আবার যখের ধন (পর্ব ১০)

আবার যখের ধন (পর্ব ১০)

বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে বিমল চেঁচিয়ে ডাক দিলে, “মানিকবাবু! মানিকবাবু!” মানিকবাবুর কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

কুমার বললে, “মানিকবাবু তো এই রাত্রে একলা বাইরে বেরুবার পাত্র নন!”

—“হ্যাঁ”

—“কে সে? মানুষ না জন্তু?”

_“জানি না!”

—“দেখ, মানিকবাবুর বিছানায় তার লেপখানাও নেই! লেপ মুড়ি দিয়ে কেউ বাইরে বেরোয় না। লেপসুদ্ধ নিশ্চয় কেউ তাকে ধরে নিয়ে গেছে!”

—“কে তাঁকে ধ’রে নিয়ে যাবে? কোন জন্তু?”

—“ঘটোৎকচ যে আসেনি, তাই-বা কে বলতে পারে।”

বাহির থেকে কে কাতর-কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, “ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে রে!”

—‘ঐ মানিকবাবুর গলা! এস কুমার, আমর সঙ্গে এস।”

–- বলতে বলতে বিমল নিজের বন্দুকটা তুলে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল।

সে-রাত্রে আকাশ থেকে চাঁদ আলোর ধারা ঢালছিল বটে, কিন্তু সে-আলো যেন আরো বেশি করে প্রকাশ করে দিচ্ছিল নিবিড় অরণ্যের ভীষণ বিজনতাকে।

গাছের পর গাছ পরস্পরকে জড়াজড়ি করে যে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কেঁপে কেঁপে শিউরে শিউরে উঠছে – – তারা এইমাত্র একটা ভয়ানক কাণ্ড দেখতে পেয়েছে।

বন এত ঘন যে, চাঁদের আলোতেও তার ভিতর নজর চলে না।

বনের বাইরেই একটুখানি পথের রেখা, তারপরেই ছোট একটি মাঠ। সেখানেই আজ তাঁবু খাটানো হয়েছে।

এদিকে-ওদিকে চারিদিকে তাকিয়েও বিমল ও কুমার কোন জীবজন্তু বা মানিকবাবুকে আবিষ্কার করতে পারলে না।

—“মানিকবাবু! মানিকবাবু!”

দূর থেকে সাড়া দিলে কেবল প্রতিধ্বনি। তারপরেই আলো অনেক দূর থেকে অনেকগুলো সিংহ একসঙ্গে ঘন-ঘন গর্জন করতে লাগল! কী-একটা অজানা জানোয়ারের মৃত্যু-আর্তনাদ শোনা গেল। একদল শেয়াল চেঁচিয়ে জানতে চাইল — “কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া ?”

কুমার কাতরভাবে বললে, “মানিকবাবু বোধহয় আর বেঁচে নেই।”

বিমল কান পেতে কি শুনছিল। সে বললে, “মানিকবাবু বেঁচে আছেন কিনা জানি না, কিন্তু যে শত্রু আজ আমাদের তাঁবুতে এসেছিল, বোধহয় ঐখানটা দিয়ে সে বনের ভেতর ঢুকেছে—বলে সে বনের একজায়গায় অঙ্গুলি-নির্দেশ করে দেখাল!

কুমার বললে, “কী করে জানলে তুমি?”

—“শুনছ না, ঐখানটার গাছের ওপরে পাখি আর বাঁদররা কিচির-মিচির করছে? যেন কোন অস্বাভাবিক কাণ্ড দেখে ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, আর ঘুমোতে পারছে না।”

–“তাহলে এখন আমাদের কি করা উচিত?”

—“এখনি ঐ বনের ভিতর ঢুকব।”

–“লোকজনদের ডাকব না?”

—“সে সময় কোথায়? বলেই বন্দুকটা বগলদাবা করে বিমল অগ্রসর হল।

—“ঠিক বলেছ” বলে কুমারও তার পিছন ধরল।

ভীষণ বন! ভালো করে ভিতরে ঢুকতে না-ঢুকতেই কাঁটা ঝোপের আক্রমণে বিমল ও কুমারের জামা গেল ছিন্নভিন্ন হয়ে, সর্বাঙ্গ গেল ক্ষতবিক্ষত হয়ে । এমন অসময়ে, এই দুৰ্গম, অরণ্যে মানুষকে ঢুকতে দেখে বিস্মিত বানর ও পাখির দল আরো জোরে কলরব করে উঠল।

কুমার বললে, “বিমল, এদিক দিয়ে আর এগোবার চেষ্টা করা বৃথা। এখান দিয়ে কোন জীব যেতে পারে না_আমাদের শত্রু নিশ্চয় এ পথ দিয়ে যায়নি।”

টর্চের আলো একটা ঝোপের উপর ফেলে বিমল বললে, “দেখ ।”

কুমার সবিস্ময়ে দেখলে, একটা কাঁটাগাছে সাদা একখানা কাপড় ঝুলছে। সে বললে, কী ও?”

—“মানিকবাবুর বিছানার চাদর । এখন বুঝছ তো, শত্রু কোন পথে গেছে?”

বিমল চাদরখানা নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখে বললে, “এখন পর্যন্ত মানিকবাবু যে আহত হয়েছেন, এমন কোন প্রমাণ পেলুম না! কুমার, দেখে, চাদরে রক্তের দাগ নেই।”

কুমার বললে, “ভগবান, তাকে বাঁচিয়ে রাখুন। নইলে তার জন্যে দায়ি হব আমরাই। কারণ, আমরাই তাকে জোর করে এই বিপদের ভেতর টেনে এনেছি। আহা, বেচারা…”

“শুধু বেচারা নয়, গো-বেচারা। এইরকম সব গো-বেচারা সন্তান প্রসব করছেন বললেই বাংলা-মায়ের আজ এমন দশা । আমাদের বঙ্গ-জননীকে ব্যাঘ্ৰবাহিনী বলে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু কোথায় সে ব্যাঘ্ৰ?”

কুমার বললে, “আলিপুরের চিড়িয়াখানায় বন্দি হয়ে হালুম-হুলুম করছে।”

বিমল বললে, “কিন্তু যেদিন খাঁচা ভেঙে বেরুবে, মায়ের ভক্ত এই গো-বেচারার দল কী করবে?”

সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কুমার বললে, “বিমল, দেখ,দেখ!”

কুমারের টর্চের আলো একটা প্রকাণ্ড গাছের তলায় গিয়ে পড়েছে। সেখানে পড়ে আছে একটা চিতাবাঘের দেহকে জড়িয়ে ধরে মস্ত বড় একটা অজগর সাপ | অজগরের সর্বাঙ্গ ছিন্নভিন্ন। বাঘ আর সাপ, কেউ নড়ছে না ।

বিমল খুব সাবধানে কয় পায় এগিয়ে গিয়ে বললে, “হু, ব্যাপারটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। সর্পরাজ ভুল শিকার ধরেছিল। যদিও তার আলিঙ্গনে পড়ে ব্যাঘ্রমশাইকে স্বর্গ দেখতে হয়েছে, তবু চোখ বোজবার আগে আঁচড়ে-কামড়ে আদর করে সর্পরাজকেও সঙ্গে টেনে নিয়ে গিয়েছে।”

বিমল বন্দুকের নলচে দিয়ে সাপ আর বাঘের দেহকে দু-চারবার নাড়া দিল। তারা মরে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে আছে।

একটু তফাতে ঝোপের ভিতর থেকে তিন-চারটে হায়েনার মাথা দেখা গেল ।

কুমার বললে, “চল বিমল, হায়েনার দল আসন্ন ভোজের আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আমাদের দেখে ওরা এদিকে আসছে না – ওকি বিমল, তোমার মুখ হঠাৎ ও রকমধারা হয়ে গেল কেন?” বিমল যেদিকে তাকিয়েছিল, সেইদিকে তাকিয়ে কুমারও যা দেখলে, তাতে তার গায়ের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে গেল!

সামনের ঝোপের ভিতরে প্রকাণ্ড একখানা কালো মুখ জেগে উঠেছে! সে মুখ মানুষের মতন বটে, কিন্তু মানুষের মুখ নয়!

ঠিক তার পাশের ঝোপ দুলে উঠল এবং সেখানেও দেখা দিলে আর-একখানা তেমনি কালো, কুৎসিত, নিষ্ঠুর,—মানুষের মতন, অথচ অমানুষিক ভীষণ মুখ!

আর-একটা ঝোপ দুলিয়ে আবার আর একখানা ভয়ঙ্কর মুখ বাইরে বেরিয়ে এল!

তার পরেই একটা গাছের উপর থেকে দুম দুম দুম করে মাটি কাঁপিয়ে আবির্ভূত হল দানবের মতন মস্ত আরো চার-পাঁচটা মূর্তি।

কুমার শুকনো গলায় অস্ফুট-স্বরে বললে, “বিমল, আর রক্ষে নেই – আমাদের অন্তিমকাল উপস্থিত!”

বিমল কিছু বললে না, তার মুখ স্থির। প্রথম যে মূর্তিটা মুখ বাড়িয়েছিল, ঝোপের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে সে বাইরে এসে দাড়ালো ।

বিমল বললে, “কুমার, এরা আমাদের আক্রমণ করবে। এরা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি বলিষ্ঠ,–বনের হিংস্র জন্তুরা পর্যন্ত ভয়ে এদের ছায়া মাড়ায় না। এরা কী জীব, তা জানো তো?”

–“হু, গরিলা।”

—“তাহলে মরবার জন্যে প্রস্তুত হও।”

 

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ৯)

আবার যখের ধন (পর্ব ১১)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত