আবার যখের ধন (পর্ব ৩)

আবার যখের ধন (পর্ব ৩)

চোরেরা গুপ্তধনের ইতিহাস আর ম্যাপখানা নিয়ে গেছে শুনে মানিকবাবুর যে অবস্থা হল তা আর বলবার নয়। সেই-যে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন, আর উঠলেন না, কথাও কইলেন না ।

দেখে কুমারের বড় দুঃখ হল।
বিমলের মুখ দেখে বোঝা গেল, রামুর কথায় তার বিশ্বাস হয় নি ।
খানিকক্ষণ চিন্তা করে সে বললে, “মানিকবাবু, আমার বোধ হচ্ছে রামু মিছা কথা বলচে । যারা এসেছিল তারা ম্যাপ আর চিঠি নিয়ে যেতে পারে নি”

মানিকবাবু নিরাশ-মুখে বললেন, “কী করে জানলেন, আপনি?”

“ম্যাপ আর চিঠি তারা যদি নিয়েই যাবে, তাহরে রামুও তাদের সঙ্গে পালায় নি কেন? রামু তো ঐ দুটো জিনিসই চুরি করবার জন্যে আপনার বাড়িতে চাকর সেজে আছে? তবে কাজ হাসিল হবার পরেও সে এঘরের ভেতর কী করছিল?”

রামু বললে, “আপনারা হঠাৎ এসে পড়লেন যে! কেমন করে আমি পালাব?”

বিমল বললে, “কিন্তু আমারা আসবার পরেও ম্যাপ আর চিঠি পেয়েও তোমার দলের লোকেরা ছাতের ওপরে অপেক্ষা করছিল কেন?.. না মানিকবাবু, আপনার চিঠি আর ম্যাপ বোধ হয় এইখানেই কোথাও আছে! আসুন, আমরা আর একবার ভালো করে খুঁজে দেখি ।”

তন্ন তন্ন করে প্রায় একঘন্টা ধরে তারা ঘরের চারিদিক খুঁজল, কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। তাদের দিকে তাকিয়ে রামু ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।

মানিকবাবু ক্ষাপ্পা হয়ে বললেন, “পোড়ার মুখে আবার হাসি হচ্ছে! দেব ঠাস করে গালে এক চড়, হাসি একেবারে বেরিয়ে যাবে!”

বিমল বললে, রামু, ভালো চাও তো এখনো বল, ম্যাপ আর চিঠি কোথায় গেল?”

—“যারা নিতে এসেছিল তারা নিয়ে গেছে।”

–“কে তারা? কোথায় থাকে?” রামু জবাব দিলে না ।

মানিকবাবু বললেন, “সহজে তুমি জবাব দেবে না-নয়? দেখবে তার মজাটা?”

রামু বললে, “আমাকে মেরে ফেললেও আমার পেট থেকে আর কোন কথা বেরুবে না ।”

বিমল বললে, “মানিকবাবু, ওকে নিয়ে আর সময় নষ্ট করে কাজ নেই। আজকের মতো ওকে থানায় পাঠিয়ে দিন তার পরে ও মুখ খোলে কি না দেখা যাবে!”

মানিকবাবু তাই করলেন, দু’জন লোকের সঙ্গে রামুকে থানাতে পাঠিয়ে দিলেন।

বিমল বললে, “আজ বৈকালে বেশ এক পশলা বৃষ্টি পড়েছিল। আমি আসবার সময়েই দেখেচি মাঠের মাটি এখনো ভিজে আছে।”

কুমার বললে, “তুমি একথা বলচ কেন?”

—“বটগাছের আশে পাশে ভিজে মাটির ওপরে চোরেদের পায়ের দাগ নিশ্চয়ই দেখতে পাওয়া যাবে। এগুলোর আমি একবার পরীক্ষা করতে চাই ।”

মানিকবাবু হতাশভাবে বললেন, “তাতে আর আমাদের কী সুবিধে হবে?”

বিমল বললে, “সুবিধে হয়তো কিছুই হবে না। তবে পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কী? অন্তত এটা বুঝতে পারব তো, চোরদের দলে ক’জন লোক ছিল!”

বিমল এগুল, তার সঙ্গে সঙ্গে কুমারও অগ্রসর হলো । মানিকবাবুও নিতান্ত নাচারের মতন তাদের পিছনে পিছনে নিচে নেমে এলেন । সদর-দরজা পার হয়ে মাঠের উপর পড়েই বিমল বিজলি মশালের আলো চারিদিকে ফেলতে ফেলতে বললে, “মানিকবাবু এতক্ষণ আমরা কি ঐ ঘরে ছিলুম?”

–“হ্যাঁ।”

কুমার, এ ঘরের ঠিক নিচেই মাঠের ওপর সাদা কি-একটা পড়ে আছে দেখ তো?”

কুমার এগিয়ে গিয়ে বললে, “কাগজের একটা মোড়ক।”

মানিকবাবু এক লাফ মেরে বললেন, “কাগজের মোড়ক? কাগজের মোড়ক? কৈ, দেখি–দেখি!” কুমার মোড়কটা নিয়ে এল।

মানিকবাবু মোড়কটা সাগ্রহে টেনে নিয়ে মহা উল্লাসে বলে উঠলেন, “এই যে আমার হারানিধি। এরই ভেতরে সেই চিঠি আর ম্যাপ আছে।”

বিমল বললে, “যা ভেবেচি তাই! আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলুম, চিঠি আর ম্যাপ চোরেরা নিয়ে যেতে পারে নি! আমরা এসে পড়াতে পালাবার পথ-না-পেয়ে রামু ঐ কাগজের মোড়কটা জান্‌লা গলিয়ে মাঠে ফেলে দিয়েচে!”

মানিকবাবু কাগজের মোড়কটা ভিতরকার জামার পকেটে রেখে দিয়ে বললেন, “উঃ! বিমলবাবু আপনার কি বুদ্ধি!”

বিমল বললে, “বুদ্ধি সকলেরই আছে মানিকবাবু! তবে কেউ তা খেলাতে পারে, আর কেউ তা খেলাতে পারে না … যাক আপনার জিনিস তো ফিরিয়ে পেলেন, এখন ঐ গাছের কাছে গিয়ে পায়ের দাগগুলো দেখে আসি চলুন।”

বটগাছের কাছে গিয়ে বিজলি-মশালের আলোতে দেখা গেল, ভিজে কাদার ওপরে নানা আকারের অনেকগুলো পায়ের দাগ। বিমল সেইখানে বসে কাগজ আর পেন্সিল বার করে একে একে দাগগুলোর মাপ নিলে । তারপর বললে, “চোরেদের দলে লোক ছিল পাঁচজন । কিন্তু সেই পাঁচজনের ভেতর একজন হচ্ছে অসাধারণ লোক!”

কুমার বললে, “অসাধারণ লোক?”

মানিকবাবু বললেন, “অসাধারণ লোক! সে আবার কী?”

বিমল বললে, “এই দাগটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। যার পায়ের এই দাগ, তার পা হচ্ছে সাধারণ মানুষের পায়ের চেয়ে প্রায় দু-গুণ বড়। তার পায়ের বুড়ো-আঙ্গুল অন্য আঙ্গুলগুলোর চেয়ে অনেকটা তফাতে। সে মাটির ওপরে সমানভাবে পা ফেলে চলতে পারে না। তারপর অন্য-অন্য পায়ের দাগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, এ-দাগটা তাদের চেয়ে কত বেশি গভীর। এর দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে, এ-একটা খুব লম্বাচওড়া আর ভারি লোকের পায়ের দাগ। এক একটা দাগ যেন এক-একটা গর্ত! কে জানে তার দেহের ওজন কত মণ!… সেইজন্যেই ছাতের ওপরে তার পায়ের শব্দ শুনে মনে-হচ্ছিল, যেন একটা মত্ত হাতি ছাতময় চলে বেড়াচ্ছে।”

কুমার বিস্ফারিতচক্ষে বললে, “একি মানুষের পায়ের দাগ, না দানবের?”

মানিকবাবু ভয়বিহবল কণ্ঠে বললেন, “ও বাবা, চোরের কি একটা পোষা দৈত্য নিয়ে চুরি করতে এসেচে?”

কুমার বললে, “আমরা তো দূর থেকে ছায়ার মতন তাকে একবার দেখেচি! প্রকাণ্ড তার কালো চেহারা-সর্বাঙ্গ উলঙ্গ!”

মানিকবাবু এদিকে ওদিকে তাকিয়ে শুষ্কস্বরে বললেন, “ও বাবা, আমার বুক যে ধুক ধুক করচে। যদি সে আবার ফিরে আসে।”

বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “হ্যাঁ, দানবেরই মত বটে। সে যে কি, আমি তা কতকটা আন্দাজ করতেও পেরেচি, কিন্তু ব্যাপারটা আরো ভালো করে তলিয়ে না বুঝে এখন কিছু বলতে চাই না তবে এইটুকু জেনে রাখুন, মানিকবাবু, আমার আন্দাজ যদি সত্যি হয়, তাহলে আমরা সাম্‌না-সামনি পড়লে কিছুতেই এই দানবের হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারব না। আমরা তো দূরের কথা, চল্লিশ-পঞ্চাশজন মানুষকেও সে শুধু-হাতে পরাস্ত করতে পারে” ।”

মানিকবাবু আঁৎকে উঠে বললেন, “ও বাবা, সে কি কথা।” কুমার বললে, “বিমল, তোমার কথা শুনে মনে হয়, ময়নামতির মায়াকানন থেকে আবার কোন দানব বুঝি আমাদের পিছনে পিছনে কলকাতায় এসে হাজির হয়েচে!”

বিমল মুখ টিপে একটুখানি হাসলে, কোন কথা বললে না।

মানিকবাবু আচম্বিতে বিমলকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন। বিমল সবিস্ময়ে বললে, “কী হল মানিকবাবু, কী হল-হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরলেন কেন?”

মানিকবাবু বললেন, “ঐ তারা আবার আসচে!”

বিমল সচমকে দেখলে মাঠে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দুটো ছায়া মূর্তি তীরের মত ছুটতে ছুটতে প্রায় তাদের কাছে এসে পড়েছে।

এক ঝট্‌কান মেরে বিমল তখনি মানিকবাবুর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলে। তারপর দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সিধে হয়ে দাঁড়ালো।

তাদের দেখেই মূর্তিদুটো প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, “ওরে বাপরে, গেলুম! ভূতে ধরলে!”

“কে এরা?”

তাদের মুখের ওপরে আলো ফেলেই চিনতে পারলে, যাদের সঙ্গে রামুকে থানায় পাঠানো হয়েছিল এরা হচ্ছে তারাই।

মানিকবাবুর ধড়ে এতক্ষণে যেন প্রাণ এল। তিনি বলে উঠলেন, “কে সতীশ? সুরেন? এমন করে ছুটে আসচ কেন? কি হয়েছে?”

—“বাবু? আপনারা এখানে আছেন? বাঁচলুম। আমরা ভেবেছিলুম সেই ভূতটা এখানে হাজির হয়েছে।”

—“কী বলচ্‌ সতীশ, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ভূত কি?”

—“ভয়ানক ব্যাপার বাবু, ভয়ানক ব্যাপার। আমরা যে প্রাণে বেঁচে পালিয়ে আসতে পেরেছি, এইটুকুই আশ্চর্য ।”

বিমল বললে, “রামু কোথায়?”

–“হয় পালিয়েচে, নয় ভূতের হাতে পড়েচে ।”

—“বেশি বাজে বোকো না। আগে আসল কথা খুলে বল।”

“বললে হয়তো আপনারা বিশ্বাস করবেন না, তবু না বলেও উপায় নেই। রামুকে নিয়ে আমরা থানায় যাচ্ছিলুম। এত রাত্রে পথে লোকজন ছিল না। আগে ছিল সুরেন, মাঝখানে রামু, আর পিছনে আমি । তারপর শীতলা-মন্দিরের সামনে সেই ঝুপসি অশ্বত্থ-গাছের তলায় গিয়ে যখন পৌঁছলুম তখন-আপনারা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমি স্বচক্ষে দেখলুম হঠাৎ মস্ত বড় একখানা কালো হাত গাছের উপর থেকে সাঁ করে নেমে এসে সুরেনের গলা ধ’রে তাকে টেনে নিল। তারপর ব্যাপারটা ভালো করে বোঝবার আগেই ওপর থেকে একখানা হাত নেমে এসে আমাকেও ঠিক তেমনি করেই টেনে নিলে। মিনিট-খানেক আমাকে শূণ্যে ঝুলিয়ে রেখেই হাতখানা আবার আমাকে ছেড়ে দিলে — কিন্তু মাটির ওপরে পড়ে রামুকে আর দেখতে পেলুম না। তারপর আমরা ছুটতে ছুটতে পালিয়ে আসছি।”

বিমল বললে, “রামু তাহলে পালিয়েচে ? মানিকবাবু, রামুর মুখে চোরেরা এতক্ষণে তাহলে শুনেচে যে কাগজের মোড়কটা কোথায় আছে! নিশ্চয়ই তারা আবার এখানে আসবে,—শীগ্‌গির বাড়ির ভেতরে চলুন!”

মানিকবাবু তীরের মত বাড়ির দিকে ছুটলেন। ভিতরে ঢুকেই তিনি বললেন,“তারা আসচে। দরজা বন্ধ করে দাও–দরজা বন্ধ করে দাও!”

বিমল হেসে বললে, “সেই দানবের সামনে দরজা বন্ধ করে কোনই লাভ হবে না! সে যদি আপনার দরজায় এক ধাক্কা মারে তাহলে আপনার দরজা এখনি তাসের বাড়ির মত হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে।”

মানিকবাবু ভীত মুখে বললেন, “ও বাবা, তার গায়ে এত জোর। তাহলে কী হবে?”

বিমল বললে, “হবে আর কী! আমাদের সঙ্গে বন্দুক আছে, এই যা ভরসা। তাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আমরা প্রস্তুত হয়েই আছি!”

মানিকবাবু বললেন, “না মশাই, আমি মোটেই প্রস্তুত নই। মানুষ হয়ে দানবের সঙ্গে দেখা করব কি! আজ যদি বাঁচি, কালকেই আমি দেশে পালাব।”

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব  ১)

আবার যখের ধন (পর্ব ৪)

 

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত