বিমল বললে, “সর্দার, ওয়া-কিকুউ কাদের বলে?”
গাটুলা বললে, “তারা অসভ্য জাতের লোক, কেনিয়া জেলার কেডং নদীর ধারে তাদের বাস । তারা লড়াই করতে খুব ভালোবাসে, আর ভারি নিষ্ঠুর। কিন্তু তারা এমুল্লুকে এল কেন, আর আমাদেরই বা আক্রমণ করলে কেন, এটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি হলুম গিয়ে সিংহদমন গাটুলা-সর্দার, আমাকেও তারা ধাঁধায় ফেললে দেখছি!”
বিমল বললে, “কোন ভাবনা নেই সর্দার, তোমার ধাঁধার জবাব এখুনি পাবে -বলেই সে পকেট থেকে একটা ছোট বাঁশি বার করে খুব জোরে বাজালে।
পর-মুহূর্তেই তাঁবুর ভিতর থেকে আস্কারি অর্থাৎ সশস্ত্র রক্ষীর দল বেগে বেরিয়ে এল।
বিমল হুকুম দিলে, “ঐ জঙ্গলের ভিতর থেকে আমাদের লক্ষ করে কারা বর্শা ছুড়ছে। তাদের তাড়িয়ে দাও, আর পারো তো তাদের এখানে ধরে নিয়ে এস।”
রক্ষীর দল বন্দুক কাঁধে করে চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে জঙ্গলের দিকে ছুটল।
গাটুলা বললে, “বা,-সাহেব, বা আপনারা লোকজন নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছেন দেখছি । তাহলে গুপ্তধন না নিয়ে আর ফিরবেন না?”
বিমল বললে, “এই রকম তো আমাদের মনের ইচ্ছে। আর এই জন্যেই তো আমরা তোমার সাহায্য চাই।”
গাটুলা বললে, “সুরেনবাবু-হুজুরের ভাইপো যখন আপনাদের দলে, তখন গাটুলা-সর্দার আপনাদের গোলাম হয়ে থাকবে । কিন্তু সম্রাট লেনানার গুপ্তধন তো ছেলের হাতের মোয়া নয়, যে আব্দার ধরলেই পাওয়া যাবে? যার প্রাণের মায়া আছে, সেখানে সে যেতে পারে না ।”
বিমল বললে, “আমরা হাসতে-হাসতে প্রাণ দিতেও পারি, নিতেও পারি সর্দার! কিন্তু একটা প্রাণ দেবার আগে দশটা প্রাণ নিয়ে মরব, এটা তুমি জেনে রেখ।”
গাটুলা বললে, “সাবাস বাবু-সাহেব! আপনার কথা শুনে সিংহ-দমন গাটুলা-সর্দার পরম তুষ্ট হল । কিন্তু-”
এমন সময় রক্ষীরা ফিরে এসে খবর দিলে, জঙ্গলের ভিতর কারুকে দেখতে পাওয়া গেল না ।
বিমল বললে, “তাহলে তারা পালিয়েছে আচ্ছা, তোমরা যাও।” তারপর গাটুলার দিকে ফিরে বললে, “কিন্তু কি বলছিলে সর্দার?”
গাটুলা বললে, “কিন্তু হুজুর, সম্রাট লেনানার গুপ্তধন যেখানে আছে, সেখানে মানুষ যেতে পারে না।”
বিমল বললে, “তুমি কী বলছ সর্দার, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সে গুপ্তধন কি শূন্যে আছে, না পাতালে আছে, যে, মানুষ সেখানে যেতে পারবে না?”
গাটুলা বললে, “হুজুর, এখন তো আকাশেও মানুষ যাচ্ছে, পাতালেও মানুষ যাচ্ছে; সুতরাং আকাশ-পাতালের কথা কী বলছেন? আকশে কি পাতালে এ-গুপ্তধন থাকলে এতদিনে মানুষ নিশ্চয়ই তা লুটে আনত,–কিন্তু এ আকাশও নয়, আর পাতালও নয়, আর সেইটেই তো হচ্ছে দুঃখের কথা ।”
বিমল কিঞ্চিৎ অধীর-স্বরে বললে, “সর্দার, তুমি ত’ বেশি কথার মানুষও নও, যা বলতে চাও, অল্প কথায় গুছিয়ে বল।”
“সম্রাট লেনানার সে গুপ্তধন হচ্ছে, যখের ধন।”
–“যখের ধন?”
—“হ্যাঁ হুজুর, যখের ধন। কিন্তু এ এক-আধ জন যখ নয়, —হাজার – দু’হাজার যখ!”
—“কী তুমি বলছ, গাটুলা?”
গাটুলা তার ভয় মাখানো দৃষ্টি দূরে — বহু দূরে স্থাপন করে, কেমন যেন আচ্ছন্নভাবে বললে, “হাজার-দু’হাজার যখ-কতকাল, কত যুগ আগে থেকে কাবাগো-পাহাড়ের বিপুল সেই অন্ধকার গুহার ভেতরে বসে-বসে এই গুপ্তধনের উপরে কড়া পাহারা দিয়ে আসছে, তার ঠিক হিসেব কেউ জানে না ! মানুষ তো ছার, বোধকরি দেবতা-দানবও সেখানে পা বাড়াতে ভরসা পায় না। তার ভেতরে তো দূরের কথা, কোন মানুষ তার আশ-পাশ দিয়েও হাঁটতে চায় না!….কতবার কত লোক গুপ্তধনের লোভে সেখানে গিয়েছে কিন্তু যারা গিয়েছে, তারা গিয়েছেই, প্রাণ নিয়ে তাদের কেউ আর ফিরে আসে নি! এই তিরিশ বছর আগেই আট-দশ জন সায়েব অনেক তোড়জোড় করে গুপ্তধন আনতে গিয়েছিল। শোনা যায়, গুপ্তধনের সন্ধানও তারা পেয়েছিল। কিন্তু ঐ-পর্যন্ত। তারপর যে তাদের কী হল, কর্পূরের মতন তারা যে কোথায় উবে গেল কেউ তা বলতে পারে না। কেবল একজন সায়েবকে ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে ফিরে আসতে দেখা গিয়েছিল কিন্তু পাগল অবস্থায়।
…..যুগ যুগ ধরে এই যে শত-শত লোভী মানুষ গুপ্তধন আনতে গিয়ে প্রাণ খুইয়েছে, গুহার বাইরে, চারিদিকের নিবিড় অরণ্যে-অরণ্যে, আজও তাদের অশান্ত আত্মা নাকি হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ঘুরে-ঘুরে বেড়ায় প্রতি রাত্রে নাকি তাদের অমানুষিক কান্না শুনে বাঘ-সিঙ্গিরা পর্যন্ত ভয় পেয়ে গর্জন ভুলে যায়–”
বিমলের পাশ থেকে হঠাৎ বলে উঠল, “বাবা, বল কী!”
বিমল ফিরে দেখে বললে, “এই যে, মানিকবাবু যে! আপনি কখন এলেন এখানে?” —“আমি কখন এসেছি, আপনারা দেখতে পান নি, গল্প শুনতেই মত্ত হয়ে আছেন …কিন্তু এ-লোকটি কে? এ যা বলেছে, তা কি সত্যি? সত্যি হলে তো ভারি সমস্যার বিষয়!”
–“কিছুই সমস্যার বিষয় নয়। কারণ আমি ভূত মানি না। আর যখের নাম শুনলেও ভয় পাবার ছেলে আমি নই।”
–“কিন্তু বিমলবাবু, আমি ভূতও মানি, যখেও বিশ্বাস করি।”
—“তাতে আমার কিছু এসে যায় না।”
—“কিন্তু আমার বিলক্ষণই এসে যায়। গুপ্তধনের লোভে ভূত-প্রেতের হাতে প্রাণ খোয়াতে আমি রাজি নই।”
—“কিন্তু মানিকবাবু, সে-সমস্যার সমাধান তো আমি আগেই করে দিয়েছি। আপনার যদি ইচ্ছে না থাকে, আপনি তো অনায়াসেই দেশে চলে যেতে পারেন।”
—“ধন্যবাদ। কথাটা আপনি যত সহজে বলছেন, কাজে সেটা ততটা সহজ হবে না বোধহয় । এ তো মামার বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাওয়া নয়, এ সাত-সমুদ্দুর পেরিয়ে আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে যাওয়া । তার ওপর বনের বাঘ-সিঙ্গির কথা ছেড়ে দি, পথে যদি ঘটোৎকচের দলের সঙ্গে একবার দেখা হয়ে যায়, তাহলে — বাপ্রে–”
–“হু, তাহলে ব্যাপারটা যা দাঁড়াবে, আন্দাজেই আমি সেটা বুঝতে পারছি। সুতরাং বেশি আর গোল করবেন না, সুড়-সুড় করে লক্ষ্মী ছেলেটির মতন আমাদের সঙ্গে চলুন।”
মানিকবাবু কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন, “হা অদৃষ্ট, আমার কপালে শেষটা এই ছিলো গা! সিঙ্গির মুখে থেকেও বেঁচে ফিরেছি, কিন্তু এবারে ভূতের হাতে পড়েই আমার বুঝি দফা রফা হল!”
রামহরি এতক্ষণ চুপ কর বসে শুনছিল। এতক্ষণে সে-ও এগিয়ে এসে বললে, “খোকাবাবু, মানিকবাবু ঠিক কথাই বলেছেন, আর এ নতুন বিপদের ভেতরে তুমি যেয়ো না, লক্ষ্মীটি।”
গাটুলা মানিকবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, “এ ভদরলোকটি কে, হুজুর?”
বিমল বললে, “ইনিই তোমার সেই সুরেনবাবুর ভাইপো ।”
গাটুলা প্রকাণ্ড মুখে প্রকাণ্ড একটা হা করে সবিস্ময়ে বললে, “সুরেনবাবু-হুজুরের ভাইপো অমন সাহসী লোকের এমন ভীতু ভাইপো! আমি বিশ্বাস করি না।”
বিমল বললে, “না সর্দার, বাঙালি কখনো ভীতু হয় না। মানিকবাবুও ভীতু নন, তবে দেশের জন্যে ওঁর মন কেমন করছে বলেই উনি এমনি সব নানা মিথ্যে ওজর তুলছেন।”
গাটুলা বললে, “ও, বুঝেছি! আমারও অমন হয়। আমি হলুম গিয়ে সিংহদমন গাটুলা-সর্দার, কিন্তু বিদেশ-বিভুঁয়ে গেলে বলব কি হুজুর, বৌ-এর জন্যে আমারও মন কেমন করে। এই বলেই সে তার প্রকাণ্ড হাত দুখানা দিয়ে মানিকবাবুকে নিজের বুকের ভিতর টেনে নিয়ে বললে, “আপনি হচ্ছেন আমার প্রভু সুরেনবাবু-হুজুরের – তার আত্মা স্বর্গলাভ করুক – ভাইপো ! আসুন, আপনাকে আমি আলিঙ্গন করি।”
বিমল বসে ছিল, উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “তাহলে গাটুলা সর্দার, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার কোন আপত্তি হবে না, বোধহয় ? যে-সব বিপদ-আপদের কথা বললে, আমি বাঙালির ছেলে, সে-সব বিপদ-আপদকে আমি একটুও গ্রাহ্য করি না। বিপদকে আমি ভালবাসি, ছুটে গিয়ে বিপদের ভেতরে আমি ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। বিপদের কথা নিয়ে যারা বেশি মাথা ঘামায়, বিপদ আগে আক্রমণ করে তাদেরই !’
গাটুলা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, “সাবাস, সাবাস! এই তো মরদকা বাত্! আমি সাহসীর গোলাম, আপনারা যেখানে যাবেন, আমি সেইখানেই আপনাদের সঙ্গে যাব।”
বিমল বললে, “তাহলে কালকেই আমরা কাবাগো-পাহাড়ের দিকে যাত্রা করব। ভূত-প্রেত, যক্ষ-রক্ষ, যে যেখানে আছে সকলকেই আমি আমন্ত্রণ করছি, তারা পারে তো আমাদের বাধা দিয়ে দেখুক।”
মানিকবাবু ফ্যাল্-ফ্যাল্ করে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে বললেন, “ও বাবা বলেন কী!”
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……