সাত্যকির সঙ্গে যে এখানে এরকম হঠাৎ করে দেখা হয়ে যবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। হাওড়া-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়ার ঠিক মিনিট খানেক আগে সাত্যকি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে সিটে বসল। বুঝলাম ছোটোবেলার অভ্যেস এখনও যায়নি, তখনও ও এরকম শেষমুহূর্তে হাঁফাতে হাঁফাতে পরীক্ষার হলে এসে ঢুকত। সাত্যকি না এলে রাজধানীর এই এসি টু টায়ার কামরার এইদিকের চারটে সিটে আমি একাই যাত্রী ছিলাম, অন্তত হাওড়া থেকে। কিন্তু ও আসায় তা হল না। তবে পুরনো বন্ধুকে এত বছর বাদে দেখে আমি মোটেই খুশি হলাম না, বরং অনেক কথা মনে পড়ে গেল আর আমি তাই একটুও দেরি না করে সঙ্গে আনা গল্পের বইটা মুখের সামনে খুলে ধরলাম। আড়চোখে দেখলাম ওপাশের সিটে সাত্যকি তখনও নিজের ব্যাগ, সুটকেস নিয়েই ব্যস্ত।
সাত্যকিকে এড়াবার জন্যে আমি বই খুলে বসলাম বটে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মনের মধ্যে সেই পুরনো কথাই ঘুরতে লাগল! তখন সবে ক্লাস টুয়েলভের টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্কর মোটা মোটা বইগুলোর হাত থেকে মাত্র দু’দিনের ছাড় পাওয়া গেছে। দু’দিনে আর কোথায় বেড়ানো হবে। সাত্যকি বলল, “আমাদের বাড়িতে আয়, গল্প করে, খেলে আর সিনেমা দেখে দিব্যি কেটে যাবে।”
সাত্যকিদের বাড়িটা পেল্লায়, বাগানখানাও। আমাদের সবারই পছন্দ। উপরন্তু আমরা গেলেই কাকিমা মানে সাত্যকির মা এলাহি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাই আমি, অভ্র আর চয়ন এ-সুযোগ ছাড়লাম না। যেদিন পরীক্ষা শেষ হল তার পরদিনই বেশ সক্কাল সক্কাল তিনজনে মিলে সাত্যকির বাড়িতে হাজির হলাম। সাত্যকিদের বাড়িতে দেখার জিনিসের অভাব নেই। খাঁচাভর্তি রঙবেরঙের পাখি আছে, একটা কথা বলা কাকাতুয়া আছে, বড়ো অ্যাকোয়ারিয়ামে লাল, নীল মাছ আছে, বইয়ের আলমারিতে ঠাসা একটা ঘর আছে আর বাড়িভর্তি কত যে জিনিসপত্র! তার মধ্যে অনেক কিছু এখনকার দিনে আর পাওয়া যায় না মানে পুরনো দিনের জিনিসপত্র আর কী। সাত্যকিদের বাড়িটাও কম পুরনো নয়। ওর ঠাকুরদার করা। কিন্তু দেখলে বোঝা যায় না। বাইরে ভেতরে সবসময় ঝাঁ-চকচক করছে।
দোতলার পুবদিকের একখানা ঘরে আমাদের তিনজনের থাকার ব্যবস্থা হল। ঘরে একখানা বিরাট খাট – লম্বা, চওড়া মিলে তার যা আকার দেখলাম তাতে আমাদের তিনজনের ভালোভাবে শুতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়। তার মধ্যে অভ্র তো বলতে গেলে তালপাতার সেপাই। ঘরের একদিকে একটা টেবিলের ওপর একটা বড়ো দেওয়াল ঘড়ি রাখা দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে। ঘড়িটা বন্ধ।
“বন্ধ ঘড়ি রেখে দিয়েছিস কেন রে?” চয়ন জিজ্ঞেস করল।
“ও-ঘড়ির একটা বিশেষত্ব আছে। যে সে ঘড়ি ভাবিস না এটাকে।” গম্ভীর মুখে সাত্যকি জবাব দিল।
“বিশেষত্ব! কী বিশেষত্ব?” একই প্রশ্ন আমাদের তিনজনের গলা থেকে ছিটকে এল।
কিন্তু কেন কে জানে সাত্যকি বলতেই চাইল না, এড়িয়ে গেল। বলল, “ওসব পরে হবে। মা ডাকছে, খেতে চল এখন।”
ঘড়ির কথা তখনকার মতো সেখানেই চাপা পড়ে গেছিল।
রাতে শুতে যাওয়ার আগে চয়ন অবশ্য একবার সেটাকে নাড়াচাড়া করে দেখে মন্তব্য করেছিল, “সাত্যকি যতই বলুক এর বিশেষত্ব আছে, কিন্তু এ-ঘড়ি আর জন্মে চলবে বলে তো মনে হচ্ছে না। কাঁটাগুলো যেন একেবারে আটকে গেছে। ঠিকই, এ-ঘড়ির বারোটা ছেড়ে সাড়ে বারোটা বেজে গেছে!”
ঘড়িটা কাঁটা বলছে সাড়ে বারোটা বাজতে আর কয়েক সেকেণ্ড দেরি আছে, তাই চয়নের এ হেন মন্তব্য। আমরা সবাই খুব হেসেছিলাম ওর কথায়, মনে আছে। তারপর ওকে সাবধানও করেছিলাম, “ছেড়ে দে বাবা, আর ঘাঁটাঘাঁটি করিস না। পরে শুনবি হয়তো এরকম ঘড়ি সারা ভারতে এক পিসই আছে বা এটা অমুক বিখ্যাত লোকের তমুক আত্মীয়র ঘড়ি। সাত্যকিদের ব্যাপার বলা যায় না, কত পুরনো জিনিসপত্র চারদিকে, দেখিস না?”
“যা বলেছিস।” অভ্র সায় দিয়েছিল, “দু-দু’খানা এরকম বড়ো ব্যাবসা, ওদের কথাই আলাদা।”
এই পর্যন্তই। সেদিন আর ঘড়ি নিয়ে কোনও কোথা হয়নি। তবে পরের দিন সকালে সাত্যকি নিজেই তুলেছিল কথাটা। “তোরা বিশ্বাস করবি কি না জানি না, তাই আর ও-ঘড়ির কথা কিছু বলিনি।”
“বিশ্বাস না করার মতো এমন কী কথা!” আমি খুব অবাক হয়েই বললাম।
“তাছাড়া ও-ঘড়ি আর চলবে বলেও তো মনে হয় না,” চয়ন বিজ্ঞের মতো বলল।
“ও-ঘড়ি এমনি এমনি চলে না, কোনও এক বিশেষ সময় এলে তবেই ও-ঘড়ি চলবে, ঘন্টাও বাজবে। তবে সেরকম সময় না আসাই ভালো,” বলল সাত্যকি।
“বিশেষ সময় এলে চলবে? সে আবার কী কথা? আবার সেরকম সময় না আসাই ভালো? কী হেঁয়ালি করছিস তুই, সাত্যকি?” আমরা তিনজন একসঙ্গে বলে উঠলাম।
“বলেছিলাম না তোরা বিশ্বাস করবি না, সেই জন্যেই তো কিছু বলিনি,” এইটুকু বলেই সাত্যকি চুপ করে গেল।
কিন্তু আমাদের কৌতূহলও তখন ক্রমশ বাড়ছে। সাত্যকি চুপ করে গেলেও আমরা কি আর ওকে চুপ করে থাকতে দিই? এমনকি এ ভয়ও দেখালাম যে সব খুলে না বললে আমরা এক্ষুনি চলে যাব। সাত্যকি আর কী করে? বলা ছাড়া তার আর কোনও উপায়ই রইল না।
“এ-ঘড়িটা এতদিন আমাদের গ্রামের বাড়ির একটা গুদোমে পড়ে ছিল। অনেকদিনের ঘড়ি। আমার বাবার ঠাকুমা এটাকে ওই গুদোমঘরে ফেলে রেখেছিলেন। ঘড়িটা এমনিতে চলে না, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ চলতে শুরু করে। এক-দু’মিনিট বড়োজোর চলে আর তারপরেই এর ঘন্টা বেজে ওঠে। যখন বাজে তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের পরিবারের কেউ না কেউ মারা যায়। ঘড়িটা কে এনেছিল আমাদের বাড়িতে সে তো আর এখন কেউ জানে না, কিন্তু বেশ কয়েকবার এইরকম ঘটনা ঘটার পর সবাই নিশ্চিত হয়েছেন। বাবার ঠাকুমা তাই অলক্ষুণে বলে এটাকে গুদোমঘরে আজেবাজে জিনিসপত্রর সঙ্গে রেখে দিয়েছিলেন। সত্যি কথা হচ্ছে, উনি ফেলে দিয়ে আসতেই বলেছিলেন। কিন্তু যাকে বলেছিলেন সে আবার ফেলে না দিয়ে ওইখানে রেখে দিয়েছিল। এই তো কয়েক মাস আগে গুদোমঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে ঘড়িটা বেরোয়। আমাদের গ্রামের বাড়ির পুরনো চাকর লক্ষ্মণদাদা দেখেই চিনতে পেরেছে। সব শুনে বাবা এ-বাড়িতে এটাকে নিয়ে এসেছেন। মা কিন্তু খুব রাগারাগি করেছেন। বাবা যদিও বলেন, ভালোই তো, আগাম সতর্ক করে দিচ্ছে, কিন্তু এসব শুনলেই কীরকম গাটা ছমছম করে ওঠে, তাই না? যেই ঘন্টা বাজবে অমনি কেউ না কেউ মারা যাবে! কী জানি বাবা!”
“বলিস কী রে? মৃত্যু-ঘন্টা!” অভ্র বলে উঠল।
“বেশ বলেছিস তো, মৃত্যু-ঘন্টা!” আমি বললাম, “কিন্তু তোরা কি এসবে সত্যিই বিশ্বাস করিস?”
“বিশ্বাস… বাদ দে তো এসব কথা, চল ক্যারম খেলি গে যাই,” সাত্যকি বলল।
ঘড়ির প্রসঙ্গ আবার চাপা পড়ে গেল। তবে গোলমালটা হল রাতে। জব্বর একখানা ভয়ের ইংরিজি সিনেমা দেখে-টেখে শুতে শুতে প্রায় এগারোটা হয়ে গেল। ঠাণ্ডাটাও পড়েছে ভালোই। লেপের তলায় ঢুকতে না ঢুকতেই আমরা তিনজনে তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরে দেখি আলো জ্বলছে আর চয়নও আমার মতোই জেগে গেছে, কিন্তু অভ্র নেই।
“অভ্রটা গেল কোথায়? টিউব লাইটটাই বা জ্বালল কে?” চয়ন বলল।
“নিশ্চয়ই অভ্রই জ্বালিয়েছে। এত ঠাণ্ডা আসছে কোথা দিয়ে? এই চয়ন, ওই দেখ, দরজা খোলা। অভ্র এই রাতে বাইরে কোথায় গেল?” আমি বলে উঠলাম, “বাথরুম তো এইদিকে, ও বাইরে বেরোল কেন?”
চয়ন বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলটার ওপর থেকে কাঁচের গ্লাসটা সবে হাতে নিয়েছে, জল খাবে, কিছু একটা বলতেও যাচ্ছিল বোধহয়, হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢং করে বিকট একটা আওয়াজ হল। নিঝুম শীতের রাত, আওয়াজে একেবারে পিলে চমকে গেল। চয়নের হাত থেকে গ্লাসটা ছিটকে প্রথমে বিছানায় পড়ল, তারপর গড়িয়ে মেঝেতে। কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দে আমরা দ্বিতীয়বার চমকে উঠলাম। আর ঠিক তখনই অভ্র হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এল।
“সাবধান, সাবধান, কাচ আছে মেঝেতে!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
“এই তোর জন্যেই এসব হল। এই মাঝরাতে তুই বাইরে বারান্দায় গেছিস কেন বল তো?” চয়ন জিজ্ঞেস করল। তারপরেই যেন কিছু খেয়াল করে বলল, “তখন ঢং করে আওয়াজটা কীসের হল? ঘড়িটা বাজল নাকি? তার মানে তো…”
“তার মানে যা তাই। লোকটা না কাকুকে মেরেই দেয়! যেরকম উত্তেজিত হয়ে রয়েছে! ঘড়ির ঘন্টা বেজেছে মানে কিছু একটা তো হবেই,” অভ্র ততক্ষণে ওপাশ দিয়ে ঘুরে বিছানায় উঠে বসেছে। বসে গা থেকে বেড কভারটা খুলছে।
“তুই বেড কভার মুড়ি দিয়ে বাইরে গেছিলি কেন? আর এসব কী বলছিস? কে লোক? সে কাকুকে মারবেই বা কেন?” অভ্রর কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোধহয় চয়নও না।
“সব শুনবি তবে তো বুঝবি, না শুনেই তো আগে থেকে গাদা গাদা প্রশ্ন করে যাচ্ছিস,” বলল অভ্র। তারপর সব খুলে বললও। কিন্তু যা বলল তাতে আমরা যথেষ্টই ঘাবড়ে গেলাম।
চেঁচামিচির আওয়াজে নাকি অভ্রর ঘুম ভেঙে গেছিল। আমরা দু’জনেই ঘুমোচ্ছি দেখে ও আর আমাদের না ডেকে একাই দরজা খুলে বেডকভার মুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। দোতলায় সারি সারি ঘর, আর ঘরের লাগোয়া টানা বারান্দা। ঘরে টিউব লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়েছে, দরজাও হাট করে খোলা, ফলে বারান্দায় আর তেমন অন্ধকার ছিল না। অভ্র একেবারে টিঙটিঙে রোগা বলে আমরা বন্ধুরা ওকে তালপাতার সেপাই বলে খেপাই ঠিকই, কিন্তু মনের জোরে আর সাহসে ও যে আমাদের অনেককে টেক্কা দিতে পারবে একথাও আমরা ভালোই জানি। ও বলেই কাউকে না ডেকে দিব্যি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যেতে পেরেছে। আমি বা চয়ন হলে পারতাম না। বারান্দায় রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে অভ্র দেখল একটা লোক গেটের কাছে খুব উত্তেজিত হয়ে চেঁচাচ্ছে। যদিও তার কথা ও সব বুঝতে পারেনি, তবে কাকু মানে সাত্যকির বাবাকে যে গালাগালি দিচ্ছিল তা পরিষ্কার। দু’পাশে দু’জন দারোয়ান তাকে ধরে রেখেছে। রাতে তো গেটে তালা থাকে, দারোয়ানও আছে, তাও সে কী করে ভেতরে ঢুকে এল সেটাই আশ্চর্য। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাকু বেরিয়ে এলেন আর তাঁকে দেখেই লোকটার চেঁচানি আরও বেড়ে গেল। দোতলার বারান্দা থেকে যে কেউ এসব দেখছে, এটা কিন্তু কাকু বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদেরই যে কেউ তাও নিশ্চয়ই, কারণ আমাদের ঘরেই আলো জ্বলছে, ঘরের দরজাও খোলা। এরপরেই দারোয়ান দু’জন লোকটাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেল, কাকুও সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। ঠিক তখনই ঘড়িতে ঘন্টা বেজে উঠল আর চয়নের হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল, অভ্রও আর দেরি না করে দুদ্দাড়িয়ে ঘরে ঢুকে এসেছে।
“বলিস কী রে! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার!” আমি আর চয়ন একসঙ্গে বলে উঠলাম।
“সেই তো বলছি। এখন কী করবি ভাব,” অভ্র বলল।
“কী করব মানে? আমরা আবার কী করব? চুপচাপ শুয়ে পড়,” চয়ন আবার লেপের তলায় ঢোকার উপক্রম করল।
“তুই শুয়ে পড়, কিন্তু আমি পারব না। সাত্যকি আমাদের বন্ধু। তার কোনও বিপদ হলে আমাদের শুয়ে থাকাটা কি ভালো দেখায়?” অভ্র বলল।
“বিপদ! বিপদ মানে?”
“ঘড়িটা কখন বাজে তুই জানিস না, চয়ন? সাত্যকি কী বলেছিল ভুলে গেছিস? আর রাতে এরকম একটা লোক ঢুকে চেঁচামিচি করবে এটাও তো ঠিক স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।”
অভ্রর কথায় যুক্তি আছে, আমরা অস্বীকার করতে পারলাম না। কিন্তু তাও কী করব, কাকে ডাকব এসব ঠিক করতে করতেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর আমরা তিনজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
সাত্যকির ঘর বারান্দার অপর প্রান্তে, ঠিক করলাম ওকে গিয়েই ডাকব। কিন্তু অত দূর আর যেতে হল না। দেখি, কাকু আমাদের দিকেই আসছেন।
“আপনি ঠিক আছেন তো? ওই লোকটা কে? এই রাতে বাড়িতে ঢুকে ওরকম চেঁচামিচি করছিল কেন?” কাকুকে দেখেই অভ্র বলে উঠল। ওর গলায় উদ্বেগ।
কাকু খুব আশ্চর্য হলেন। আমাদের সবার মুখের ওপর একবার দৃষ্টি বোলালেন। তারপর বললেন, “আমি ঠিক থাকব না কেন? কী হবে আমার? বরং তোমাদের কী হয়েছে বলো, একটা আওয়াজ শুনলাম মনে হল এদিক থেকে।”
“ঘড়িটায় ঢং করে ঘন্টা পড়ল আর সেই শুনে এত চমকে গেছিলাম যে আমার হাত থেকে কাচের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেল,” চয়ন বলল, “যাক, আপনার যে কিছু হয়নি এই রক্ষে। অভ্র বলছিল লোকটা নাকি খুব উত্তেজিত হয়েছিল?”
“লোক! কে লোক? কী বলছ বলো তো তোমরা?” কাকু আকাশ থেকে পড়লেন। “আগেও বললে বাড়িতে লোক ঢুকে নাকি চেঁচামিচি করছিল? আর কোন ঘড়ির কথা বলছ? একতলার বৈঠকখানার বড়ো দেওয়াল ঘড়িটায় তো সারাদিনই আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর ঘন্টা বাজে। কিন্তু সেই শুনে দোতলায় তোমাদের এত চমকে যাওয়ার কী হল?”
“না না, একতলার ঘড়ি নয়, একতলার ঘড়ি নয়,” আমি বলে উঠলাম, “আমাদের ঘরে যে ঘড়িটা আছে, বন্ধই ছিল, হঠাৎ ঘন্টা বেজে উঠল…”
“বন্ধ ঘড়িতে ঘন্টা বেজে উঠল?”
“সাত্যকি বলেছিল যে…”
“কী বলেছিল?”
“ওই ঘড়িতে ঘন্টা বাজলে আপনাদের পরিবারের কেউ মারা যান, তাই আমরা…”
“রাবিশ! এরকম অনেক গল্প প্রত্যেক পরিবারে, প্রত্যেক বাড়িতেই থাকে। মানুষের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের ফল। তাই বলে সেসব সত্যি হবে? তোমরা এ-যুগের পড়াশোনা করা ছেলে হয়ে এসব বিশ্বাস করো? কই দেখি, কোথায় ঘড়ি?” কথা বলতে বলতেই কাকু ঘরে ঢুকে এলেন।
“এ হে-হে, এ তো সারা ঘরে কাচ ছড়িয়ে আছে! এক্ষুনি পরিষ্কার করাতে হবে দেখছি,” খুব বিরক্ত হয়ে হাঁকাহাঁকি করে একজন চাকরকে নিয়ে এলেন। দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙা কাচ পরিষ্কার করালেন, তারপর ঘড়িটা নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য আমাদের দিকে বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, “কাল রাতে কীসব ভয়ের সিনেমা দেখছিলে, তাই না? ওই তারই ফল। যাও, দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়ো। এ-বাড়ির গেটে চব্বিশ ঘন্টা পাহারা থাকে। অত সহজে বাইরের লোক কেউ ঢুকতে পারে না, বুঝলে? যাও, শুয়ে পড়ো।”
সবচেয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা অভ্রর। ও ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।
“কী দেখতে কী দেখেছিস তার ঠিক নেই! আর তোর কথা বিশ্বাস করে কী হল দেখ! কাকু কী ভাবলেন কে জানে!” চয়নও এবার বিরক্ত।
“আমি কিছুই ভুল দেখিনি। যা দেখেছি ঠিকই দেখেছি,” দৃঢ় কন্ঠে অভ্র বলল, “কিন্তু লোকটাকে নিয়ে গেল কোথায়? লোকটাই বা কে? এত রাতে এখানে এসেছেই বা কেন?”
বলা বাহুল্য, এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর আমাদের কারুর কাছেই নেই।
পরের দিন সকালে সাত্যকি এই নিয়ে এক চোট হাসল বটে, কিন্তু সে হাসিতে আড়ষ্টতাটাও স্পষ্ট ছিল। আমাদেরও যাওয়ার সময় হয়ে গেছিল, আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম।
কথাটা আমরা আর কাউকে বলিনি, কারণ আমাদের মনে তখন অন্য ভয় ঢুকেছিল। অভ্র যা দেখেছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে কিছু গোলমাল তো আছে বটেই। লোকটাকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাড়ির পেছনদিকে চাকরবাকরদের ঘরগুলোর দিকে। কাকুর কিছু হয়নি, উনি ঠিক ছিলেন। কিন্তু অন্য সম্ভাবনার কথাটা মনে এলেই আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। যা দেখা উচিত নয় এরকম কিছুই অভ্র দেখে ফেলেনি তো? আমরাও তাই এ নিয়ে আর কখনও কোনও কথা বলিনি। সাত্যকির সঙ্গে মেলামেশাতেও কেমন যেন ভাটা পড়ে গেছিল। তারপর তো হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে একেক জন একেক দিকে ছিটকে গেলাম। এখন যদিও চয়ন আর অভ্রর সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয়েছে, কিন্তু সাত্যকির সঙ্গে কোনওই যোগাযোগ নেই।
এতকাল বাদে ট্রেনের কামরায় দেখে এসব কথা আবার নতুন করে মনে পড়ল। কী জানি সেদিন আসলে কী ঘটেছিল।
কতক্ষণ আর বইয়ে মুখ ঢেকে রাখা যায়! খাবার এল। বই বন্ধ করতেই হল।
“তোরা কী ভেবেছিলিস আমি জানি। অবশ্য দোষ যে একেবারে আমাদেরও ছিল না তা নয়। তাই ভুল বোঝাবুঝি স্বাভাবিক।”
কথাগুলো এতই আচমকা বলল সাত্যকি যে আমার হাতে ধরা স্যুপের কাপটা কেঁপে গিয়ে কয়েক ফোঁটা স্যুপ কামরার মেঝেতে পড়ে গেল।
সামলে নিয়ে বললাম, “তাহলে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার চেষ্টা করিসনি কেন এতদিন?”
“করা উচিত ছিল অস্বীকার করছি না, কিন্তু ওই যা হয়, হয়ে ওঠেনি। এতদিনের কথা বাদ দে, আজ সুযোগ হয়েছে, আজ করতে পারি যদি তুই চাস।”
“আবার নতুন একটা গল্প? অভ্র সেদিন সবকিছু ভুলভাল দেখেছিল বলে তোর মনে হয়, সাত্যকি? অভ্রর মতো সিরিয়াস ছেলে এসব মজা করতে পারে কখনও? তোদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর ও দু-তিনদিন কীরকম যেন হয়ে ছিল, জানিস তুই? আমি চাইলেই বা কী হবে সাত্যকি, তুই কি সব সত্যি কথা বলবি? আমার তো মনে হয় না।”
“তুই যসি আমাকে বলতে সুযোগ দিস তাহলে আমি বলতে পারি, বিশ্বাস করা না করা তোর হাতে। সে রাতে একটা লোক ঢুকেছিল আমাদের বাড়িতে। অভ্র ভুল দেখেনি। দারোয়ানদের ফাঁকি দিয়েই ঢুকেছিল। শীতের রাতে তারাও বোধহয় পাহারা না দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। লোকটার অনেকদিনের রাগ আমাদের ওপর। শুধু আমার বাবার ওপর নয়, আমার ঠাকুরদার ওপরেও। ঠাকুরদা তো তখন ধরাছোঁয়ার বাইরে, কাজেই যত রাগ বাবার ওপর। বাবা সব জেনেশুনেও ওর জিনিস ওকে দিয়ে দেননি বলে।”
“ওর জিনিস?”
“ওই ঘড়িটা। ওটা ওদের। আমার ঠাকুরদা ওটা ওর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন ওদের দুঃস্থ অবস্থার সুযোগ নিয়ে। তাও মনে হয় সহজে দিতে চায়নি। ঠাকুরদা কাজ হাসিল করেছিলেন কিছুটা ভয় আর কিছুটা লোভ দেখিয়ে। ওদের তখন একবেলা খাওয়া জুটলে আরেক বেলা জোটে না। বুঝতেই পারছিস ঠাকুরদাকে খুব বেশি খরচ করতে হয়নি। বলতে গেলে নামমাত্র মূল্যে নিয়েছিলেন। ঠাকুরদার ঘড়িটার ওপর লোভ ওর বিশেষত্ব শুনেই। ওই কারুর মারা যাওয়ার সময় হলে ও-ঘড়ি হঠাৎ চলতে শুরু করে আর ঘন্টা বেজে ওঠে। পরে ওর মনে হয় নিজেদের জিনিস এভাবে বিক্রি করা ঠিক হয়নি, ও টাকাটা ফেরত দিয়ে আবার ঘড়িটা নিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা রাজি হননি। আগে কখনও এরকমভাবে রাতবিরেতে আসেনি। সে রাতে এল আর…”
“তুই তো বলেছিলি ঘড়িটা তোদের গ্রামের বাড়ির গুদোমঘরে রাখা ছিল। তোর বাবার ঠাকুমা ওটা ফেলেই দিতে চেয়েছিলেন অলক্ষুণে বলে,” সাত্যকির কথার মাঝেই আমি বলে উঠলাম, “আমি কোনটা বিশ্বাস করব, সাত্যকি? কোনটা সত্যি?”
“আমি তখন যা জানতাম তাই তোদের বলেছিলাম। বাবা আমাদের তাইই বলেছিলেন। আমাকে, ভাইকে, বাবার বন্ধুবান্ধবদের। ঘড়িটা গ্রামের বাড়িতেই ছিল। সত্যি কথা আমি জেনেছি পরে। তবে ঘড়িটা সত্যিই অদ্ভুত ছিল। ওই লোকটার বংশের কেউ মারা যাওয়ার আগে ঘড়িটা সত্যিই বেজে উঠত। শেষবার বেজেছিল ওই রাতে।”
“তার মানে সেদিন তোদের দারোয়ানের হাতে লোকটা খুন হয়? তোরা মেরেই ফেলেছিলিস লোকটাকে? অভ্র ঠিকই বুঝেছিল!” স্থান, কাল ভুলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
“না না, আমরা কেউ কিছু করিনি, বিশ্বাস কর,” অনুনয় ঝরে পড়ল সাত্যকির কন্ঠস্বরে, “লোকটার বয়স হয়েছিল, অভাবে অনটনে শরীরের অবস্থাও ভালো ছিল না। দারোয়ানরা ওকে টেনে নিয়ে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু মারধোর করেনি। লোকটা হাঁফাচ্ছিল। ওর অবস্থা দেখে মা বাবাকে প্রায় রাজিই করে ফেলেছিলেন ঘড়িটা ফেরত দিয়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু ঘড়ি ছিল তোদের ঘরে। তোরা আবার লোকটাকে চেঁচামিচি করতেও দেখেছিলি। বাবা ওকে সে-রাতটা থাকতে বলেছিলেন। ভেবেছিলেন, তোরা সকালে চলে গেলে ঘড়িটা দিয়ে বিদেয় করবেন। কিন্তু তা হল না। লোকটা সেই রাতেই মারা গেল। অনেক কাণ্ড করে লুকিয়ে চুরিয়ে ওর দেহ বাইরে রেখে আসা হল। জানি এটাও ঠিক হয়নি, কিন্তু বাবা ভয় পেয়ে গেছিলেন। আমাদের ব্যাবসা। এসব খবর বাইরে জানাজানি হলে বদনাম রটবে, ব্যাবসারও ক্ষতি হতে পারে। তাই…” কথা না শেষ করেই সাত্যকি থেমে গেল।
“আর ঘড়িটা? ওটা কোথায়? এখনও কি তোদের কাছেই?” আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
“না। বাবা খোঁজখবর নিয়েছিলেন। লোকটা তো আমাদের গ্রামেরই। বাবা যে চিনতেন না তা তো নয়। কিন্তু ওর নিজের বলতে কেউ ছিল না, অন্তত গ্রামে তো নয়ই। ঘড়িটাও ভেঙে গেছিল, কাঁটাগুলো খুলে পড়ে গেল। মা আর রাখতে চাননি, ফেলে দিয়েছিলেন।”
সাত্যকি আর কিছু বলল না। একবার আমার দিকে তাকিয়ে জানালার দিকে মুখ ফেরাল। ওকে দেখে মনে হল যেন এতদিনে সব বলতে পেরে হালকা হল। আমিও জানালার দিকে তাকালাম। ঘড়িটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এরকম ঘড়িও হয়! আশ্চর্য!
(সমাপ্ত)