এই তো টাঙ্গানিকা হ্রদ। কিন্তু এ কি হ্রদ, না সমুদ্র?
চোখের সামনে আকাশের কোল জুড়ে থৈ-থৈ করছে শুধু জল,—কোথায় তার ওপার, আর কোথায় তার তল!
এপারে তীরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর শ্যাম বনানী এবং আকাশের নীল-মাখানো জল-আয়নায় নিজেদের ছায়া দেখে বনের গাছপালার যেন মনের আনন্দে মর্মর-গান গেয়ে উঠছে।
বিমল, কুমার, মানিকবাবু ও রামহরি হ্রদের ধারে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কারণ, যদিও মানিকবাবুর মেজো কাকার পত্রে তারা জেনেছিল যে, টাঙ্গানিকার চেয়ে লম্বা হ্রদ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই এবং স্থানে-স্থানে তা পঁয়তাল্লিশ মাইল চওড়া, তবু টাঙ্গানিকাকে স্বচক্ষে দেখবার আগে তারা এর বিপুলতার স্পষ্ট ধারণা করতে পারেনি।
বনের ভিতরে Mvule নামে এক জাতের গাছ দেখা গেল, তাদের বিপুলতা দেখলেও আশ্চৰ্য্য হতে হয় । তাদেরই গুঁড়ি কেটে নিয়ে এদেশি লোকেরা যে-সব নৌকা তৈরি করেছে, হ্রদের উপরে সেগুলি সারে-সারে নেচে-নেচে ভেসে যাচ্ছে। কূল দিয়ে একখানা বড় স্টিমারও হ্রদের বুক দুলিয়ে চলে গেল, কুমার দেখলে, স্টিমারে তার নাম লেখা রয়েছে, Hedwig von Wissmann!
কুমার বললে, “নাম দেখে বোঝা যাচ্ছে, এখানা জার্মান স্টিমার।”
বিমল বললে, “হুঁ, উজিজি যখন মার্জনদের স্টেশন তখন এখানে তাদেরই স্টিমার থাকা স্বাভাবিক ।” তারপর পথ-প্রদর্শকের কাছ থেকে তারা জানতে পারলে যে, টাঙ্গানিকার পূর্ব তীরে মার্জনদের, দক্ষিণ তীরে ইংরেজদের ও পশ্চিম তীরে বেলজিয়ানদের প্রভুত্ব এবং তার জলে স্টিমারও ভাসে অনেকগুলো ।
উজিজি নামে যে বড় গ্রামখানি হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, তা জার্মান স্টেশন হলেও দলে-দলে আরব এসে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছে এবং সোয়াহিলি জাতের লোকেরাও এখানে দলে বেশ ভারি। সোয়াহিলি কথাটির সৃষ্টি হয়েছে সোয়া হিলি শব্দ থেকে। সোয়াহিলির (swahili) মানে হচ্ছে, “যারা শত্রু-মিত্র সবাইকে সমান ঠকায !” চমৎকার নাম !
গ্রামের ঠিক বাইরেই, টাঙ্গানিকার তীরে বিমলদের তাঁবু পড়ল।
রামহরি আঁজ্লা করে টাঙ্গানিকার জল মুখে নিয়ে বললে, “ও খোকাবাবু, সমুদ্দুরের জলের মতন অতটা না হোক, এ-জলও যে বেশ একটু নোন্তা! এ-জল তো খেতে ভালো লাগে না ।”
বিমল বললে, “তাহলে খাবার জল অন্য জায়গা থেকে আনতে হবে। কিন্তু রামহরি, তোমাকে এখন অন্য কাজ করতে হবে । জনাকয়েক লোক নিয়ে একবার গাঁয়ের ভেতরে যাও। দেখে এস, এখানে হাট-বাজার কিছু আছে কিনা। আর গাটুলা বলে কোন বুড়ো সর্দার এই গাঁয়ে বাস করে কিনা, সে খোঁজটাও নিয়ে এস।”
রামহরি বললে, “গাটুলা? সে আবার কে?”
—“মানিকবাবুর মেজো কাকা সুরেনবাবুর চিঠিতে তার পরিচয় পেয়েছি। সুরেনবাবুর সঙ্গে গাটুলাও গুপ্তধন আনতে গিয়েছিল, আমারও তাকে সঙ্গে নেব। পথের খবর সে সব জানে ৷”
রামহরি বললে, “পারি তো, গাটুলাকে তোমার কাছে নিয়ে আসব কি?”
– “হ্যাঁ।”
রামহরি চলে গেল। মানিকবাবু এগিয়ে এসে আস্তে-আস্তে বললেন, “বিমলবাবু আপনার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।”
—“বলুন।”
—“আপনারা তাহলে গুপ্তধন না নিয়ে ফিরবেন না?”
—”এই রকমই তো আমাদের মনের ইচ্ছে!”
—“মেজো কাকার চিঠি পড়ে যা বুঝেছি, আমরা গুপ্তধন আনতে গেলে সেখানকার অসভ্য লোকদের সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হবে অর্থাৎ এখন যে-সব বিপদের বোঝা আমাদের ঘাড়ের ওপরে চেপে রয়েছে, তার ওপরেও এই নতুন বিপদ নিয়ে আমাদের ভুগতে হবে?”
– “হুঁ।”
—“মশাই, তাহলে আপনারাই গুপ্তধন আনতে যান। আমি লিখে দিচ্ছি, তার বখ্রা আমার চাই না!”
—“আপনি কী করবেন?”
—“দেশে যাব ।”
—“বেশ, আগে তো গুপ্তধনের সন্ধানে যাওয়া যাক, তারপর আপনার কথামতো কাজ করা যাবে – গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলে বিমল একটা গাছতলায় গিয়ে বসে পড়ল ।
মানিকবাবু খানিকক্ষণ নিরাশমুখে সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকে, ফোঁস্, করে একটা দুঃখের নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন এবং এ-যাত্রা প্রাণটা নিতান্তই বাজে খরচ হবে বুঝে বিছানাকে আশ্রয় করে দুই চক্ষু মুদে ফেললেন।
হ্রদে খুব মাছ পাওয়া যায় শুনে কুমার মাছ ধরবার আয়োজন করবার জন্যে বেরিয়ে গেল ।
তাঁবু থেকে খানিক তফাতে একটা সঙ্গিহীন একানিয়া-গাছের উপরে চড়ে একটা বানর ভারি বিপদে পড়েছে। তাকে দেখেই সুযোগ বুঝে বাঘা সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছে এবং থাবা পেতে গাছতলায় বসে এক দৃষ্টিতে বানরটার দিকে তাকিয়ে নীরব ভাষায় যেন বলছে,—আর তো পালাবার পথ নেই স্যাঙাত। কাজেই সুড় সুড় করে নেমে এসে দেখ, আমি কেমন চমৎকার কামড়ে দিতে শিখেছি!
ঘণ্টাখানেক পরে রামহরি একদল আরবের সঙ্গে ফিরে এল ।
আরবদের ভিতর থেকে একটা লোক দূর হতেই বিমলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার মুণ্ডটা প্রকাণ্ড এক ফুটবলের মত গোলাকার, তার বক্ষদেশ প্রকাণ্ড এক বৃক্ষের কাণ্ডের মতন চওড়া, তার ভুঁড়িটি প্রকাণ্ড এক পোঁটলার মতন, যেন কোমরে বাঁধা থেকে ঝুলছে ও দুলছে এবং তার প্রকাণ্ড পা দুটো পৃথিবীর উপর দিয়ে চলছে, আর মনে হচ্ছে, দু-দুখানা কোদাল যেন মাটি খুঁড়তে-খুঁড়তে এগিয়ে আসছে! এ লোকটার আগাগোড়া সমস্তই প্রকাণ্ড!
রামহরি এসে বললে, “খোকাবাবু, তুমি যাকে খুঁজেছিলে তাকে এনেছি!”
বিমল বললে, ‘গাটুলা?”
সেই প্রকাণ্ড-মুণ্ড-বুক-ভুঁড়ি-পা-ওয়ালা লোকটি প্রকাণ্ড একটা হা করে হা-হা স্বরে হেসে বললে, “হ্যাঁ হুজুর! আমারই নাম গাটুলা-লোকে আমাকে সিংহদমন গাটুলা-সর্দার বলে ডাকে।আজ পর্যন্ত সতেরোটা সিংহকে আমি যমের বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছি।”
বিমল বিস্মিত হয়ে বললে, “গাটুলা, তুমি বাংলা জানো?”
–“হ্যাঁ জানি বৈকি,-বাংলা জানি, ফার্সি জানি, ইংলিশ জানি, জার্মান জানি! আমি বাংলা শিখেছি সুরেনবাবু-হুজুরের – তার আত্মা স্বৰ্গবাস করুকু – কাছ থেকে।”
—“আমরাও সুরেনবাবুর চিঠিতেই তোমার পরিচয় পেয়েছি। সুরেনবাবুর ভাইপোর সঙ্গে আমরা বাংলাদেশ থেকে তোমার কাছেই এসেছি।”
গাটুলা আগ্রহভরে বললে, “কোথায় সুরেনবাবুর ভাইপো? আমি তাকে আলিঙ্গন করে ভালোবাসা জানাতে চাই।”
—“তিনি তাঁবুর ভেতরে বিশ্রাম করছেন, একটু পরেই তার সঙ্গে দেখা হবে।”
গাটুলা মাটির উপরে বসে পড়ে দুলতে দুলতে বললে, “হুঁ, আপনারা কেন এসেছেন, তা আমি জানি। আপনারা যে শীঘ্রই আমার কাছে আসবেন, তাও আমি কাল রাতেই টের পেয়েছিলাম।”
বিমল আশ্চর্য হয়ে বললে, “কাল রাতেই টের পেয়েছিলে? কেমন করে?”
—“শুনুন হুজুর, বলি। আমি বেশি কথার মানুষ নই, যা বলব দু-চার কথায় বলব। যারা বেশি কথা কয়, তারা বাজে কথা কয়। তারা সিঙ্গি মারতে পারে না। যারা সিঙ্গি মারতে পারে না, তারা বীরপুরুষ নয়। আর যারা বীরপুরুষ নয়, সিংহদমন গাটুলা সর্দার তাদের মুখে থুতু দেয়।”- এই বলে গাটুলা ভূমিতলে থু থু করে থুতু ফেললে।
মনে-মনে হেসে বিমল গম্ভীর মুখে বললে, “হ্যাঁ, তুমি যে বেশি কথার মানুষ নও, তোমার কথা শুনেই তা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা যে শীঘ্রই এখানে আসব, কাল রাতেই তুমি কেমন করে তা টের পেয়েছিলে?”
—সেই কথা জানতে চান তো শুনুন হুজুর, বলি। সাধু লোক রাত্রে ঘুমোয়। গাটুলা-সর্দার সাধু লোক, কাজেই অন্য রাত্রের মতো কাল রাত্রেও সে ঘুমোতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয় যে, ঘুমোলে অতি বড় জ্ঞানবান লোকও অজ্ঞান হয়ে যায়। কাজেই কে এক অসাধু ব্যক্তি কাল রাত্রে কখন যে আমাকে চুরি করতে এসেছিল, আমি তো মোটেই জানতে পারি নি।’
আশ্চর্য স্বরে বিমল বললে, “তোমাকে চুরি করতে এসেছিল? বল কী?”
—“হ্যাঁ হুজুর, হ্যাঁ। চোরের আস্পর্ধাটা বুঝুন একবার। আমি হলুম গিয়ে সিংহদমন গাটুলা-সর্দার, আমি কি মেয়েদের কানের মাকড়ি, নাকের নথ বা হাতের চুড়ি, যে বেমালুম আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে?…. কিন্তু হুজুর, এ বড় সোজা চোর নয় -হয় তো এ মানুষই নয়-”
বিমল বাধা দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, “অ্যাঁ, মানুষই নয়!
—“উহু, মানুষ তো নয়ই, তবে ভূত-প্ৰেত দৈত্য-দানো কিনা জানি না, তা, আচ্ছা হুজুর, ভূত-প্রেতের গায়ে কি লোম থাকে?”
–“তার গায়ে কি লোম ছিল?”
–“সে যখন আমাকে কোলে করে নিয়ে পালাচ্ছিল, তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারে কারুকে আমি দেখতে পাচ্ছিলুম না, কিন্তু যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল তার গায়ে হাত বুলিয়ে পেলুম খালি রাশি-রশি লোম!”
বিমল রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলে, “তারপর—তারপর?”
—“তারপর আর কী গাটুলা-সর্দারের সিংহগর্জন- সিংহের কাছ থেকেই আমি গর্জন করতে শিখেছি, -শুনে চারিদিক থেকে লোকজন এসে পড়ল, চোরটাও তখন আমাকে ফেলে অদৃশ্য হল!”
–“কেউ তাকে দেখতে পায় নি।”
–“না!”
—“কিন্তু আমরা যে আসব, সেটা তুমি জানলে কী করে?”
—“জানব না কেন? গাটুলা-সর্দার আজ পঁয়ষট্টি বছর এ-অঞ্চলে বিচরণ করে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললে, কিন্তু তাকে চুরি করতে পারে এমন মানুষ সে দেখে নি । আর, তাকে চুরি করে লাভ? তাকে চুরি করবেই বা কেন? নিশ্চয় গুপ্তধনের লোভে । সম্রাট লেনানার গুপ্তধনের ভাণ্ডার কোথায়, আমার তা জানা আছে। আর এ-কথা এখন জানেন কেবল সুরেনবাবুর ভাই আর ভাইপো । কাজেই আমি আন্দাজে বুঝেছিলাম যে, এ-অঞ্চলে হয়তো আপনাদের কারুর না-কারুর শুভাগমন হয়েছে।….কিন্তু হুঁশিয়ার।” এই বলে চিৎকার করেই গাটুলা বিদ্যুৎবেগে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ল এবং পরমুহূর্তে দেখা গেল তার দক্ষিণ হস্তের দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টির ভেতরে এক সুদীর্ঘ ও সুতীক্ষ বর্শার আবির্ভাব হয়েছে। এ যেন এক ভেল্কিবাজি!
রামহরি বললে, “খোকাবাবু, এ-বর্শা তোমাকে টিপ করে ছোঁড়া হয়েছে! কিন্তু, কে এটা ছুঁড়লে!”
বিমল বললে, “যেই ছুঁডুক কিন্তু গাটুলা-সর্দার বর্শাটাকে ধরে না ফেললে এতক্ষণে আমাকে মাটিতে লোটাতে হত।…..নিশ্চয় এ বিষাক্ত বর্শা। সর্দার, তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে । এ-কথা আমি ভুলব না।”
গাটুলা একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “আরে–আরে, শীগ্গির গাছের আড়ালে এসে দাঁড়ান, দেখছেন না, আরো বর্শা আসছে?”
আরো পাচ-ছয়টা বর্শা বিদ্যুৎশিখার মতন এদিক-ওদিক দিয়ে সাঁৎ-সাঁৎ করে চলে গেল,—সকলে তাড়াতাড়ি একটা প্রকাণ্ড গাছের আড়ালে এসে দাঁড়াল। নিজের হাতের বর্শাটাকে ক্ষণকাল পরীক্ষা করে গাটুলা বললে, ‘ওয়া-কিকুউ জাতের যোদ্ধারাই এরকম বর্শা ব্যবহার করে! কিন্তু তারা আমাদের আক্রমণ করলে কেন?”