রবিবার দুপুরবেলা ব’সে–ব’সে হাই তুলছি। কোন কাজ নেই। গরমও পড়েছে বড্ড; আশ্বিন মাসে যখন প্রচণ্ড রোদ ওঠে আর একটুও হাওয়া দেয় না, সেই দম-আটকানো পিন-ফোটানো গরম। ভেবেছিলাম, আনকোরা, টাটকা অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বইখানা পড়বো, কিন্তু দু’পাতা পড়েই মনে হচ্ছে কোথায় যেন আগে পড়েছি! বসে আছি চুপচাপ।
এমন সময় পা টিপে টিপে অনুতোষের প্রবেশ। পা টিপে টিপে কেননা, মেজকাকা পাশের ঘরে দিবানিদ্রায় সচেষ্ট; যে-বেচারারা নেহাতই ছেলেমানুষ, তারা যেন কোন রকমেও তাঁর সেই মহৎ চেষ্টায় বাধা না দেয়, এই হচ্ছে তাঁর তিন নম্বর আইন। এক আর দুই নম্বর এখন নাই শুনলে।
‘কী রে অনুতোষ, কী মনে করে?’
কপালের ঘাম মুছে অনুতোষ বললে, ‘চল।’
‘কোথায়?
‘চল, সিনেমা দেখে আসি।’
‘পাগল! এই রোদ্দুরে!’
‘কী যে বোকার মতো কথা বলিস। মেট্রোর ভিতরটা কেমন ঠাণ্ডা! গরমের দিনে দুপুরে কাটাবার জায়গাই যে ঐ।’
‘আচ্ছা-চুপ কর। বাগবিতণ্ডা করবার উপায় নেই, পাছে মেজকাকার হুমকি শুনতে হয়। মনের মধ্যে নানা রকম প্রতিবাদ ফোঁস ফোঁস করছে, তবু, চুপ করে থাকতে হল।
‘তবে চল।’
‘পয়সা?’
‘সেজন্য ভাবতে হবে না। ওঠ তুই। দেরী হয়ে যাচ্ছে।’’
মাকে বলে, এমন কি চার আনা পয়সা আদায় করে নিয়ে, (এটা দিয়ে ‘হ্যাপি বয়’ খাওয়া হবে) বেরিয়ে পড়লুম অনুতোষের সঙ্গে। খাঁ খাঁ রোদ, গাছের পাতা নড়ে না। এদিকে বালিগঞ্জের রাস্তায় ট্রাম তো আর সহজে আসবে না।
একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি দুজনে, এমন সময় একটা বুড়ী এসে আমাদের কাছে হাত পাতলো। ভিখিরীর জালায় কোনখানে কি শান্তি আছে। আমরা একটু সরে দাঁড়ালাম, কিন্তু ছায়াটুকু ছেড়েও যেতে পারিনে। বাড়ীটা আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। এমনিতেই ভিখিরী দেখলে আমার বড় ঘেন্না করে, তার উপর ভিখিরীদের মধ্যেও অমন বীভৎস কঙ্কালমূর্তি চট করে চোখে পড়ে না। ও কিছু বললে না, ওর নুয়ে-পড়া শরীর থেকে যেন একখানা কাদায় গড়া হাত বেরিয়ে এসে শূন্যে ঝুলে রইল। আমি ওর দিকে না-তাকাবার যতই চেষ্টা করলাম, ততই আমার চোখ ওর ওপরে গিয়ে পড়তে লাগল। বিশ্রী!
অনুতোষ বললে, ‘দ্যাখ, গরমে বুড়ীটা কেমন ধুঁকছে! ঠিক কুত্তার মতো!’
আমি বললাম, ‘যাক, ঐ ট্রাম এলো।’
‘চল, বুড়ীকে মেট্রোতে নিয়ে যাই, খুব ঠাণ্ডা লাগবে’, বলে হো–হো করে হেসে উঠলো অনুতোষ।
একটু পরেই আমরা ট্রামে চেপে বসলুম। ঢিকিস–ঢিকিস চলেছে বালিগঞ্জের ট্রাম, সময় আর কাটে না। একযুগ পরে এসে পৌঁছনো গেল। রাস্তাটুকু পার হয়েই মেট্রো। আজ বন্ড ভিড়, জোর ছবি দিয়েছে। ন’ আনা টিকিটের জানলায় ফিরিঙ্গি–বাঙ্গালী মিশিয়ে দশ–বারোজন দাঁড়িয়ে। অনুতোষই আজ ‘বস্’ করছে; সে এগিয়ে গেলো টিকিট আনতে, আমি একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
টিকিট নিয়ে এলো অনুতোষ, আমরা ভিতরে ঢুকতে যাবাে, এমন সময় ভাবতে পারো! আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো সেই বুড়ী, সেই তার কাদায়-গড়া হাতখানা বাড়িয়ে ধরলো আমাদের সামনে! আমরা তো হতভম্ব!
‘এ কী। ও এখানে এলে কেমন করে?’ বলে উঠলো অনুতোষ।
আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। এই মেট্রো সিনেমায়, সায়েব, মেম আর ঝকঝকে বাঙ্গালীর ভিড়ের মধ্যে ওকে যে কী বেখাপ্পা, কী বীভৎস দেখাচ্ছিল, তা আর কী বলবো! ওকে যে ওরা তাড়িয়ে দিচ্ছে না, সেটাই তো আশ্চর্য! এ-সব জায়গায় তো আর কোনোদিন ভিখিরী দেখি নি।
আমি বললাম, ‘আমাদের ট্রামে করেই উঠে এলো নাকি?’
অনুতোষ বললে, ‘হ্যাঁ রে, ট্রামে এসেছে না রোলস্ হাঁকিয়ে এসেছে?’
‘তবে ও এলো কি করে? উড়ে তো আর আসেনি?’
‘নে, নে, আর মাথা ঘামাতে হবে না। চল, ভিতরে বসি গে।’
বুড়ীটা কিন্তু সেই একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, একটি কথাও বলছে না, একটু নড়ছেও না। চারিদিকে এত লোক
‚ ওকে কেউ লক্ষ্য করছে না কেন? আশ্চৰ্য্য!
ভিতরে গিয়ে বসে পড়লাম, কিন্তু মাথার মধ্যে কথাটা কেবলই ঘুরতে লাগলো! অনুতোষকে বললাম, ‘দ্যাখ, এ বুড়ী ঠিক সেই বুড়ীই তো’
‘মনে তো হলো ঠিক সেই রকমই। কে জানে! কলকাতায় কত ভিখিরী আছে, হতেও পারে এ আর-একজন। কিন্তু এক্কেবারে এক রকম।’
‘যদি ও-ই হয় কী করে এলো বল, তো! আশ্চৰ্য্য না?’
অনুতোষ চুপ করে রইলো।
‘তা ছাড়া’, আমি চুপি-চুপি বললুম, ‘আমার মনে হচ্ছিল, আমরা ছাড়া আর কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে না।’
অনুতোষ হেসে উঠলো। ‘তোর মাথা খারাপ হলো নাকি রে?’
‘তবে ওকে ওরা তক্ষুনি তাড়িয়ে দিলে না কেন?’
‘কী যে বলিস‚ ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ে নি আর কি! নে, চুপ কর। আরম্ভ হলো।’
একটা বেগুনি রঙের ঠাণ্ডা অন্ধকারের মধ্যে বসে সিনেমা দেখতে লাগলাম। নিউজ-রীল হয়ে গেলো, আরম্ভ হলো, দিগ্বিজয়ী ছবি।
অনেকক্ষণ এক মনে দেখছি, হঠাৎ কীরকম অন্যমনস্ক হয়ে গেলুম। ছবির পর্দা থেকে আমার চোখ নেমে এলো প্রেক্ষাগৃহে। আধো চাঁদের আকারে চেয়ারের পর চেয়ারের সারি কত রকম লোক বসে‚ দেখতে মন্দ লাগে না। তারপর হঠাৎ যেন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো।
ঠিক আমাদেরই সারিতে, আমাদের কয়েকটা চেয়ার পরে, সেই বুড়ী বসে। স্পষ্ট দেখলুম সেই রঙিন অন্ধকারে। ঠিক সে বসেছে চেয়ারে, শরীর নুয়ে-পড়া, একখানা কাদায়-গড়া হাত সামনের দিকে বাড়ানো।
আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেলো, কিছুতেই চোখ সরিয়ে নিতে পারলুম না।
অনেকক্ষণ পর আস্তে একটা ঠেলা দিলুম অনুতোষকে। ফিসফিস করে বললুম, ‘ঐ দ্যাখ।’
‘কী?’
‘ঐ যে’‚ আমি আঙ্গুল বাড়ালুম ওদিকে, কিন্তু তার আগেই অনুতোষের মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেলো।
হয়তো আমাদের চোখের ভুল, হয়তো আমাদের দুজনেরই মাথা-খারাপ হয়েছে।
জোর করে আবার সিনেমা দেখতে লাগলুম; অর্থহীন কতগুলো ভেল্কিবাজি নেচে যাচ্ছে চোখের সামনে। একটু, পর-পরই আমরা তাকাচ্ছি ওদিকে‚ হ্যাঁ, ঠিক ব’সে আছে বুড়ী। শরীর নুয়ে-পড়া, একখানা কাদার মতো হাত সামনে বাড়ানো! মেট্রো সিনেমার ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে বসেও ঘেমে জল হয়ে গেলুম।
হঠাৎ অনুতোষ বললে‚ ‘আর না, চল।’
আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। উঠে দাঁড়ালাম দুজন। নুয়ে–নুয়ে কয়েকটা পা মাড়িয়ে, দু’-একটা হাঁটুতে ধাক্কা দিয়ে বাইরে এসে যেন বাঁচলাম। পিছন ফিরে তাকালুম না একবারও। এক দৌড়ে এক্কেবারে রাস্তায়!
বাইরে ঝাঁ–ঝাঁ রোদ, বিরাট সহর, আর লোক, কত লোক!
ফিরতি ট্রাম ধরলুম। সারা রাস্তা দুই বন্ধু, এক্কেবারে চুপ। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কেমন একটা ভয় যেন গলা আঁকড়ে ধরলো। আবার যদি সেইখানে, সেই গাছের ছায়ায় ওকে দেখি! কিন্তু না কিছু নেই, কেউ নেই। বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই, হঠাৎ যদি আবার! রাত্তিরে ভালো ঘুম হলো না।
পরের দিন খেতে বসে মা বললেন, কী কাণ্ড! কাল দেখি, আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় গাছের নীচে একটা বুড়ী মরে পড়ে আছে।
বাবা বললেন, ‘কত হচ্ছে এ-রকম!’
‘মরে পড়েই আছে কতক্ষণ পর কর্পোরেশনের লোক এসে নিয়ে গেলো।’
আমি বললুম, ‘কখন বলো তো?’
‘এই তো দুপুরবেলা। তুই বেরিয়ে গেলি, তার একটু পরেই। কী বিশ্রী দেখতে। ও কি? তোর খাওয়া হয়ে গেলো!’
আমি তাড়াতাড়ি পাতে জল ঢেলে বললুম, ‘আর খাবো না।’
‘কী হলো তোর ’
‘কিছু হয় নি’ বলে আমি উঠে পড়লুম।
(সমাপ্ত)