আবার যখের ধন (পর্ব ৬)

আবার যখের ধন (পর্ব ৬)

সেদিন বিকালে বিমল, কুমার ও রামহরি ডেকের উপর দাঁড়িয়ে কথাবার্তা কইছিল। মানিকবাবু আজ কেবিন থেকে বাইরে বেরুতে পারেন নি। তিনি সামুদ্রিক-পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন – ক্রমাগত বমন করছেন।

চারিদিকে নীল জল থৈ-থৈ করছে — অগাধ সমুদ্ৰ যেন নিজের সীমা হারিয়ে সমস্ত পৃথিবীকে গিলে ফেলে, আকাশের প্রান্তে ছুটে গিয়ে তাকেও ধরে টেনে পাতালে চুবিয়ে দিতে চাইছে। এবং সূর্য শূণ্য-পথে পশ্চিমে এগুতে-এগুতে মহাসাগরের অনন্ত বুক জুড়ে যেন লক্ষ-কোটি হীরের প্রদীপ জ্বালছে আর নেবাচ্ছে– জ্বালছে আর নেবাচ্ছে! সে আলো-খেলার দিকে তাকালেও চোখ অন্ধ হয়ে যায়!

রামহরি বলছিল, “খোকাবাবু, তোমরা মিছে ভয় পেয়েছ। শত্রুরা আমাদের পিছু নিতে পারেনি। তাহলে এতদিনে নিশ্চয়ই আমরা টের পেতুম।”

বিমল বললে, “হ্যাঁ, আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। আমরা বোধ হয় তাদের ফাঁকি দিয়েছি।

কুমার বললে, “একটা বিপদ কমল বটে, কিন্তু আমাদের সামনে এখনো লক্ষ বিপদ আছে।…আচ্ছা বিমল, আমাদের সমুদ্রযাত্রা কবে শেষ হবে বলতে পারো? আর ভালো–”

কুমারের মুখের কথা ফুরুবার আগেই বিমল তাকে ও রামহরিকে এক-এক হাতে প্রচণ্ড এক-একটা ধাক্কা মেরে নিজেও বিদ্যুতের মতন সাঁৎ-করে এক পাশে সরে গেল। ধাক্কার বেগে সামলাতে না পেরে কুমার ও রামহরি দু-দিকে ঠিকরে পড়ে গেল এবং পড়তে-পড়তে শুনতে পেলে, তাদের পাশেই দমাস্ করে বিষম এক শব্দ আর ওপর থেকে হো-হো করে অট্টহাসির আওয়াজ!

দুজনে উঠে দেখে, তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল ঠিক সেইখানটায় মস্ত একটা পিপে পড়ে ভেঙে গেছে এবং তার ভিতর থেকে একরাশ লোহা-লক্কড় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে!

বিমল হাস্যমুখে বললে, “কুমার, ভাগ্যে আমি দেখতে পেয়েছিলাম! নইলে এই লোহা বোঝাই পিপেটা মাথায় পড়লে আমাদের সমুদ্রযাত্রা আজকেই শেষ হয়ে যেত!”

কুমার বিবর্ণমুখে বললে, “কে এ কাজ করলে?”

—“ওপরের ডেক থেকে এই পিপেটা পড়েচে । সেই সময়েই পিপেটার দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়ে যায়। আমি আর কিছু দেখতে পাইনি–দেখবার সময়ও ছিল না। কিন্তু আমাদের বধ করবার জন্যেই যে এই পিপেটাকে ফেলা হয়েছে, তাতে আর কোনই সন্দেহ নেই।”

রামহরি বললে, “আমি একটা বিচ্ছিরি হাসি শুনেছি।”

কুমার বললে, “আমিও শুনেছি। চল, ওপরে গিয়ে একবার খোঁজ করে আসা যাক। যদি তাকে পাই তাহলে এবারে সে নিশ্চয়ই আর হাসবে না।”

তিন জনে ওপর-ডেকে গেল। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। তখন জাহাজের কাপ্তেন-সাহেবকে ডেকে এনে বিমল সব কথা বললে ও ভাঙা পিপেটাকে দেখালে। কাপ্তেন জাহাজের কর্মচারী ও লস্করদের ডেকে আনিয়ে অনেক প্রশ্ন করলে, কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারলে না ।

পরের রাত্রে জাহাজ মোম্বাসায় পৌঁছবার আগের রাত্রেই আবার এক ঘটনা!

বিমলরা একটা গোটা কেবিন রিজার্ভ করে সবাই এক ঘরে থাকত ।

মানিকবাবু, কুমার ও রামহরি ঘুমিয়ে পড়বার পরেও বিমল একখানা বই নিয়ে জেগে রইল। তারপর রাত যখন একটা বাজল, তখন সে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। জাহাজের ওপরে আছড়ে সমুদ্রের জল কেঁদে উঠেছে; তাই শুনতে-শুনতে তার চোখ ঘুমে এলিয়ে এল।

…হঠাৎ বাঘার গোঁ-গোঁ গর্জন তারপরই তার আর্তনাদ শুনে চট করে বিমলের ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে বসতেই সে শুনলে, বাঘা আবার গর্জন করে উঠল–সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে তাদের কেবিনের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল! আলোর চাবি টিপে বিমল দেখলে, বাঘা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে কেবিনের বন্ধ দরজার ওপরে বার-বার ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ততক্ষণে আর-সকলেও জেগে উঠল ।

বিমল বললে, “অন্ধকারে ঘরের ভিতর কে ঢুকেছিল, বাঘার সঙ্গে লড়াই করে সে আবার দরজা বন্ধ করে চম্পট দিয়েছে!”– বলেই সে নিচে নেমে মেঝে থেকে কী তুলে নিলে! কুমার বললে, “কী ও?”

–“একরাশ লোম ।”

–“লোম!”

–“হ্যাঁ।” বিমল পকেটে হাত দিয়ে একটা কাগজের ছোট মোড়ক বার করে বললে, “মানিকবাবু দেখে যান!”

মানিকবাবু ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দাঁড়ালেন।

বিমল বললে, “মানিকবাবু, আপনি প্রথম যেদিন আমাদের বাড়িতে যান, সেই দিন এই কাগজের মোড়কটা আপনি আমাকে দিয়েছিলেন, মনে আছে?”

—“হ্যাঁ, ওর ভেতরে একথোকা লোম আছে । শত্রুরা আমার বাড়ি আক্রমণ করে চলে যাবার সময়ে আমার মরা-কুকুরের মুখে ঐ লোমগুলো লেগেছিল।”

—“আর কেবিনে যে ঢুকেছিল, তারও গা থেকে বাঘা কামড়ে লোমগুলো তুলে নিয়েছে। দেখুন এই লোম আর আপনার মোড়কের লোম এক কিনা!”

সকলে আগ্রহে ঝুঁকে পড়ে দেখলে, সব লোমই এক-রকমের । মানিকবাবু ভয়ে ঠক্ ঠক্‌ করে কাঁপতে লাগলেন। রামহরি তাড়াতাড়ি বাঘার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল, তার কোথাও চোট্, লেগেছে কিনা!

কুমার বাঘার মাথা চাপড়ে বললে, “সাবাস বাঘা! মানিকবাবুর কুকুর যুদ্ধে মারা পড়েছিল, তুই কিন্তু লড়াই ফতে করেছিস্! আমাদের বাঘা কি যে-সে জীব, জলে-স্থলে-শূণ্যে সর্বত্র সে জয়ী হয়েছে।”

এমন সময়ে বাইরে গোলমাল শোনা গেল–চারিদিকে যেন অনেক লোকজন ছুটাছুটি করছে। বিমল, কুমার ও রামহরি তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে গেল। মানিকবাবু কেবিনের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে হতাশভাবে বসে পড়ে বললেন, “প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারব না দেখছি?”

ডেকের ওপরে লোকারণ্য। কাপ্তেন-সাহেব দাঁড়িয়ে আছে এবং নিচে দুহাতে ভর দিয়ে বসে একজন পূৰ্ব্ববঙ্গীয় লস্কর ক্ষীণস্বরে বলছে, “না, না, আমি ভুল দেখি নি! ভূত, একটা ভূত আমাকে মেরেছে!”

একে-তাকে জিজ্ঞাসা করে বিমল ব্যাপারটা সব শুনলে । খানিক আগে ঐ লস্করটা এদিক দিয়ে যাচ্ছিল । চাঁদের আলোয় হঠাৎ সে দেখতে পায় কে যেন চোরের মত লুকিয়ে-লুকিয়ে তার সামনে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে। লস্করটা তাকে ধরতে যায়, অমনি সেও তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা টিপে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে। লস্কর বলছে, মানুষের মতন তার হাত-পা আছে বটে, কিন্তু সে মানুষ নয়, ভূত! কাপ্তেন তার কথায় বিশ্বাস করছে না।

ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে বিমল কাপ্তেনের কাছে সেই অজ্ঞাত শত্রুর সঙ্গে বাঘার যুদ্ধের কথা খুলে বললে। কাপ্তেন বিস্মিত-স্বরে বললে, “তুমি বলতে চাও, যে তোমাদের কেবিনে ঢুকেছিল তার গায়ে লোম আছে?”

—“হ্যাঁ, এই দেখ।” বিমল মোড়কটা কাপ্তেনের সামনে খুলে ধরল। কাপ্তেন হতভম্বের মতন মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বললে, “জানি না, এ কী ব্যাপার! ভগবান আমাদের রক্ষা করুন।”

কে একজন অস্ফুটকণ্ঠে হেসে উঠল। বিমল চমকে মুখ তুলে দেখলে, ভিড়ের ভিতরে সকলের মাথার ওপরে মাথা তুলে সেই সাড়ে-ছয়-ফুট উঁচু লম্বা-চওড়া কাফ্রিটা ওষ্ঠহীন মড়ার মতন দাঁত বার-করা ভয়ানক মুখে হাসছে, কি যে হাসছে, না ভয় দেখাচ্ছে?

* * *

পরদিন জাহাজ ইস্ট আফ্রিকার মোম্বাসা-বন্দরে এসে থামল । সঙ্গে সঙ্গে অগণিত ছোট নৌকা এসে পঙ্গপালের মতন জাহাজখানিকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেললে; এবং তাদের ওপরে বসে সোয়াহিলি জাতের মাঝি-মাল্লারা দুর্বোধ্য ভাষায় চেঁচিয়ে, নানারকম ভঙ্গিতে হাত নেড়ে আপন আপন নৌকায় আসবার জন্যে যাত্রীদের ডাকতে লাগল।

বিমল, কুমার, মানিকবাবু ও রামহরি নিজেদের মালপত্তর ডেকের ওপরে এনে রাখছে, এমন সময়ে বিমল হঠাৎ দেখলে, সেই মড়াদেঁতো ঢ্যাঙা কাফ্রিটা ও তার আরো দুজন স্বদেশি লোক একটা মস্ত সিন্দুক ধরাধরি করে বাইরে বয়ে নিয়ে এবং সেটাকে খুব সাবধানে ডেকের ওপরে নামিয়ে রেখে আবার কেবিনের দিকে গেল–খুব সম্ভব, অন্যান্য মোট বাইরে আনবার জন্যে।

সিন্দুকের আকার দেখে বিমলের মনে কেমন সন্দেহ হল। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকটা পরখ করতে লাগল। সিন্দুকটা কাঠের । বিমল টেনে দেখলে, ডালা বন্ধ। তারপর ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ-দৃষ্টিতে দেখলে, সিন্দুকের ওপরে গায়ে সর্বত্রই অগুন্তি লোম লেগে রয়েছে! মোড়কটা আবার বার করে সিন্দুকের লোমের সঙ্গে মিলিয়ে সে বুঝলে, এ সবই অজ্ঞাত শত্রুর গায়ের লোম কিন্তু তার লোম এই সিন্দুকের গায়ে কেন? এই লম্বা চওড়া সিন্দুক, এর মধ্যেই অনায়াসেই একজন মানুষের ঠাঁই হতে পারে! তবে কি কাফ্রিরা তখনো আসে নি। বিমল তাড়াতাড়ি নিজেদের দলের কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর বললে, “মানিকবাবু, কুমার আমি এক অপূর্ব আবিষ্কার করেচি!”

–“কী, কী?”

—“ঘটোৎকচ! ঘটোৎকচ ঐ সিন্দুকের ভেতর লুকিয়ে আছে।” মানিকবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, “অ্যাঁ?”

—“চুপ? গোল করবেন না। চললুম আমি কাপ্তেনের কাছে।”

—“আজ ঘটোৎকচ গ্রেপ্তার হবে।”–-বিমল তীরবেগে কাপ্তেনের খোঁজে ছুটল।

মানিকবাবু দুই চোখ কপালে তুলে বললেন, “ও বাবা! আরব্য উপন্যাসের দৈত্য বেরিয়েছিল কলসির ভেতর থেকে। আর আজ এই সিন্দুকের ভেতর থেকে বেরুবে, ঘটোৎকচ? এখন আমার উপায়? …ও কুমারবাবু, আমাকে এখানে একলা ফেলে আপনিও বিমলবাবুর সঙ্গে কোথায় চললেন ? ও রামহরি! তুমিও যাও যে! বাঘা বাঘা! আরে, বাঘাও নেই। ঐ সিন্দুকে ঘটোৎকচ, আর আমি এখানে একা। যদি সে ফস্ করে সিন্দুক থেকে বেরিয়ে পড়ে? ও বাবা!”—মানিকবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ভয়ে ভয়ে দুই চোখ মুদে ফেললেন।

 

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ৫)

আবার যখের ধন (পর্ব ৭)

 

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত