রাত দশটা বেজে গেছে। তারা মানিকবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো।
মানিকবাবুর বাড়ি একেবারে গঙ্গার খালের ধারে । প্রথমে খাল, তারপর রাস্তা, তারপর একটা ছোট মাঠ, তারপরে মানিকবাবুর বাড়ি। জায়গাটা কলকাতা হলে কি হয়, যেমন নিরালা, তেমনি নির্জন আর বাড়ি-ঘরগুলোও খুব তফাতে-তফাতে।
আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে বটে কিন্তু সে চাঁদে নামরক্ষা মাত্র। চারিদিকে প্রায় অন্ধকারে আচ্ছন্ন-আশপাশের গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল, ঠিক যে কালোর কোলে জমাট বাঁধা অন্ধকারে গাছ।
বিজলি-মশালের (ইলেকট্রিক টর্চ) আলোটা একদিকে ফেলে বিমল বললে, “মানিকবাবু, আপনার বাড়ীর গায়েই ঐ যে মস্ত-বড় গাছটা ছাত ছাড়িয়ে ওপরে উঠেছে, ওটা বোধ হয়, বটগাছ ?”
মানিকবাবু বললেন, “হ্যাঁ।”
সন্দেহপূর্ণ নেত্রে গাছের চারিদিকে আলো দেখতে-দেখতে বিমল কয়েক পা এগিয়ে গেল।
মানিকবাবু কৌতূহলী হয়ে বললেন, “কী দেখছেন বলুন দেখি ?”
—“দেখচি ও-গাছের ভেতরে কেউ লুকিয়ে আছে কি না ?”
—“ও বাবা, সে কি কথা! ও-সব দেখে শুনে দরকার নেই মশাই, চলুন, আমরা বাড়ির ভেতরে গিয়ে দরজার খিল লাগিয়ে বসে থাকিগে ?”
—“কিন্তু ওরা যদি ঐ গাছ থেকে লাফিয়ে বাড়ির ছাতে গিয়ে ওঠে, তাহলে সদর দরজায় খিল লাগিয়ে করবেন কি ?”
—“গাছ থেকে লাফিয়ে ছাতে গিয়ে উঠবে ? অসম্ভব!”
—“কেন ?”
—“গাছ থেকে আমার বাড়ির ছাত হচ্ছে এগারো বারো হাত তফাতে। মানুষ অত লম্বা লাফ মারতে পারে না!”
বিমল এগিয়ে গিয়ে গাছ আর বাড়ির ব্যবধান দেখে কতকটা আশ্বস্ত হয়ে বললে, “না, আপনার কথাই সত্যি বটে। কিন্তু আমি এই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি, তবে বাইরের লোক আপনার বাড়ির ভেতর গিয়ে কী করে ঢোকে ?” .
—“আমিও ভেবে কোন কূল-কিনারা পাই না মশাই ।” বিজলি-মশালের আলোটা বাড়ির দেওয়ালের গায়ে ঘুরিয়ে বিমল বললে, “হয়েচে । ছাত থেকে বৃষ্টির জল বেরুবার ঐ যে তিন-চারটে নল রয়েছে, চোরেরা নিশ্চয়ই ঐ নল বেয়ে ওপরে ওঠে।”
—ও বাবা, বলেন কী ? ব্যাটাদের কি পড়ে মরবার ভয় নেই ?”
বিমল বললে, “চলুন, এখন আমরা বাড়ির ভেতরে যাই ।” মানিকবাবু এগিয়ে গিয়ে দরজার কড়া নাড়তেই একজন চাকর ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলে ।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে বিমল বললে, “ মানিকবাবু, আজ সদর দরজা ভিতর থেকে একেবারে তালা বন্ধ করে দিন। কেউ যেন আর দরজা না খোলে।”
মানিকবাবু সেই হুকুম দিলেন।
বিমল বললে, “আচ্ছা, আপনার চাকর-বাকরেরা সব বিশ্বাসী তো ?”
—“আজ্ঞে, তাদের কারুকে সন্দেহ করবার উপায় নেই। সব পুরানো চাকর । কেবল–”
—“কেবল কী ? বলুন, থামলেন কেন ?”
–“কেবল একজন নতুন লোক আছে।”
—“নতুন ? কতদিন তাকে রেখেচেন ?”
—“সবে কাল সে এসেছে।”
–“আপনি তাকে চেনেন না ?”
—“না। কিন্তু তাকেও সন্দেহ করবার কারণ দেখি না। দিব্যি ভদ্দর-চেহারা, আর চেহারা দেখেই তাকে রেখেচি।”
—“আচ্ছা, তাকে একবার ডাকুন দেখি ?” যে চাকরটা সদরে তালা বন্ধ করেছিল, তার দিকে ফিরে মানিকবাবু বললেন, “ওরে, রামুকে একবার ডেকে দে তো ?”
সে বললে, “আজ্ঞে, রামু বোধ হয় বেরিয়ে গেছে।”
—“বেরিয়ে গেছে?”
—“আজ্ঞে, ঠিক বলতে পারছি না, তবে তাকে খানিকক্ষণ আর দেখতে পাচ্ছি না।” মানিকবাবু চোখ রাঙিয়ে বললেন, “আমি না বারণ করেছিলুম, সন্ধ্যের পর কারুকে বাড়ি থেকে বেরুতে ?”
বিমল বললে, “থাক মানিকবাবু, এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করে কাজ নেই। আমরা এখন আপনার পড়বার ঘরে যেতে চাই ।”
মানিকবাবু বললেন, “চলুন।”
কুমার চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলে, “সেই ঘরেই তো আপনার কাকার চিঠি আর ম্যাপখানা আছে?” । –
— হ্যাঁ।”
পড়বার ঘরের দরজার কাছে এসেই মানিকবাবু সচমকে রলে উঠলেন, “এ কি!”
কুমার বললে, “কী হয়েচে মানিকবাবু?”
মানিকবাবু হতভম্বের মত খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, “এ—ঘরের তালা খুলল কে ?”
বিমল বললে, “আপনি তালা দিয়ে গিয়েছিলেন তো?”
—“আলবৎ। আমি নিজের হাতে ঘরে তালা দিয়ে দিয়েছি। বিমল এক ধাক্কা মারতেই দরজা খুলে গেল। সৰ্ব্বাগ্রে ঘরের ভিতর ঢুকে বললে, “মানিকবাবু, আমি যে ভয় করেছিলুম তাই বুঝি ঠিক হল। দেখুন দেখুন ম্যাপ আর চিঠিখানা এখনো আছে কিনা?”
মানিকবাবু তীরের মতো ঘরের ভিতরে ঢুকে আগে গিয়ে একটা আলমারি খুলে ফেললেন। তারপর তাড়াতাড়ি একখানা মোটা বই বার করে খানকয়েক পাতা উল্টে হতাশভাবে বললেন, “সর্বনাশ হয়েচে, সে চিঠিও নেই, ম্যাপও নেই।”
কুমার বললে, “না মানিকবাবু, আমরা ঠিক সময়ে এসে পড়েচি।”
মানিকবাবু কপালে করাঘাত করে বললেন, “ঠিক সময়ে এসে পড়েচি না ছাই করেচি । আমার…………”
কুমার বাধা দিয়ে বললে, “আগে ঐ টেবিলের তলায় তাকিয়ে দেখুন!”
মানিকবাবু ও বিমল ঘরের কোণে একটা টেবিলের তলার দিকে চেয়ে দেখলে, কে একজন লোক সেখানে হুমড়ি খেয়ে বসে আছে।
কুমার বললে, “চুরি করে চোর এখনো পালাতে পারে নি!”
বিমল এগিয়ে গিয়ে লোকটার পা-দুটো দু-হাতে ধরে তাকে হিড় হিড় করে টেনে বার করে আনলে !
তার মুখের পানে তাকিয়ে মানিকবাবু সবিস্ময়ে বললেন, “রামু!”
বিমল বললে, “এই কি আপনার নূতন চাকর ?”
মানিকবাবু বললেন, “হ্যাঁ। – ওরে রাস্কেল, এই জন্যই তুমি আমার বাড়িতে চাক্রি নিয়েছ ? সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবে ?”
ঠিক সেই সময়ে ঘরের ছাতের উপর শব্দ হল ধুপ্-ধুপ্-ধুপ্ ! মানিকবাবু সেদিন কিছু ভুল বলেন নি, ছাতময় যেন একটা হাতি চলে বেড়াচ্ছেই বটে। প্রত্যেক পায়ের চাপে ঘরখানা পর্যন্ত কেঁপে-কেঁপে উঠছে, মানুষের পায়ের শব্দ এমন-ধারা হয় না!
মানিকবাবু ভয়-শুকনো মুখে বললেন, “ঐ শুনুন নিচে চোর, ওপরে ভূত! আমি এবারে গেলুম!”
কেবল পায়ের শব্দ শুনে ভয় পাবার ছেলে বিমল ও কুমার নয়। আসামের পাহাড়ে, মঙ্গল-গ্রহে ও মায়া-কাননে গিয়ে তারা যে-সব অমানুষিক বিপদের কবলে পড়েছিল, তার কাছে এ-তো তুচ্ছ ব্যাপার! সুতরাং তারা স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল, শব্দটা ধীরে ধীরে ছাতের পূর্বদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিমল বললে, “মানিকবাবু, ছাতের পূর্ব দিকে কি আছে!”
–“নিচে নামবার সিঁড়ি!”
—“তাহলে ছাতে যার পায়ের আওয়াজ শুনচি, সে বোধ হয় আমাদের সঙ্গেই আলাপ করতে আস্চে।”
মানিকবাবু আঁৎকে উঠে বললেন, “ও বাবা, সে কি কথা!”
বিমল বললে, “এস কুমার, আমরা আগে এই লোকটাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখি। তারপর যে মহাপুরুষ আসচেন তাকে ভালো করেই অভ্যর্থনা করব। বিমল ও কুমার রামুর হাত পা বাঁধতে লেগে গেল।
মানিকবাবু দৌড়ে গিয়ে দেওয়ালের উপর থেকে তার নতুন কেনা বন্দুকটা পেড়ে নিলেন। তারপর খোলা-জানারার দিকে ফিরে, প্রাণপণে দুই চক্ষু মুদে মুখ সিটকে দুম করে একবার বন্দুক ছুড়লেন এবং ধপাস করে একখানা চেয়ারের উপর বসে পড়লেন। ছাতের ওপরে পায়ের শব্দ থেমে গেল!
কুমার বললে, “ওকি মানিকবাবু, চোখ মুদে আছেন কেন?”
মানিকবাবু বললেন, “ও বাবা, বন্দুক ছোঁড়া কি সোজা কথা?”
বলেই আর একবার বন্দুক ছুঁড়লেন তেমনি মুখ সিটুকে ও দুই চক্ষু মুদে। ছাতের ওপরে পায়ের শব্দ আবার ধুপ্ ধুপ্ করে ঘর কাঁপিয়ে এবারে এগিয়ে গেল পশ্চিম দিকে,–তারপরেই যে আওয়াজ হল তাতে বোঝা গেল যে, কেউ ছাত থেকে পাশের বটগাছের ওপরে লাফিয়ে পড়ল ।
মানিকবাবুর হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে বিমল রললে, “শিগগির টোটা দিন–শিগগির!”
মানিকবাবু তাড়াতাড়ি উঠে টোটা এনে বিমলের হাতে দিলেন। বিমল বন্দুকে টোটা ভরতে-ভরতে বললে, “কুমার, তুমি টর্চের আলোটা মাঠে ফেলে দেখ, গাছ থেকে কে নামচে?”
কুমার বিজলি-মশাল জ্বেলে জান্লার কাছে গেল এবং বিমলও তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু মশালের আলো অত দূরে ভালো করে পৌঁছালো না কেবল অস্পষ্টভাবে এইটুকু দেখা গেল যে চার-পাঁচটা মূর্তি মাঠের ওপর দিয়ে ছুটছে এবং তার মধ্যে একটা মূর্তি হচ্ছে মিশমিশে কালো — আকারে প্রকাণ্ড ও তার দেহে একখণ্ড বস্ত্র পর্যন্ত নেই।
মনিকবাবু জানলা দিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখেই ভূত ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠে পিছিয়ে এলেন ।
কুমার বিস্মিতস্বরে বললে, “কী ও? মানুষের মতন দেখতে অথচ…”
বিমল মুখ ফিরিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে বললে, “আর বন্দুক ছোঁড়া মিছে। নাগালের বাইরে গিয়ে পড়েচে ।”
মানিকবাবু বললেন, “কিন্তু কী দেখলুম। বিমলবাবু! ভূত আর মানুষ একসঙ্গে ছুটচে ?”
বিমল বললে, “ব্যাপারটা আশ্চর্য বটে, আমিও কিছু বুঝতে পারলুম না; কিন্তু সেকথা পরে ভাবা যাবে এখন। আপাতত শ্রীমান রামুর সঙ্গে একটু গল্প করা যাক। কী বল রামু ? তাহলে আজ সন্ধ্যের সময়ে তুমিই বোধ হয় আমার বাড়িতে আড়ি পাততে গিয়েছিলে ?”
রামু কোন জবাব দিলে না।
—“কিহে, কথা কইচ না যে বড়? মৌনী-বাবা হয়ে ধ্যান করচ নাকি ?”
রামু মুখ খুললে না। কুমার বললে, “ওহে বিমল, রামু কথা না কইল তো বড় বয়ে গেল! ওর কাছে যে চিঠি আর ম্যাপ আছে তাই নিয়েই আমাদের দরকার।”
—“যা বলেচ!” বলে বিমল রামুর জামা-কাপড় সব হাতড়াতে লাগল! কিন্তু চিঠি ও ম্যাপ পাওয়া গেল না। বিমল তাকে খুব খানিক ঝাঁকানি দিয়ে বললে, “সেই চিঠি আর ম্যাপ কোথায়?”
রামু চুপ।
– মানিকবাবু ক্ষাপ্পা হয়ে ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে এসে বললেন, “তোর বোবার নিকুচি করেচে! এখুনি মেরে হাড় ভেঙে দেব জানিস?”
রামু বললে, “আমার কাছে কিছু নেই।”
—“নেই? চালাকি পেয়েছিস? নেই তো গেল কোথায়?”
–“যারা এসেছিল তারা নিয়ে গেছে!”
মানিকবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……