পাহাড় থেকে নেমেই দেখা গেল, আর-এক ভয়ানক দৃশ্য!
তখন ভোরের আলো এসে উষার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছে এবং বনের গাছেগাছে পাখিদের গানের আসর বসেছে।
কিন্তু এমন সুন্দর প্রভাতকেও বিশ্রী করে দিলে সামনের সেই বীভৎস দৃশ্য!
ভূমিতলে চিৎ হয়ে পড়ে প্রাণপণে যুঝছে গাটুলা-সর্দার এবং তার বুকের উপরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে বিপুলদেহ দানবের মত প্রকাণ্ড একটা গরিলা ।
কুমার চেঁচিয়ে উঠল,—“গরিলা, গরিলা! সর্দারকে গরিলায় আক্রমণ করেছে- গুলি কর!”
চিৎকার শুনেই গরিলাটা গাটুলাকে ছেড়ে একলাফে দাঁড়িয়ে উঠল এবং সামনেই বিমলকে দেখে ভীষণ এক চিৎকার করে মহাবিক্রমে তাকে আক্রমণ করলে!
এখন, যারা ‘যখের ধন’ পড়েছেন তারাই জানেন বিমলের শারীরিক ক্ষমতার কথা। সে কুস্তি, যুযুৎসু ও বক্সিংয়ে সুদক্ষ,–সে অসুরের মতো বলবান। যদিও সে জানত গরিলায় গায়ের অমানুষিক শক্তির সামনে পৃথিবীর কোন মানুষই দাঁড়াতে পারে না, তবুও সে কিছুমাত্র ভয় পেলে না। কারণ, ভয় তার ধাতে নেই।
এই বৃহৎ গরিলাটার অতর্কিত আক্রমণে বিমল প্রথমেই মাটির উপরে ঠিকরে পড়ে গেল; কিন্তু শত্রু তাকে দ্বিতীয়বার ধরবার আগেই বিমল ক্ষিপ্রগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে গরিলার মুখের উপরে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিয়ে স্যাঁৎ করে একপাশে সরে গেল ।
কিন্তু ঘুষি খেয়েও গরিলাটা একটুও দমল না, দু-হাত বাড়িয়ে বিমলকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হল। এবারে বিমল যুযুৎসুর এক প্যাঁচ কষলে এবং চোখের নিমেষে যেন কোন মন্ত্রশক্তিতেই গরিলার সেই বিশাল দেহ, গোড়া-কাটা কলাগাছের মত ভূমিসাৎ হল।
আহত গাটুলা-সর্দার রক্তাক্ত দেহে মাটির উপরে দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বললে, “সাবাস বাবুজি! বহুৎ আচ্ছা। মরদ-কা বাচ্চা।”
কুমার রিভলভার তুলে গরিলাটাকে গুলি করতে উদ্যত হল। বিমল বললে, “এখন মেরো না কুমার আগে দেখা যাক মানুষ জেতে, না, গরিলা জেতে? এ-এক অদ্ভুত লড়াই!”
ভূপতিত গরিলাটা মাটির উপরে শুয়ে শুয়েই বিদ্যুতের মতো সড়াৎ করে খানিকটা সরে গিয়ে হঠাৎ বিমলের পা দুটোকে জড়িয়ে ধরলে,—সঙ্গে সঙ্গে বিমলকে ধরাশায়ী হতে হল। তারপরে শুরু হল এক বিষম ঝটাপটি,—কখনো বিমল উপরে আর গরিলা নিচে, কখনো বিমল নিচে আর গরিলা উপরে, কখনো দুজনেই জড়াজড়ি করে মাটিতে গড়াগড়ি দেয় এবং ওরই মধ্যে ঘুষি, চড়, কিল, লাথি কিছুই বাদ গেল না!
সকলে অবাক ও স্তম্ভিত হয়ে সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখতে লাগল, তখন গরিলাটাকে আর গুলি করবারও উপায় ছিল না — কারণ, সে গুলি গরিলাটার গায়ে না লেগে বিমলেরই গায়ে লাগাবার সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট! কেবল বাঘা ঘেউ-ঘেউ করে বকতে-বকতে ছুটে গিয়ে গরিলাটাকে কামড়ে দিতে লাগল।
সবাই কী করবে তাই ভাবছে, এমন সময়ে বিমল হঠাৎ কী কৌশলে সেই মস্ত বড় গরিলার দেহটা পিঠের উপরে নিয়ে স্প্রিং টেপা পুতুলের মত টপ্ করে দাঁড়িয়ে উঠল এবং কারুর চোখে পলক পড়ার আগেই গরিলাটাকে ছুঁড়ে প্রায় সাত-হাত তফাতে ফেলে দিলে!
গাটুলা চেঁচিয়ে উঠল, “বাহবা বাবুজি! বাহবা বাবুজি, বাহবা বাবুজি!”
মাটির উপরে দুহাত তুলে সশব্দে আছড়ে পড়ে গরিলাটা আর নড়ল না। বাঘার ঘন ঘন কামড়েও তার সাড়া হল না, সবাই বুঝল তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।
বিমল অবসন্নের মত মাটির উপরে বসে পড়ল- তার মুখ ও গা দিয়ে তখনও রক্ত ঝরছে। রামহরি তাড়াতাড়ি তার সেবায় লেগে গেল। কুমার বললে, “সর্দার এ গরিলাটা কোত্থেকে তোমায় আক্রমণ করলে?”
বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “গরিলা তো সর্দারকে আক্রমণ করে নি, সর্দারই গরিলাকে আক্রমণ করেছে।”
গাটুলা সবিস্ময়ে বললে, “তুমি কী করে জানলে বাবা?”
বিমল বললে, “কারণ, আমি গোড়া থেকেই সন্দেহ করছি, ঘটোৎকচ হচ্ছে একটা পোষা গরিলা। ঐ দেখ গুপ্তধনের বাক্স যা নিয়ে ঘটোৎকচ পালাচ্ছিল।”
কুমার বললে, “আমি তো শুনেছি গরিলা পোষ মানে না।”
বিমল বললে, “আমিও তাই জানতুম, কিন্তু এখন দেখছি সে-কথা ঠিক নয়।”
কুমার খুঁৎ-খুঁৎ করতে করতে বললে, “বিমলের এক আছাড়ে গরিলার মত বলবান বুনো জন্তু কখনো মরতে পারে? আর হাজারই পোষ মানুক গরিলা জানোয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়, ধনরত্নের লোভে কি গরিলা মানুষ খুন করে?” বলতে বলতে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গরিলার মৃতদেহের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সচকিত বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মৃতদেহের পানে তাকিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠল, “শীগ্গির এস। তোমরা সবাই দেখে যাও!”
সকলে কৌতুহলী হয়ে ছুটে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলে, গরিলার কাঁধের উপর থেকে গরিলার মুখের চামড়া সরে গিয়েছে এবং ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে যে কালো কুৎসিত মরা-মানুষের মুখখানা, মাংসহীন মড়ার মাথার দাঁত গুলো যেমন বেরিয়ে থাকে, তারও দুই পাটি দাঁত তেমনিভাবে ছরকুটে বাইরে বেরিয়ে আছে–কারণ, তার উপরের আর নিচের দুই ঠোঁটই না জানি কবে কোন দুর্ঘটনায় কেমন করে উড়ে গিয়েছে।
বিমল বললে, “অ্যাঁঃ– কি আশ্চর্য! এ যে দেখছি জাহাজের সেই মরা দেঁতো ঢ্যাঙা কাফ্রিটার মুখ।”
মানিকবাবু বললেন, “ও বাবা, এই ব্যাটাই তাহলে গরিলার চামড়া মুড়ি দিয়ে ঘটোৎকচ সেজে এতদিন আমাদের ভয় দেখিয়ে আসছে!”
বাক্সের ডালা খুলে দেখা গেল, তার ভিতরটা রাশি রাশি হীরা-চুনী-পান্না ও মুক্তোর জেল্লায় ঝক্মক্ ঝক্মক্ করছে– এত মূল্যবান ঐশ্বর্য তারা কেউ কোনদিন একসঙ্গে দেখবার কল্পনাও করেনি।
বিমল বললে, “কিন্তু মাখনবাবুর মুখে শুনেছ তো, গুহায় যা আছে তার তুলনায় এ ঐশ্বর্য যৎসামান্য মাত্র! আমরা শুধু-হাতে ফিরছি না বটে, কিন্তু সে গুহার কোন গুপ্তকথাই জানা হল না! সেই ঘুমন্ত গুহার অন্ধকার থেকে অমন হাজার হাজার কণ্ঠে চিৎকার জাগল কোত্থেকে, কেনই-বা শত শত সিংহ গর্জন করছিল আর অত ঘণ্টা বাজ্ছিল, আর কেনই বা মাখনবাবু ভয় পেয়ে পালিয়ে এলেন, আর কেনই বা সে গুহাকে ভূতুড়ে গুহা বললেন, সে-সব কিছুরই তো কিনারা করা হল না!”
রামহরি বললে, “থাক্ – থাক্ , যা জেনেছ তাই-ই যথেষ্ট, আর বেশি কিছু জানতে হবে না। এখন প্রাণ নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে চল !”
বিমল হেসে বললে, “না রামহরি, এ-যাত্রায় আর বেশি কিছু জানা চলবে না – গুহার যখেরা সব সজাগ হয়ে আছে। কিন্তু এক বৎসর পরে হোক্, আর দু’বৎসর পরেই হোক, গুহার রহস্যেভেদ করবার জন্যে আবার আমরা নিশ্চয়ই আসব,–কী বল কুমার?”
কুমার বললে, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।”
মানিকবাবু বললেন, “ও বাবা, বলেন কী! এই আমি নাক মল্ছি, কান মল্ছি — এ জীবনে এ-মুখো আর কখনো হব না! দয়া করে আর আমাকে ডাকবেন না, কারণ, ডাকলেও আর আমার সাড়া পাবেন না।”
গাটুলা বললে, “বাবুজি! আবার যদি আপনারা এখানে আসেন আর সিংহদমন গাটুলা-সর্দারকে যম যদি চুরি করে না-নিয়ে যায় তাহলে ঠিক তাকে আপনাদের সঙ্গে দেখতে পাবেন । আমি সাহসীর গোলাম!”
আচম্বিতে সকলের কান গেল আর-একদিকে ।
দুম্-দুম্-দুম্-দুম্-দুম্-দুম্-দুম্! যেন চার-পাঁচশো ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে তালে তালে পা ফেলে কারা যেন এগিয়ে আসছে। ধুপ্-ধুপ্-ধুপ্-ধুপ্-ধুপ্-ধুপ্-ধুপ্ ! সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী যেন কাঁপতে লাগল – ঢিপ্-ঢিপ্ ঢিপ্-ঢিপ্ ঢিপ্-ঢিপ্ ঢিপ্-ঢিপ্! পৃথিবীর বুকের উপর পড়ছে হাজার-হাজার সৈনিকের পা!
গাটুলা-সর্দার দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “আর এখানে নয়! রত্ন-গুহার রক্ষীরা ফিরে আসছে।”
(সমাপ্ত)
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……