট পরির মধ্যে কি যেন পরিবর্তন হতে লাগল। মাত্র একমাসের বাচ্চা
কিন্তু ওর চোখ যেন অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যাচ্ছে, চোখগুলো কেমন যেন লালও হয়ে যাচ্ছে। ছোট পলিকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে,
আরো বেশি ফর্সা লাগছে এবং ওর মধ্যে যে আরেকটা চেহেরা ভেসে উঠতেছে বার বার, আর কেমন যেন হাসছে মনে হচ্ছে। হঠাৎ ওনি খেয়াল
করলেন পরির ছোট হাতটি দিয়ে ওনার চোখে, মুখে আলতো করে ছোঁয়ে দিচ্ছে। শরিফার মত কি ওনার মুখেও নক দিয়ে আঁছড়িযে দিতে চাচ্ছে
নাকি আদর করতে চাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারতেছে না আফসার আলী। তাই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন এবং নিজেকে তিরষ্কার করলে লাগলেন—
এ কি করলেন ওনি? নিজে নিজেই তো বিপদ ডেকে আনলেন। কেন পরীর নাম মুখে নিতে গেলেন? কেন নিজের ছোট নাতনীকে পরীর সাথে তুলনা
করতে গেলেন? পরী কি তাহলে এ সুযোগ পেয়ে নিজের নাতনীর দেহটা বশ করে নিল? হঠাৎ এমন সময় তিনি বাহিরে জোরে সেই মেয়েলি অট্টহাসির
শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি বুঝলেন না এখন আর পলির সামনে থাকা যাবেনা। তাহলে হয়তো দেখা যাবে তিনি যেমনটা ভেবে ভয় পাচ্ছেন তেমনটায়
হয়ে গেছে। তিনি পলিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে
চলে যেতে চাইলেন। হঠাৎ ওনি যেইনা বিছানায় শুইয়ে চলে আসতে চাইলেন দেখলেন ছোট্ট পলি তার হাতের একটা আঙ্গুল ধরে আছে। ওনি আঙ্গুলটা
ছাড়াতে চাচ্ছেন, কিন্তু পারতেছেন না। মনে হচ্ছে যেন বড়কোন মানুষ ধরে রেখেছে। জোর করে কোনমতে ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলেন রুম থেকে।
আফসার আলীর স্ত্রীর মারা যাওয়ার একবছর পূর্ণ হতে চলেছে। ওনি ওনার শোকে এখনও পাগল প্রায়। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করেন না, নিজের রুম
থেকে তেমন বেরই হোননা। বেশিরভাগ সময়ই রুমের মধ্যে বসে থাকেন। ওনার কেমন যেন ভয় করে ওনি রুম থেকে বের হলেই হয়তো কোন না
কোন অঘটন ঘটে যাবে। তার নাতনীর কাছেও বেশি যাননা। আবার যদি কোনভাবে পরীর নাম উচ্চারণ করে ফেলে? যদি আবার ঐদিনের মত হয়?
একদিন রাতের কথা। ফয়সালদের দোকান থেকে কয়েকজন লোক আসল, যারা তাদের দোকানের কাজ করে। তারা এসে জানালো তাদের দোকানে
হিসেব নিয়ে কি যেন গন্ডগোল হয়েছে। কয়েকজন শ্রমিক তো হাতাহাতিও করেছে ফেলেছে ঝগড়ার রেশ ধরে। তাই ফয়সাল বা তার বাবাকে গিয়ে
মিমাংশা করতে হবে এখনিই। এখনি না গেলে শ্রমিকদের মধ্যে ঝগড়া আরো
বাড়তে থাকবে। তারপর হয়তো দেখা যাবে হাসপাতালের কাজও লেগে যেতে পারে। কিন্তু কে যাবে দোকানে? আফসার আলী তো নিজেকে সবকিছু
থেকেই ঘুটিয়ে নিয়েছে, অন্যদের সাথে তেমন কথাও বলেনা। তো ফয়সালকেই যেতে হবে। প্রিয়া এসে বাঁধা দিল। ফয়সাল প্রিয়াকে আশ্বশ্ত করলো মাত্র
তো নয়টা বাজে, দশটার আগেই চলে আসবে। যারা ফয়সালকে নিতে এসেছে তারা জানে ফয়সালদের বাড়ির ঘটনা। তাই তারাও প্রিয়াকে বল্লো — ভাবীসাব,
আমরা যেমন ভাইজানকে নিয়ে যাচ্ছি বাসা থেকে, তেমনি বাসায়ই দিয়ে যাবো।
তারপর প্রিয়া কিছুটা রাজি হল।
ফয়সাল যাওয়ার আগে প্রিয়াকে বলে গেল প্রিয়া যেন দরজার কাছাকাছি থাকে। ফয়সাল এসে ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই যেন দরজা খুলে দেয়।
প্রিয়া বল্লো আচ্ছা সে থাকবে। কিন্তু আফসার এসবের কিছুই জানতো না। ফয়সাল চলে গেল তাদের সাথে দোকানে। দোকানে গিয়ে দেখে আসলেই
খুব খারাপ অবস্থা। শ্রমিকরা দুএকজন মারামারি করে নাক-মুখ যেন ফাটিয়ে দিয়েছে। আসলে শ্রমিকরা একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছিল যে,
সে হিসাবে কারচুপি করে টাকা সরিয়ে রেখেছে, এভাবে একজন আরেকজনকে দোষ দিচ্ছিল। এভাবেই ঝগড়ার সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। ফয়সাল
তাদের ঝগড়া থামাল। তারপর সেই হিসাবের খাতা নিয়ে বসল হিসাব করতে। তাদের থেকেই সকল লেনদেনের খবর নিয়ে হিসাব করছিল এবং
খাতার সাথে মিলাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরে হিসাব মিলানোর চেষ্টা করলো। তারপর দেখলো দুটা লেনদেন ভুলে তারা লিপিবদ্ধই করেনি খাতাতে।
একবস্তা চাল, একবস্তা ডাল বাকিতে বিক্রি করেছে কিন্তু তা লিপিবদ্ধ করেনি। তাদের তো বড় আড়ত তাই তারা তাদের পরিচিত কাস্টমারদের
বাকিতেই অনেক টাকার মাল বিক্রি করে থাকে। কিন্তু সাথে সাথে তা নিয়ম অনুযায়ী তা হিসাবের খাতায় লিখে রাখে। কিন্তু আজ মনেহয় কোন
কারনে তারা লিখতে ভুলে গেছে। টাকা সরানোর ধান্ধা তাদের নেই। কারন যারা আছে দোকানে তারা সবাই বিশ্বাসী, ফয়সালের বাবাই তাদের রেখেছে
এবং সব সময় তারাই এগুলো দেখাশুনা করে। ভুলেই হয়তো এমনটা করেছে এটা ফয়সালও জানে। কিন্তু দুই বস্তায় তো অনেক টাকায়, যা লেখা
হয়নি হিসাবের খাতাতে। তাই তাদের হিসাবে গন্ডগোল হচ্ছিল। তারপর সে নিজেই খাতাতে তা লিপিবদ্ধ করে নিল। তারপর তাদের বলে দিল এরপর
ভবিষ্যতে কিছু বিক্রি করার সাথে সাথে যেন খাতাতে লিপিবদ্ধ করে নেয় তারা, যাতে এভাবে আর ভুলে না যায়। সবাই বল্লো এমন ভুল আর তারা করবে না।
যারা দুজন মারামারি করেছিল তাদের কিছু টাকা দেয় ফয়সাল, যাতে তারা ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঔষুধ কিনে খায়। আর তাদের শাসিয়ে আসে ভবিষ্যতে
এমন হলে যেন তারা কেউ মারামারি শুরু না করে, আগে ফয়সালকে যেন জানায় তারা। তারা মাথা নিচু করে বল্লো তারা জানাবে। এসব মিমাংশা করে
বের হওয়ার সময় দেখে প্রায় এগারটা বেজে যাচ্ছে। আসিফ ঘড়ি দেখেই ভয় পেয়ে গেল। ও তো এতক্ষণ খেয়ালই করেনি ঐসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে।
আরো পঁনের মিনিট বাকি আছে। বাসায় যেতে যেতে ঠিক এগারটা বেজে যাবে। তাকে এভাবে দেখেই ফয়সাল যে টেনশনে আছে ওরা বুঝে ফেল্লো যারা
ফয়সালকে বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল। তাই তারা বল্লো– চলেন আমরাও আফনার সাথে যাবো, আফনাকে বাসায় দিয়ে হেরপর আমরা বাসায় যামু।
ফয়সাল ওদের সাথে তাড়াতাড়ি হাঁটা দিল। কে জানে কি আছে কপালে আজ? ওরাও ফয়সালের ঘা ঘেসেই হাঁটতেছে। যাতে ফয়সালের কোন ক্ষতি না
হয়ে যায়। তারপরও ফয়সালের ভয় হচ্ছে। এমন সময় ফয়সালের মনে পড়লো আরে হ্যা গতবছর এদিনেই তো ওর মাকে মেরে ফেলেছিল পরী।
কারন গতবছরের আগের বছর এদিনেই বাবাকে পরীস্থান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর এদিনেই সে বাহিরে বের হলো? খুব আপসোস হচ্ছে কেন
বাবাকে সে নিয়ে আসলো না সাথে? বাবা থাকলে তো আর তার খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা ছিল না। খুব রাগ হচ্ছে এসব ভেবে। আবার ভয়টা আরো
বেড়ে গেল এসব মনে হওয়াতে। ঐদিকে হয়েছে অন্য কান্ড। প্রিয়া দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, যাতে ফয়সাল এসে ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই প্রিয়া
দরজা খুলে দিতে পারে। খুব ভয় করছে প্রিয়ার ফয়সাল এখনও আসছে না বলে। হঠাৎ প্রিয়া ফয়সালের গলা শুনতে পেল– প্রিয়া দরজা খুলো। প্রিয়া
ফয়সালের গলা শুনেই তাড়াতাড়ি দরজা খুল্লো। দেখলো ফয়সাল দরজার সামনে নেই। প্রিয়া ভাবলো হয়তো আছে সাইডে কারন সে ফয়সালের কণ্ঠ
শুনেই দরজা খুলেছে। প্রিয়া ঘর থেকে বের হয়ে দরজার সামনে গেল। দুপাশে খোঁজছিল ফয়সালকে। হঠাৎ এমন সময় ঠাস করে ওর বামগালে একটা
জোরে থাপ্পড়ের আওয়াজ শুনতে পেল। গালে হাত দিয়ে প্রিয়া সামনে তাকিয়ে দেখে তার একদম সামনে তার সাথে লাগালাগি অবস্থায় পরী দাঁড়ানো।
সাথে সাথে প্রিয়া মাটিতে পড়ে যায় সোজা নিচের দিকে উপুর হয়ে। তারপর কি হয়েছিল তা অজানা। এদিকে ফয়সাল তার সাথের দুজনের হাত ধরেই
হাঁটছে। খুব ভয় করছে। তার মার মত আবার উপড়ে নিয়ে যাবেনা তো পরী? তারপর সেই উপর থেকে ফেলে দেবেনা তো? তাই ওদের হাত ধরেই হাঁটছিল।
তারা ফয়সালদের বাসার গেইটের ভেতরে চলে আসে। এখান থেকে ফয়সালের বাসার দরজার কাছে যেতে ১/২ মিনিট লাগবে। ওর সাথের দুজন বল্লো—
ভাই, আফনে যান, আমরা এখানেই দাঁড়ায় আছি। আপনি ঘরের ভেতর গেলেই আমরা চলে যামু। ফয়সাল বল্লো– আচ্ছা। ওরা ভাবলো এখন তো ফয়সাল
ঘরেই চলে যাবে ১/২ মিনিটের মধ্যে। কি আর সমস্যা হবে? ওরা পিছন ফিরে হাঁটা দিল। যেইনা তারা পিছন ফিরে মনে হয় একপা বাড়ালো হঠাৎ বড় একটা
শব্দ হলো। তারা পিছন ফিরলো দেখার জন্য কিসের শব্দ? কার কি হয়েছে? পেছনে পিরে দেখে ফয়সাল মাটিতে পড়ে আছে নিচের দিকে মুখ থুবরে দিয়ে,
তার মাথার পাশে বড়সড় একটা পাথর। তারা দৌড়ে কাছে এসে দেখে মাথাটা যেনে ছেঁচে গেল, মাথার মগজও দেখা যাচ্ছে প্রায়। উপরে তাকিয়ে দেখে পরী
উড়ে চলে যাচ্ছে। পরী আসলে ফয়সালকে নজরে রাখছিল। যখনই ওরা ওর থেকে আলাদা হল পরী সুযোগ বুঝে বড় একটা পাথর ফেল্লো ঠিক তার মাথার
উপর। তারা চিৎকার শুরু করে দিল। কি হয়ে গেল, একি হয়ে গেল এসব বলে বিলাপ শুরু করে দিল। তারা ফয়সালকে ধরে দরজার কাছে নিয়ে আসলো
দরজার কাছে এসে দেখল সেখানে প্রিয়াও নিচে মুখ থুবরে পড়ে আছে। প্রিয়ার মুখ উপড়ে তোললো, মুখ উপরে তোলে দেখে প্রিয়ার সুন্দর মুখে বামগালে
থাপ্পড়ের দাগটি স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। তারা নাকের সামনে হাত রেখে দেখল শ্বাস নিচ্ছেনা। তাই তারা আরো জোরে চিৎকার শুরু করলো। ঘর থেকে ফয়সালের
বাবা, জেঠিমা এবং দুটা জেঠাতো ভাই দৌড়ে চলে আসল। আশেপাশের বাড়ির মানুষও জড়ো হয়ে গেল। সবাই এসে এ অবস্থা দেখে তারাও কান্না শুরু
করলো। ফয়সালের বাবা যেন কাঠের মূর্তির মত হয়ে গেছে। কোন নাড়াচাড়াই করতে পারতেছেন না, কাঁদতেও পারতেছেন না। যেন বোবা হয়ে গেছে।
শুধু কান্নায় ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না। পরেরদিন সকালে ফয়সালকে এবং প্রিয়াকে এক সাথেই দাফন করা হয়, পাশাপাশিই
তাদের কবর দেওয়া হল। একেবারে ডানপাশে ওনার স্ত্রী শরিফা বেগমের কবর, তারপরে ওনার ছেলে ফয়সালের, তারপর ওনার পুত্রবধূ প্রিয়ার কবর। ওনি শুধু দিনেরবেলা এসে এ তিনটা কবরের পাশে বসে থাকেন। আর নিরবে চোখের জল ফেলেন, আর ভাবেন কেন তিনি এখনও বেঁচে আছেন? কেন ওনার মৃত্যুটা
আসেনা? আফসার আলী কি করবেন কিছুই বুঝতে পারতেছে না। তার আর চোখ খুলতেই ইচ্ছে হয়না, বার বার মনে হয় কেন তার মৃত্যু হচ্ছে না? মৃত্যু
হলেই ভাল হত। আবার মাঝে মাঝে ভাবেন ওনি মারা গেলে ওনার বংশধর, ওনার ছেলে ও পুত্রবধূর রেখে যাওয়া শেষ আমানত ছোট্ট পলির কি হবে? কে
তাকে দেখবে? কে তার দায়ভার নিবে? না ওনাকে বাঁচতেই হবে। আর কিছুর জন্য নাহলেও তার ছোট নাতনী পলির জন্য হলেও। অন্যদেরকে না বাঁচাতে
পেরেছেন কিন্তু পলিকে ওনি বাঁচিয়ে রাখবেনই ঐ পরীর হাত থেকে। তারপরও ওনার মনে একটা সংশয় রইয়েই যাচ্ছে আসলেই কি ওনি পারবেন পরীর
হাত থেকে তার আদরের ছোট্ট নাতনী এবং ওনার বংশধরকে বাঁচাতে? নাকি তিনটা কবরের পাশে আরেকটা যোগ হবে?
কয়েক মাস পরের কথা। এখন আফসার আলী সারাদিন শুধু পলির সাথে কাটায়। পলির সবকিছু দেখাশুনা করে। পলিকে যত্ন করার জন্য নতুন একটা
বুয়াও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আফসার আলীর ভাবীও আছে, ওনিও পলিকে দেখাশুনা করে। আফসার আলীর বড় ভাই আজিজ ওনি ঢাকাতেও
বাড়ি করেছে। ওনার সাথে ঢাকাতে ওনার দুই ছেলে ও তাদের পুত্রবধূরা। কিন্তু আজিজের স্ত্রী এবং আরো দুইপুত্র গ্রামে এখানেই থাকে। কারন ওদের গ্রামে
থাকতেই ভাল লাগে। এমনকি আফসার আলী এবং ফয়সালও গ্রামই পছন্দ করতো তাই তারা শহরে যায়নি। যদিও আজিজ সবাইকে শহরে গিয়ে থাকার
জন্যই বলতো, কিন্তু ওরা যেত না। যাইহোক, আসল
ঘটনায় আসা যাক। আফসার পলির যত্নের কোন ত্রুটি রাখেনা। সারাক্ষণ পলিকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। পলির এখন ১.৫ বছর বয়স। হঠাৎ একদিন
আফসার রাত ১০:৩০ দিকে বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় চলে যায় পলিকে নিয়ে। ওনি হয়তো ভুলেই গেছেন তাদের যে রাতেরবেলা বাহিরে যাওয়া মানা।
আফসার ছোট্ট পলিকে দূর আকাশের চাঁদ, তারা দেখাচ্ছে। হঠাৎ ওনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কান্নাভেজা অবস্থায় পলিকে দূর আকাশের কয়েকটা তারাকে
নির্দেশ করে
বল্লো—–
: দাদুভাই তোর বাবা-মাকে দেখতে ইচ্ছে হয়? আমি জানি তোর ইচ্ছে। ঐযে দেখ, আকাশে সুন্দর ঝলমল করা পাশাপাশি দুটা তারায় তোর বাবা-মা
এবং তাদের ডানপাশের আরো উজ্জ্বল তারাটির তোর দাদি। পলি তো ছোট্ট, সে কি এতকিছু বুঝে? সে দাদার মুখের দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে কথা শুনতেছে।
এই কথাগুলো বলে আফসার আলী আরো কেঁদে উঠলেন। আজ হয়তো আফসার আলীর তার হারানো প্রিয়জনদের বেশি করে মনে পড়ছে। তাই হয়তো
সব ভূলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ এমন সময় ওনার হাত থেকে ছুঁ মেরে পলিকে নিয়ে আকাশে চলে গেল। আফসার আলী তাকিয়ে দেখে পলি
তার কাছে নেই। আকাশে তাকিয়ে দেখে পরীর কোলে। ওনি ভয় পেযে গেলেন। তখন হঠাৎ ওনার মনে হল আরে হ্যা! ওনি তো বারান্দায় এসেছেন।
এটা কি করলেন?
কেন পলির জীবনটাকেও সংকটে ফেলে দিলেন? ওনি চিৎকার করতে লাগলেন—-
: না পরী, তুমি এমনটা করতে পারোনা। ওর কোন ক্ষতি করবে না। ওর কিছু করলে কিন্তু আমাকে
আর কোনদিনও পাবেনা, মরার পরেও না।
: তাহলে তুমি বলো তুমি রাজি? শুনবে আমার কথা?
আফসার আলী কিছুটা চুপ হয়ে গেলেন, কিছুটা ভাবনায় চলে গেলেন। তখন পরী পলিকে
আকাশের মধ্যে ছুড়ে দিল। পলি চিৎকার করতে লাগল। আফসার আলী তাকিয়ে এটা দেখে
তাড়াতাড়ি বল্লো—
: পরী আমি তোমার সব কথা শুনবো। শুধু তুমি ওকে আমার কাছে দিয়ে যাও। পরী সাথে সাথে
গিয়ে পলীকে ধরে ফেল্লো। তারপর আবার বল্লো—-
: তুমি রাজি আছ তো?
: হ্যা রাজি।
পরী পলিকে নিয়ে নিচে নেমে আসল এবং আফসার আলীর কোলে দিল। আফসার আলী পলিকে জড়িয়ে ধরে চোখে, মুখে চুমু দিতে লাগল।
তারপর পরীকে জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে এসে রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল সাথে সাথে। ওনি জানেন যে, এখান থেকে ধাক্কা দিলে
পরী পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবেন না, শুধু পরীর তাল সামলাতে একটু সময় নিবে। এরমধ্যে ওনি শুধু দরজাটা বন্ধ করার সময় পাবেন। ওনি তাই করলেন।
আর সাথে সাথে ওনি ওনার বামহাত থেকে তাবিজটা খুলে পলির বামহাতে বেধে দিলেন। ওনার যাইহোক, পলি যেন বেঁচে থাকে। কারন পলি ওনার
শেষ বংশধর। সাথে সাথে দরজায় জোরে ধাক্কার শব্দ পেলেন। আর মেযেরি সেই কন্ঠটা শুনতে পারলেন।
: আফসার তুমি এমনটা করতে পারোনা। এতটা বিশ্বাসঘাতক হতে পারোনা। তুমি আমাকে কথা
দিয়েছ, তা বরখেলাপ করতে পারোনা।
: কথা দেওয়া? তুই কি মানুস যে তোকে কথা দিযে রাখতেই হবে? মানুষ মানুষকে কথা দিলে তা অবশ্যই রাখে। কিন্তু তুই মানুষ না,
তাই আমি রাখিনি। আর তুই আমার পরিবারে যা যা ক্ষতি করেছিস তা কোন মানুষ হলর হলে করতে পারতো না, তাই আমি রাখিনি।
তাতে কোন অপরাধ নেই আমার।
: তুমি বাঁচাতে পারবে না ওকে কোনভাবেই। আজ না কাল আমি ঠিকই ওকেও মেরে ফেলবো।
: যাতে তুই এমনটা না করতে পারিস সেই ব্যবস্থায় করবো।
: না তুমি কোন ব্যবস্থা নিয়েই ওকে বাঁচাতে পারবে না।
পরী রেগেমেগে শেষে চলেই গেল। আফসার ভাবলো সকালে গিয়ে ঐ খাদেমের সাথে দেখা
করবে। কোন না কোন উপায় বের করবেনই ওনি ওনার বংশধরকে বাঁচানোর।
সকালে খাদেমের কাছে গেল। খাদেম ওনাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল—–
: কেমন আছেন কাকু?
: কেমন আর থাকতে পারি? ঐ পরী তো ভাল থাকতে দিচ্ছেনা। ও তো একে একে সবাইকে মেরে
ফেলতেছে।
: জ্বি আমি জানি। শুনেছি সবকিছু।
: পরী এখন আমার ছোট নাতনীকেও মেরে ফেলতে চায়।
: হ্যা পরী এমনই করবে। সে এমনটায় বলেছিল।
: কোন ব্যবস্থা কি নেই পরীকে আটকানোর? আমার ছোট নাতনীটাকে বাঁচানোর?
: না। আপনি যতদিন এই পৃথিবীতে আছেন, বেঁচে আছেন ততোদিন পর্যন্ত সে আপনার পিছু
ছাড়বে না।
: আর আমিই যদি না থাকব তো? (আফসার আলীর ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
তাই দেখেই খাদেম বুঝে ফেল্ল ওনি কি বলতে চাচ্ছেন।
: আপনি কি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতেছেন? এমনটা কখনো ভাববেন না। এমনটা করা যে
পাপ। মৃত্যুর পরও শান্তি পাবেন না।
: তো কি করবো? আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না। এখন আমি আমার শেষ বংশদরকেও রক্ষা
করতে পারবো না? ওকে রক্ষা করতে আমার যা যা করা দরকার সবই করবো।
খাদেম অনেক বুঝালেন ওনাকে। কিন্তু ওনি শুনতেই চাচ্ছেন না। এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলে
চলে আসলো। বাসায় আসার পরেও তার মনটা খুব ভারী হয়ে আছে। খুব বিষণ্নতায় ভুগছেন। এট
লাস্ট ওনি ডিসিশন নিযেই ফেল্লেন ওনার মন যা চাচ্ছেন তাই করবেন।
পরেরদিন সকালবেলায় ওনি পলিকে ওনার ভাবীর কাছে দিযে বল্লেন—-
: ভাবী তুমি পলিকে দেখো। আমি ঢাকায় ভাইয়ার কাছে যাচ্ছি। ওনার সাথে আমার কিছু কথা
বলার আছে।
: আচ্ছা। তো তুমি বাসা থেকে তোমার ভাতিজাদের কারোর মোবাইল নিয়ে যাও। যাতে
তোমার ভাইয়াকে প্রয়োজনে ফোন দিতে পারো রাস্তায় কোন সমস্যায় পড়লে।
: না ভাবী। মোবাইল ব্যবহার আমার ভাল লাগেনা সেটা তো জানোই। আর ভাইয়ের মোবাইল
নাম্বার এবং বাড়ির মোবাইল নাম্বার তো আমার জানা আছেই। প্রয়োজনে ফোন দিতে
পারবো। আর কাল সকালে তো চলেই আসবো।
: তো আমরা কি তোমার ভাইয়া ফোন দিযে জানিযে দেবো তোমার যাওযার কথা?
: আচ্ছা। তো আমি আসছি?
: আচ্ছা। সাবধানে যেও। আর গিয়েই আগে বাসায় ফোন দিয়ে আমাদের জানিও।
: আচ্ছা। তোমরা পলির খেয়াল রেখো। কোনভাবেই সে যেন কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল
রেখো। আর রাতে কিন্তু কেউ বাহিরে যাবেনা পলিকে নিয়ে।
: আচ্ছা সে চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা। আমরা পলির যথেষ্ট খেয়াল রাখবো।
আফসার আলী একটা ব্যাগে নিজের প্রযোজনীয কিছু কাপড়-চোপড় এবং কিছু টাকা নিয়ে
রওনা দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় যেতে দুঘণ্টা লাগবে এবং এগারটার দিকেই তার ভাইয়ের
বাসায় পৌঁছে যাবে। কিন্তু দুপুর বারটা বেজে গেছে ওনি এখনও পৌঁছায়নি। তাই ওনার ভাই
বাসায় ওনার স্ত্রীর কাছে ফোন দিল।
: আচ্ছা তুমি যে বল্লে আফসার আমার এখানে আসছে? তো এখনও আসেনি কেন?
: কি? এখনও যায়নি? এটা কিভাবে হয়? এতক্ষণে তো অবশ্যই চলে যাওয়ার কথা। কোথায় আছে
তাহলে ও?
খুব টেনশনে পড়ে গেল সবাই। দুপুর ১টার দিকে আজিজ রাহমানের এবং এখানে ওনার স্ত্রীরমোবাইলে ফোন আসে অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে।
ফোন দিয়ে তাদেরকে বল্লো— যেফোন করেছে সে একজন পুলিশ অফিসার। এবঙ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো তারা আফসার আলীকে চিনে কিনা?
তারা বল্লো— “হুম তারা চিনে।কিন্তু আফসারের কি হয়েছে জিজ্ঞেসকরলে ওরা আর কোন উত্তর দেইনি। বল্লো ওরা যেন তাড়াতাড়ি গিয়ে ওদের থানাতে
দেখা করে। তারপরই সব জানতে পারবে। তাই ঐদিক থেকে আফসার আলীর বড় ভাই এবং এদিক থেকে আফসারের ভাবী ওনার এক ছেলেকে নিয়ে ঐ
থানায় গেল। পলিকে বুয়ার কাছে রেখে গেল এবং ওনার ছোট ছেলেকে বাসায় থাকতে বলে গেলেন পলির দিকে খেয়াল রাখার জন্য।
আজিজ রাহমান ঐ থানায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। এর কিছুক্ষন পরই ওনার স্ত্রীও ওনার ছেলেকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। তারা ঐ পুলিশ
অফিসারের কাছে বার বার জানতে চাচ্ছিলেন আফসারের কথা। পুলিশ উত্তর দিচ্ছেনা। বরং পুলিশ তাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে একটা
জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে উঠেও ওরা জিজ্ঞেস করলো পুলিশ অফিসার বল্লো ঐ জায়গায় গিয়ে তাদের সব বিস্তারিত বলবে।
পুলিশের গাড়ি বড় ব্রিজের কাছে এসে থামল। তারপর সবাইকে গাড়ি থেকে নামতে বল্লো। এখানে আরো কয়েকজন পুলিশও ছিল।
একজন ডুবুরী পানিতে নামিয়ে কি যে খোঁজতেছিল। ওরা আরো কৌতূহলী হয়ে গেল। তাই আবার জিজ্ঞেস করলো তারা। তখন পুলিশ
আফসারের সেই ব্যাগ, জোতা বের করে বল্লো—
: দেখেন তো এগুলো আপনার চিনতে পারেন কিনা?
: হ্যা এই ব্যাগ তো আফসারেরই। আজ এই ব্যাগ এবং এই জোতা পড়েই বের হয়েছিল তার বড় ভাই
মানে আমার স্বামীরর সাথে দেখা করার জন্য। (আজিজের স্ত্রী)
: আফসার কোথায় আছে এখন কিছু বলছেন না কেন আপনারা? (আজিজ)
: দুপুর ১২টার দিকে এগুলো এ। ব্রিজের মাথায় পায় আমরা। আমরা বল্লে ভুল হবে। অন্যরা এগুলো
দেখে আমাদেরকে ফোন দিয়ে আনিয়েছে। সাথে আরেকটা জিনিসও পেয়েছিলাম।
: কি?
: সুইসাইড নোট।
: কি!! (চমকে উঠে একই সাথে বল্লো সবাই)
: কি কাকাবাবু সুইসাইড করেছে? ( আজিজের ছেলে)
: এই নেন সেই নোট। দেখেন তো আপনার ভাইয়ের হাতের লেখার সাথে মিল আছে কিনা?
: হ্যা সম্পূর্ণ তো মিল আছে। হ্যা ওই এভাবে টানা টানা লেখায় লিখতো।
: হু পড়েন।
আজিজ কিছুটা জোরে জোরে পড়তে শুরু করলো—— “আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আমি নিজ থেকেই আত্মহত্যা করেছি।
কারন পরী আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তোলেছে। তাই আমি সেচ্ছ্বায় আত্মহত্যা করলাম। কারর আমি না থাকলে আর সে কাউকে
মারতে আসবে, পলিও বেঁচে যাবে ওর হাত থেকে। আশাকরি আমার বড় ভাই পলির যথেষ্ট খেয়াল রাখবে, তাকে সুন্দর করে বড় করে
তোলবে। আর বড় ভাইয়ের কাছে আমার একটায় শেষ দাবী– পলি বড় হলে যেন আমার সব সম্পত্তি ওকে বুঝিয়ে দেয়। আর ভাইয়ের
উপর আমার সেই বিশ্বাস আছেও। সমাপ্ত।” এবং লেখার সবচেয়ে নিচে ডানপাশে আজিজ এবং তার স্ত্রীর দুজনের ফোন নাম্বার দেওয়া
আছে এবং ছোট করে লেখা আছে– “কোন সহৃদয়বান যদি কেউ যদি থাকেন তো আমার এই নাম্বারগুলোতে একটু ফোন করে আমার
বাসায় জানিয়ে দেবেন।” নোটটা পড়ার পর আজিজ এবং ওনার স্ত্রী এবং ছেলে সবাই কান্না শুরু করে দিল। এতক্ষণে ডুবুরীও জানালো
কাউকে বা কারোর লাশ পাওয়া যায়নি নিচে। আজিজ আরো কিছুক্ষণ খোঁজে দেখার কথা বল্লো ডুবুরীকে। কিন্তু কোন হদিসই মিল্লো না।
তো আর কি করার? ডুবুরীকে তার প্রাপ্য টাকা দিয়ে ওনারা চলে আসলেন। ঐদিন রাত্রে পরী বাসায় পা রেখেই বুঝতে পারলো আফসার
এখানে নেই। তাই পরী আরো বেশি জোরে দরজায় ধাক্কাতে শুরু করল এবং বলতে লাগলো—
: আফসার, আফসার, তুমি কোথায়?
ঘরের ভেতর থেকে আজিজ জবাব দিল—-
: আফসার আর এ পৃথিবীতে নেই। সে মারা গেছে। আত্মহত্যা করেছে, শুধু তোমার দোষেই।
: না। ও মরেনি। বেঁচে আছে। ও যদি মারা যেত তো আমার অন্তর-আত্মাই জানান দিত আমাকে।
তোমরা হয়তো কোথাও লুকিয়ে রেখেছ ওকে।
: কি? যেখানে আমরাই ওর কোন খোঁজ পাচ্ছিনা, টেনশনে আছি। সেখানে তুমি এসব কি শুনাচ্ছ?
আমরা কোথায় এবং কিভাবে লুকিয়ে রাখবো? এতই যখন জানো তো তুমি খোঁজে নেও।
: পারতেছি না। আমার দিব্যদৃষ্টি সেখানে পৌঁছাতে পারতেছে না ওর কাছে।
: অদ্ভূত তো। কি আজগুবি গল্প শুনাচ্ছ? আমরা কেউ তার কোন হদিস জানিনা। তুমি যদি কখনো
জানতে পারো তো আম্দের এসে জানিও।
এভাবে আরো কিছু কথা চলে চলে গেল পরী।
।।
আজিজ রহমান পলি এবং ওনার সম্পূর্ণ পরিবার নিয়ে পরেরদিন সকালেই ঢাকা চলে গেলেন
একেবারে। ওনি আফসারের কথা এবং স্বপ্ন পূরণ করতে চায়। পলিকে মনের মত করে সুন্দর করে
গড়ে তুলবেন। পলির জীবনে কোনকিছুর অভাব পেতে দিবেন না।
পলিকে ওনি ওখানে ঢাকার তার বড় ছেলে এবং বড় ছেলে সায়িদ এবং পুত্রবধূর হাতে তোলে
দিলেন। তারপর বল্লেন—
: পলির যেন কোন অভাব না পড়ে কোনকিছুতে। আর পলি আজ থেকে তোমাদের পরিচয়ে মানুষ
হবে। তোমরাই ওর বাবা-মা। পলির যাতে কোনদিন এটাও মনে না হয় যে, তোমরা ওর বাবা-মা না। তোমরা ওর সাথে এমন কোন আচরন করবে না।
যেটাতে ওর বা অন্য কারোর দেখলে সে সন্দেহ হবে। এটা তোমাদের কাছে আমার আবদার। পলিকে তারা আন্তরিকভাবেই নিয়ে নিলেন। কামরন
তাদের কোন মেয়ে নেই। দুটা ছেলে আছে
পাঁচ ও সাত বছরের। তো একটা মেয়ে থাকলে কোন সমস্যা হবেনা। বরং ভালই হবে। আজিজ বাড়ির অন্যদেরকেও বল্লো পলিকে যেন তাদের
নিজেদের ভেবে নেয় সবাই, ভুল করেও যেন কখনো কেউ ওর সাথে খারাপ ব্যবহার না করে। সবাই পলিকে তাদের কাছের মানুষ ভেবেই আচরন করে।
তাছাড়া এ পরিবারে আর কোন মেয়ে নেই এখন পর্যন্ত তাই পলি সবার আদরি প্রাপ্য। আর সবাই পলিকে নিযেই সারাদিন মেতে থাকে। এভাবেই পলি
সবার আদর পেযেই বড় হতে লাগল। পলি যেন সবার চোখরমনি হয়ে গেছে দিন দিন।
২২ বছর পরের কথা। পলি এখন বড় হয়েছে। অনার্স ৪র্থ বর্ষে পড়ে। পলির বিয়ে ঠিক হয় অনিক নামের একটা ছেলের সাথে। পলিও রাজি।
পলিও তাকে ভালই লাগে। পলি ২য় বর্ষ থাকতেই ছেলেটার সাথে ওর পরিচয়। ছেলেটা প্রথম থেকেই পলিকে ভালবাসতো। অনিকরা দুভাই এবং
একবোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। অনিকের ভাই চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে পড়ে। বাড়িতে বলতে শুধু অনিকই থাকে এবং একজন কাজের বুয়া।
যথারীতি তাদের বিয়ে হয়ে যায়। বাসর রাতে প্রবেশ করলো অনিক। পলি গিয়ে ওকে সালাম করলো। তারপর তারা খাটের মধ্যে বসে বিভিন্ন কথা
বলছিল। হঠাৎ এমন সময় অনিকের নজর গেল পলির বাম হাতের তাবিজটার প্রতি, ব্লাউজের হাতা ছোট হওয়ায় তাবিজটি স্পষ্ট দেখাযাচ্ছে।
অনেক পুরনো হয়ে গেছে, কেমন যেন মরিচা ধরা অবস্থা। পলির সুন্দর হাতে খুবি
বেমানান লাগছে এই তাবিজটি। তাই অনিক বলেই ফেল্ল—-
: এটা কিসের তাবিজ? তোমার কি কোন সমস্যা আছে?
: আমি জানিনা। আমার দাদা খুব ছোট থাকতে লাগিয়েছে আমার হাতে শুনেছি। কিন্তু কেন
লাগিয়েছে, কি কারনে তাও জানিনা। না আমার কোন সমস্যায় নাই। আমি আজ পর্যন্ত আমার
কোন সমস্যা দেখিনি।
: তো তাবিজটা খুলে ফেল্লে হয়না? যদি তোমার সমস্যা না থাকে। কারন এটা খুব বেমানান
লাগছে।
: হুম খুলে ফেলা যায়। এতে আমার কোন সমস্যা নাই।
পলিই খুলতে গেল। কিন্তু খুলতে পারতেছিল না। তখন অনিক খুলে ফেল্লো। তারপর বারান্দায়
গিযো ঢিল দিয়ে বাহিরে বাগানে ফেলে দিল। তারপর পলিকে বল্লো—-
: চলো বারান্দায় যায়। আজ খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে চাঁদটাকে।
পলি এবং অনিক ছাদে গেল। দূর আকাশের দিকে তাকিযে রইল দুজন। হালকা বাতাস বইছে।
পলির ঘন কালো চুল উড়ে বেড়াচ্ছে। তা দেখে অনিক হঠাৎ বলে উঠল—
: তোমাকে এখন অপরূপ সুন্দরী লাগে লাগছে। ঠিক যেন পরীর মত। জানো তোমার নামটা যদি
পলি না রেখে পরী রাখতো তাহলে ভালই হতো।
এ কথাটা শুনার পরই পলি কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। চোখ দুটো বড় বড় হতে লাগলো এবং খুব
লাল হয়ে গেল। যেন কোঠর থেকে বের হয়ে যাবে। আর তার মাঝে কেমন যেন অন্য একটা
চেহেরা ভেসে উঠছে আবছা আবছাভাবে। আরো বেশি সুন্দর সেই চেহেরাটা। হঠাৎ এ অবস্থায়
পলিকে অনিক দেখে কিছুটা ভয়ই করতেছে। তারপরও বল্ল—
: পলি তোমার কি হয়েছে?
পলি আরো খুব ভয়ংকরভাবে তাকালো অনিকের দিকে। হঠাৎ করে অনিকের গলাটা চেপে ধরল পলি। অনিককে পেছনে ঠেলে দেয়ালের
দিকে ঠেসে ধরল। অনিক কিছুই বুঝে পাচ্চেনা। শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছে পলির মধ্যে অন্যকিছু বশ করে নিয়েছে যা অনিককে মারতে চাচ্ছে।
কোনভাবেই অনিক তার হাত সরাতে পারতেছে না। এদিকে অনিকের যেন দম বন্ধ হয়ে আসতেছে, যেন এখনি মারা যাবে। অনিক মনে সাহস
সঞ্চয করলো। তারপর সেও আচমকা জোরে পলিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পলি গিয়ে পেছনের ইজি চেয়ারে পড়ে বসে পড়ল। সাথে সাথে জ্ঞান
হারালো। অনিক দৌঁড়ে পলির কাছে গেল। ভাবলো পলি আবার ব্যাথা পেল না তো? কাছে গিয়ে দেখে পলি অজ্ঞান। পানি ছিটা দিলে তারপর জ্ঞান ফিরে।
পলিই
জিজ্ঞেস করলো—
: কি হয়েছিল আমার? আমি জ্ঞান হারালাম কিভাবে?
: না কিছুনা। এমনিই।
: আচ্ছা তোমার গলায় কিসের দাগ পড়েছে ঐটা?
: না তেমন কিচুনা।
: আচ্ছা। আমার খুব ঘুম পেয়েছে।
: আচ্ছা চলো ঘুমাবে।
পলি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। অনিক তার পাশে শুইয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল—
পলির তখন কি হয়েছিল? পরী শব্দটা শুনার পর এমন করলো কেন? হযতো কোন রহস্য আছে, পূর্ব
যোগসূত্র আছে। এসব ভাবতে ভাবতে সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে পলি যখন কিচেনে রান্না করতেছিল তখন গিয়ে কিছুটা ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল—
: আচ্ছা পলি তুমি কি পরী সম্পর্কে কিছু জানো?
: না (পলি খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল।)
অনিক কিছুই বুঝে পাচ্ছেনা। তো রাতে পরীর কথা শুনে এমন করলো কেন পলি? তো এখন
স্বাভাবিক কেন?
আবার পরেরদিন রাতে ওরা ওদের রুমে শুয়ার পূর্বে পলি অনিককে ফল কেটে দিচ্ছিল
খায়ওযার জন্য। তখন অনিক হঠাৎ পলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বল্লো—-
: আমার মিষ্টি বউ, পরী বউ।
এই কথা শুনে পলি আবার ঘুরে তার দিকে তাকালো। অনিক অনেকটা ভয় পেয়ে গেল। কারন পলির অবস্থা আগেরদিন রাতের মতই।
খুব ভয় পেয়ে গেল অনিক। অনিক কিছুটা পেছনে সরে গেল। হটাৎ পলি তার হাতের ছুড়িটা নিয়ে অনিকের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল
ধীর পায়ে। কেন ছুড়িটা অনিকের বুকের মাঝখানে বসিয়ে দেবে এখনই। অনিক দৌঁড় দিয়ে বের হয়ে দরজাটা বাহির থেকে লক করে দিল।
অনিক কিচুতেই বুঝতে পারতেছে না পরীর নামটা শুনলে পলি এমন করে কেন? শুধু রাতেই এমন করে কেন? দিনে তো এমন করেনা?
কার সাথে এটা নিয়ে আলাপ করবে বুঝে পাচ্ছেনা। হঠাৎ মনে পড়ল হ্যা পলির দাদার সাথেই তো এটা নিয়ে আলাপ
করা যায়। আজিজ দাদুর সাথে অনিকের ভার সম্পর্ক ওনাকেই সব বলতে পারেন।
পরেরদিন রাত দশটার দিকে হঠাৎ বাসায় কলিংবেল বাজল। অনিকই গিয়ে দরজা খুলে দিল। একটা বৃদ্ধলোক ভেতরে প্রবেশ করলো,
ওনার চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। অনিক ওনাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। পলি তাকে দেখেই বল্ল—
: অনিক এটা কে? আর তুমি ওনাকে এভাবে আমন্ত্রন জানিয়ে ঘরে এনেছ কেন?
: ওনাকে এনেছি তোমার ঘাড় থেকে ভূত নামানোর জন্য।
: কি? আমার কোন ভূত-টূত নেই।
: হুম চুপ। আছে পরী নামের একটা ভূত।
: পরী!!।
পরী নামটা শুনেই পলির মধ্যে আবার পরিবর্তন হতে লাগল। কিন্তু এখনো কিছুটা কিছুটা হুশ
আছে পলির। এমন সময় ঐ বৃদ্ধলোকটা বলে উঠল——
: পরী তুমি পলির শরীর থেকে বের হয়ে আসো। আমি বলছি বের হও। (আদেশের সুরে বল্লো)
হঠাৎ তখনি পলির শরীর থেকে বের হয়ে পরী তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন পলি যেন দূর্বল হয়ে পড়ে যাচ্ছিল পরী তার শরীর থেকে
বের হওয়ার পর। পলি পড়ে যাচ্ছিল। অনিক তাকে ধরে ফেলে এবং বুকে জড়িয়ে রাখে। পলি আস্তে আস্তে করে তাকালো সামনে কি হচ্ছে দেখার
জন্য। দেখল ঐ বৃদ্ধলোকটার সামনে একটা পরী দাঁড়ানো। পরী বল্ল—–
: আফসার তুমি এসেছ? আমি জানতাম তুমি একদিন না একদিন আসবেই। তুমি আনতে বাধ্য।
জানতাম তুমি বেঁচেই আছ। তবে এমন কোথাও আছ যেখানে আমার দিব্যশক্তি পৌঁছাতে
পারতেছিল না। কোথায় ছিলে তুমি?
: আগে বলো তুমি আমার একমাত্র নাতনীকে এবং শেষ বংশধরকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিলে কেন?
কেন তার ক্ষতি করতে চাচ্ছিলে?
পলি খুব অবাক হয়ে শুনছিল। কিছুি বুঝতে পারতেছিল না।
: তুমি আসছো না যে তাই। যদি এমন না করতাম তো এখনও তো আসতে। এতটা বছর তোমার জন্য
অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে এখনও সেই আগের মত ভালবাসি। এখনও তোমার অপেক্ষায়
আছি। (পরী)
: চুপ। একদম চুপ। আর কথা বলবে না। তুমি এখনও কিভাবে ভালবাসার কথা বলছো? আমি তোমাকে ভালবাসি না। শুধু ঘৃণা করি।
কিভাবে এখনও আমার ভালবাসা পাবার ইচ্ছে করো। সবকিছু তো ছিনিয়ে নিয়েছ আমার কাছ থেকে। আমার স্ত্রী, একমাত্র পুত্র ফয়সাল
এবং পুত্রবধূ সব ছিনিয়ে নিয়েছ। আমার ছোট্ট নাতনী পলিটাকে তো এতিম করেছই, এখন আবার তার জীবন এবং তার সংসারও পুড়িয়ে
দেওয়া চেষ্টা করছিলে? পলি বড়সড় ধাক্কা খেল এটা শুনে। পলি অনিককে আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরে তারপর
অনিককে বল্লো—-
: এসব কি বলছে বুড়ো? মাথা ঠিক আছে তো? আমার তো মা, বাবা, দাদা, দাদি সবই আছে। তো
ওনি কি বলছে।
: ওনি যা বলছেন ঠিকই বলছেন। যাদের কথা বলছো ওনারা তোমার আপন না। ওনিই তোমার
আপন দাদা। আর আজিজ দাদু হচ্ছে ওনার আপন ভাই।
: কি বলছ এসব? তুমি মিথ্যা বলছ তাই তো? তুমি এসব আজগুবি কথা কার থেকে শুনেছ? নিশ্চয়ই
বুড়ো বলেছে? আর তুমি বিশ্বাস করে নিয়েছ?
: না। ওনি কিছু বলেনি। আজিজ দাদুই বলেছে। আজ সকালে গিয়েচিলাম দাদুর কাছে তোমার
এই পরীর রোগটার কথা জানতে। তখন ওনি সব খুলে বল্লেন। আর এই হচ্ছে তোমার আসল দাদু,
আফসার। তোমার বাবা, মাকে এই পরীই মেরে ফেলেছে খুব ছোট থাকতে।
পলির দুচোখ বেয়ে অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়লো এসব শুনে। সে কান্নাভেজা এবং ভীত
নয়নে আবার তার দাদু এবং পরী দিকে তাকাল, তাদের কথা শুনতে। পরী আফসারকে বলছিল—-
: কি করবো বলো? তোমাকে যে খুব বেশি ভালবাসি। আর তোমাকে পাওয়ার জন্যই আমি
এতকিছু করেছি। আল্লাহর প্রত্যেক সৃষ্টিই তার ভালবাসাকে পাওয়ার জন্য অনেককিছুই করে।
আর আমি তোমাকে খুব ভালবাসি বলেই এতকিছু করেছি।
: কিন্তু আমি তোমাকে শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই করিনা।
: তুমি আসাকে ঘৃণা করো আর যাই আমি তোমাকে ভালবাসি। তাই আমি তোমাকে আমার
সাথে নিয়ে যেতে চাই।
: আমি যাবোনা।
: তাহলে জোর করে হলেও নিয়ে যাবো।
: প্রয়োজনে মরবো, তারপরও না।…… এটা বলেই আফসার তার পকেট থেকে একটা ব্লেট বের করে
গাতের কব্জির একানে রক্তনালীতে লাগিযে দিল। সাথে সাথে রক্ত গড়িযে পড়তে লাগলো।
আফসার মেঝেতে শুইয়ে গেল। পরি চিৎকার দিয়ে ওর কাছে এসে আফসারের মাথা তার
কোলে নিল এবং বলতে শুরু করল—-
: এটা কি করলে আফসার? কেন করলে এমনটা। তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি তাই তোমাকে
পেতে চাইতাম তাই বলে তোমার মৃত্যু কামনা নয়। সত্যিই তোমাকে খুব ভালবাসি।…
পরী কাঁদতে লাগলো। পরীর চোখের জলেরর কয়েক ফোটা আফসারের মুখে গিয়ে পড়ল। তারপর
পরী আফসারের কপালে একটা চুমু খেয়ে উঠে গেল। তারপর বল্লো—
: তুমিই যখন থাকবে না তো আমি আর পৃথিবীতে থেকে কি করবো? আমি চলে যাচ্ছি আমার
ঠিকানায়। তুমি এখন মুক্ত। আমার দ্বারা তোমার বা তোমার বংশধর আর কারোর কোন ক্ষতি
হবেনা।
এটা বলেই পরীটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। পলি এবং অনিক দৌঁড়ে তাদের দাদুর কাছে গেল।
এতক্ষণ পরীর ভয়ে কাছে যেতে পারিনি। পলি কাঁদতে কাঁদতে বল্লো —
: এটা কি করলে দাদু?
: তোর জীবনটা ঠিক করে গেলাম। (কাঁপাকাঁপা গলায় বল্লো আফসার)
: না দাদু তোমার কিছু হতে দিবোনা। তোমাকে আমরা বাঁচাবোই।
পলি অনিককে এম্বুলেন্স ডাকতে বল্লো। তাড়াতাড়িই এম্বুরেন্স এসে পড়ল এবং আফসারকে হাসপাতাল নিযে যাওয়া হল।
ওকে ইমারজেন্সিতে রুমে নিয়ে যাওয়া হল। আফসার আলী বেঁচে গিয়েছিল। কারন তখন হাদের মেইন রক্তনালীটি কাটেনি।
অবশ্য অনেক রক্তক্ষরণের জন্য ওনাকে অনেক দুব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছিল। পলির সাথে োননার রক্তের গ্রুপ মিরে যাওয়ায়
পলিই রক্ত দিয়েছিল। যদিো অনিক বলেছিল রক্ত কিনে নিতে। কিন্তু পলির একটায় কথা। পলিকে বাঁচাতে ওর দাদু নিজের জীবন
দিতেও চেযেছিল আর ও রক্ত দিতে পারবে না? ওর শরীরে সব রক্ত যদি লাগে তাও দিয়ে দিবে। কিছুদিন পর আফসার আলী ভালও
হয়ে যায়। এখন গভীর রাতেও বারান্দায় বা ছাদে চলে যেতে পারে। এখন আর কোন ভয় নেই। কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে আগের
সেই ভয়টাকেই খুব মিস করে ওনি। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। কেন আগে ওনি এমনটা করেননি? নাহয় ওনার নিজের
জীবনটা চলে যেতো কিন্তু আর সবাই তো বেঁচে যেতে? কেন ওনার বেঁচে থাকার এত
লোভ ছিল তখন? আজ তো সবই হারিয়েছেন। আজ মুক্ত হয়েও মুক্ত লাগছে না নিজেকে। আপন সবাইকে তো হারিয়েছেনই।
এমনকি এখন পরীকেও হারিয়েছেন, যে কিনা ওনাকে এত ভালবাসতো। মাঝে মাঝে পরীর লাস্ট কথাগুলো খুব মনে বাজতে থাকে।
..
খুব ইচ্ছে হচ্ছে জানতে যে আফসার আলী এতদিন কোথায় ছিল? ঐদিনের আত্মহত্যাটা ছিল একটা নাটক। এই নাটকের মেইন কেন্দ্রবিন্দুতে
ছিলেন আফসার, খাদেম এবং আজিজ। ঐদিনের আগেরদিন যখন ওনি খাদেমের সাথে দুঃখ প্রকার করছিলেন, আত্মহত্যার কথা বলছিলেন তখন
খাদেমই এই পরামর্শটা দেন। তারা তিনজন ছাড়া সম্পর্কে আর কেউ জানতো না। আর আফসার ছিল একটা বাংলো বাড়িতে। বাড়িটা খাদেমের নিজের।
ঐ বাড়ির গরের চারপাশে মাটি পড়ে বাঁদ রেখেছিল পুরো ঘরের চারপাশে। তাই পরীর দিব্যশক্তি সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া আফসার আলী
কখনোই ঘরের বাহিরে যাননি, ঘরের দরজা জানালা খুলতেনই না। শুধু ওনাকে দেখাশুনার জন্য একটা কাজের ছেলে রাখা ছিল। সেই শুধু প্রয়োজনে
কিছু আনা- নেওয়ার জন্য যেত। আর ওনি যে একদিন থেকেছেন তার করচ সম্পূর্ণ আজিজই বহন করতেন। সে প্রতিমাসে বাজার করিয়ে পাটিয়ে দিতো।
আর মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতেন ওনার ছোট
ভাইকে।
।।
……………………………………….সমাপ্ত…………………………………