বারো বছরের মিনু ভারী অসুখ থেকে ওঠার পর ডাক্তারবাবুরা পরামর্শ দিলেন কিছু দিনের জন্য ওর চেঙে যাওয়া দরকার। কিন্তু কোথায় যাবেন সেটাই সমস্যা। ক্রিসমাসের ছুটি পড়ে গেছে, বেশ ঠান্ডাও পড়েছে। এসময় বেশিরভাগ মানুষ চেঞ্জ অথবা বেড়াতে বেরোন, ফলে কোথাও বাড়ি খালি পাওয়া যাচ্ছে না। একটা হলিডে হোম বা ভাড়া বাড়ি না হলে কোথাও বেশিদিন কাটানোও তাে অসম্ভব। মিনতি দেবী আর বিনোদবাবুর এখন একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কাগজ দেখে দেখে হলিডে হোমগুলোর সঙ্গে যােগাযােগ করা। কিন্তু কোনােটাই হচ্ছে না। হয় খালি নেই, নয় পছন্দসই বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় যখন চেঞ্জ যাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন এঁরা ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটল।
বিনোদবাবুর অফিসের বন্ধু জয়ন্ত ঘোষালের মামাশ্বশুরের বাড়ির একটা সন্ধান পাওয়া গেল। বাড়িটা জসিডি স্টেশনের কাছেই। মাত্র পাঁচ বছর আগে তারক মুখার্জী অর্থাৎ জয়ন্তবাবুর স্ত্রীর মামা জসিডিতে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। ইচ্ছে ছিল মাঝে মধ্যে গিয়ে থাকবেন। তারকবাবু কলকাতার বড় ব্যবসায়ী। সুতরাং, পয়সার কোনো অভাব নেই। আর তার ফলে যা হয়ে থাকে আত্মীয়- স্বজন প্রায়ই জসিডির বাড়িতে গিয়ে ক’দিন করে থেকে আসে।
তারকবার তার ভাইপাে মন্মথকে খুব ভালবাসতেন। মন্মথ তার স্ত্রী জয়া আর বারাে বছরের মেয়ে মাধুরীকে নিয়ে বেড়াতে গেল জসিডির বাড়িতে। কিন্তু সাতদিন যেতে না যেতে সাংঘাতিক একটা খবর এলাে। তারকবাবু খবরটা শুনে বজ্রাহত হয়ে গেলেন। ছােট্ট মাধুরী অত্যন্ত দুরন্ত ছিল। সব সময় তাকে চোখে চোখে রাখতে হত। জসিডির বাড়ির ছাদের কার্নিশটা খুব চওড়া ছিল। মাধুরী সবার অলক্ষ্যে ছাদের কার্নিশে উঠে সার্কাস সার্কাস খেলতে গিয়ে দোতলা থেকে একতলায় পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ। খবরটা পাওয়ামাত্র পাগলের মতাে ছুটে চলে যান তারকবাবু। কিন্তু, সেখানে গিয়ে যা দেখেন তাতে তাঁকে সামলানােই দায় হয়ে ওঠে। মেয়ের শােকে মন্মথ আর জয়া দুজনেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তারকবাবুকে অসুস্থ অবস্থার কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। একটু সুস্থ হয়ে তারকবার উঠে পড়ে লাগলেন বাড়িটি বিক্রি করার জন্যে। কিন্তু বাড়িটা বিক্রি হল না। ওখানকার মানুষের ধারণা বাড়িটায় ভূত আছে। সন্ধের পর নাকি বাড়িতে ওদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। জয়ন্ত বাবুর কাছে সব শুনে বিনােদবাবু বলেন—শােন জয়, বাড়িটা যখন এখনাে বিক্রি হয়নি, আমরা ক’দিন নয় ওখানে কাটিয়ে আসি। তারপর বিক্রি করা যাবে।
অবাক হয়ে জয়ন্ত বললেন—বাড়িটা ভূতের শুনেও তুমি থাকতে চাইছাে? বিনােদবাবু বললেন–আমরা ভূতে বিশ্বাস করি না। এসব লােকাল লােকদের রটনা।
—কিন্তু……একটু ইতস্তত করলেন জয়ন্তবাবু।
বিনােদবাবু জয়কে থামিয়ে দিয়ে বলে –আর কোনাে কিন্তু নয় ভাই—তুমি তারকবাবুকে রাজি করাও। আর একটা কথাও বােল তুমি তারকবাবুকে—যদি আমরা প্রমাণ করে দিতে পারি বাড়িটা ভূতের বাড়ি নয় তাহলে কিন্তু বিক্রি হতে আর অসুবিধে হবে না।
কথাটা জয়ন্ত বাবুর মনে ধরল। তিনি তারকবাবুকে বলে বিনোদবাবুদের জন্য বাড়িটা ব্যবস্থা করে দিলেন।
বাড়িটা হাতে পাবার পর বিনােদবাবু গেলেন তারকবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। লম্বা চওড়া ফর্সা চেহারার মানুষটাকে দেখলে শ্রদ্ধ হয়। কিন্তু মুখের মধ্যে একটা বিষাদের ছাপ। পরিচয় দেবার পর বিনােদবাবু বলেন–আপনি আমাকে বাড়িটা দিয়ে খুব উপর করলেন। এখন বলুন, এর জন্যে কত ভাড়া দিতে হবে।
বিনোদবাবু একটু চুপ করে থেকে বললে– আপনি শুনেছেন হয়তে, লোকে বলে ওখানে অশরীরী ও আছে। তা সত্তেও কি চাইছেন?
—দেখুন, আমার মেয়ের চেঞ্জের জন্যে আমাকে এখন বেশ কিছুদিন স্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকতে হবে। কিন্তু কোনাে জায়গা পাচ্ছি না।
—আপনি ভূতের বাড়ি শুনেও নেবেন? আপনার স্ত্রী-কন্যা যদি ভয় পায়?
—না না— ঘন ঘন মাথা নেড়ে বিনােদবাবু বলে ওঠেন—আমি এ সব বিশ্বাস করি না। তাছাড়া এ সব কথা আমি ওদের বলবই না। আপনি আর কিন্তু করবেন না দাদা, শুধু বলুন কত টাকা ভাড়া দেব?
—কতদিন থাকতে চান?
এই ধরুন একমাস।
বেশ। তবে বলি শুনুন, যদি আপনি প্রমাণ করে দিতে পারেন ওটা ভূতের বাড়ি নয় তাহলে আপনার কাছে এক পরসাও নেব না। কারণ এর ফলে ভাল দামেই ও বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবে। আর যদি সত্যিই ভূত থাকে তবে তো আপনি ওখানে থাকতেই পারবেন না। যদি থাকেন তাে তখন দেখা যাবে।
তারকবাবু উঠে দাঁড়ালেন। ড্রয়ার থেকে এক গােছা চাবি বার করে বিনােদবাবুর হাতে দিয়ে বললেন—এই নিন ও বাড়ির চাবি। দরকার হলে আমাকে ফোনে খবর দেবেন।
বিনােদবাবু নমস্কার করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তারকবাবু পিছু ডাকলেন–শুনুন। একটু সাবধানে থাকবেন।
বিনােদবার একটু হেসে বেরিয়ে গেলেন।
খুব সুন্দর বাড়িটা, বেশ বাংলো পাটার্নের। ওরা গিয়ে দাঁড়াতেই একজন দরজা খুলে দিল। পরিচয় দিল ‘মলুয়া’ বলে। ঐ বাড়ির দেখাশােনার ভার ওর ওপর রয়েছে। সারাদিন ও থাকে কিন্তু রাত্তিরে একটু দূরে এর নিজের ধরে চলে যায়। সেখান থেকে নজব রাখে ও বাড়ির ওপর। ওরা যখন পেছােল তখন প্রায় বিকেল। মলুয়া মিনতির দিকে তাকিয়ে বলল–মা, আমার ঐ দুখিয়া রসুই করে দেবে–আর সব কাম ভি করবে, আপনাকে ভাবতে হবে না।
তারপর মিনুর দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বলল- তুই ঠিক আমার দিদিমণি আছিস। তুকে আমি দিদি বলে ডাকব? কেমন?
মলুয়ার কালো কুচকুচে চেহারটির মধ্যে এখনো সরলতা দেখে ওরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। এমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে মনেই হয় না এখানে কেউ থাকে না।
বিনোদ বাবু হঠাৎ বলে ওঠে—মলুয়া চল তো, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে। মলুয়া কে নিয়ে বাগানের ভেতর গিয়ে বিনােদ বাবু বললেন
— মলুয়া, যা শুনেছি সব কি সত্যি? এ বাড়িতে ভূত আছে?
মলয়া মাথা নিচু করে খানিক্ষণ বসে , তারপর মাথা তুলে বলে ওঠে—বাবু, আপনি তো সব শুনে জেনে এসেছেন। একটু সাবধানে থাকবেন, আমি আর কি বলব?
বিনােদবাবু বুঝলেন মলুয়া কিছু বলতে চায় না, তাই আর জোর না করে বললেন- শোন মলুয়া, তুমি আমি যা জেনেছি বা দেখব—মিনতি আর মিনুকে বলব না। তুমিও বলবে না কিন্তু। ঠিক আছে?
মলুয়া মাথা নেড়ে জানায়—সব ঠিক।
সন্ধ্যে ছটার পর মলুয়া আর থাকে না। ঠিক ছ’টা বাজতেই মলুয়া বিনােদবাবুর কাছে ছুটি নিয়ে চলে গেল। বাড়িটা বাংলাে প্যাটার্নের। নীচে ঢুকেই যে ঘর সেটা বসার ঘর। এই বসার ঘরের দু’পাশে দুটো বেডরুম। দুটোই চাবি দেওয়া। বিনােদবাবু নীচের ঘর নিয়ে চিন্তা করেননি। তিনি ওপরে অর্থাৎ দোতলায় যে তিনটে বেডরুম আছে সেগুলােই নিয়েছেন। সামনে ছােট্ট একটা ছাদ। ওপরটা ঘেরা। মিনতি দেবী ঠিক করলেন ঐখানেই তিনি রান্না করবেন। বিনােদবাবু দেখলেন খাটের ওপর সুন্দর পরিপাটি করে বিছানা করা। তাতে তিনজনের শােবার মতাে বালিশ, গায়ের চাপা পরিপাটি করে বিছানাে। মিনতি দেবীরও
ব্যাপারটা অবাক লাগছিল। তিনি বিনােদবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন—দেখে মনে হচ্ছে, না যেন কেউ এখানে থাকে।
—কে আবার থাকবে? বিনােদবাবু তাড়াতাড়ি মিনতি দেবীর সন্দেহ ভঞ্জন করার চেষ্টায় বলে ওঠেন–কি যে বল না? দেখলে তাে ঘরবাড়ি সব বন্ধ ছিল, আমরাই তাে এসে খুললুম।
চিন্তিত মুখে মিনতি বললেন—সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ তুমি। যাক গে, তুমি হাত মুখ ধুয়ে নীচে বসার ঘরে বােস, আমি চা নিয়ে যাচ্ছি।
বিনােদবাবু বললেন—শােন, মলুয়া বলে গেছে নীচটা খােলা আছে। আমি বরং বন্ধ টন্ধ করি। আজ আর কিছু খােলাখুলি কোরাে না। তাড়াতাড়ি খেয়ে সব শুয়ে পড়ব। যা করার কাল সকালে করা যাবে।
নতুন জায়গায় এসে মিনুও খুব খুশি। নীচের ঘরে বসে সকালে চা-জলখাবার খাচ্ছে এমন সময় দরজায় মৃদু টোকা। বিনােদবাবু দরজা খুলতে একটু ইতস্তত করছিলেন কিন্তু বাইরে থেকে ভেসে এল এক পুরুষের কণ্ঠস্বর। বললে—ভয় নেই বিনােদবাবু, দরজাটা খুলুন। আমরা তারকবাবুর লােক।
বিনােদবাবু আর দ্বিধা না করে দরজাটা খুলে দিলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় পরিবার। মনে হয় স্বামী-স্ত্রী আর তাদের এগারাে-বারাে বছরের একটি মেয়ে।
বিনােদবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন–কি ব্যাপার বলুন তো! এত রাতে…..
ভদ্রলােক বললেন–আমার নাম রাজনাথ। ইনি আমার স্ত্রী জয়া দেবী। আর আমাদের একমাত্র কন্যা পাপিয়া। আমরা তারকবাবুর খুব নিকট আত্মীয়। দেওঘরে আমাদের পূজো দিতে আসার কথা ছিল। ভেবেছিলাম ওনার বাড়িটা খালিই থাকে তাই আগে থেকে বলবার দরকার নেই। কিন্তু আজ সকালে তারকবাবু বললেন আপনাদের কথা। আরও বললেন—নীচের ঘর দুটো তাে খালি থাকবে। ওরই একটা ঘরে আমরা থাকতে পারি। অবশ্য আপনাদের যদি কোনাে অসুবিধে না হয়।
বিনােদবাবু হেসে বললেন—বাড়ি তাে আপনাদের। নিশ্চয়ই থাকবেন। অসুবিধে কি বলছেন মশাই, আমার তাে শুনে ভালই লাগছে। এই নির্বান্ধব পুরীতে তবু একটা সঙ্গী পাওয়া গেল। আসুন, ভেতরে আসুন।
বাড়ির সব চাবি ছিল বিনােদবাবুর কাছেই তাই কোনাে অসুবিধে হল না। মিনতি দেবী বললেন—আপনাদের রান্না-খাওয়ার কি হবে?
জয়া দেবী হেসে বললে—এ বাড়িতে আমি বহুবার এসেছি। নীচের ঘরে রান্নার সুন্দর জায়গা আছে। আপনারা চিন্তা করবেন না।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা বেশ মিশে গেল। মিনু তে পাপিয়াকে পেয়ে খুব খুশি। শুতে যাবার আগে মিনু বলে-পাপিয়া কাল সকালে চলে আসবি ওপরে। আমার অনেক বই আছে দেখাব।
জয়া দেবী একটু কিন্তু কিন্তু করে বলেন—একটা ব্যাপার আছে। সেটা হল পাপিয়ার চোখে কনজেনটিভাইটিস হয়ে রেটিনার একটা সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার ওকে দিনের বেলা ঘর থেকে একদম বেরােতে বারণ করেছেন। আর সেজন্যে ওকে সঙ্গ দিতে আমাকে থাকতে হয়। তবে সূর্য ডােবার পর আর কোনাে অসুবিধে নেই।
পরদিন সকালে উঠে বিনােদবাবু ভদ্রলােকের অনেক খোঁজ করলেন, পেলেন না। সব-চেয়ে অবাক লাগল, ওদের ঘরটায় বাইরে থেকে চাবি ঝুলছে। সারাদিন ওদের কোনাে সন্ধান পাওয়া গেল না। সন্ধে ঠিক সাড়ে ছ’টা নাগাদ ওরা আবার হাজির হল। বিনােদবাবু কোতুহলী হয়ে জিগ্যেস করলেন–কি হল মশাই, সারাদিন থাকেন কোথায় ?
—আর বলবেন না। দেওঘর গিয়েছিলাম সব ব্যবস্থা করতে। আটকে গেলাম এক পান্ডার পাল্লায় পড়ে। ছাড়ন ওসব কথা। আপনি দাবা খেলতে পারেন? বিনােদবাবু খুশি হয়ে বললেন—ওরে বাবা, দাবা আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা।
-আপনি বাের্ড এনেছেন?
-না আনিনি তাে, কেন যে আলাম না! এখন আফশােস হচ্ছে।
–তাতে কি আমারটায় খেলব। দাঁড়ান নিয়ে আসছি।
যতই পাশাপাশি ঘর হােক এত তাড়াতাড়ি কেউ বাের্ড আনতে পারে তা বিনােদবাবুর ধারণারও অতীত। কিন্তু তেমন করে আর ভাবতে সময় পেলেন না বিনােদবাবু। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরােপুরি জমে উঠল ওঁদের আড্ডা।
মিনতি দেবী জয়া দেবীকে নিয়ে ওপরে চলে গেলেন। আর মিনু পাপিয়াকে ছবির বই দেখতে লাগল।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হল, ওদের ওঠার কোনাে লক্ষণ নেই। মিনতি দেবী শেষে বলেই ফেলেন—আপনারাও তাে খাবেন—রাত হল ।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে জয়া দেবী একটু হেসে বললেন–বেশ লাগল আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে, চলি।
দু একদিন পরে হঠাৎ মিনু একদিন মিনতি দেবীকে ডেকে বলল—জানো মা পাপিয়া কেমন ম্যাজিক জানে। তুমি যা চাইবে ও ঘরে বসে তােমায় এনে দেবে। উঠতেও হবে না। শুনে অবাক হলো মিনতি দেবী। বললেন সে আবার কিরে, তাও আবার হয়। নাকি!
—বেশ আমি তােমায় দেখাব। তাহলে বিশ্বাস হবে তাে? শুধ ম্যাজিক না মা, ও ভাল সার্কাসও জানে। বলে আমি দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতেও পারি।
-সে কিরে! পড়ে যাবে তাে? আঁতকে ওঠেন মিনতি দেবী ।
পরদিন সকাল এগারােটা নাগাদ হঠাৎ চিৎকার-চঁচামেচি শুনে ছুটে আসেন বিনােদবাবু, মিনতি দেবী। বাইরে এসে যা দেখলেন তাতে অতি কষ্টে নিজেকে সামলালেন।
দেখালেন পাপিয়া রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর তার পাশে দুটো মৃতদেহ। একটা জয়া দেবীর, অন্যটা রথীন্দ্রনাথের। মলুয়া কাছেই ছিল। বিনােদবাবু চিৎকার করে ওঠেন।
—মলুয়া, তারক বাবুকে এখুনি খবর পাঠানাে দরকার। এ সব কি করে হল!
মলুয়া খুব ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে–আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না বাবু।
বিনােদবাবু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেন—কি বলছাে মলুয়া ? আমি ভাববাে না! এমন একটা ঘটনা! এক্ষুনি ডাক্তার, আমবুলেন্স চাই।
মলুয়া তেমনি ঠান্ডা গলায় বলে–কোনাে লাভ নেই বাবু, ওরা কেউ বেঁচে নেই। বিনােদ বাবু শুনলেন না ওর কথা। কোন রকমে চটি গলিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
মিনতি দেবী মিনুকে নিয়ে ঘরে খিল দিলে। কি জানি মিনু অসুস্থ। যদি কোনো ভাবে দেখে ওর বন্ধুকে ঐ অবস্থায়—কি না হতে পারে।
মলুয়া শেষ বারের মতো বাধা দেয় বিনোদ’কে। বলে–বাবু, যাবেন না। শুনুন না হামার কথা।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স সব নিয়ে এসে হাজির করলেন বিনােদ বাবু। কিন্তু একি, তিন তিনটে বডি গেল কোথায় ?
বিনোদ বাবু, চিৎকার করে ওঠে -মলুয়া এদের কোথায় সরালে?
মলুয়া ও হেসে বলে-বাবু, আপনার , মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখানে তো কিছু হয়নি। আপনি এসব কি বলছেন?
হতভম্ব বিনােদ বাবু ধপ করে বসে পড়লেন বাইরে ঘাসের ওপর। ডাক্তারবাবু রাগ করে বললেন–পাগল জানলে কি বিশ্বাস করতুম ওঁর কথায়! ছিঃ ছিঃ সময় নষ্ট হল—ঝামেলার একশেষ।
সমস্ত ঘটনায় পরিস্থিতি থমথমে হয়ে গেছে। বসার ঘরে চুপ করে বসে আছেন বিনােদবাবু। মলুয়া ঘরে ঢুকল। বিনোদবাবুর পায়ের কাছে এসে বলল—-বাবু— আপনাকে বলেছিলুম না—
বিনােদবাবু মলুয়ার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।
মলুয়া বলল- “আজ অঘ্রান মাসের পাঁচ অরিখ——ঠিক এমনি দিনে এমনি সময়ে গতবছর রথীন্দ্রনাথবাবু, বৌদিমণি আর পাপিয়া দিদিমণি—তিনজনেই মারা গেছিল। বিনােদবাবু চমকে উঠে বললেন–মানে?
—বাবু, এরাই তারকবাবুর ভাইপাে ও তার পরিবার। এ বাড়ির মায়া এরা ছাড়তে পারেনি। এখানেই থাকে।
বিনােদবাবু বললেন—তবে যে সেদিন রাত্তিরে ওরা এসে বললেন–তারকবাবু পাঠিয়েছেন।
মিথ্যে কথা না বললে আপনারা তাে সন্দেহ করবেন। তাই বলেছে। একটা কথা বলি বাবু, আপনারা কিন্তু আর এখানে থাকবেন না। প্রেতাত্মাদের ব্যাপার। কখন কি করে ঠিক আছে।
সেদিন সন্ধেবেলাই বিনােদবাবু যাত্রা করলেন কলকাতার দিকে।
(সমাপ্ত)