আমার বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুল

আমার বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুল

মিতাকে আমার বাঁ-হাতের পাঁচ আঙুলের আসল ব্যাপারটা খুলে বলিনি। কারণ, খুলে বলাটা খুব সহজ নয়। কিন্তু ও যে বারবারই আমার বাঁ-হাতের দিকে তাকায় সেটা আমি লক্ষ করেছি। এখনও দেখছি, ও কোল্ড ড্রিঙ্কের গ্লাসে চুমুক দিতে-দিতে আমার বাঁ-হাতের দিকে চেয়ে আছে।

আমি বাঁ-হাতে সবসময় সাদা দস্তানা পরে থাকি। কাপড়ের দস্তানা। ঠাটবাটওলা রেস্তোরাঁয় বেয়ারারা যেমন পরে থাকে। এখনও আমাদের টেবিলের আশেপাশে দু-তিনজন বেয়ারা এরকম সাদা দস্তানা পরে আছে।

মৌমিতাকে আজ ডিনার খাওয়াতে ‘দ্য অর্কিড-এ নিয়ে এসেছিলাম। ই এম বাইপাসের ধারে এই ‘দ্য অর্কিড় রেস্তোরাঁটা মন্দ নয়। এখানে জগঝম্প নাচ-গান নেই। তার বদলে শান্তু নিস্তব্ধ পরিবেশ। খুব সফট টোনে খুশির মুড তৈরির মিউজিক বাজছে। এসি-র তীব্রতা প্রায় শীত করার মতাে। বেশিরভাগ টেবিলই ভরতি থাকলেও কারও কথা শােনা যাচ্ছে না। সবাই নিশ্চয়ই নীচু গলায় কথা বলছে আমাদেরই মতাে।

‘একটা কথা জিগ্যেস করব? মৌমিতা হঠাৎ মাথার চুল ঝাকিয়ে বলল।

‘করাে। আমি জানতাম ও কী জিগ্যেস করবে।

‘তুমি বাঁ-হাতে সবসময় গ্লাভস পরে থাকো কেন?

‘গ্লাভস নয়—গ্লাভ বলো…’ হেসে বললাম আমি, আমি তাে শুধু বাঁ-হাতে পরেছি— দুহাতে পরিনি।’

‘তুমি আনসারটা এড়িয়ে যাচ্ছ। কোল্ড ড্রিঙ্কর গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বায়নার সুরে ও বলল, বলল না! বলতে কোনও প্রবলেম আছে?

আমার মনটা হঠাৎ কেমন-কেমন হয়ে গেল। প্রবলেম? ভালাে কথাই বলেছে মৌমিতা। প্রবলেম নেই আবার!

একহাতে দস্তানা পরে থাকি বলে অনেকের কাছেই আমাকে জবাবদিহি করতে হয়। কাউকে বলি, এটা আমার এক বিচিত্র শখ। কাউকে বলি, হােটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার সময় এই অভ্যেসটা ডেভলাপ করেছে। আবার কাউকে বা তিতিবিরক্ত হয়ে বলি, আমার বাঁ-হাতে স্কিন ডিজিজ আছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে কী সেটা একজন ছাড়া কাউকে বলিনি–অদ্ভুত এখনও। কৌতূহল থাকাটা দোষের নয়। সুতরাং মৌমিতার কোনও দোষ নেই। ব্যাপারটা ওর জানতে ইচ্ছে করতেই পারে। তাই ওর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মৌ, বলতে কোনাে প্রবলেম নেই। তবে…মানে…এর পেছনে একটা ইন্টারেস্টিং স্টোরি আছে…।’

ও বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাই? তা হলে বলাে–প্লিজ..।

রেস্তোরাঁর ছায়া-ছায়া আলােয় আমি ওকে ভালাে করে দেখতে চাইলাম। মৌমিতা। লম্বা স্লিম চেহারা। মাথার একরাশ চুলে সােনালি রঙের ঝিলিক। লম্বাটে ফরসা মুখ। টানা-টানা চোখ। এই চোখে চোখ পড়লে নজর ফেরানাে যায় না। চোখা নাক। সামান্য ফোলা দু-ঠোট যেন সবসময়েই দুষ্টু হাতছানি দিচ্ছে।

মৌমিতাকে আমি ভালােবাসি। খুব সাধ ওকে নিয়ে বাকি জীবনটা একসঙ্গে থাকব। আমার ভেসে-বেড়ানাে দিকশুন্য ছন্নছাড়া জীবনে ও সারথি হয়ে আসুক। আমাকে সামলে নিক। আমার সুখ-দুঃখের শরিক হােক। আমার অভিভাবক হয়ে উঠুক। মৌমিতাকে এখনও এসব কথা বলিনি। দস্তানার গল্পটা বলার পর বলব। মনে হয় না ও আমাকে ফিরিয়ে দেবে।

আমি বেয়ারাকে ডেকে বিল দিতে বললাম। তারপর মৌ-কে চাপা গলায় বললাম, এখানে নয়-গল্পটা তােমাকে গাড়িতে যেতে-যেতে বলব। ও খুব খুশি হল। কোল্ড ড্রিঙ্কের খালি গ্লাসটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, ‘সােনু, আই লাভ য়ু…।’

আমি বললাম, “গল্পটা তাে এখনও শােনােনি…আগে শােনাে…তারপর…।

বিল মিটিয়ে আমরা দুজনে উঠে পড়লাম। রেস্তোরাঁর কাচের দরজার কাছে এসে দেখি বৃষ্টি পড়ছে–তবে তেমন জোরে নয়। আমি আর মৌ হাত ধরাধরি করে ছুট লাগালাম গাড়ি লক্ষ করে।

গাড়িতে গুছিয়ে বসার পর মৌ বলল, “বৃষ্টিটা হেভি রােম্যান্টিক—তাই না?’

‘তুমি পাশে থাকলে আমার কাছে মরুভূমিও রােম্যান্টিক লাগবে।

‘হােয়াও!’ বলে আমার জামা ধরে টান মারল মৌ। ঠোটজোড়া ছুঁচলাে করে ছােট্ট ঠোকরানাে চুমু খেল গালে।

জানলার কাচ তােলাই ছিল। হালকা করে এসি চালিয়ে দিলাম। তারপর পার্কিং লট থেকে গাড়ি তুলে নিয়ে এলাম বৃষ্টিভেজা রাস্তায়। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে গেল এপাশ থেকে ওপাশে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল। বৃষ্টির জন্যে রাস্তা দেখতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে ওয়াইপার চালিয়ে দিলাম। ড্যাশবাের্ডের ঘড়ির দিকে চোখ গেল। আটটা উনচল্লিশ।

নাঃ, রাত বেশি হয়নি। ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে মৌ-কে ঘড়িতে পৌঁছে দিলেই হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সাইডরােডে ঢুকে পড়লাম এ-রাস্তাটায় গাড়ি-টাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। দোকানপাটও চোখে পড়ছে না। আলে বলত রাস্তার দুপাশের ল্যাম্পপােস্ট গুলাের সােডিয়াম বাতি।

মৌমিতার দিকে তাকিয়ে বললাম, এই দস্তানার ব্যাপারটা তােমার অনেকদিন ধরেই জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না?

হ্যাঁ। য়ু আর স্মার্ট, সােনু। তােমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই এটা আমার কাছে একটা বিশাল কিউরিয়ােসিটি…। আজ কৌতূহল চাপতে না পেরে তােমাকে স্ট্রেটকাট জিগ্যেস করে ফেলেছি…। হঠাৎ কী ভেবে ও বলল, তুমি কি মাইন্ড করলে, সােনু ? তা হলে থাক…।

‘ওহহাে, কী যে বলাে! হােয়াই শুড আই মাইন্ড?’ কথা বলতে-বলতে ঝুঁকে পড়ে ওর মাথায় একটা চুমু খেলাম ও ‘তােমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারলে আমার খুব ভালাে লাগে। কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখছি, গল্পটা শুনলে তুমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবে না। উত্তরে সে আমার দস্তানা-পরা আঙুলগুলাে আঁকড়ে ধরল। প্রায় ফিশফিশ করে বলল, ‘আই উইল বিলিভ এনিথিং য়ু সে।

ভালােবাসা এমনই জিনিস, আজগুবি রূপকথাও বিশ্বাস করতে মন চায়।

রাস্তার একটা বাঁক পেরিয়ে ঝোপজঙ্গল ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করালাম । মৌমিতা তাতে অবাক হল না। কারণ, আগেও এরকম ফাঁকা স্পটে আমি গাড়ি দাঁড় করিয়েছি। এবং মৌমিতা আর আমি গাড়ির মধ্যে খুশিমতন হুটোপাটি করেছি। ইংরেজিতে একেই বােধহয় ‘হেভি পেটিং বলে। আজও গল্প-টল্প বলা হয়ে গেলে ওসবে মন দেওয়া যাবে। গাড়ির চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছিল। জানলার কাচ বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল। ওয়াইপার দুটো প্রাণপণে উইন্ডশিল্ডের জল সরাচ্ছিল। ওদের চলার তালে-তালে মােটরের মিহি শব্দ হচ্ছিল।

আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। তারপরই মেঘের ডাক শােনা গেল। আমি গল্পটা বলতে শুরু করলাম।

মৌ তােমাকে কখনও বলা হয়নি…মানে, আমার বাবা দেড় বছর আগে মারা গেছে…মানে, খুন হয়েছিলেন। সেইসময় কলকাতায় একটা জঘন্য সিরিয়াল কিলিং চলছিল। একের পর এক খুন  করে চলেছিল লােকটা। প্রথমে খুন করেছিল একটা এগারাে বছরের বাচ্চা মেয়েকে। না—শুধুই খুন করেছিল—অন্য কিছু করেনি। মেয়েটাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছিল। খুনের পর মেয়েটার যা চেহারা হয়েছিল,..মানে, কাগজে যেসব ফটোগ্রাফ ছাপা হয়েছিল…সেসব দেখলে তুমি শিউরে উঠতে। মেয়েটার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। ঠোটের কোণে ফেনা ছিল। আর জিভটা মরা ছাগলের জিভের মতাে বাইরে বেরিয়ে ঝুলছিল।

মেয়েটার মারা যাওয়ার আগের ছবি আর পরের ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল কাগজে। দেখে মনে হচ্ছিল, দেবশিশু আর পিশাচ। খুনির হাত ওকে এমনই বদলে দিয়েছিল। কাগজে দিনের পর দিন এই খুনের রিপাের্ট বেরিয়েছিল। তাতেই পড়েছিলাম, খুনি এত জোরে মেয়েটার গলা টিপে ধরেছিল যে, থাইরয়েড বােন আর কার্টিলেজ বোন-ভেঙে গিয়েছিল।

এই যে…গলায়…এখানে। কণ্ঠমণি…মানে, ইংরেজিতে অ্যাডামস অ্যাপেল যাকে বলে। না, না, তােমার শিউরে ওঠার কোনও কারণ নেই। বললাম যে, ব্যাপারটা তিন বছরের বেশি পুরােনো। মেয়েটার নখের ভেতরে আঁশ মতন কিছু পাওয়া গিয়েছিল। ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা গেল, সেগুলাে পুরােনাে শুকনাে কোনও চামড়ার আঁশ। অর্থাৎ, খুনি চামড়ার দস্তানা ব্যবহার করেছিল। নাঃ, কোনওরকম আঙুলের ছাপ-টাপ পাওয়া যায়নি। পুলিশ ফুল এনথু নিয়ে ইনভেস্টিগেট করেও কিছু করতে পারল না। মেয়েটার খুনি ধরা পড়ল না।

দ্বিতীয় খুনটা হওয়ার পর পুলিশ নড়ে চড়ে বসলো। এবারে খুন হল একজন মাঝবয়েসি পুরুষ। খুনের স্টাইল একই। মার্ডার বাই স্ট্রাংগুলেশান । এবারেও ভিকটিমের নখের নীচে চামড়ার ফাইবার পাওয়া গেল। অর্থাৎ, সেই দস্তানা। প্রথমবারে যেমন খুনের মােটিভের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি, এবারেও তাই। সব মিলিয়ে পুলিশ বেকুব  বনে গেল। খুনি রয়ে গেল সবার চোখের আড়ালে।

তিন নম্বর খুনটা হওয়ার পর পুলিশ বুঝতে পারল ব্যাপারটা সিরিয়াল কিলিং। মিডিয়া খুনির নাম দিল দস্তানা-খুনি’। ইংরেজি চ্যানেল আর খবরের কাগজ নাম দিল ‘গ্লাভ কিলার’। সারা শহর জুড়ে খুনির খোজ চলতে লাগল। সবই জোট বেঁধে দস্তানা পরা লােক খুঁজে বেড়াতে লাগল। বুঝতেই পারছ, কলকাতা শহরে চামড়ার দস্তানা আর কোন কাজে লাগে! তাই দস্তানা পরা লোক খোঁজার কাজটা বেশ সহজ। কিন্তু সেরকম কাউকেই পাওয়া গেল না। এদিকে খুনের ব্যাপারটা চলতেই লাগল। তিন নম্বরের পর চারনম্বর, চার নম্বরের পর পাঁচ নম্বর, তারপর ছ’নম্বর। আর ছ’নম্বরের পর সাতনম্বর আমার বাবা।

বাবা খুন হওয়ার পরই সিরিয়াল কিলিং-এর ব্যাপারটা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। খুনি যেন হঠাৎই চলে যায় বনবাসে। কেউ-কেউ বলল, সাতটা খুন করাটাই লোকটার টার্গেট ছিল। আবার কেউ-বা বলল, ভয় পেয়ে খুনি গা-ঢাকা দিয়েছে। কারণ, গােটা শহরের লােক সাবধান হয়ে গেছে। তা ছাড়া সবাই এমন হন্যে হয়ে দিন-রাত দস্তানা পরা লােকের খোঁজ করছে যে, নতুন খুনের ভিকটিম খুঁজে পাওয়াই মুশকিল—তাকে খুন করা তাে অনেক পরের ব্যাপার। বাবা খুন হওয়ার পর আমি অনাথ হয়ে গেলাম, কিন্তু সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ, সাইকোপ্যাথ খুনির সিরিয়াল কিলিং বন্ধ হয়ে গেল।

এতে সমস্যা মিটলেও নতুন কিছু প্রশ্ন উঠে এল পুলিশের সামনে। আমার বাবা খুন হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়ালের কাছে। মানে, এলাকার বাউন্ডারি ওয়ালের কাছাকাছি ঝােপের মধ্যে বাবার ডেডবডিটা পড়েছিল।

শুনলে তােমার অবাক লাগবে মৌ, বাবাকে কিন্তু গলা টিপে খুন করা হয়নি। ধারালাে অস্ত্র দিয়ে পাগলের মতাে কোপানাে হয়েছিল বাবাকে। ছত্রখান হওয়া ডেডবডিটা পড়ে ছিল ঘাসের ওপরে। মুখটা ধারালাে ফলার কোপে শতচ্ছিন্ন। হাতের আঙুলগুলাে শরীর থেকে আলাদা হয়ে এখানে-সেখানে পড়েছিল। বাঁ-হাতটা কাঁধের কাছ থেকে প্রায় খুলে এসেছিল। সে এক বীভৎস ব্যাপার! বাবার পকেটে পাওয়া ক্রেডিট কার্ড থেকে পুলিশ পরিচয় আর ঠিকানার খোঁজ পায়। আমি বাবাকে শনাক্ত করতে পেরেছিলাম হাতের একটা আংটি দেখে, আর ডানহাঁটুর নীচে একটা কাটা দাগ দেখে। আইডেটিফাই করার পরই আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।  এবারে তােমাকে প্রশ্নগুলাের কথা বলি।

প্রথমত, বাবাকে গলা টিপে খুন করা হয়নি। ফলে খুনের কায়দাটা সিরিয়াল কিলারের স্টাইলের সঙ্গে মিলছে না। কেন খুনি হঠাৎ স্টাইল বদলাতে গেল? দ্বিতীয়ত, মার্ডার স্পটে একটা কালাে চামড়ার দস্তানা পাওয়া যায়। রক্তমাখা দস্তানা—ছুরির কোপে টুকরাে টুকরাে হয়ে গেছে। দস্তানার রক্তের সঙ্গে বাবার রক্ত মিলে গিয়েছিল। এই দস্তানাটি কি খুনির দস্তানা হতে পারে?

তৃতীয়ত, খুনের ধরনটা এমনই যে, পুলিশের মনে হয়েছে, খুনটা প্রতিহিংসা বা আক্রোশ- থেকে করা হয়েছে। প্রচণ্ড আক্রোশ না থাকলে কেউ এভাবে খুন করেনা। তা হলে সিরিয়াল কি হঠাৎ এই আক্রোশ দেখাল কেন?

পুলিশ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছােতে চাইছিল। কিন্তু হাতে একটিমাত্র বাধা ছিল। নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ কী সেই সিদ্ধান্ত, আর কী সেই বাধা? যাকগে, আমিই বলছি।

পুলিশের সেই সিদ্ধান্ত হল আমার বাবাই সেই সিরিয়াল কিলার। খুন হওয়া কোন ভিকটিমের রিলেটিভ বা বন্ধুবান্ধব প্রতিহিংসায় আক্রোশে বাবাকে ওরকম বীভৎসভাবে খুন করে। আর এই সিদ্ধান্তের পথে বাধা হল, খুজে না-পাওয়া বাঁ-হাতের দস্তানা। দস্তানাটা পুলিশ কেন খুঁজে পায়নি জানাে? ওটা আমি নিয়ে এসেছিলাম।

প্রথমদিন অন্ধকারে পুলিশ ভালাে করে জায়গাটা সার্চ করতে পারেনি। হয়তাে বাবার সঙ্গে খুনি বা খুনিদের ধস্তাধস্তির সময় দস্তানাটা দুরে কোনও ঝােপের মধ্যে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল।  ওরা সেটা দেখতে পায়নি। খুনের পরদিন দুপুরে গােয়েন্দারা লােকজন নিয়ে এসে জায়গাটা তন্নতন্ন করে সার্চ করে

কিন্তু ওটার খোঁজ পায়নি। কারণ, সেদিন ভােরবেলা পাহারাদার কনস্টেবলদের চোখে ধুলাে দিয়ে দস্তানাটা আমি খুঁজে বের করি। ঘন ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে ওটা লুকিয়ে ছিল। ওটার গায়ে কোনও ছুরির কোপ ছিল না। শুধু দু-একজায়গায় শুকনাে রক্ত লেগে ছিল।

দস্তানাটা বাড়ি নিয়ে এসে আমি লুকিয়ে রাখলাম। বাবার শােক ভুলতে আমার কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, পুলিশের সন্দেহ ঠিক। আমার বাবাই সেই সিরিয়াল কিলার।

না, না-মৌ, তােমার আপসেট হওয়ার কিছু নেই। আফটার অল ট্রুথ ইজ ট্রুথ। সিরিয়াল কিলার লােকটা যে আমার বাবা, এর মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বহু সিরিয়াল কিলারই ফ্যামিলি ম্যান ছিল। মানে, ওরা কারও-না-কারও বাবা ছিল।

এবারে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড আরও একটু বলি। আমার মা ছােটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। তাই মা-কে আমার ভালাে করে মনে নেই। কিন্তু মায়ের সম্পর্কে বাবা খুব বাজে-বাজে কথা বলতেন।

প্রথম-প্রথম আমার খারাপ লাগত। কিন্তু পরে একই ধরনের কথা রােজ-রােজ শুনতে-শুনতে বাপারটা গা-সওয়া হয়ে এসেছিল। কে জানে, হয়তাে বাবার অভিযােগগুলাে বিশ্বাস করতেও শুরু করেছিলাম। বাড়িতে মায়ের কোনও ফটো ছিল না। বাবা রাখেননি। তাই আমি আজও জানি না, আমার মা-কে কেমন দেখতে ছিল। এই শূন্যতা নিয়ে আমি বড় হয়েছি, মৌ। আমার বাবা এমনিতে শান্ত মানুষ হলেও হঠাৎ-হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠতেন। ঘরের জিনিসপত্র পাগলের মতাে ভাঙচুর করতেন। আমার মরা মা-কে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে নােংরা গালিগালাজ করতেন। বাবার একটা ব্রিফকেস ছিল। ব্রিফকেসটা খুলে আমি কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস পেয়েছিলাম।  মেয়েদের মাথার ক্লিপ, ছেলেদের দুটো রিস্টওয়াচ, তিনটে আংটি, একটা চামড়ার বেল্ট, আর দুটো নাইলনের প্যান্টি।

জিনিসগুলাে দেখে আমার মনে হল, ওগুলাে ভিকটিমদের গা থেকে বাবা খুলে নিয়েছেন। মানে, জিনিসগুলাে মার্ডার সুভেনির।

সিরিয়াল কিলিং-এর ব্যাপারটা অনেক নিউজপেপারেই বেশ বড় করে দিনের পর দিন বেরিয়েছিল। বাবার ওই ব্রিফকেসে তার কাটিংগুলাে আমি পেয়েছিলাম। সেগুলাে বারবার করে খুঁটিয়ে পড়ে ভিকটিমদের হারানাে কয়েকটা জিনিসের কথা জানতে পারলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, হারানাে জিনিসগুলাে বাবার ব্রিফকেসেই রয়েছে। সুতরাং, সন্দেহের আর কোনও জায়গা রইল না। এবারে তােমাকে দস্তানাটার কথা বলি।

মাস আষ্টেক আগের কথা। তুমি তাে জানাে, আমি মাঝে মাঝে একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করি। একদিন রাতে বাড়িতে একা-একা বসে হুইস্কি খাচ্ছিলাম তোর বাবার কথা ভাবছিলাম। ঘরে নাইটল্যাম্পের আবছা নীল আলাে। সিডি প্লেয়ারে হালকা মিউজিক বাজছে। নেশা বেশ জমে উঠেছে। সামনের টেবিলে বােতল আর গ্লাসের পাশে পড়ে ছিল বাবার দস্তানাটা।

আমি ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, এর ভেতরে একটা খুনি হাত বাস করত। আর সেই হাতটা আমার বাবার হাত।

গ্লাভটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতে হঠাৎ কী-খেয়াল হল, আমি ওটা বাঁ-হাতে পরে ফেললাম।

সঙ্গে সঙ্গে কী যে হল, তােমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার বাঁ-হাতের আঙুলের ডগাগুলােয় যেন হাই ভােল্টেজের শক খেলাম। বাঁ-হাতের প্রতিটি শিরা চিনচিন করতে লাগল। অসহ্য জ্বালায় আমি ছটফট করতে লাগলাম। ছটফট করতে-করতে বেসামাল হয়ে ছিটকে পড়ে গেলাম চেয়ার থেকে। আমার পায়ের লাথিতে টেবিলটা উলটে গেল। তার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাস আর বােতলও।

হাতের অসহ্য জ্বালাটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। আমি মরিয়া হয়ে দস্তানাটা টেনে খােলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! ওটা কিছুতেই খােলা যাচ্ছিল না। ওটা সিমেন্টের ঢালাইয়ের মতাে আমার হাতে একেবারে সেঁটে গেছে।

মেঝেতে পড়ে আমি হিস্টিরিয়ার রুগির মতাে হাত-পা ছুড়ছিলাম আর গ্লাভটা খােলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কিছুতেই পারলাম না। হাতের জ্বালা-পােড়াটা এত বাড়তে লাগল যে, একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

যখন জ্ঞান ফিরল, টের পেলাম, জ্বালাটা আর নেই। নেশাও পুরােপুরি কেটে গেছে। কোনও রকমে উঠে ঘরের টিউব লাইট জ্বেলে দিলাম। তারপর তাকালাম আমার বাঁ-হাতের দিকে।

কবজি থেকে আমার হাতের পাঞ্জা, আঙুল সব কালাে চামড়ায় ঢাকা। এমনকী হাতের তালুর রং-ও কালাে হয়ে গেছে। তবে দস্তানাটাকে আর দস্তানা বলে চেনা যাচ্ছে না। ওটা যেন আমার হাতেরই চামড়া হয়ে গেছে। কারণ, কালাে চামড়ার তালুতে হাতের রেখাগুলাে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। নখগুলাের আকার বােঝা গেলেও সেগুলাের রং আর চরিত্র বদলে গেছে।

কী আশ্চর্যভাবেই না আমি একটা কালাে হাতের মালিক হয়ে গেলাম! হতভম্ব হয়ে হাতটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎই শুনলাম একটা কর্কশ স্বর: এইবার তুই উপযুক্ত হয়েছিস, সােনু। আমার অসম্পূর্ণ কাজ তুই শেষ করবি। যারা ঘোর পাপী, দুশ্চরিত্র, ব্যাভিচারী, তাদের সবাইকে তুই শাস্তি দিবি। আমার সব শক্তি আমি তােকে দিলাম। আবার একপ্রস্থ জ্বালা-যন্ত্রণা, ছটফটানি, চিনচিনে ব্যথা।

তারপর, কিছুটা সময় কেটে যেতেই, আমি চেতনা ফিরে পেলাম। টের পেলাম, অদ্ভুত এক আনন্দ আর তৃপ্তিতে আমার মনটা টগবগ করছে।

তবে সমস্যা একটা হল। আমার এই কালাে রঙের বাঁ-হাতটা দেখে কৌতুহলী লােকজন স্বাভাবিক ভাবেই বিরক্ত করে মারবে। কিন্তু সবাইকে তাে আর এ-গল্প বলা যায় না। তাই আমি সবসময় বাঁ-হাতে সাদা দস্তানা পরে থাকি। লােকে আমাকে হয়তাে রেস্তোরাঁর বয়-বেয়ারা ভাবে। তা ভাবুক! অন্তত পাগল করা কৌতুহলের হাত থেকে তাে আমি রেহাই পাব কী বলো?

আমার গল্প শেষ হতেই মৌমিতা খিলখিল করে হেস্যে, উঠল। ‘সােনু, তুমি ফ্যানটাস্টিক! তােমার জবাব নেই। এই অন্ধকার…এই অল্প-অল্প আলাে… এই বৃষ্টি…মাঝে-মাঝে মেঘের গর্জন…বিদ্যুতের ঝলকান্তির চেয়ে আইডিয়াল পরিবেশ আর কী হতে পারে, সােনু ? তােমার দস্তানার গল্পটা বানিয়ে দারুণ। এবারে প্লিজ, রিয়েল স্টোরিটা বলাে।

কথা বলতে-বলতে আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল মৌ। আমার গায়ে হাতও রেখেছিল। আর একই সঙ্গে ওর মিষ্টি গলায় খিলখিল করে হাসছিল।
আমি বারবার ওকে বােঝাতে চেষ্টা করলাম…বলতে চাইলাম যে, আমি যা বলেছি সেটাই আসল ঘটনা কিন্তু কে শােনে কার কথা।

বৃষ্টি কিছুটা কমে এলেও মেঘের ডাকাডাকি চলছিল। আমি উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকালাম। আর ঠিক তখনই মৌ একটানে আমার হাত থেকে সাদা দস্তানাটা খুলে নিয়েছে। আমি চমকে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখের রং সাদাটে হয়ে গেছে। ও গােল-গােল চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার কালাে রঙের বাঁ-হাতটার দিকে, কালাে রঙের পাঁচটা আঙুলের দিকে।

আমি নীচু গলায় বললাম, “মৌ, প্রথম মেয়েটাও তােমারই মতন ছিল। ওর নাম ছিল জিনিয়া। সুন্দরী, ছটফটে, চঞ্চল, মুখে সবসময় খই ফুটছে। তার সঙ্গে উগ্র পােশাক। চটকদার মেকাপ। জিনিয়াও আমার গল্পটা বিশ্বাস করতে চায়নি। তখন বাবা ওকে শাস্তি দিতে বলল…।

মৌমিতা আর কোনও কথা বলতে পারছিল না—শুধু আমার কালাে হাতটার দিকে তাকিয়ে।

এমন সময় আমার কালাে হাতের আঙুলগুলাে মাকড়সার পায়ের মতাে নড়ে উঠল। আর কর্কশ গলায় হাতটা বলে উঠল, ‘সােনু, আর দেরি করা ঠিক হবে না। তাের গাড়িটা অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। নে, চটপট কাজ সেরে নে।

পিতাশ্রীর আদেশ অমান্য করি কেমন করে!

আমার বাঁ-হাতের আঙুলগুলাে যখন সাঁড়াশি হয়ে মৌমিতার গলায় চেপে বসল, তখনও ও অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। ব্যাপারটা কিছুতেই ও বিশ্বাস করতে পারছে না।

জিনিয়াও বিশ্বাস করতে পারেনি। মৌমিতাও পারল না। আর পরের মেয়েটাও পারবে না।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত