আবার যখের ধন (পর্ব ১১)

আবার যখের ধন (পর্ব ১১)

বিমল এমন শান্তস্বরে বললে, যে, “তাহলে মরবার জন্যে প্রস্তুত হও,–কুমার সমস্ত বিপদের কথা ভুলে তার মুখে পানে আর একবার না তাকিয়ে থাকতে পারলে না। অবশ্য এ অভিজ্ঞতাও তার পক্ষে নতুন নয়। কারণ, কুমার বরাবরই দেখে এসেছে, বিপদ যত গুরুতর হয়, বিমলের মাথাও হয়ে ওঠে তত বেশি শান্ত। বিপদকে সে খুব সহজভাবেই গ্রহণ করত বলে তার বিরুদ্ধে অটল পদে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বুঝতেও পারত!

কুমারের কাছেও বিপদ অপরিচিত নয়। আসামের জঙ্গলে যখের ধন আনতে গিয়ে, মঙ্গল গ্রহের বামনদের হাতে বন্দি হয়ে, এবং ময়নামতির মায়াকাননে পথ হারিয়ে যতরকম মহাবিপদ থাকতে পারে, সে-সমস্তেরই সঙ্গে তাকে পরিচিত হতে হয়েছে, সুতরাং আজকের এই মস্ত বিপদ দেখেও কুমারের মনের ভাব যেরকম হল, তা কাপুরুষের মনের ভাব নয়।

এত দেশ বেড়িয়েও বিমল ও কুমার আজ পর্যন্ত স্বচক্ষে জ্যান্ত গরিলা দেখে নি! আজ তাদের প্রথম দেখে তারা বুঝতে পারলে যে পশু রাজা সিংহ পর্যন্ত গরিলা দেখে কেন মানে-মানে পথ ছেড়ে দেয়। এরা যে শক্তি সাহস ভীষণতা ও নিষ্ঠুরতার জীবন্ত মূর্তি তাদের হিংস্র চক্ষু, দাঁতওয়ালা মুখ আর মস্ত বুকের পাটা দেখলে প্রাণমন আঁৎকে ওঠে। আকারে তারা অন্য সব জীবের চেয়ে মানুষেরই কাছাকাছি আসে বটে, কিন্তু তবু তাদের চেহারার সঙ্গে স্যান্ডোর মতন কোন মহাবলবান মানুষেরও তুলনা হয় না। তাদের হাতের এক চড় খেলে স্যান্ডোর কাঁধ থেকেও মাথা বোধ হয় উড়ে যেত ।

সর্বপ্রথমে যে গরিলাটা ছিল, সেই-ই বোধহয় দলের সর্দার। হঠাৎ সে দুহাতে বুক চাপৃড়ে গর্জন করে উঠল।

বিমল বললে, “বন্দুক ছোঁড়ো কুমার। ওরা এই বারে আমাদের আক্রমণ করবে! ওরা বেশি কাছে এলে আমরা আর কিছুই করতে পারব না।”

বিমলের কথাই ঠিক! সর্দারের সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য গরিলাগুলোও দুই হাতে বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে ও গজরাতে-গজরাতে অগ্রসর হতে লাগল।

প্রায় একসঙ্গেই বিমল ও কুমারের বন্দুক সশব্দে অগ্নি উদগার করলে! সর্দার গরিলার গায়ে বোধহয় গুলি লাগল! চিৎকার করে বসে পড়তেই সে আবার উঠে দাঁড়াল !

কিন্তু উপরি-উপরি দু-দুটো বন্দুকের আওয়াজের সঙ্গে-সঙ্গেই আর-এক কাণ্ড! বিমল ও কুমারের পিছন দিকের বামপাশের বনের ভিতর থেকে আচম্বিতে যেন একদল দানব ঘুম থেকে জেগে উঠল! তারপর সে কী মাতামাতি আর দাপাদাপির শব্দ! মাটি কাঁপতে লাগল থর থর করে তিন-চারটে গাছ ভেঙে পড়ল মডুমডু করে! কারা যেন দ্রুতপদে ধেয়ে আসছে।

গরিলাগুলো এক মুহূর্তের মধ্যে কে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, তার আর কোনই পাত্তা পাওয়া গেল না।

দুটো সিংহ কোথা থেকে বেরিয়ে বিদ্যুতের মতন আর-এক দিকে দৌড়ে গেল — বিমল ও কুমারের পানে ফিরেও তাকালো না!

কুমার সবিস্ময়ে বললে, ‘ওরা কারা আসছে, –ওদের দেখে গরিলারা আর সিংহেরাও ভয়ে পালিয়ে গেল?”

কুমারকে টেনে নিয়ে বিমল একটা ঝোপের ভিতরে ঢুকে গুড়ি মেরে বসে পড়ল। তারপর বনের ভিতর থেকে বেরুল একে-একে বারো-তেরোটা চলন্ত পাহাড়ের মতন মূর্তি,–চারিদিকে ধুলো ও শব্দে ঝড় বহিয়ে তারা বেগে আর একটা জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকল! বিমল বললে, “হাতির দল। আমাদের বন্দুকের আওয়াজে ভয় পেয়েছে।”

কুমার বললে, “হাতি। হাতির মাথায় কি শিং থাকে?”

বিমল বললে, “কুমার, অন্তত তোমার আশ্চর্য হওয়া উচিত নয়। আর কোন মানুষেরা চোখে যা দেখে নি, ময়নামতি মায়াকাননে গিয়ে সেই-সব অদ্ভুত জীবও তুমি তো দেখে এসেছ?”

কুমার বললে, “ময়নামতির মায়াকানন হচ্ছে সৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টিছাড়া, দেশ,-আর এ হচ্ছে আফ্রিকা। এখানে যে শৃঙ্গ হস্তী পাওয়া যায়, এমন কথা আমি কোনদিন শুনিনি।”

বিমল বললে, “কিন্তু এই শৃঙ্গ হস্তীর কথা সম্প্রতি আমি একখানা ইংরেজি কেতাবে পড়েছি। এরা দুর্লভ জীব,–খুব কম লোকই দেখেছে। এখনো অনেকে এদের কথা বিশ্বাস করে না …..যাক, এখন আর এ-সব আলোচনায় দরকার নেই। চাঁদ পশ্চিম আকাশে নেমে গেছে। গরিলারা আবার দেখা দিতে পারে । আশে পাশে সিংহরা গর্জন করছে। অন্ধকার হবার আগেই আমাদের তাবুতে ফিরে যেতে হবে।”

কুমার কাতরকণ্ঠে বললে, “সবই তো বুঝছি, কিন্তু মানিকবাবুর কোন খোঁজই তো পাওয়া গেল না ।”

বিমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, “সেটা আমাদের দোষ নয়। আজ আর খোঁজাখুঁজি বৃথা। কাল সকালে আবার সে-চেষ্টা করা যাবে।”

কুমার বললে, “মানিকবাবু আর বেঁচে নেই।”

সে কথার জবাব না দিয়ে বিমল বলল, “ওঠ কুমার” ।

দুজনে আবার জঙ্গল ভেঙে পথ খুঁজতে লাগল কিন্তু পথ কোথায়? যেখানেই টর্চের আলো পড়ে, সেখানেই ছোট বড় ঝোপঝাপ বা নিবিড় অরণ্য ছাড়া অপর কিছুই দেখা যায় না।

বিমল বললে, “আমরা যে দিক দিয়ে এসেছি, সেদিক দিয়ে ফিরতে গেলেই আবার গরিলাদের কবলে গিয়ে পড়ব । এখন কী করা যায়? এই বনে বসেই কি রাত কাটাতে হবে?”

কুমার মাটির উপরে টর্চের আলো ফেলে বললে, “দেখ, এখানে কতরকম জন্তুর পায়ের দাগ । মাটিও যেন স্যাঁৎ-স্যাঁৎ করছে । এর কারণ কী?”

বিমল হেঁট হয়ে কিছুক্ষণ দেখে বললে, “হ্যাঁ। গণ্ডার, হিপো, হাতি, সিংহ, হরিণ নানারকম জীবেরই পায়ের দাগ দেখছি বটে। মাটিও খুব নরম। নিশ্চয়ই কাছে কোন জলাশয় আছে – এইখান দিয়ে জানোয়ারেরা জল খেতে যায়। কুমার, আর কোন ভয় নেই — কাছেই একটা-না-একটা পথ আছেই যদিও সেটা তাঁবুতে ফেরবার পথ নয়, তবু পথ তো!”

বিমলের কথাই সত্য। সামনে একটা বড় ঝোপের আড়ালেই জানোয়ারদের পায়ে-চলা পথ পাওয়া গেল। অদূরে আকাশ কাঁপিয়ে কী একটা বড় জন্তু চিৎকার করে উঠল।

বিমল বললে, “হিপোর চিৎকার। জলে সাঁতার কাটতে-কাটতে হিপোর দল মঝে মাঝে চেঁচিয়ে মনের আরাম জানায়।”

পথ দিয়ে এগুতে-এগুতে বিমল বললে, “কুমার, চারিদিকে চোখ রেখে সাবধানে চল। এই পথে নানা জীব জল পান করতে যায়। তাই শিকার ধরবার জন্যে বাঘ আর সিংহেরা আশেপাশে ওঁৎ পেতে বসে থাকে।”

সৌভাগ্যক্রমে ব্যাঘ্র বা সিংহ কারুর সঙ্গেই শুভদৃষ্টি হল না। পথ শেষ হতেই সামনে দেখা গেল প্রকাণ্ড এক জলাশয়। তার দিকে কালো বনের আড়ালে অদৃশ্য হবার আগে চাঁদ ম্লান-চোখে পৃথিবীকে শেষ-দেখা দেখে নিচ্ছে। জলের ভিতরে অনেকগুলো জীব ডুব দিচ্ছে বা সাঁতার কাটছে — দূর থেকে তাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

বিমল বললে, “হিপোপটেমাস।”

কুমার বললে, “আঃ, জল দেখে প্রাণ ঠাণ্ডা হল। যা তেষ্টা পেয়েছে!” বলেই সে একদৌড়ে জলের ধারে গিয়ে তীরের উপর উপুড় হয়ে পড়ল। তারপর হাত বাড়িয়ে অঞ্জলি করে জলপান করতে যাবে, অমনি জলের ভিতর থেকে বিদঘুটে দুঃস্বপ্লের মতন একখান প্রকাণ্ড ও ভীষণ মুখ ঠিক তার মুখের সুমুখেই হঠাৎ জেগে উঠল এবং সেই সঙ্গেই পিছন থেকে বন্দুকের শব্দ এবং জলের ভিতরে ভয়ানক তোলপাড়!

এক টানে কুমারকে জলের ধার থেকে সরিয়ে এনে বিমল বললে, “বন্ধু, সাত-তাড়াতাড়ি জল খেতে গিয়ে এখনি কুমিরের জলখাবার হয়েছিলে যে! যাক তুমি ঠাণ্ডা না হও, কুমিরের পোকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছি, অরে ও আবার কী ?”

খানিক তফাতেই একটা মস্ত জানোয়ার দাঁড়িয়ে বন্দুকের শব্দে খাপ্পা হয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে।

—“বোধহয় গণ্ডার। পালিয়ে এস কুমার, পালিয়ে এস।”

বিমল ও কুমার যত-জোরে-পারে দৌড় দিয়ে আবার নিবিড় জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকলে—ধুপ ধুপ শব্দ শুনে বুঝলে গণ্ডারটাও তাদের পিছনে পিছনে ছুটে আসছে।

জঙ্গলের ভিতর আর দৌড়োবার উপায় নেই — চারিদিকেই অন্ধকার আর গাছপালা, দৌড়োবার চেষ্টা করলে কোন গাছের ধাক্কা লেগে হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে যাবার সম্ভাবনা। বিমল বললে, “কুমার শুয়ে পড়!”

তারা শুয়ে-পড়ার সঙ্গে পাঞ্জাব মেলের ইঞ্জিনের মত বেগে ছুটে এসে, গণ্ডারটা ঠিক তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল — সামনের জঙ্গল ছত্রভঙ্গ করে গাছপালা কাঁটাঝোপে ভেঙেচুরে!

খানিক পরে বিমল উঠে বসে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, “ভাগ্যে গণ্ডারদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ নয়, আর তারা একরোখা হয়ে ঠিক সোজা পথে ছোটে, তাই এ-যাত্রাও বেঁচে যাওয়া গেল।”

কুমার বললে, “এ কী কঠিন ঠাঁই বাবা! প্রাণ বাঁচাতে বাঁচাতেই প্রাণ তো যায়-যায় হয়ে উঠল!—উঃ!” •.

জঙ্গলের ফাঁকে-ফাঁকে চোখ চালিয়ে বিমল বললে, “ঐ চাঁদ অস্ত গেল। ব্যস্‌, আজকের রাতের মত বনবাস ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ঐ যাঃ! কুমিরটাকে গুলি করবার সময় টর্চটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, গণ্ডারের তাড়া খেয়ে সেটা আর তুলে আনবার সময় পাই নি!”

কুমার বললে, “আমার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ। জল খাবার সময়ে টর্চ আর বন্দুক দুটিই পাশে রেখেছিলুম। সে দুটো সেখানেই আছে।”

বিমল বললে, “কী সু-খবর! এই অন্ধকারেই আমার নৃত্য করতে ইচ্ছে করছে।”

কুমার গুম্‌ হয়ে রইল!……

বিরাট অন্ধকার নিয়ে বিপুল অরণ্য তাদের বুকের উপরে ক্রমেই যেন চেপে বসতে লাগল। দূরে দূরে আশে-পাশে কাদের সব আনাগোনার শব্দ–কখনো থেমে থেমে কখনো তাড়াতাড়ি, কখনো ধীরে ধীরে। চারিদিকে কারা যেন নিঃশব্দে পরামর্শ বা ষড়যন্ত্র করছে, চারিদিকে কারা যেন চক্ষুহীন চক্ষু মেলে তাকিয়ে আছে-চারিদিকে ঝিঁঝিঁদের অশ্রান্ত আর্তনাদ, গাছের পাতায়-পাতায় বাতাসের কান্না।

আরো যেন ঈশ্বরের আশীৰ্বাদ। সে আশীৰ্বাদ হারালে পৃথিবীর রূপ বদলে যেতে বিলম্ব হয় না।

পূর্বে-পশ্চিমে-উত্তরে-দক্ষিণে কেবল অন্ধকারের মহাবন্যা বইছে। বিমলের মনে হলো, এমন অন্ধকার সে ভারতবর্ষে কখনো দেখে নি,–এ অসম্ভব শব্দময় অন্ধকারের গর্ভে বন্দী হওয়ার চেয়ে সিংহ, গণ্ডার বা গরিলার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোও ভালো,—এ অন্ধকার তাকে যেন অন্ধ আর দম বন্ধ করে হত্যা করতে চায়! বিমলের প্রাণ হাঁপিয়ে উঠল—নিজের দুর্বলতায় নিজেই লজ্জিত হয়ে সে ভাবতে লাগল, আজ কেন তার এ-রকম দুশ্চিন্তা হচ্ছে?

হঠাৎ খুব কাছেই কতকগুলো শুকনো পাতা মড়-মড় করে উঠল, তারপরেই সব চুপচাপ!

কোন অদৃশ্য শত্রু কি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে? কোন হিংস্ৰজন্তু কি আবার তাদের আক্রমণ করতে চায়? তার আত্মা কি আগে থাকতে সেটা জানতে পেরে তাকে সাবধান করে দিচ্ছে? এই অজ্ঞাত ভয় কি তাহলে অমূলক নয়? বিমল প্রাণপণে অন্ধকার ভেদ করে দেখবার চেষ্টা করলে, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলে না।

সে অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে চুপি-চুপি ডাকলে, “কুমার!”

—‘কী বলছ?”

–“কাছেই একটা শব্দ শুনলে? পায়ের শব্দের মত?”

—‘হু! একটু আগে আমার মনে হলো, কারা যেন ফিসফিস্ করে কথা কইছে।”

—“ওটা তোমার শোনবার ভুল। কিন্তু শুকনো পাতার উপরে একটা শব্দ হয়েছে। হয়তো কোন জীবজন্তু!”

_“সম্ভব ।”

—“কিন্তু দেখবার কোন উপায় নেই। অন্ধকারে আমরা এখন অন্ধ।”

“আমার কাছে একটা দেশলাই আছে। জ্বালব নাকি?”

বিমল কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আচম্বিতে কারা তার উপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল–কোন রকম আত্মরক্ষার চেষ্টা করার আগেই মাথার উপরে সে ভীষণ এক আঘাত অনুভব করলে এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল।

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ১০)

আবার যখের ধন (পর্ব ১২)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত