সবাই আবার উপরের ঘরে এসে উঠলেন । বিমল আগে ঘরের সমস্ত জানলা বন্ধ করে দিলে। তারপর একটা জানলার খড়খড়ি একটুখানি ফাঁক করে রেখে বললে, “কুমার, তুমি এইখানে চোখ দিয়ে বসে থাকো। তারা এলেই খবর দেবে। ততক্ষণে আমি মানিকবাবুর কাকার চিঠিখানা পড়ে ফেলি।”
চিঠিখানা হচ্ছে এইঃ
“স্নেহাস্পদেষু,
মানিক, আমি এখন মৃত্যুমুখে, আমার আর বাঁচবার কোন আশাই নেই। আত্মীয়-স্বজন
হীন এই সুদূর অসভ্যের দেশে থেকে, তোমাদের মুখ না দেখেই আমাকে পরলোকে যেতে হবে, এ কথা কোনদিন কল্পনা করতে পারি নি। এ সময়ে তোমার ছোটকাকাও যদি কাছে থাকত, তাহলে অনেকটা সান্ত্বনা পেতুম। কিন্তু সে হতভাগা আমার সঙ্গে ঝগড়া করে কোথায় চলে গেছে। হয়তো আমারই মত আফ্রিকার কোন জঙ্গলের ভিতরে তাকেও বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে । কিন্তু সে-সব কথা এখন থাক!
যুদ্ধের সময় ইস্ট-আফ্রিকায় এসে কিভাবে আমি দিন কাটিয়েছি, সে-সব কথা এখন বলবার দরকারও নেই, সময়ও নেই। আর বেশিক্ষণ আমি বাঁচব না-এখনি চোখে ঝাপসা দেখছি, লিখতে হাত কাঁপচে। নিতান্ত দরকারি কথা ছাড়া আর কিছুই বলবার সময় হবে না।
ইষ্ট-আফ্রিকার যে জায়গাটায় আমি এখন আছি, তার নাম হচ্ছে উজিজি। এটা হচ্ছে আরবদের এক উপনিবেশ । এখানে বেশির ভাগই আরব ও সোহাহিলি জাতের লোক বাস করে। অন্যান্য জাতের লোকও কিছু কিছু আছে। উজিজি ঠিক শহর নয়, একটা মস্ত গ্রাম মাত্র। এই গ্রামটির কাছে আছে মস্ত একটি হ্রদ, তার নাম টাঙ্গানিকা। এদেশি ভাষায় টাঙ্গানিকা অর্থে বোঝায়, মেলা-মেশার স্থান! টাঙ্গানিকাকে দেখলে সমুদ্র বলেই ভ্রম হয়, কারণ তার এপার থেকে ওপারে নজর চলে না যেন অনন্ত জলরাশি থৈ থৈ করছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে টাঙ্গানিকা আগে সমুদ্রেরই অংশবিশেষ ছিল । পৃথিবীতে টাঙ্গানিকার চেয়ে লম্বা হ্রদ আর দুটি নেই। লম্বায় তা চারশো মাইলেও বেশি এবং চওড়ায় কোথাও পঁয়তাল্লিশ আর কোথাও ত্রিশ মাইল ।
এই বিশাল হ্রদের তীরে এক বুড়ো আরবের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তুমি জানো, দেশে থাকতেই আমার সখ ছিল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করা। এখানে এসেও আমি সে সখ ভুলতে পারিনি। অসুখ-বিসুখ হলে স্থানীয় লোকেরা আমার আশ্রয় গ্রহণ করে। সেই সূত্রেই এই বুড়ো আরবের সঙ্গে আমার আলাপ। বছর তিন আগে বুড়ো আমার ওষুধের গুণে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল । সেই থেকেই সে আমার অনুগত। কেবল অনুগত কেন, আমি তাকে আমার বন্ধু বলেই মনে করতুম।
বুড়োর নাম হচ্ছে টিপ্যু টিব। পাঁচ ছয় মাস আগে সে-বেচারি মারা পড়েছে। তার একমাত্র ছেলে ছিল, গেল বছরে তারও যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ গেছে। বুড়োর মৃত্যুকালে কেবল আমি তার কাছে ছিলুম। মৃত্যুর অল্পক্ষণ আগে বুড়ো আমাকে বললে, “বাবু তুমিই এখন আমার মা-বাপ, তুমিই আমার ছেলে । তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, তাই আজ আমি তোমাকে এক গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যেতে চাই ।”
জ্বরের ঘোরে বুড়ো প্রলাপ বকছে ভেবে আমি বললুম, “থাক্ থাক্, ওসব কথা এখন থাক্।”
বুড়ো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললে, “বাবু, আমার কথা মিথ্যা বলে মনে কোরো না। সত্যি-সত্যিই আমি এমন গুপ্তধনের সন্ধান জানি, যা পেলে তুমি সম্রাটের চেয়েও ধনী হবে।”
আমি বললুম, “এমন গুপ্তধনের সন্ধান সত্য-সত্যই যদি তোমাদের জানা থাকে, তবে তুমি এত গরিবের মত আছ কেন?”
—“গরিবের মত আছি কি সাধে? সে গুপ্তধন যেখানে আছে, সে বড় সহজ ঠাঁই নয়। সেখানে যেতে গেলেও লোকবল, অর্থবল, বাহুবল থাকা চাই! সে-সব কিছুই আমার নেই। কে আমার সঙ্গে যাবে? কাকে বিশ্বাস করব? হয়তো বন্ধু বলে যাদের সাহায্য চাইব, টাকার লোভে তারা আমারই গলায় ছুরি বসাবে। এমনি সাত-পাঁচ ভেবে এতদিন এই গুপ্তধনের ইতিহাস আর কারুর কাছে প্রকাশ করতে বা নিজেও সেখানে যেতে পারি নি। কিন্তু আজ খোদাতালা আমায় ডাক দিয়েছেন, আজ সমস্ত – সাম্রাজ্যও আমার কোন কাজে লাগবে না। তাই তোমাকেই আমি এই গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যেতে চাই ।”
আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “এ গুপ্তধন কোথায় আছে?”
–“টাঙ্গানিকা হ্রদের ধারে উজিজির দক্ষিণ দিকে কাবেগো পাহাড়ের নাম শুনেছ তো? এই গুপ্তধন আছে তার কাছেই ।”
আমি বললুম, “কিন্তু আমি তার খোঁজ পাব কেমন করে?”
বুড়ো নিজের আলখাল্লার ভিতরে হাত চালিয়ে দিয়ে একখানা কাগজ বের করে বললে, “এই নাও একখানা ম্যাপ। এই ম্যাপ দেখলেই তুমি সমস্ত বুঝতে পারবে।”
ম্যাপখানা নিয়ে তার ভিতরে ইংরেজি লেখা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, “এ ম্যাপ তুমি কোথায় পেলে?”
বুড়ো আমার কথার জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ চোখ কপালে তুলে সে গোঁ গোঁ করতে লাগল। তারপর সে অজ্ঞান হয়ে গেল! অনেক চেষ্টা করেও আর তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারলুম না এবং সেই অবস্থাতেই তার মৃত্যু হল।
…মানিক, তারপর থেকেই সেই গুপ্তধন ভূতে-পাওয়ার মতন আমাকে পেয়ে বসল। দিন রাত খালি সেই চিন্তা। শেষটা আর থাকতে না পেরে, জন-পনেরো অসভ্য কুলি নিয়ে আমি সেই গুপ্তধনের সন্ধানে যাত্রা করলুম। কিন্তু পথেই রোগ, বন্য-জন্তু আর অসভ্য বুনোদের কবলে পড়ে আমার সাঙ্গপাঙ্গদের অধিকাংশই মারা পড়ল । যথাস্থানে গিয়ে যখন উপস্থিত হলুম, তখন আমার দলে লোক ছিল মাত্র দুজন এবং আমিও পড়লুম জ্বরে। তার ওপরে প্রায় পাঁচ-ছয়শো অসভ্য লোক আমাদের আক্রমণ করতে এল। কাজেই পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করে কোন গতিকে পালিয়ে এসে আমরা প্রাণরক্ষা করলুম।
অসভ্যদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচালুম বটে, কিন্তু সেই জ্বর হল আমার কাল । আমার ভাগ্যে গুপ্তধন লাভ হল না! কিন্তু গুপ্তধন যে সেখানে আছে, সে-বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই। স্থানীয় লোকদের কাছে শুনে জনেছি, ঐ গুপ্তধনের কাহিনী সেখানে লোকের মুখে মুখে ফেরে। অনেককাল আগে কোন রাজা নাকি সেখানে ঐ গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় তা আছে এ-কথা কেউ জানে না! অনেকেই সেই গুপ্তধনের খোঁজ করেছে, কিন্তু কেউ তা পায়নি। এবং পাছে কেউ তার খোঁজ পায়, সেই ভয়ে সেখানকার অসভ্য জাতিরা সর্বদাই সজাগ হয়ে থাকে এবং কোন বিদেশিকেই সেখানে অগ্রসর হতে দেয় না ।
মানিক, এই গুপ্তধনের সন্ধান আমি তোমাকে দিয়ে গেলুম। সঙ্গে ম্যাপখানি দেখলেই তুমি সমস্ত সন্ধান জানতে পারবে। আমার তো আপন বলতে আর কেউ নেই। তুমি আমার বিষয়ের উত্তরাধিকারী! কাজেই আমার অবর্তমানে তুমিই এই গুপ্তধনের অধিকারী হতে পারবে ।
কিন্তু সুদূর ভারতবর্ষ থেকে এই গুপ্তধনের লোভে তুমি হয়তো কোন দিনই এখানে আসবে না। তবে যদি কখনো আসো, প্রস্তত হয়ে আসতে ভুলো না। মনে রেখ, এখানে আসতে গেলে লোকবল, অর্থবল, বাহুবল থাকা চাই। এখানকার বনে জঙ্গলে সিংহ আছে, চিতাবাঘ আছে, গরিলা, গণ্ডার, বিষাক্ত সাপ, অসভ্য শত্রু ও সাংঘাতিক রোগের ভয় আছে এবং তার ওপরে আছে বিষম পথকষ্ট ।
ম্যাপখানি খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখো। আমি ছাড়া আর এক জন এই ম্যাপের কথা জানে। সে-যে কে, তা আর তোমাকে বলতে চাই না। তবে এর মধ্যেই সে ঐ ম্যাপখানা চুরি করবার চেষ্টা করেছিল। অতএব খুব সাবধান! মনে রেখো, ঐ ম্যাপ হারালে তুমি গুপ্তধনও হারাবে।
আর আমার কিছু বলবার নেই। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
ইতি —
আশীৰ্বাদক — তোমার কাকা
পুঃ। হ্যাঁ, ভালো কথা তোমরা যদি উজিজিতে আসো, তাহলে এখানে গাটুলা বলে এক বুড়ো সর্দার আছে, তার সঙ্গে দেখা করে নিজের পরিচয় দিও। গাটুলা খুব বিশ্বাসী, আর আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। আমি যখন গুপ্তধন আনতে গিয়েছিলুম, তখন সেও আমার সঙ্গে ছিল । পথের খবর সে সব জানে। তাকে সঙ্গে নিলে তোমার অনেক উপকার হবে।”
চিঠিখানা পড়ে বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে, “মানিকবাবু, কালকেই আপনার বাড়ির সবাইকে দেশে পাঠিয়ে দিন। তারপর এ-বাড়িতে তালা বন্ধ করে আপনি আমার বাড়িতে থাকবেন, চলুন।”
মানিকবাবু বললেন, “আপনার বাড়িতে গিয়ে থাকব? কেন বলুন দেখি?”
—“তাহলে আপনি অনেকটা নিরাপদ থাকতে পারবেন। আমরা তো আর রোজ এখানে এসে পাহারা দিতে পারব না।”
—“কিন্তু বিমলবাবু মাথার ওপরে এ-রকম বিপদ নিয়ে আর কদিন এমন করে চলবে?”
–“আর বেশি দিন নয়, সাত দিন। তারপরেই আমরা আফ্রিকায় যাত্রা করব।”
মানিকবাবু চমকে উঠে বললেন, “ও বাবা, সে কি কথা? আফ্রিকায় যাব কী?”
বিমল বললে, “আফ্রিকায় না গেলে গুপ্তধন পাবেন কি করে?”
মানিকবাবু শুকনো মুখে বললেন, “কাকার চিঠিখানা পড়লেন তো? সেখানে সিঙ্গি আছে, বাঘ আছে, সাপ আছে, গরিলা আছে।”
বিমল বাধা দিয়ে বললে, “হ্যাঁ, পৃথিবীর যত বিপদ সব সেখানে আছে। তা আমি জানি। আর জানি বলেই তো সেখানে যেতে চাচ্ছি। আপনার জন্যে সেখানে গুপ্তধন আছে, আর আমাদের জন্যে আছে বিপদ, কেবল বিপদ। আপনার গুপ্তধনের ওপরে আমাদের কোন লোভ নেই, আমরা চাই খালি বিপদকে। সে বিপদ হবে যত ভয়ানক, আমাদের আনন্দ হবে তত বেশি।”
মানিকবাবু হতভম্বের মতন বললেন, “বলেন কি মশাই?”
কুমার জানলার কাছ থেকে সরে এসে বললে, “হ্যাঁ, মানিকবাবু, বিপদকে আমরা ভালবাসি। বিপদ না থাকলে মানুষের জীবনটা হয় আলুনি আলুভাতের মতন! সে-রকম জীবনকে আমরা ঘৃণা করি। বিপদকে আমরা ভালবাসি।”
মানিকবাবু বললেন, “আমি কিন্তু বিপদ-আপদ মোটেই পছন্দ করি না।”
কুমার হেসে বললে, “কিন্তু পছন্দ না করলেও বিপদ এসে আপনারই দরজায় অপেক্ষা করছে। জানলার ফাঁক দিয়ে দেখুন, নিচে কারা দাঁড়িয়ে আছে!”
বিমল বললে, “অ্যাঁ! তারা এসেচে নাকি?”
কুমার বললে, “হ্যাঁ। কিন্তু অন্ধকারে তাদের দেখাচ্ছে, আবছায়ার মত। বিশেষ কিছুই বোঝবার যো নেই।”
মানিকবাবু ধপাস করে একখানা চেয়ারের ওপরে বসে পড়লেন। বিমল জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
বাইরে এত অন্ধকার যে, চোখ প্রায় চলে না। নিচে জমির ওপরে কারা চলা-ফেরা করছে —ঠিক যেন কতকগুলো ছায়া ন’ড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে। একটা ছায়া খুব প্রকাণ্ড এবং অন্ধকারের চেয়েও কালো! কেবল সেই ছায়াটা চলা-ফেরা করছিল না। সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খালি দুলছে আর দুলছে। অন্ধকারের ভিতর থেকে তার দুটো চোখ দু-টুকরো কয়লার মতন জ্বলে উঠছে। সে চোখ কি মানুষের চোখ ?
হঠাৎ নিচ থেকে চাপা-গলায় কে বললে, “না, সে কাগজের মোড়কটা এখানে নেই।”
আর একজন বললে, “ভালো করে খুঁজে দ্যাখ।”
–“আর খোঁজা মিছে! সেটা নিশ্চয়ই কেউ কুড়িয়ে নিয়ে গেছে।”
—“নিয়ে আর যাবে কোথায় ? দেখচি আমাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হবে। ঘটোৎকচ!”
প্রকাণ্ড ছায়াটা দুলতে-দুলতে এগিয়ে এল।
—“ঘটোৎকচ ! আমাদের সঙ্গে আয় আবার আমাদের গাছে চড়তে হবে।”
বিমল ওপর থেকে চেঁচিয়ে বললে, “এস বন্ধুগণ, আমরাও তোমাদের আদর করবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছি।…কুমার, বন্দুকটা এগিয়ে দাও তো।”
এক মুহূর্তের ভিতরে মাঠের ওপর থেকে ছায়াগুলো স্যাঁৎ-স্যাঁৎ করে সরে গেল।
বিমল মুখ ফিরিয়ে বললে, “মানিকবাবু, চাঙ্গা হয়ে উঠুন। ঘটোৎকচ আজ আর যুদ্ধ করবে না।”
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……