আবার যখের ধন (পর্ব ৫)

আবার যখের ধন (পর্ব ৫)

ডেক-চেয়ারের ওপরে বসে এবং রেলিংএর ওপরে হাত ও মুখ রেখে মানিকবাবু অত্যন্ত ম্ৰিয়মানের মতন সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ।

কুমার তার কাঁধের ওপরে একখান হাত রেখে বললে, “মানিকবাবু, কী ভাবছেন?”

—“ভাবচি আমার মাথা আর মুণ্ডু, আকাশ আর পাতাল!”

—“ভেবেও কোন কুল-কিনারা পাচ্ছেন না বুঝি?”

—“কূল-কিনারা? অকূলে ভেসে কূল-কিনারা খুঁজে লাভ? আমি এখন মরিয়া হয়ে উঠেচি—একদমৃ মরিয়া! এখন আমি মানুষ খুন করতে পারি।”

–“ভাল কথাই তো! তাহলে এখন আপনার আর কোন দুঃখ নেই তো?”

মানিকবাবু আবার কেমন মুষড়ে পড়লেন। কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “ও বাবা, দুঃখ আবার নেই? কোথায় যাচ্ছি ভগবান জানেন; কাঁধের ওপরে মাথা নিয়ে আর কি কখনো দেশে ফিরতে পারব?”

এমন সময়ে বিমল, পুরাতন ভৃত্য রামহরি এবং তাদের পিছনে পিছনে বাঘা কুকুর সেখানে এসে হাজির হল ।

বিমল বললে, “মানিকবাবুর সঙ্গে কী কথা হচ্ছে কুমার?”

কুমার বললে, “দেশ ছেড়ে মানিকবাবুর বড় দুঃখ হয়েচে ।”

বিমল বললে, “তা তো হবেই কুমার! তাই হওয়াই তো উচিত। দেশ ছাড়তে যার মনে দুঃখ হয় না, আমি তাকে ঘৃণা করি। যে দেশের মাটি আমাকে শয়নের শয্যা পেতে দিয়েচে, ক্ষুধায় ফল-ফসল জুগিয়েচে, তেষ্টায় অমৃতের মতন মিষ্টি জল দান করেচে,যে দেশের বাতাস আমার নিঃশ্বাস হয়েচে, যে-দেশের আকাশ সূর্য-চাঁদের আলো জ্বেলে আমার চোখে দৃষ্টি দিয়েচে, সে-দেশকে ছাড়তে প্রাণ যে না কেঁদে পারে না! মানুষ-মায়ের চেয়েও যে এই দেশ-মা বড় মানুষ-মা তো চিরদিন তার সন্তানকে লালন-পালন করতে পারেন না। কিন্তু দেশ-মা যে চিরদিন তার নিজের মাটি-কোলের ভিতরে ছেলে-মেয়েকে আদরে আগলে রেখে দেন — তার মৃত্যু নেই, শ্রান্তি নেই, অযত্ন নেই। ঐ চেয়ে দেখ, আমাদের সোনার দেশ সোনার সূর্যের সোনার আলোয় ঝলমল করতে করতে এখনও আমাদের মুখের পানে কত স্নেহ, কত প্রেম নিয়ে তাকিয়ে আছেন।”

জাহাজ তখন আরব-সাগরের সুনীল বক্ষ ভেদ করে সশব্দে অগ্রসর হচ্ছিল। দূরে দেখা যাচ্ছে মা ভারতবর্ষের রৌদ্রধৌত বিপুল তটভূমি — মাথার উপরে নির্মেঘ নীলাকাশের উজ্জ্বল চন্দ্ৰাতপ, বুকের উপরে শত উপবনের শ্ৰীমন্ত শ্যামলতসা আর সহস্র মন্দির-প্রাসাদের উচ্চ চূড়া এবং চরণের উপরে আরতিমত্ত মহাসমুদ্রের ফেনশুভ্র লক্ষ চঞ্চল বাহুর প্রণাম-আগ্ৰহ!

…ভারতবর্ষ। ভীমাৰ্জুনের জন্মক্ষেত্র! আর্য-জাতির স্বদেশ! সকলে নীরবে সেই দিকে চেয়ে অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর রামহরি বলল, “দেশকে যদি অতই ভালবাস, তাহলে দেশ ছেড়ে আবার বিদেশে যাওয়া কেন বাপু? সুখে থাকতে ভূতে কিলোচ্ছে বুঝি?”

বিমল হেসে বলল, “হ্যাঁ, রামহরি, ঠিক তাই। তুমি তো জানই আমাদের ঘাড়ে সর্বদাই একটা ভূত চেপে থাকে, যেই দুদণ্ড চুপ করে বসি, অমনি সেই ভূতটা এসে পিঠে কিল মারে, আর ভূতের কিল হজম করতে না পেরে আমরাও তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে পড়ি ।”

রামহরি রাগে গজগজ করতে-করতে বললে, “ঐ ভূতই একদিন তোমাদের ঘাড় মটকাবে!”

কুমার বললে, “আচ্ছা রামহরি, ময়নামতির মায়াকাননে তুমিই তো প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে, আর কখনো আমাদের সঙ্গে আসবে না। তবে এবারেও আবার এলে কেন?”

রামহরি বললে, “আসি কি আর সাধে রে বাপু? চিলে যখন চড়ুইয়ের ছানাকে ছ্যোঁ মারে তখন চড়ুই-মা চিলের পিছনে ছুটে যায় কি সখ করে? তোমাদের সঙ্গে আসতে হয়, না এসে উপায় নেই বলে। এখনো আমার এই বুড়ো হাতে ঘুণ ধরে নি, এখনো চার পাঁচটা জোয়ান মরদের সঙ্গে খালি হাতে লড়তে পারি। আর আমি থাকতে তোমরা কেন বিদেশে বেঘোরে প্রাণ হারাবে, তাও কি কখনো হয়! আয়রে বাঘা, এখান থেকে চলে আয়, পাগলদের সঙ্গে বকাবকি করে লাভ নেই — এই বলে বাঘাকে নিয়ে সে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু যেতে-যেতে হঠাৎ একদিকে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বিমলকে বললে, “দেখ খোকাবাবু, জাহাজে উঠে পর্যন্ত দেখচি, ঐ বেয়াড়া-চেহারা লোকটা সব জায়গাতেই খালি আমাদের পিছনে পিছনে ঘুরচে।”

একটু তফাতেই একটা লোক বুকের উপরে দুই হাত রেখে রেলিঙে ঠ্যাসান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল এবং তার চেহারা কেবল বেয়াড়া নয়, ভয়ানকও বটে। লোকটা মাথায় অন্তত সাড়ে-ছয় ফুট উচু চওড়াতেও প্রকাণ্ড — এমন লম্বা চওড়া লোক যে থাকতে পারে, না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু সব-চেয়ে ভীষণ হচ্ছে তার মুখ! তার রং আবলুস কাঠের মতন কালো-কুচুকুচে ও তার চোখ দুটো আশ্চর্য-রকম জ্বলজ্বলে ও জন্তুর মতন হিংস্র। তার নাকটা বাঁদরের মতন থ্যাব্‌ড়া। আর মাংসহীন মড়ার মাথার দাঁতগুলো যেমন বেরিয়ে থাকে তারও দু-পাটি দাঁত তেমনিভাবে ছরকুটে বাইরে বেরিয়ে আছে – কারণ, তার ওপরের ও নিচের দুই ঠোঁটই না-জানি কোন দুর্ঘটনায় কেমন করে উড়ে গেছে। তার মাথায় লাল রঙের একটা তুর্কি ফেজ টুপি, পরনে খাঁকি কোর্তা ও প্যান্ট এবং হাতে এমন একগাছা লাঠি, যার এক ঘায়ে যে কোন মানুষের মাথা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যেতে পারে।

এ-রকম খাপ্‌ সুরৎ চেহারা রাতের বেলায় সুমুখে দেখলে রাম নাম জপ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না, দিনের বেলাতেই তাকে দেখে মানিকবাবু চক্ষু ছানাবড়া করে ভয়ে আঁৎকে উঠলেন।

বিমল অবাক হয়ে তার দিকে দুপা এগিয়ে যেতেই সে আস্তে আস্তে অন্যদিকে চলে গেল এবং যাবার সময়েও কুৎকুতে চোখের কোণ দিয়ে চোরাচাহনিতে বার-বার তাদের পানে তাকাতে লাগল।

তার চলার ধরন দেখে বিমলের দৃষ্টি তার পায়ের দিকে আকৃষ্ট হল। লোকটার ডান পায়ে মাত্র কড়ে আঙুল ছাড়া আর কোন আঙুল নেই!

কুমার বিস্মিতকণ্ঠে বললে, “কে ও ? আর আমাদের পিছুই-বা নিয়েচে কেন?”

বিমল বললে, “ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, লোকটা জাতে কাফ্রি আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই আফ্রিকারই বাসিন্দা। ওর ফেজটুপি দেখে বোঝা যাচ্চে, লোকটা ধর্মে মুসলমান । ওর ভাবগতিক দেখে বোঝা যাচ্চে, লোকটা যেই-ই হোক, আমাদের বন্ধু নয়।”

কুমার বললে, “বন্ধু নয়! শত্রু? তবে কি বুঝতে হবে, শত্রুরাও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এই জাহাজে চড়ে, আফ্রিকায় যাচ্চে ।

বিমল বললে, “আমার তো সেই সন্দেহ-ই হচ্চে।”

–“কিন্তু তারা কারা?”

–“কী করে বলব? রামু ছাড়া তাদের দলের আর কারুকে আমরা দেখি নি। রামু যদি জাহাজে উঠে থাকে, তবে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। অন্য কোন শত্রুকে আমরা চিনি না, আর এই কাফ্রিটা সত্য-সত্যই আমাদের শত্রু কিনা তাও ঠিক করে বলা যায় না। কিন্তু সন্দেহ যখন হচ্চে, তখন আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।”

মানিকবাবু বললেন, “ও কাফ্রিটা যে কে, আমি বলতে পারি।”

বিমল সবিস্ময়ে বললে, “আপনি বলতে পারেন?”

–“হ্যাঁ। ঐ লোকটা হচ্ছে আপনার সেই ঘটোৎকচ!”

বিমল হাসতে-হাসতে বললে, “না মানিকবাবু, না। ঘটোৎকচের চেহারা এতটা ভদ্র হতে পারে না।”

মানিকবাবু বললেন, “ও বাবা, ঐ কাফ্রিটার চেহারা হল আপনার কাছে ভদ্র?”

বিমল মাথা নেড়ে বললে, “না, আমার কাছে নয় — কিন্তু ঘটোৎকচের কাছে ওর চেহারা ভদ্র বৈকি! ঘটোৎকচকে সামনে দেখলে আপনি এখনি মূৰ্চ্ছা যেতেন।”

–“কী করে জানলেন আপনি?”

—“আমার কাছে প্রমাণ আছে। আর সে প্রমাণ আপনিই আমাকে দিয়েছিলেন।”

–“ও বাবা, সে আবার কী?”

–“হ্যাঁ। পরে সব জানতে পারবেন।”

 

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ৪)

আবার যখের ধন (পর্ব ৬)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত