মঙ্গলবার বড়দিন বলে আমি ঘুমাতে গেলাম দেরীতে, ‘বাটাভিয়া মেডিকেল জার্নাল’-এর
জন্য একটি লেখা তৈরি করলাম দুপুর পর্যন্ত, তারপর গেলাম জাহাজঘাট। সিঙ্গাপুরে
যাওয়ার জন্য জাহাজের টিকেট কাটতে। সামারিন্ডায় কম দিন তো কাটালাম না। পুরো ছয় বছর। এখন এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছি চিরতরে।
অবশ্য এজন্য আমি মনে মনে খুশি।কাজটাজ সেরে ফিরে এলাম বাড়িতে। বাঁধাছাঁদা শুরু করলাম।
দুপুর দুটোর দিকে হঠাৎ কেন জানি একটা অদ্ভুত অস্থিরতা গ্রাস করল আমাকে। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজার শব্দ হলো,
শব্দটা থেমে যেতেই ভয়ের শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।
হঠাৎ এই ভয় এবং অস্থিরতার কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না আমি। আধিভৌতিক কোনও ব্যাপারেও আমার বিশ্বাস নেই।
কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি অহেতুক আমার ভেতরে এ ধরনের কোনও অনুভূতি কাজ করছে না।
মনে হলো খুব শিগ্গিরই ভয়ঙ্কর কোনও ঘটনার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি আমি।
ঘণ্টাখানেক পর কর্লিনের কাছ থেকে একটি অদ্ভুত চিঠি পেলাম আমি। চিঠিটি নিয়ে এল
এক ক্যান্টোনিজ ছোকরা। চিঠিতে লেখা :
প্রিয় ডাক্তার ভ্যান রুলার,
আপনি এলিসকে শেষ বার যখন দেখে গেলেন, বললেন জ্বর হয়েছে। সেই জ্বর এখন আরও খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে।
সামারিন্ডা ছেড়ে যাওয়ার আগে অনুগ্রহ করে একটিবার যদি আমার বাড়িতে পদধূলি দেন, চিরকৃতজ্ঞ থাকব আমি।
আর একটি ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আসার পথে জঙ্গলের ওপর যদি কোনও ঘুড়ি উড়তে দেখেন,
মনের ভুলেও ওটাকে মাটিতে নামানোর চেষ্টা করবেন না।
আপনার বিশ্বস্ত
এডওয়ার্ড কর্লিন।
বার দুই চিঠিটি পড়লাম আমি। কর্লিনের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশি দিনের নয়। বছরখানেক আগে সে ব্রিটিশ নর্থ বোর্নিও থেকে এখানে আসে।
ওখানে সে জঙ্গল রক্ষক হিসেবে কাজ করত। তার আসার কয়েকদিন পর অন্য আরেকটি স্টীমারে আসে তার স্ত্রী এলিস এবং কন্যা ফে।
কর্লিন সম্পর্কে লোকে নানা কথা বলে। গুজব আছে, জঙ্গলরক্ষকের চাকরি করার সময় ডায়াক আদিবাসীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে
সে তাদের সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করে। তার এই নিষ্ঠুরতার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাকে চাকরিচ্যুত করে।
সামারিন্ডায় আসার কিছুদিনের মধ্যে কর্লিন মাহাকাস নদী থেকে কিছু দূরে, একটি পুরনো রেস্ট হাউসে আস্তানা গাড়ে।
পরে ওটাকেই সে নিজের বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। তার স্ত্রী এবং কন্যা তখন থেকে বাধ্য হয় জঙ্গলের ওই
অনাত্মীয় পরিবেশে প্রায় একঘরে অবস্থায় জীবনাযাপনে।
ক্যান্টোনিজ ছেলেটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে সামনে। আমার ইচ্ছে করল সরাসরি বলি যে যাব না। সত্যি বলতে কি কর্লিনকে আমি খুব একটা পছন্দ করি না।
কিন্তু চিঠিতে ঘুড়ির ব্যাপারটা আমাকে আগ্রহী করে তুলল। তাই ছোকরাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাংচো,
তোদের গ্রামের ডায়াকরা কি ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব শুরু করেছে?’
মাথা নাড়ল সে।‘তাহলে কি মালয়রা ওড়াচ্ছে?’
‘ওখানে কোনও মালয় নেই। মাত্র একটি ডায়াক গ্রাম আছে। আপনি যাবেন?’
আমি একটু ইতস্তত করলাম। তারপর বললাম, ‘হ্যাঁ, যাব। তোর মাঝিমাল্লাকে সাম্পান নিয়ে রেডি থাকতে বল। আমি আধঘণ্টার মধ্যে জেটিতে আসছি।’
আমি এমনিতে সাম্পানে চড়ে কোথাও গেলে খড়ে ছাওয়া কেবিনের ছায়ায় বসে পাইপ খেতে খেতে যাই।
কিন্তু আজ টেনশনের জন্যই বোধহয় সূর্যের প্রখর তাপ অগ্রাহ্য করে গলুইতে বসে তীরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।
ঘণ্টা দুই কেটে গেল কোনও ঘটনা ছাড়াই। তারপর, কর্লিনের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেছি, নদীর শেষ মোড় ঘোরার সময় কাংচো আঙুল তুলে আকাশ দেখাল।
উত্তেজিত গলায় বলল, ‘দেখেছেন? ঘুড়ি, বড় ঘুড়ি।’
নদীর বুকে বসে স্পষ্ট দেখতে পেলাম ঘুড়িটিকে। তবে অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না।
ঘুড়িটি বেশ বড়, দু’টুকরো বাঁশ আর লাল রাইস পেপার দিয়ে সুন্দর করে ওটাকে তৈরি করা হয়েছে, লেজটা লম্বা, রূপকথার ড্রাগনের কথা মনে করিয়ে দিল।
হঠাৎই জিনিসটা চোখে ধরা পড়ল আমার। যে সুতোতে বেঁধে ঘুড়িটি উড়ছে, ওটা
গ্রামবাসীদের তৈরি পাটের দড়ি কিংবা সুতো নয়, তার। তামার তার! সূর্যের আলোতে
সোনার মত ঝকমক করে উঠল তারটি। ক্রমশ নিচু হতে হতে একসময় জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে
গেল।
‘তীরে, কাংচো,’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, ‘জলদি তীরে ভেড়াও সাম্পান।’
কয়েক মিনিট পর ঘন জঙ্গল আর পোকামাকড় অগ্রাহ্য করে ছুটতে শুরু করলাম আমি সামনের দিকে।
একটি বড় পালাপাক গাছের মাথায় আটকে আছে তারটি।
কাছে পিঠে কোনও মানুষজন চোখে পড়ল না আমার। অবাক হলাম ভেবে তাহলে ঘুড়িটি কে ওড়াচ্ছিল?
ঘুড়িটি কোনও আদিবাসীর তৈরি, কিন্তু ওই তামার তারের সঙ্গে কোনও শ্বেতাঙ্গের সম্পর্ক আছে, ধারণা করলাম আমি।
চিন্তান্বিত মুখে ফিরে চললাম আবার সাম্পানে। মিনিট দশেক পরে কর্লিনের জেটিতে
মাঝিরা সাম্পান বাঁধল। কাংচো আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল কর্লিনের বাড়িতে।
কর্লিন দরজায় দাঁড়িয়েছিল। আমার সাথে হাত মিলিয়ে ঢুকল ভেতর ঘরে।
‘আপনি এসেছেন বলে খুব খুশি হয়েছি, ডাক্তার,’ বলল সে। ‘আপনার অপেক্ষায় থাকতে
থাকতে চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম আসবেন কি আসবেন না ভেবে। এলিস পেছনের ঘরে আছে।
আমার মেয়ে ফে তার সেবা করছে।’
‘রোগীর অবস্থা এখন কেমন?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘ভাল না,’ বলল কর্লিন। ‘কুইনাইন খাওয়াচ্ছি ওকে যেভাবে আপনি বলেছেন। কিন্তু জ্বরের জন্য সে এত অসুস্থ হয়ে পড়েনি।
আচ্ছা ডাক্তার, আসার সময় কোনও ঘুড়ি চোখে পড়েছে আপনার?’
আমি লোকটার দিকে কড়া চোখে তাকালাম। কর্লিনের মুখটা বাজপাখির মত, চোখদুটো শুয়োরের চোখের মত কুঁতকুঁতে। ওর মুখে,
হাতে পোকামাকড়ের অসংখ্য কামড়ের দাগ। এসব গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। ওর চেহারায় প্রচণ্ড অস্থির একটা ভাব।
আমার কঠিন দৃষ্টি দেখে সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তারচে’ আপনি বরং আমার স্ত্রীকে একবার দেখুন।’
পেছনের একটি ঘরে নিয়ে গেল সে আমাকে।
ঘরটি ছোট। একটি মাত্র বিছানা ঘরে। জানালার শাটার অর্ধেক নামানো। অসুস্থ মানুষের গায়ের গন্ধ প্রকটভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরটিতে।
কর্লিনের স্ত্রী মরার মত পড়ে আছে বিছানায়। তার পাশের চেয়ারে বসে আছে তার মেয়ে, ফে।
আমি মহিলার হাতের নাড়ি পরীক্ষা করতে লাগলাম, তাপমাত্রা দেখলাম। হৃৎস্পন্দন দ্রুত।কিন্তু থার্মোমিটারে দেখলাম স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে।
কর্লিন হঠাৎ এসে ঢুকল ভেতরে, আমাকে টেনে নিয়ে গেল জানালার কাছে। আঙুল তুলল আকাশের দিকে। ‘দেখুন!’ ভাঙা গলায় বলল সে।
‘দেখতে পাচ্ছেন?’
দেখলাম। সেই ঘুড়িটি। আগের মত উঁচুতে আকাশে উড়ছে, কিন্তু বাতাস কাছিয়ে আনছে ওটাকে দ্রুত।
লাল রাইস পেপার নীল আকাশের বুকে ক্ষতচিহ্নের মত দগদগে হয়ে ফুটে আছে।
‘দেখলাম,’ বললাম আমি। ‘একটা ঘুড়ি। কিন্তু তাতে কী…?’
কর্লিন দ্রুত বাধা দিল, ‘ঘুড়িটা দেখতে থাকুন ভ্যান রুলার। কথা বলবেন না, প্লীজ।’
আমি আবার আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইলাম। এবার বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল।
‘ঘুড়িটা দেখতে দেখতে ওর নাড়ি পরীক্ষা করে দেখুন,’ কর্কশ গলায় বলল কর্লিন। কাঁপা
হাতে একটি সিগারেট ধরাল সে, হেলান দিয়ে দাঁড়াল দেয়ালের গায়ে।
আমি অনেকক্ষণ ধরে এলিসের নাড়ি পরীক্ষা করলাম, ঘুড়িটির দিকে চোখ রেখে। ড্রাগনের মত লেজ বাতাসে উড়ছে পতপত করে,
নামতে নামতে ঘুড়িটি মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উচ্চতায় এসে দাঁড়াল।
এলিসের ভয়ানক শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। হাঁপানি রোগীর মত শ্বাস টানতে শুরু করল সে। নাড়ির গতি ভয়ানক ক্ষীণ হয়ে এল।
আমি তাড়াতাড়ি একটি ক্যাপসুল খাইয়ে দিলাম এলিসকে। ধীরে ধীরে অবস্থা স্বাভাবিক
হয়ে এল। বাইরে চেয়ে দেখি ঘুড়িটি ওপরে উঠতে শুরু করেছে, তাড়া খাওয়া পাখির মত ওটা দিক বদলে চলে গেল।
সেন্ট্রাল রুমে এসে ঢুকলাম আমি। এক গ্লাস হুইস্কি ঢেলে কর্লিনের মুখোমুখি বসলাম।
‘কর্লিন,’ কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বললাম, ‘বোর্নিওতে আমি ছয় বছর ধরে আছি। অনেক অদ্ভুত এবং কঠিন রোগের চিকিৎসা করেছি।
কিন্তু এমন ঘটনা আমার জীবনে এই প্রথম। এটা-এটা-গুড লর্ড, এ অসম্ভব!’
‘তাহলে আমি মিথ্যে বলিনি, বলেন?’ বলল কর্লিন। ‘আপনি দেখেছেন?’
‘আমি দেখেছি,’ বললাম আমি। ‘আর ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। আপনার
স্ত্রীর শারীরিক সুস্থতা কোনও অদ্ভুত এবং অশুভভাবে ওই ঘুড়ির ওড়াউড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঘুড়িটি যখন ওপরে উঠতে থাকে, তখন তার নাড়ির গতিও থাকে স্বাভাবিক। কিন্তু যেই মুহূর্তে জিনিসটা মাটির দিকে নেমে আসতে শুরু করে,
তার হৃৎস্পন্দন ধীর হয়ে আসে, মৃত্যুচলে আসে নিকটে।
এই ব্যাপারটার শুরু কবে থেকে?’
‘গতকাল দুপুর থেকে,’ বলল কর্লিন। ‘এলিস এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে বিছানায় শুয়ে
পড়তে বাধ্য হয়েছিল। প্রথমেই আমার মনে আসে ওই শয়তান ঘুড়িটাকে টেনে নামানোর, আমি কাজটা করতে গিয়েছিলাম।
সেই সঙ্গে প্রায় মেরে ফেলার জোগাড় করেছিলাম ওকে। ওই গাছে উঠে ওটাকে আস্তে আস্তে টেনে নামাতে শুরু করেছি,
এই সময় ফে রিভলভারে গুলি ছুঁড়ে জানাল ওর মায়ের অবস্থা খুবই খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে। গাছ থেকে নেমে পড়ি আমি তৎক্ষণাৎ।
কর্লিন আমার দিকে ঝুঁকল। ‘খোদার কসম, ডাক্তার! এ কিসের বিরুদ্ধে লড়াই করছি আমরা?’
আমি জবাব না দিয়ে পাশের আরেকটি কামরার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেতরে দেখলাম অনেকগুলো শেলফ,
দেয়ালে থরে থরে সাজানো অদ্ভুত কিছু জিনিস।
‘আপনার কালেকশন আমাকে দেখতে দিন,’ বললাম, ‘হয়তো এ থেকে কোনও ক্লু খুঁজে পাবো।’
কর্লিন তার কালেকশনের জন্য এই এলাকায় বেশ পরিচিত। বহু বছর ধরে সে এই কালেকশনের পেছনে লেগে আছে। সে মাথা ঘুরিয়ে ডাকল,
‘কাংচো, এদিকে আয় শিগ্গির।’
ক্যান্টোনিজ ছেলেটি দৌড়ে এল কর্লিনের গলা শুনে, দ্রুত দরজা খুলল।
‘কয়েকদিন আগে এক চোর ঢুকেছিল আমার ঘরে,’ বলল কর্লিন। ‘আমার জিনিসপত্র চুরি করতে চেয়েছিল হারামজাদা।
আমি গুলিও করেছিলাম ব্যাটাকে লক্ষ করে। কিন্তু মিস হয়েছে গুলি।’
কর্লিনের সংগ্রহের বেশিরভাগ জিনিস বোর্নিও থেকে সংগ্রহ করা। বেশকিছু জিনিস যেমন
জাগ, সিলেবস। এসব চীন থেকে আনা। আমার চোখে পড়ল পরাং ব্লো-পাইপ এবং কিছু
মৃন্ময়পাত্র। তবে চোখ আটকে গেল কোনার দিকে একটি শেলফের ওপর। টকটকে লাল রঙের বিশাল একখণ্ড সিল্কের কাপড় রাখা ওখানে।
‘সিল্কের এই কাপড় খণ্ড খাঁটি তিব্বতী কাজ,’ আমার আগ্রহ লক্ষ করে বলল কর্লিন।
‘এনেছি উত্তর ভারতের নিষিদ্ধ মন্দির পো উয়ান কোয়ান থেকে। যখন জিনিসটা আমার চোখে পড়ে তখন ওটা দিয়ে অগ্নিদেবতার পূজা করা হচ্ছিল।’
‘আ-সত্যি বলতে কি, আমি লোভ সামলাতে পারিনি। বাইরের দেয়াল বেয়ে, খোলা এক
জানালা দিয়ে ঢুকে কাপড়টা নিয়ে আসি আমি। মন্দিরের পুরোহিতরা তখন সবাই ঘুমাচ্ছিল।’
‘আপনি ওটা চুরি করেছেন?’ চিৎকার করে উঠলাম আমি। মাথা ঝাঁকাল কর্লিন। ‘যারা এসব দু®প্রাপ্য জিনিস সংগ্রহ করে
তাদের প্রয়োজন পড়লে এরকম এক আধটু শঠতার আশ্রয় নিতেই হয়। এতে অন্যায়ের কিছু নেই। তিব্বতীদের কাছে এই কাপড়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
সন্ন্যাসীরা এটাকে অগ্নি দেবতার বস্তু বলে উল্লেখ করছিল। তাদের বিশ্বাস যারা এই বস্ত্রের অবমাননা করবে তাদের ওপর সপ্ত নরক ভেঙে পড়বে।’
বস্ত্রখণ্ডটির সকল সৌন্দর্য নিহিত এর মাঝখানে, ড্রাগনের ছবি আঁকা ডিজাইনটির মধ্যে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই,
তবে জানি সকল পৈশাচিক পূজা অর্চনা এই ড্রাগনের নামেই করা হয়। এশিয়ার সবচে অজ্ঞাত ধর্মগুলোর মধ্যে এটিও একটি।
ধর্মটি প্রেতপূজার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং…
আমি কাছে এসে কাপড়টি পরীক্ষা করে দেখলাম। ডানদিকের নিচের অংশটি ছেঁড়া লক্ষ করলাম।
‘যে চোরটা ওটা হাতাবার চেষ্টা করেছিল সে এই কাজ করেছে,’ ঘোঁতঘোঁত করে উঠল
কর্লিন। ‘তবে কাপড়টা নিয়ে যাওয়ার আগেই আমি এসে উপস্থিত হই। সে ওইটুকু ছিঁড়ে
অন্ধকারে পালিয়ে যায়- কি হয়েছে, ফে?’
কর্লিনের মেয়ে এসে ঢুকেছে ঘরে। তার মুখ কাগজের মত সাদা।
‘তাড়াতাড়ি, ডাক্তার,’ কেঁদে উঠল সে, ‘আমার মা…’
বিদ্যুৎবেগে আমি এলিসের ঘরে ঢুকলাম। তার পাশে বসেই বুঝতে পারলাম সমস্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে সে। মারা গেছে এলিস কর্নিল।
স্পন্দনহীন কব্জিটি হাতে ধরে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। ঘুড়িটি ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিচে।
গাছের মাথায় আছড়ে পড়ল ওটা, পরক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘন জঙ্গলে।
সামারিন্ডা ত্যাগ করার জন্য যেভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, এলিস কর্লিনের অস্বাভাবিক মৃত্যু আমার সেই ব্যস্ততার আগুনে জল ঢেলে দিল।
ডেথ সার্টিফিকেট যদিও লিখলাম অতিরিক্ত ম্যালেরিয়া জ্বর এলিসের মৃত্যুর কারণ, কিন্তু আমি জানি কারণটা আরও রহস্যময়, আরও গভীরে প্রোথিত।
ঘুড়িটিকে সংগ্রহ করেছি আমি। কর্লিনের বাড়ির কাছে ডায়াক অধিবাসীরা তামাকের বদলে ওটাকে দিয়ে গেছে আমায়।
জিনিসটা বাঁশ আর রাইস পেপার দিয়ে তৈরি, যেমন ধারণা করেছিলাম আমি। কিন্তু ওপরের অবশিষ্টাংশে ছোট এক টুকরো লাল সিল্ক কাপড় সিরিশ দিয়ে
জোড়া লাগানো।
গন্ধ শুঁকলাম। কর্লিনের সেই অগ্নি দেবতার পূজার বেদির কাপড়ের গন্ধ!
হপ্তাখানেক পর কর্লিন এল আমার বাড়িতে। বারান্দায় মুখোমুখি বসলাম দু’জনে। কর্লিনকে
ভয়ানক উদ্ভ্রান্ত লাগছে।
‘ভ্যান রুলার,’ বলল সে। ‘আবার আরেকটা ঘুড়ি।’
‘কী?’ চিৎকার করে উঠলাম।
মাথা ঝাঁকাল কর্লিন। ‘অবিকল আগেরটার মত। একই সাইজ, একই রঙ, একই রকমের তার,
দিন দুই ধরে দেখতে পাচ্ছি ওটাকে। তবে মনে হয় রাতের বেলা ওটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমার মেয়ে ফে…’
‘ওকেও ধরেছে?’ ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি।
কর্লিন হাত মুঠি করল। ‘এলিস যেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেভাবে নয়। মানসিকভাবে
অসুস্থ হয়ে পড়েছে ফে। কোনও দুষ্ট আত্মা ওকে ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে।’
এবার নিজে থেকেই বললাম, ‘ফে-কে দেখতে যাব আমি।’ কর্লিনকে অপছন্দ করলেও ঘটনাটা
আমাকে যেন সম্মোহিত করে তুলছিল। কর্লিনকে জানালাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি
সাম্পানে চড়তে যাচ্ছি।
রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার কারণে আকাশের মুখ কালো। কাংচোকে নিয়ে সাম্পানে চড়ে
বসলাম আমি। ও সাম্পানের পেছনে বসে ডায়াক মাঝিদের নির্দেশ দিতে লাগল।
গতবারের ঘুড়িটি যে জায়গায় দেখেছিলাম ঠিক একই স্থানে এই ঘুড়িটিকেও দেখলাম।
নদীঘাটে সাম্পান ভেড়ার আগ পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম ঘুড়িটির দিকে। কিন্তু
কোনও মন্তব্য করলাম না।
কিছুক্ষণ পর ফে কর্লিনের সঙ্গে দেখা করলাম আমি। ঘরের মাঝখানে একটি চেয়ারে
পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে মেয়েটি। চোখ দুটো সামনের দিকে স্থির। একটি মুখোশ যেন
পরে আছে সে, ঠোঁট দুটো রক্তশূন্য।
মিনিট পাঁচেক ওর সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বলার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ফে কোনও কথা বলল না। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ল,
গলা চিরে বেরিয়ে এল সুতীব্র আর্তনাদ। পরমুহূর্তে মরা মানুষের মত ধপাস করে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
আমি ওকে পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু ভয়ে আমার বুক ইতোমধ্যে ধড়ফড় শুরু করে দিয়েছে।ঘুড়িটি আবার তার কাজ শুরু করে দিয়েছে!
কিন্তু এবার আর ব্যাপারটাকে সহজে ছেড়ে দেব না প্রতিজ্ঞা করলাম। মেয়েটির শারীরিক সামর্থ্য ওই ঘুড়ির ওঠা-নামার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা সত্য। ঘুড়িটিকে টেনে নামানো যাবে না, তাহলে মেয়েটি মারা যাবে, ওকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করতে হবে।
ওষুধের বাক্সটা নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরুলাম আমি। জঙ্গলের মধ্যে থেকে দৌড়াতে
দৌড়াতে চলে এলাম নদীর ঘাটে। চড়ে বসলাম সাম্পানে। তীর লক্ষ করে বৈঠা বাইতে শুরুকরলাম সর্বশক্তি দিয়ে।
আকাশে ঝড়ো মেঘ জমেছে, ঝড়ের পূর্বাভাস। তামার তারটিকে অনুসরণ করে আমি তীরে চলে এলাম, ঢুকলাম জঙ্গলে।
তারটি এখনও সেই পালাপাক গাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমি ওষুধের বাক্স খুলে কাজে লেগে গেলাম।
প্রথমেই বের করলাম পাইরোক্সিলিন, প্রে করে দিলাম সামনে। ইথার এবং অ্যালকোহলের সঙ্গে চল্লিশ গ্রাম পাইরোক্সিলিন মেশালে তৈরি হয় কলোডিয়ন,
ছোটখাট ক্ষত সারাবার মহৌষধ। আসলে পাইরোক্সিলিন গানকটন ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বাক্স থেকে একটি ব্রাশ টিউবও বের করলাম। ওটার দুটো মুখেই বারুদের ক্যাপ পরানো। ক্যাপ দুটো খুলে ওগুলোর মধ্যে গানকটন ঢোকালাম।
পকেট থেকে একটা বড় কাগজের টুকরো বের করলাম, তারপর ঘড়ির চেইনটি খুললাম।
বাচ্চাদের ঘুড়ির লেজেতে বেঁধে খবর পাঠাতে দেখেছেন? আমিও তাই করতে যাচ্ছি। তবে পার্থক্য হলো আমার ‘খবর’ হচ্ছে বিস্ফোরক গানকটন।
আকাশে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠলেই হলো, সামান্য ছোঁয়াও যদি এই পাইরোক্সিলিনে লাগে, সঙ্গে
সঙ্গে মাঝ আকাশে ধ্বংস হয়ে যাবে ওই ঘুড়ি। আমি তামার তারটিকে গাছের সঙ্গে ভাল করে বাঁধলাম,
তারপর মালমশলা জড়ানো কাগজটিকে ওটার সঙ্গে বেঁধে দিলাম।
কাজ করতে করতে কাছিয়ে এল ঝড়। ঘুড়িটি জঙ্গলের ঢেউ খেলানো গাছগুলোর ওপর উড়তে শুরু করল।আমি তারটিকে খুলে দিলাম।
তারের সঙ্গে বাঁধা কাগজের টুকরোটি এক মুহূর্তের জন্য নট নড়ন চড়ন হয়ে থাকল, তারপর মৃদু গুঞ্জন তুলে তারের সঙ্গে ওটা উঠতে লাগল ওপরের দিকে।
আমি আর দেরী করলাম না। ফিরে চললাম সাম্পানের উদ্দেশে। বাইতে শুরু করলাম
বৈঠা।বাড়ি ফিরে দেখি ফে কর্লিনের কালেকশন রুমের কটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ঘরের শেষ মাথার জানালার কাছে উঁকি
মেরে দাঁড়িয়ে আছে ক্যান্টোনিজ ছোকরা কাংচো।আমি ফে-র কব্জি চেপে ধরে বসে থাকলাম। কর্লিন ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল।
কাংচোকে দেখেও না দেখার ভান করল।ঘরের কোণে, কাঠের বাক্সে রাখা তিব্বতী সেই সিল্ক কাপড় খণ্ডকে দেখলাম অনেকখানি
বেরিয়ে আছে বাইরে। লাল রঙটাকে আরও উজ্জ্বল এবং তীব্র লাগছে।ঝড় বোধহয় এসেই গেল। পুবাকাশ থেকে ছুটে এল বিশাল এক
টুকরো কালো মেঘ, ধেয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। পরক্ষণে সাপের জিভের মত ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ ঠিক ঘুড়িটির কাছে। প্রচণ্ড বজ্রপাতের
শব্দে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল থরথর করে।
পাঁচ সেকেন্ড পর আকাশে জ্বলে উঠল আগুনের বিশাল এক চাবুক, খোলা জানালার ওপরে।চাবুকটা আঘাত হানল ড্রাগন লেজটাকে,
তামার তারটি সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে, সাপের মত পাক খেতে লাগল। পরমুহূর্তে ঘুড়িটি অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।
খাটে শুয়ে থাকা মেয়েটির সারা শরীর নাড়া খেল প্রবলবেগে। মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল। নাড়ি কাঁপতে লাগল থরথর করে।
তারপর ধীরে ধীরে বিট স্বাভাবিক হয়ে এল, আমি স্বস্তিসূচক চিৎকার দিলাম।
সাফল্যের উল্লাসের স্বাদ অনুভব করার আগেই কাংচো-র গগনভেদী চিৎকারে আঁতকে উঠলাম আমি। ছেলেটা বিস্ফারিত
চোখে চেয়ে আছে রক্তলাল সিল্কের কাপড়ের টুকরোটির দিকে।স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম কাপড়টি থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে,
পরক্ষণে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল ওটাতে।
গুঙিয়ে উঠল কর্লিন। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন নড়তে ভুলে গেছে। কাঠের বাক্সটির মুখ খুলে গেল কারও অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে,
সাপের মত জটা মেরে এঁকেবেঁকে বেরুতে শুরু করল জ্বলন্ত সিল্কের টুকরো। তারপর বাতাসে যেন পাখা মেলল ওটা, ভাসতে থাকল ঘরের মধ্যে।
কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে জ্বলন্ত এবং জ্যান্ত কাপড়ের টুকরোটি ছুটে গেল কর্লিনের
দিকে। পালাতে চেষ্টা করল কর্লিন, কিন্তু ওর পা যেন গেঁথে থাকল মেঝের সঙ্গে, ভীত
এবং হতভম্ব হয়ে সম্মোহিতের মত চেয়ে রইল সে ছুটে আসা মৃত্যুদূতের দিকে। আতঙ্কিত আমি দেখলাম জ্বলন্ত সিল্ক টুকরো সাপের মত পেঁচিয়ে ধরল কর্লিনকে।
ওকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যেতে চাইলাম সামনে। কিন্তু অদৃশ্য কোনও শক্তি এক পা-ও এগুতে দিল না আমাকে নিজের জায়গা থেকে।
ভয়ঙ্কর চিৎকার করে মেঝেতে ছিটকে পড়ল কর্লিন। ধোঁয়ার বিশাল এক পর্দা ঘিরে ফেলল ওকে। মাংস পোড়ার তীব্র গন্ধ ভেসে এল নাকে।
এই সময় আমি নড়ে উঠলাম, দৌড় দিলাম সামনের দিকে। দুই হাত দিয়ে কাপড়ের টুকরোটিকে ছুটিয়ে আনতে চাইলাম কর্লিনের শরীর থেকে।
কিন্তু ওটা যেন জোঁকের মত সেঁটে থাকল তার শিকারের গায়ে। একটা কম্বল চোখে পড়ল আমার অদূরে, ওটা দিয়ে আগুন নেভানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলাম।
কিন্তু লাভ হলো না কোনও, বরং শিখা আরও লকলক করে উঠল।
শেষ মরণ চিৎকারটা দিয়ে স্থির হয়ে গেল কর্লিন। উপুড় হয়ে পড়ে থাকল।
জানুয়ারির ২৯ তারিখ সামারিন্ডা ত্যাগ করল ফে। আমি এক হপ্তা পর যাত্রা শুরু করলাম সিঙ্গাপুর অভিমুখে।
কিন্তু কাংচো-র টিকিটির দেখাও পেলাম না কোথাও।
এডওয়ার্ড কর্লিনের মৃত্যুর জন্য ক্যান্টোনিজ এই ছোকরা যে দায়ী তা আমি ডাচ কর্তৃপক্ষকে বলতে পারতাম।
অথবা এই ঘটনার ওপর একটি তদন্ত করার দাবিও জানাতে পারতাম। কিন্তু এগুলো করে ‘কলোনিয়াল কোর্ট অভ ল’
যে কথা জানতে পারত তা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভব বলেই মনে হত।
পুরো ব্যাপারটাকে আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন, আমি
কর্লিনের বাড়িতে গ্যাসোলিনের একটি ক্যান আবিষ্কার করেছিলাম। তাছাড়াও ওই বাড়িতে আমি খুঁজে পেয়েছি একগোছা তার,
তার গোছা কালেকশন রুমে ছিল। সম্ভবত বাঁশের কার্টেনের সাপোর্টিং লাইন হিসেবে ওগুলোর ব্যবহার করা হত।
এবং এই তার থেকে সৃষ্ট আগুন ওই সিল্কের কাপড়ে আগুন লাগার কারণ হিসেবে বলা যায়। আর কাংচো-র ব্যাপারে
যে কথাটি আমি জেনেছি তা হচ্ছে সে আদৌ ক্যান্টোনিজ নয়, সে আসলে সেই নিষিদ্ধ মন্দির পো ইয়ান কুয়ান, যেখান থেকে কর্লিন
অগ্নি দেবতার বস্ত্র চুরি করেছিল, সেখানকার এক প্রাক্তন সন্ন্যাসী, একজন তিব্বতী।
কিন্তু তারপরও সেই ভৌতিক ঘুড়ি, কর্লিনের স্ত্রীর মৃত্যু এবং তার কন্যার জীবনে সেটার অদ্ভুত প্রভাব, এসব প্রশ্নের জবাব আমি খুঁজে পাইনি।
শুধু জ্বরের কারণে এলিস মারা গেছে কিংবা ফে অসুস্থ হয়েছে, এই কথা আমি বিশ্বাস করি না।