আবির বসে বসে হা করে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে। এই আকাশে এতগুলো নীলরং কে ঢেলে দিল? আবির এই ভাবনা বেশিক্ষন ভাবতে পারলো না। কারণ তার মা তাকে বসা থেকে উঠিয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর মাথায় জবজবে করে নারকেল তেল লাগিয়ে দিল। নতুন জামা, নতুন জুতো পরিয়ে আবিরকে তাদের নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে বললো। আবির বসে রইলো মায়ের কথামত। বসে বসে আঙ্গুলের কর গুনতে শুরু করলো। তের পর্যন্ত যাওয়ার পরই সব গুলিয়ে যায়। তখন আবার প্রথম থেকে গুনতে শুরু করে। এভাবে চলতে থাকে তার অংক। একে একে গাড়িতে আবিরের বাবা, মা আর বড় ভাই সবাই উঠলো। তারপর গাড়ি ছুটতে লাগলো। সবার মুখ গম্ভীর হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বড় কোন ঝড় বয়ে গেছে তাদের উপর।
— ভাইয়া আমরা কোথায়?
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারেনা আবির। আসলে ইচ্ছে করেই কথা শেষ করেনা আবির। কথা শেষ করার আগেই আবিরের মস্তিষ্কের ভেতর থেকে শব্দ আসে,
— আরে বেকুব এত কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক।
মস্তিষ্কের ভেতরের সত্বার কথায় আবির কথা শেষ না করেই চুপ করে যায়। আবিরের বয়স এখন বাইশ। সেই ছোটবেলা থেকেই আবিরের এই স্বভাব। সবাই মনে করে আবির বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। এক কথায় প্রতিবন্ধী আরকি। আবিররা কোথায় যাচ্ছে তা আবির এখনো জানেনা। জানতে খুব ইচ্ছে করছে আবিরের। সে তাকায় তার বাবার চকচকে টাকের দিকে। অদ্ভুতভাবে তখনই তার বাবা তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
— বুঝেছিস আসাদ, এখন গ্রামেও মেয়েরা নিরাপদ নয়। মাদরাসায় পড়া মেয়েটাকে এভাবে শেষ করে দিতে পারলো জানোয়ারের দল?
বাবার কথায় আবির এতটুকু বুঝতে পারলো যে কেউ একজন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে শেষ হলো তা আবির জানে না। আবিরের এখন জানতে ইচ্ছে করছে না। একটা মশা আবিরের বাম হাতের কনুইয়ের উপর বসেছে। গাড়ির ভেতর মশা কিভাবে এলো কে জানে। আবির মশা মারার জন্য হাত উপরে উঠায়। তখনই তার মস্তিষ্ক বলে উঠে,
— খবরদার মারবি না। চুপচাপ রক্ত খেয়ে চলে যাবে। এত হাঙ্গামা কিসের?
আবির মশাটাকে রক্ত খেতে দেয় এরপর। মশাটা রক্ত খেয়ে চলে যেতে চায়। তবে রক্ত বেশি খাওয়ার ফলে মশা উড়তে পারছে না। এসব দেখতে দেখতে আবির ঘুমিয়ে গেল। গভীর গাঢ় নির্ভেজাল ঘুম।
আবিরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কোথায় যেন বসিয়ে দেয়া হলো। আবিরের পেছনে প্রকান্ড ধানক্ষেত আর একটু সামনে পুকুরঘাটের সামনে একটা খাটের মত জিনিস। কালো কাপড় দিয়ে উপরটা ঢাকা। ভেতরে সাদা কোলবালিশের মত কি যেন দেখা যাচ্ছে। আবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। খাটের চারপাশে মানুষের জটলা বাড়ছে।
ঘন্টাখানেক পর চারজন লোক খাট সহ কোলবালিশের মত জিনিসটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে কোথায় যেন যেতে থাকে। আবিরের বাবা, ভাই আর ওর চাচা সঙ্গে যাচ্ছে। আবির তখনও বসে আছে একটা কাঠের পিঁড়িতে। তার মাথার ভেতর তালগোল পাকাচ্ছে।
— এমন ফুলের মত মাইয়াডের এমুন ভাবে মারতে পারলো?
— এই কাম কেডায় করবার পারে?
— আরে মিয়া তুমি জানো না বুঝি? গ্রামের বেবাকে জানে এই কাম রশিদমোল্লার ছোড পোলা কালুর।
— তয় ময়নার বাপে মামলা না কইরা এমনে চুপেচাপে লাশ দাফন করাডা অয়নাই। থানা পুলিশ করার দরকার আছিল।
— থানা পুলিশ কইরা কি অইবো? ওগো টেকার কাছে গরীবের জীবনের দাম আছে কুনু? মামলা করলি পরে গেরাম থেইকা ময়নার বাপেরে খেদাইবো।
সন্ধ্যার কিছু আগে আবির বসা থেকে উঠলো। তারপর হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁশঝাড়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাঁশঝাড়ের পেছনেই কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ওদের কথা শুনে আবির বুঝতে পারলো সাদা কোলবালিশের মত জিনিসটা আসলে লাশ। মানুষ মারা যাওয়ার পর শরীরটাকে লাশ বলে। আবির ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। আরো কিছু শুনতে সে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
— কালু কয়দিন আগেও ময়নারে মাদরাসায় যাওনের পথে আটকায়ছিলো। ময়নারে অনেক উল্টাপাল্টা কতা কইছে। আমি নিজে দেখছি। মাইয়াডা সহ্য করতে না পারি কালুরে চটকানা দিছিলো। তহন কালু বাজারের বেবাকের সামনে ময়নারে হুমকি দিলো তুইলা লইয়া যাইবো।
— কালু বড় ঘাউড়া পোলা। ময়নার উচিত হয়নাই চটকানা দেওয়ার। না দিলি তো এইভাবে মরতি হতো না।
আবিরের মস্তিষ্কের ভেতর একটা নাম গেথে যায়। কালু কালু কালু, খায় শুধু গোল আলু। আবির বাঁশঝাড়ের ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন। তার মস্তিষ্কের ভেতর থেকে ভেসে আসে,
— এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিস না। তোর ভাই তোকে খোঁজে।
আবির পেছনে ফিরে তাকালো। আবিরের ভাই আসাদ আবিরকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে এখানে। আবির চোখ ফিরিয়ে নেয় আসাদের উপর থেকে। তার দৃষ্টি বাঁশঝাড়ের মাথায়। একটা দাঁড়কাক বসে আছে সেখানে। আবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাকের দিকে। কাকটাও আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাতে যেখানে আবিরের ঘুমের ব্যবস্থা হলো সেই ঘরের একটু দূরেই গ্রামের কবরস্থান অবস্থিত। রাত প্রায় এগারোটা। গ্রামের হিসেবে এখন নিশুতি রাত। কিছুক্ষন পরপরই কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। ময়নার মা কাঁদছে হয়তো মেয়ের শোকে। আবিরের পাশেই আসাদ শুয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আবির খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কবরস্থান থেকে কেমন যেন একটা শব্দ ভেসে আসছে। কুকুরের কান্নার মত। কিন্তু ঠিক যেন কুকুরের কান্না নয়। মনে হচ্ছে একদল প্রানি এই ডাকের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করছে। আবির আসাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। আসাদ ঘুমঘুম চোখে তাকায়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। তবুও আসাদ বুঝলো আবির জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে শিয়ালের ডাক শুনছে।
— আবির ঘুমিয়ে পড়। তুই ভয় পাচ্ছিস? ওগুলো শিয়ালের ডাক। গোরস্থানে নতুন লাশ এসেছে তো তাই তাদের এমন আনন্দ।
আবির আসাদের দিকে না তাকিয়ে আসাদের কথাগুলো শোনে মনযোগ দিয়ে। নতুন লাশ আসলেই শিয়ালদের আনন্দ হয়। আবিরের মস্তিস্ক কথা বলে উঠে,
— আবির চল শিয়াল দেখে আসি।
আবির আর কথা বাড়ালো না। জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বিড়ালের মত বের হয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই জানালার ফাঁক দিয়ে বিড়ালও ঠিকমত ঢুকতে পারে না। আবির হাঁটতে হাঁটতে গোরস্থানের ভেতর ঢুকে গেল। ময়নাকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে সেখানে কমপক্ষে দশটা শিয়াল জটলা পাকিয়ে আছে। আবিরের পায়ের শব্দে শিয়ালের দল প্রথমে চমকে যায় এবং ভয় পেয়ে এদিক সেদিক সরে পড়ে । আবির কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কবরের ডানপাশ দিয়ে সদ্য খোঁড়া একটা গর্ত দেখা যাচ্ছে। আরেকটু খুঁড়লেই হয়তো লাশের নাগাল পাওয়া যেত।
আবির ঠাঁয় দাড়িয়ে আছে কবরের সামনে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো হিংস্র শিয়াল। তাদের সবার দৃষ্টি আবিরের দিকে আর আবিরেরদৃষ্টি আকাশের দিকে । আবছা আবছা চাঁদের আলোয় আকাশের রঙ কেমন যেন সাদা হয়ে আছে। আবির তাকালো তাকে ঘিরে ধরে থাকা শিয়ালের দিকে। শিয়ালগুলো এগিয়ে আসছে তার দিকে। আবির কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিয়ালের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর।
পরদিন সকালে পুরো গ্রামে হইচই পড়ে যায়। গ্রামের চেয়ারম্যান রশিদ মোল্লার ছোট ছেলে কালু গতকাল রাতে শিয়ালের আক্রমনে মারা গেছে। শুধু শিয়াল না, রাতে নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে দাঁড়কাক উড়ে এসে কালুর উপর আক্রমন করেছিল। রশিদ মোল্লার বাড়ির সবাই অনেক চেষ্টা করেছিল শিয়ালের হাত থেকে কালুকে বাঁচাতে। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হয়েছে।
শিয়াল কখনো নিজ থেকে কাউকে আক্রমন করে না। কিন্তু গতকাল রাতে কালুকে এতগুলো শেয়াল একসাথে আক্রমন কেন করলো তা সবার কাছেই রহস্য। আরো বড় রহস্যের ব্যাপার হচ্ছে রশিদ মোল্লার বাড়ির চারপাশে এখনো কয়েকশত কাক উড়ছে আর বিকট শব্দে কা কা করছে। আবিরকে রেখে সবাই লাশ দেখতে গেছে। আবির বসে আছে চুপচাপ। আবিরের হাতে তখন দাঁড়কাকের পালক আর শিয়ালের লোম।