‘আবার যখের ধন’ (পর্ব ১৭)

‘আবার যখের ধন’ (পর্ব ১৭)

গাটুলা চেঁচিয়ে ডাকলে, “সবাই বেরিয়ে এস, পথ সাফ!”

কুমার, রামহরি ও সঙ্গে-সঙ্গে বাঘা ঝোপ ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল এবং তারপরেই ওরে বাপ্‌রে বলে বিকট এক আর্তনাদ করে একটা গাছের উপর থেকে কে মাটির উপরে সশব্দে আছড়ে পড়ল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, মানিকবাবু।

কুমার বললে, “একি মানিকবাবু, আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?”

মানিকবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “ঐ গাছের ওপরে!”

–“গাছের ওপরে! কেন?”

শত্রুদের আসতে দেখে আমি ঐ গাছের ওপরে উঠে লুকিয়েছিলুম।…কিন্তু–”

–কিন্তু কী?”

মানিকবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “কিন্তু তখন কি আমি জানতুম যে, গাছের পাশের ঝোপেই ভূতের বাসা আছে?”

কুমার বললে, “কী আপনি বলছেন মানিকবাবু, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?” মানিকবাবু বললেন, “পাগল এখনো হই নি বটে, তবে আপনাদের পাল্লায় পড়ে আমার পাগল হতেও আর বেশি দেরি নেই বোধ হয় । আমি দেখলুম স্বচক্ষে ভূত, আর আপনি আমাকে বলছেন, পাগল ?”

—“যাক বাজে কথা। আপনি কী দেখেছেন আগে তাই বলুন!”

–“একটু আগেই মেঘের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্ট চাঁদের আলো ফুটেছিল। সেই আলোতে দেখলুম, ঐ ঝোপের ভেতর থেকে প্রকাণ্ড একটা কালো ভূত বেরিয়ে এক দৌড়ে কোথায় মিলিয়ে গেল!”

গাটুলা সেই ঝোপের ভেতরে ছুটে গেল এবং বিমলের মূৰ্ছিত দেহ কোলে নিয়ে তখনি আবার বাইরে বেরিয়ে এল ।

সকলের সেবা-শুশ্রুষায় জ্ঞান লাভ করে বিমল সব কথা খুলে বললে।

গাটুলা বললে, “জন্তুও নয় মানুষও নয় আর তার গায়ে জানোয়ারের মতো লম্বা লম্বা লোম! বুঝেছি, এ হচ্ছে সেই জীবটা-সিংহদমন গাটুলা সর্দারকে যে চুরি করতে এসেছিল।”

মানিকবাবু বললেন,”ভূত ভূত,–আ ভূত, মস্ত ভূত! আমি স্বচক্ষে দেখেছি!”

রামহরি আড়ষ্ট ভাবে বললে, “রাম, রাম, রাম, রাম!”

কুমার বললে, “এ আর কেউ নয়, সেই ঘটোৎকচ আবার আমাদের পিছনে লেগেছে!”

বিমল বললে, “কুমার, তুমি ঠিক বলেছে, এ নিশ্চয়ই সেই ঘটোৎকচ। এবারে আমি হেরেছি। সে এসেছিল গুপ্তধনের ম্যাপ নিতে–”

কুমার রুদ্ধশ্বাসে বললে, “তারপর?”

–“এবারে ম্যাপ সে নিয়েও গেছে!”

—“সর্বনাশ!”

সকলে খানিকক্ষণ নীরবে হতাশভাবে বসে রইল । গাটুলা আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, “ভেবেছিলুম আমরাই খুব চালাক! কিন্তু তা নয়, আমাদের আসল শত্রুরাও চালাকিতে বড় কম যায় না দেখছি। তারা গুপ্তধনের রক্ষীদের আমাদের পিছনে লেলিয়ে দিয়ে আমাদের দলবলকে এখান থেকে সরিয়েছে। তারপর ম্যাপ চুরি করে নির্বিবাদে গুপ্তধনের দিকে ছুটেছে।”

মানিকবাবু বললে, “আর আমাদের এখন কাদা ঘেঁটে, দেহ মাটি আর মুখ চুন করে খালি হাতেই ফিরতে হবে! আলেয়ার পিছনে ছুটলে এমনিই হয়!”

গাটুলা বললে, “কিন্তু বাবুজি, আমি এখনো হাল ছাড়ি নি। গুহার ভেতরে ভূতপ্রেত, দৈত্য-দানো কী আছে আমি তা জানি না, গুপ্তধন কোনখানে লুকানো আছে তাও আমি বলতে পারি না, কিন্তু সেই গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছবার এমন একটি গুপ্তপথ আমি জানি, যে-পথ দিয়ে গেলে শত্রুদের অনেক আগেই আমরা সেখানে গিয়ে হাজির হতে পারব!”

বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “তবে তাই চল সর্দার, আর এক মিনিটও দেরি করা উচিত নয়!”

অন্ধকারের সঙ্গে অস্পষ্ট চাঁদের আলো মাখামাখি হয়ে গিয়ে বনের চারিদিকে তখন অদ্ভুত রহস্যের আবছায়া সৃষ্টি করেছে। বিমলরা উর্ধ্বশ্বাসে বনের পথ দিয়ে ছুটছে আর ছুটছে।

কাবাগো-পাহাড়ের উঁচু-নিচু কালো কালো চূড়োগুলো ক্রমেই চোখের খুব কাছেই এগিয়ে এল।

গাটুলা একটা ঘন বনের ভিতর ঢুকে বললে, “এখন আমাদের এই বনের ভেতর দিয়ে আধ মাইল পার হতে হবে । তার পরেই সামনে গুহায় ওঠবার পাহাড়ে-পথ পাব । তারপর চুপি-চুপি আবার বললে, “এ-বনকে সবাই এখানে ভূতের বন বলে থাকে, এর মধ্যে ভয়ে কেউ ঢোকে না ।”

টর্চের আলো জ্বেলেও পদে পদে হোঁচট খেয়ে খুব কষ্টে সকলে সেই জঙ্গলাকীর্ণ সংকীর্ণ পথ দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো–সে পথ কোন দিন চাঁদ-সূর্যের মুখ দেখে নি। সে পথের একমাত্র আত্মীয় হচ্ছে নিবিড় অন্ধকার এবং সেই অন্ধকারে বাস করে যে-সব অজ্ঞাত জীব, আচম্বিতে আজ এখানে মানুষের আবির্ভাব দেখে তারা সবাই মিলে অজানা ভাষায় কি যে কানাকানি করতে লাগল! হঠাৎ বিমলের পায়ে শক্ত কী ঠেক্‌লে, হেঁট হয়ে দেখলে, একটা নরকঙ্কাল।

কুমার বললে, “কিন্তু ওর মুণ্ডটা কে কেটে নিয়ে গেছে?”

যেন তার প্রশ্নের উত্তরেই কাছ থেকে কে বিকট স্বরে হেসে উঠল–হা হা হা হা হা হা হা হা — সে হা হা অট্টহাসি যেন আর থামবে না!

টর্চের আলোতে দেখা গেল, একটা কঙ্কালসার উলঙ্গ ভীষণ মূর্তি ক্রমাগত হাসতে হাসতে যে দিক দিয়ে বিমলরা এসেছে, সেই দিকে ছুটতে ছুটতে চলে যাচ্ছে। সে মূর্তি এতক্ষণ এই গভীর নিশীথে এই ভয়ানক স্থানে কী যে করছিল, কেউ তা বুঝতে পারলে না– বুঝতে চেষ্টাও করলে না।

গাটুলা বিকৃত স্বরে তাড়াতাড়ি বললে, “এগিয়ে চল, এগিয়ে চল, এগিয়ে চল!”

সবাই এগিয়ে চলল এবং পিছনে অনবরত উঠতে লাগল সেই বিশ্ৰী অট্টহাস্য!

হঠাৎ একটা ফর্সা জায়গায় বেরিয়ে এসে গাটুলা বলে উঠল, “ভূতের বন শেষ হল, ঐ হচ্ছে গুহায় ওঠবার পথ!”

সবাই দেখলে পঁচিশ-ত্রিশ হাত তফাতে দৃষ্টিপথ রোধ করে মস্ত একটা পাহাড়, তার নিচে অন্ধকার আর উপরে ম্লান চাঁদের আলো!

খোলা হাওয়ার হাঁপ ছাড়বার জন্যে মানিকবাবু ধপাস্ করে বসে পড়লেন, কিন্তু বিমল একটানে তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দিয়ে কঠিন স্বরে বললে, “এখন জিরুবার সময় নয় মানিকবাবু! আসুন আমাদের সঙ্গে!”

গাটুলার পিছনে পিছনে সবাই পাহাড়-পথ ধরে উপরে উঠতে শুরু করলে।

কুমার শুধোলে, “আমাদের কতটা উপরে উঠতে হবে?”

গাটুলা বললে, “প্রায় হাজার ফুট। কিন্তু কথা কয়ে না, চুপি-চুপি ওঠ।”

খানিকক্ষণ সকলে নিঃশব্দে পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগল।

তারপর একটা বাঁকের মুখে এসে গাটুলা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চুপি-চুপি বললে, “ঐ দেখ রত্নগুহার মুখ। …..গেলবারে সুরেনবাবুর সঙ্গে ঐ পর্যন্ত আসতে গিয়ে আমাদের দলের অনেক লোক মারা পড়েছিল কিন্তু তবু আমরা এর বেশি আর এগুতে পারি নি। এবারে গুহার রক্ষীরা বোকার মত খামিসির দলের পিছনে ছুটছে বলেই আমরা নিরাপদের এতটা আসতে পেরেছি,–নইলে দেখতে, গুহার ওঠবার পথে দলে দলে লোক পাহারা দিচ্ছে! এখনও একজন রক্ষী সামনে বসে আছে, দাঁড়াও, আগে ওকে শেষ করি!” এই বলেই গাটুলা তার বর্শা নিক্ষেপ করতে উদ্যত হল!

বিমল তাকে বাধা দিয়ে বললে,“সর্দার, অকারণ নরহত্যা কোরো না। লোকটা তো দেখছি বসে-বসেই ঘুমে ঢুলছে, ওর ব্যবস্থা করতে আমার দেরি লাগবে না।”

পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে বিমল নিঃশব্দে পায়ে এগিয়ে গেল, তারপর বাঘের মতন লাফ মেরে গুহার রক্ষীর উপর গিয়ে পড়ল এবং দেখতে-দেখতে তার মুখে কাপড় গুঁজে, হাত-পা বেঁধে ফেলে, তারপর তাকে তুলে আড়ালে সরিয়ে রেখে এল।

গুহার মুখ থেকেই দেখা গেল, ভেতরে ঘুট্‌ ঘুট্‌ করছে অন্ধকার ও থম্‌ থম্ করছে নিস্তব্ধতা।

এই সেই রত্ন-গুহা! যার সন্ধানে ঘরমুখো বাঙালির ছেলে পদে-পদে বিপদকে আলিঙ্গন করে পৃথিবীর এক-প্রান্ত থেকে আর-এক-প্রান্ত পর্যন্ত এসে হাজির হয়েছে! এই সেই রত্ন-গুহা,যার মৃত্যু-ভরা অন্ধকার বুকের নিচে জ্বলছে সাত-রাজার ধন হীরামানিক। এই সেই রত্ন-গুহা, খানিকক্ষণ আগেও যার কাছে এসে দাঁড়াবার সম্ভাবনা পর্যন্ত ছিল না, তারই দ্বারা আজ অরক্ষিত অবস্থায় সামনে খোলা রয়েছে !

—“ভগবান, আমাদের রক্ষা করুন” বলে গাটুলা-সর্দার সেই জমাট অন্ধকারের গর্ভে সর্বপ্রথম প্রবেশ করলে।

তারপরে পরে-পরে ঢুকল বিমল, কুমার, রামহরি ও মানিকবাবু। তাদের প্রত্যেকের বা-হাতে টর্চ ও ডানহাতে রিভলভার। বাঘাও অবশ্য তাদের সঙ্গ ছাড়লে না।

গুহার মুখে পথ এত সরু যে, একজনের বেশি লোক পাশাপাশি যেতে পারে না। বিমল বুঝলে, এখানে একজন লোক দাঁড়ালে বাইরের অসংখ্য লোকের সঙ্গে একলাই যুঝতে পারে।

হঠাৎ তারা খুব একটা চওড়া জায়গায় এসে হাজির হল । উপরে টর্চের আলো ফেলে তারা দেখলে, ছাদ যে কত দূরে চলে গেছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। তারপর টর্চের আলো সামনে-নিচের দিকে ফেলেই সকলে আঁৎকে ও চমকে উঠল!

সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি-সারি অগণ্য লোক! তাদের পরনে যোদ্ধার বেশ–কোমরে তরবারি, একহাতে ঢাল, আরেক হাতে চক্‌চকে বর্শা।

সামনে, বাঁয়ে ডাইনে যেদিকেই আলো পড়ে, সেই দিকেই যোদ্ধার পর যোদ্ধা,সংখ্যায় তারা কত হাজার, তা বুঝে ওঠা সম্ভব নয় !

এত লোক এখানে গায়ে-গায়ে মিশে দাঁড়িয়ে আছে, তবু একটি টু শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। তাদের প্রত্যেকের মুখ মড়ার মতো ফ্যাকাসে, চোখে পলকও নেই, কোন ভাবও নেই এবং দেহও একেবারে পাথরের মূর্তির মত স্থির ও নিশ্চল। উর্ধ্বে হস্ত তুলে ডান-পা বাড়িয়ে প্রত্যেকেই একসঙ্গে বর্শা নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে,কিন্তু কারুর হাত একটুও কাঁপছে না, বর্শার ডগাটুকু পর্যন্ত নড়ছে না !

সে এক বিভীষিকাময় অস্বাভাবিক দৃশ্য। তার সামনে দাঁড়ালে অতি বড় সাহসীর বুকও ভয়ে নেতিয়ে পড়বে।

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ১৬)

আবার যখের ধন (পর্ব ১৮)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত