রহস্যময়ী জগৎ

রহস্যময়ী জগৎ

আচমকা ঘুম ভেঙে গেল।বুকটা বেশ ভার ভার লাগছে।চারদিকে শুনশান নীরবতা,জানালা খোলা ছিলো।বাইরে তাকিয়ে আছি।জোছনার আলো ঘরে এসে ঠেকেছে।বেশ সুন্দর লাগছে দৃশ্যটি।হাত দিয়ে জোছনা ছুতেঁ ইচ্ছে করছে। অনুমান করার চেষ্টা করছি এখন কটা বাজবে।আমার অনুমান শক্তি ভালো নয়।মোবাইলে দেখলাম তিনটে বাজে প্রায়।অভ্রর ছোট্ট হাতগুলো আমার শরীরে।নীলাও ঘুমে বিভোর।বুকটা বেশ ভার ভার লাগছে,তাই পানি খেতে উঠলাম।

ওয়াশরুম থেকে মৃদু আওয়াজ আসছে।খুব অল্প।তাই ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য এগুচ্ছিলাম।পানির কল সম্ভবত ভালো করে বন্ধ করা হয়নি।যতোই এগুচ্ছি শব্দটা বেশ ধারালো হয়ে কানে বাজছে।লাইট অন করে ভেতরে ঢুকবো হঠাৎ শব্দটা উধাও হয়ে গেল।আর পানির কোন চিহ্ন ও পেলাম না।ভাবনায় পড়ে গেলাম কারন আমি কাছে আসার সময় আওয়াজ টা স্পষ্টই শুনেছি।।যাই হোক রাতের বেলা,হয়তো ঘুমের ঘোরে এমন মনে হয়েছে।তাই এসে শুয়ে পড়লাম।

আমি শাওন।একটা প্রাইভেট ফার্মে জব করি।নীলা আমার স্ত্রী।পালিয়েই বিয়ে করেছিলাম।বাবা মা অবশ্য পরে মেনে নিয়েছিলো।চাকুরীর কারনেই আমরা শহরে এসে থাকি।আমাদের একমাত্র সন্তান অভ্র।নীলার মতো হয়েছে অনেকটা।দুবছর চলছে বয়স ওর।আগে টংগীতে ছিলাম।এখন গাজীপুরে এসে থাকছি।পাচ ছয়দিন হচ্ছে গাজীপুরের মেইন রাস্তা থেকে একটু ভেতরে এই নতুন বাসায় উঠেছি।নতুন বললে ভুল হবে কিছুটা পুরোনোই বলা যায়।আর বাসাটা কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে।নীলার কোলাহল ভালো লাগে না তাই একটু আড়ালেই এই বাসা নেওয়া।

অফিসে বসে আছি।অভ্রকে খুব মিস করতেছিলাম তাই নীলাকে ফোন দিলাম।অদ্ভুত কারনে রিং হওয়ার আগেই রিসিভ হয়ে গেল।আমি অনেকবার হ্যালো বলার পরেও কোন আওয়াজ আসছিলো না।ধ্যাত নেটওয়ার্ক এর সমস্যা মনে হই তাই কেটে দিলাম।অস্থির লাগছিলো তাই বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এলাম।কিন্তু একি দরজা খোলা।ভেতরে ঢুকেই নীলাকে ডাকতে শুরু করলাম

-নীলা,এই নীলা।কই তুমি??

-এই কি হইছে?এতো চিল্লাচিল্লি করছ কেন?

-আরে চিল্লাচিল্লি করবো না,দরজা খোলা রেখেছ কেন?খারাপ মানুষের কি অভাব আছে?

-দরজা কেন খোলা রাখবো শুধু শুধু।।তুমি যাওয়ার পর ই তো ভালোভাবে অফ করেছি।।আর খোলার দরকার হয়নি একবার ও।

-কি বল,দরজা তো খোলাই ছিলো।আচ্ছা কল করছিলাম ধরে কথা বলছিলে না কেন?

-তুমি কখন ফোন দিয়েছ আবার?আমি তো ভাবছি ভুলেই গেছ।

-কি বল ফোন আসেনি।

-আমি কি এটা নিয়ে মজা করবো।জানো কি রাগ লাগছিলো,আর এখন এসে কি সব উলটা পালটা কথা বলছ।
নীলার মুখে চিন্তার ছাপ পড়েছে অথচ সে সব হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে।সন্ধায় এসে দরজার হুক ভালোভাবে খেয়াল করলাম।কই সব ই তো ঠিক আছে।তবে দরজা খোলা রইল কিভাবে আর তাছাড়া দুপুরে ফোন দেয়ার সময় তো রিসিভ হয়েছিল।ফোনের ব্যালান্স ও কেটে নিয়েছে।কি সব অদ্ভুত লাগছে।মাথায় তালগোল পাকিয়ে ফেলছি।আমার কি কোন বিভ্রম হচ্ছে।কিন্তু এর আগে তো এমন কিছু হয়নি।আর কি সব উদ্ভট চিন্তা করছি।।ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি না আমি।।কাল একটু তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে তাই শুয়ে পড়লাম।

-আচ্ছা নীলা তোমার এই বাড়িতে থাকতে কেমন লাগে?

-ভালোই তো।নিরীবিলী।ছাদটাও বেশ সুন্দর।এতো সুন্দর বাড়িতে পাশের ফ্লাট গুলো খালি থাকে কেন?পুরো বাসায় অনেক জনমানবশূণ্য লাগে।

-বাসায় একা থাকো কোন সমস্যা বা কোন কিছু কি অস্বাভাবিক লাগেনা?

-নাতো।সব ঠিক ই আছে।।কি সব উল্টো পাল্টা বকছো।ঘুমাও তো,মাথা ঠিক নাই তোমার।

-এই অভ্রর কোন সমস্যা হয় নাতো?

-না।সব ই ঠিক আছে।।

-আচ্ছা ঘুমোও।

রাত বাড়ছে।ঘুম আসছে না।বড্ড অস্থির লাগছে।কিছু একটা হচ্ছে কিন্তু ধরতে পারছি না।এমন ই বা কেন হচ্ছে?নাকি সব ই নিছক আমার ই ভুল,এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
সকালে উঠে রেডি হয়ে বের হচ্ছিলাম…

-এই কই,দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।

-আসছি তো,এতো অধৈর্য্য হলে কি চলে,খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।

-নীলা এবার আসি,অভ্রকে দেখো।সমস্যা হলে ফোন দিও।
এই নীলা দরজা খুলছে নে কেন?উফ অনেকবার ঝাকালাম কিন্তু দরজা তো খুলছে না

-বাইরে থেকে কি কেও লাগিয়ে দিল নাকি?
মিনিট পনের এভাবে আমি আর নীলা দরজা ঝাকাঝাকি করছি।কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দরজা খুলে গেল।বাইরে ফিরোজ সাহেব দাঁড়ানো।

-কি হয়েছে শাওন সাহেব।দরজা এভাবে ঝাঁকাচ্ছিলেন কেন?

-আরে ভাই পনের মিনিট ধরে দরজা ঝাঁকাচ্ছি।খুলছিলো না।বাইরে থেকে কেও বোধহয় আটকিয়ে দিয়েছিল

-কই বাইরে তো কোন হুক লাগানো ছিলো না।আপনারা এভাবে ঝাঁকাচ্ছেন দেখে তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আর হালকা ধাক্কা দেওয়াতেই তো খুললো

-ধন্যবাদ ফিরোজ সাহেব।কি যে অস্বস্তিতে পড়েছিলাম।অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।মিস্ত্রী এনে ঠিক করতে হবে দরজাটা।

ফিরোজ সাহেব চলা যাওয়া মাত্রই শাওন ও অফিসে যাচ্ছিলল।পুরো রাস্তা জূড়ে সে চিন্তা করতে লাগলো এটা কিভাবে সম্ভব।পনের মিনিট ধরে যেভাবে টানাটানি করতেছিল তাতে লক থাকলেও ভেঙে চলে আসার কথা।কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।এবার একটু ভয় পেতে শুরু করল শাওন।

ইদানীং কাজে মন বসাতে পারছে না নীলা।বেশ কদিন ধরেই কাজ করার সময় মনে হয় পেছনে কেও দাঁড়িয়ে আছে।পেছনে ফিরে অবশ্য কাওকেই দেখেনা।

নীলা চুলোয় পানি ফুটোতে দিয়েছিল।।সেটা উঠানোর সময় হঠাৎ সে অনুভব করল খুব ই শীতল হাত দিয়ে ওর কাধে কেও স্পর্শ করেছে।এতোটাই শীতল হাত ছিলো যে সে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।সে লাফ দিয়ে সরতে যাওয়ার সময় ওর ধাক্কাতে গরম পানি সহ কলস পড়ে গেলো।অবাক হয়ে দেখলো যে পেছনে কেও নেই অথচ গরম পানি তার পায়ে পড়ার পরও একফোটাও তার যন্ত্রণা অনুভব হলো না।সে প্রচন্ড ভয় পেয়ে শাওনকে বাসায় চলে আসতে বললো।

-নীলা কি হয়েছে?এতো জরুরী তলব কেন?অভ্র কোথায়?

কিছু বলার আগেই নীলা শাওনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো।মেয়েটা খুব বেশি ভয় পেয়েছে।কেপেঁ কেপেঁ উঠছে ওর শরীর।কিছুই বলতে পারলো না নীলা।

রাতে দুজন ই শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি,দুজন ই চুপচাপ।শাওন বুঝে উঠতে পারছে তাদের জীবনে কি শুরু হলো এসব।কেনোই বা হচ্ছে এসব

-বাবু চলো এই বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য বাসায় উঠি।

-কেন?কি সমস্যা।আর মাসের টাকা তো অগ্রিম দেওয়া হয়ে গেছে।মাস শেষ হওয়ার আগে কিভাবে যায়।

নীলা সব খুলে বললো।শাওনের ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো।সে সারারাত ছটফট করল।ঘুম আসছে না ওর।

তারপর আবার দুদিন পর দুপুরে হঠাৎ নীলার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে বাসায় এসে শাওন অবাক হয়ে দেখলো অভ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে হাত পা ছুড়ছে,হাসছে আবার কান্না করছে।অদ্ভুত অংগভংগি করছে।ওপাশে অবশ্য উপরে জানালা আছে।একটা কাক বসে আছে।কিন্তু অভ্রের ওখান থেকে জানালা দেখতে পাওয়ার কথা না।আর দেখলেও হাসার বা কান্না করার মতো কিছু নেই।নীলা ছো মেরে অভ্রকে নিয়ে এলো।
এরপর থেকেই প্রায় নিয়মিতই দরজা লাগানো বা খোলা,মাঝরাতে গোঙানির আওয়াজ,ছাদে গেলে কাওকে হাটতে দেখা এসব চলতেই লাগলো।

অনেক হয়েছে।আর পারা যাচ্ছে থাকতে এখানে।তার দুদিন পরেই শাওন নীলাদের নিয়ে ওই বাসা ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসায় এসে উঠলো।

কিন্তু শাওনের মনে অস্থিরতা কিছুতেই কমছে না।বিজ্ঞানের এই যুগে ভূত বিশ্বাস করার মানেই হয় না,কিন্তু এতোদিন ধরে যা ঘটেছে তাও কিভাবে অস্বীকার করবে।তাই ছুটির দিনে সে আবার ওই বাড়ির দিকে গেল।স্থায়ী কিছু মানুষের কাছে জানতে চাইল বাসার কাহিনী কি?এমন কেন হয়।অনেকেই বলতে চাইল না কিন্তু একজন বৃদ্ধ ডেকে একটা নিরীবিলী জায়গায় নিয়ে বাসা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য দিলো।

লোমহর্ষক কিছু ঘটনা শুনলাম।তবে সব রহস্য।উনার ভাষ্যমতে এই বাসা তেমন কেও ভাড়া নেয় না।যারা নেয় তারাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেন না।টিকে থাকার কথাও না।তবে অদ্ভুত ব্যাপার এখন পর্যন্ত কোন ক্ষতি হয়নি কারো।

বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় সেই বাসাটার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিলাম, কত না রহস্য এর ভেতর লুকিয়ে আছে।

মুচকি হেসে বলেছি থাকুক না কিছু রহস্য।সব রহস্য উদঘাটন করতে নেই।সৃষ্টির সব কিছু তো রহস্য।আদৌ কি সব রহস্য ভেদ করা যায়……

লেখকঃইমরান(রকেট)…

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত