আবার যখের ধন (পর্ব ১)

আবার যখের ধন (পর্ব ১)

সন্ধ্যাবেলা। দুই বন্ধু পাশাপাশি বসে আছে। একজনের হাতে একখানা খবরের কাগজ, আর একজনের হাতে একখানা খোলা বই। সামনে একটা টেবিল,—তার তলায় কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে, মস্ত একটা দেশি কুকুর।

একজনের নাম বিমল, আর একজনের নাম কুমার। কুকুরটার নাম হচ্ছে বাঘা ৷ যখের ধনের পাঠকরা নিশ্চয়ই এদের চিনতে পেরেছেন?

কুমার হঠাৎ খবরের কাগজখানা মহাবিরক্তির সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠল, “খবরের কাগজের নিকুচি করেচে!”

বিমল বই থেকে মুখ তুলে বললে, “কী হল হে? হঠাৎ খবরের কাগজের ওপর চট্‌লে কেন?”

কুমার বললে, “না চ’টে করি কী বল দেখি? কাগজে নতুন কোন খবর নেই। সেই থোড় বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়! নাঃ, পৃথিবীটা বেজায় একঘেয়ে হয়ে উঠেছে।”

বিমল হাতের বইখানা মুড়ে টেবিলে রেখে দিয়ে বলে, “পৃথিবীকে আর তোমার পছন্দ হচ্ছে না? তাহলে তুমি আবার মঙ্গল-গ্রহে ফিরে যেতে চাও?”

—“না, দেখা দেশ আর দেখতে ইচ্ছে নেই। তার চেয়ে চন্দ্রলোকে যাওয়া ভালো।”

—“ওরে বাস্‌রে, সেখানে ভয়ানক শীত ।”

—“তাহলে পাতালে যাই চল ।”

—“চন্দ্রলোকে গেলেও তোমাকে বোধ হয় পাতালে থাকতে হবে । সেখানে মাটির উপরে চির-তুষারের রাজ্য। পণ্ডিতরা তাই সন্দেহ করেন যে, চন্দ্রলোকের জীবরা পাতালের ভেতরে থাকে।”

—“কিন্তু চন্দ্রলোকে যাব কেমন করে?”

—“সে কথা পরে ভাবা যাবে এখন,….. আপাততঃ রামহরির পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি, বোধ হয় আমাদের জলখাবার আসচে, অতএব—”

রামহরি ঘরের ভেতরে এসে ঢুকল, তার দুই হাতে দু’খানা খাবারের থালা ।

বিমল বললে, “এস এস, রামহরি এস! রামহরি, তুমি যখন হাসিমুখে খাবারের থালা হাতে করে ঘরে এসে ঢোকো, তখন তোমাকে আমার ভারি ভালো লাগে। আজ কী বানিয়েছ রামহরি?”

রামহরি থালা দু-খানা দুজনের সামনে রেখে বললে, “মাছের কচুরি আর মাংসের সিঙাড়া!”

বিমল বললে, “আরে বাহবা কি বাহবা! হাত চালাও কুমার, হাত চালাও।”

কুমার একখানা কচুরি তুলে নিয়ে বললে, “ভগবান রামহরিকে দীর্ঘজীবী করুন! আমাদের রামহরি না থাকলে এই একঘেয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাই মুস্কিল হত।”

মাছ মাংসের গন্ধে বাঘারও ঘুম গেল ছুটে! সেও দাঁড়িয়ে উঠে প্রথমে একটা ডন দিয়ে চাঙা হয়ে এগিয়ে এসে ল্যাজ নাড়তে শুরু করল।

এমন সময়ে সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল।

বিমল বলল, “দেখ তো রামহরি, কে ডাকে?”

রামহরি বেরিয়ে গেল, খানিক পরে ফিরে এসে বললে, “একজন ভদ্রলোক তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁকে বৈঠকখানায় বসিয়ে রেখে এসেচি।”

খাবারে থালা খালি করে বিমল ও কুমার নিচে নেমে গেল। বাইরের ঘরে ভদ্রলোক বসে আছেন। তাঁর বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না, দিব্য ফর্সা রং, চেহারায় বেশ- একটি লালিত্য আছে।

বিমল বললে, “আপনি কাকে চান?”

ভদ্রলোক বললেন, “আপনাদেরই। আপনারা আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাদের চিনি, আমার নাম মানিকলাল বসু, আমার বাড়ি খুব কাছেই।”

বিমল বললে, “বসুন। আমাদের কাছে আপনার কী দরকার?”

– “মশাই আমি বড় বিপদে পড়েছি। আমার বাড়িতে বোধহয় ভূতের উপদ্রব হয়েছে।”

বিমল বললে, “কিন্তু সেজন্য আমাদের কাছে এসেছেন কেন? আমরা তো আর রোজা নই।”

মানিকবাবু বললেন, “এ যে সে ভূত নয় মশাই, রোজা এর কিছুই করতে পারবে না। আমি আপনাদের কীর্ত্তিকলাপ সব শুনেছি, তাই আপনাদের কাছে এসেচি।”

বিমল বললে, “আচ্ছা, ব্যাপারটা কী আগে খুলে বলুন দেখি!”

মানিকবাবু বললেন, “ঐ যে বললুম, ভূতের অত্যাচার। আর অত্যাচার বলে অত্যাচার? ভয়ানক অত্যাচার! উঃ!”

বিমল ও কুমার হেসে ফেললে।

– “আপনারা হাসচেন? তা হাসুন কিন্তু আমার বাড়িটা যদি আপনাদের বাড়ি হত, তাহলে আপনাদের মুখের হাসি মুখেই শুকিয়ে যেত। বুঝচেন মশাই, আমার বাড়িটা এখন ভূতের বৈঠকখানা হয়ে দাঁড়িয়েচে!”

– “কী রকম শুনি?”

– “শুনুন তাহলে। ঠিক মাসখানেক আগে আমরা বাড়িতে তালা লাগিয়ে দেশে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি আমার সদর দরজার তালা ভাঙা। ভেতরে ঢুকে দেখি, উঠোনের উপর রূপার বাসন আর আমার স্ত্রীর গয়নাগুলি ছড়িয়ে পড়ে আছে। উপরে উঠে দেখি, প্রত্যেক ঘরের তালা ভাঙা। কোন ঘরে টেবিলের ভিতর থেকে কাগজ-পত্তর বের করে কে ঘরময় ছড়িয়ে রেখে গেছে, কোন ঘরে লোহার সিন্দুক ভাঙা পড়ে আছে, কোন ঘরে আলমারী ভেঙে কাপড়-চোপড় গুলো কে লণ্ডভণ্ড করে ফেলেচে। অথচ আমার কিছুই হারায় নি। বলুন দেখি, এসব কী ব্যাপার? চোর এলে সব চুরি করে নিয়ে যেত, কিন্তু আমার চুরি যায় নি।

একি ভূতুড়ে কাণ্ড নয়?”

বিমল বললে, “তারপর?”

– “দিন পনেরো আগে, অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠেই শুনলুম আমার টেরিয়ার কুকুরটা বেজায় চিৎকার করছে। তারপরেই সে আর্তনাদ করে চুপ করে গেল। আমি ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারলুম না। তারপর বাড়ির সবাই যখন জেগে উঠল, তখন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, আমার কুকুরটাকে কে গলা টিপে মেরে ফেলেচে। আর তার মুখে লেগে রয়েচে এক খাব্‌লা লোম।”

বিমল বিস্মিত স্বরে বলল, “লোম?”

—“হ্যাঁ। কিন্তু সে লোম আমার কুকুরের নয়। লোমগুলো আমি কাগজে মুড়ে রেখে দিয়েচি। এই দেখুন না।”– বলেই মানিকবাবু কাগজের একটি ছোট পুরিয়া বার করে বিমলের হাতে দিলেন।

বিমল পুরিয়াটা খুলে লোমগুলো পরীক্ষা করে বললে, “আচ্ছা, এটা এখন আমার কাছে থাক। তারপর কী হয়েছে বলুন।”

মানিকবাবু বললেন, “কাল রাত্রে কিছুতেই আমার ঘুম আসছিল না। রাত তখন ঝাঁ-ঝাঁ করছে, চারিদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ শুনলুম, আমার বাড়ির ছাদের উপর দুম্‌ দুম্‌ করে শব্দ হচ্ছে – সে মানুষের পায়ের শব্দ নয়, মানুষের পায়ের শব্দ অত ভারী হয় না, ঠিক যেন একটা হাতি ছাতময় চলে বেড়াচ্চে। ভয়ে আমার মাথার চুলগুলো পর্যন্ত যেন খাড়া হয়ে উঠল, কাঁপতে-কাঁপতে কোন রকমে বিছানার উপর উঠে বসলুম ! বাড়িতে এই রকম গোলমাল দেখে আমি একটা বন্দুক কিনেছিলুম। তাড়াতাড়ি সেই বন্দুকটা নিয়ে একটা ফাঁকা আওয়াজ করতেই ছাতের উপরের পায়ের শব্দ থেমে গেল । রাত্রে আর কোন হ্যাঙ্গাম হয় নি।”

বিমল সুধোলে, “আপনি পুলিসে খবর দিয়েছেন ?”

—“হ্যাঁ। পুলিশ কোনই কিনারা করতে পারে নি।” |

—“দেখুন মানিকবাবু, আপনার সমস্ত কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার বাড়িতে যারা যারা আসচে তারা সাধারণ চোর নয়। তারা টাকা-পয়সার লোভে আসচে না। আপনার বাড়িতে হয়তো এমন কোন জিনিস আছে, যার দাম টাকা-পয়সার চেয়ে বেশি ।”

খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মানিকবাবু চিন্তিত মুখে বললেন, “বিমলবাবু, একথা তো আমি একবারও ভাবিনি!…..হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলছেন, আমার বাড়িতে একটা মূল্যবান জিনিস আছে বটে। ইচ্ছে করলে আমি রাজার ঐশ্বর্য পেতে পারি।”

—“তার মানে ?”

—তাহলে গোড়া থেকেই বলচি । আমার বাবার দুই ভাই । মেজো কাকার নাম সুরেনবাবু, ছোট কাকার নাম মাখনবাবু। গেল যুদ্ধের সময়ে আমার দুই কাকাই ফৌজের সঙ্গে আফ্রিকায় যান। তারপর তাদের আর কোন খবর পাইনি। আজ তিন মাস আগে জাঞ্জিবার থেকে হঠাৎ মেজো কাকার এক মস্ত চিঠি পাই । চিঠির মর্ম মেজো কাকার ভাষাতেই আমার যতটা মনে আছে আপনাকে সংক্ষেপে বলচি:

“বাবা মানিক,

আমি এখন মৃত্যুশয্যায়, আমার বাঁচবার কোন আশা নেই। এতদিন তোমাদের কোন খবর নিতে পারিনি, নিজের কোন খবর দিতেও পারি নি। কারণ, আফ্রিকার এমন সব দেশে আমাকে থাকতে হয়েছিল, যেখান থেকে খবরাখবর পাঠাবার কোনই উপায় নেই ।

এখন কী জন্যে তোমাকে এই চিঠি লিখচি শোনো ৷ ইষ্ট আফ্রিকার টাঙ্গানিকা হ্রদের কাছে এক পাহাড়ের ভিতরে আমি অগাধ ঐশ্বর্য আবিষ্কার করেছি, সে ঐশ্বর্য পেলে অনেক রাজারাজড়ারও মাথা ঘুরে যাবে।

এ-ঐশ্বর্য আমারই হত। কিন্তু সাংঘাতিক পীড়ায় আমি এখন পরলোকের পথে পা দিয়েছি। আমার স্ত্রীও নেই, সন্তানও নেই-কাজেই ঐ ঐশ্বর্যের সন্ধান আমি তোমাকেই দিয়ে গেলুম। ওখানকার সমস্ত ধনরত্ন তুমি পেতে পারো।

এই পত্রের সঙ্গে ম্যাপ পাঠালুম-সেখানি খুব যত্নে সাবধানে রেখো । কোন পথে, কেমন করে, কোথায় গেলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে, এই ম্যাপে সব লেখা আছে। আর কেউ যেন এই ম্যাপের কথা জানতে না পায়ে ।

আর একটা কথা মনে রেখো! একলা যেন এই গুপ্তধন নিতে এস না। কারণ দুর্গম পথ, পদে পদে প্রাণের ভয়-সিংহ, বাঘ, বুনো হাতি, হিপো, গণ্ডার, সাপ | অসভ্য জাতি আর নানান রকম ব্যাধি, কখন যে কার কবলে প্রাণ যাবে, কিচুই বলা যায় না। এ-সব বিপদ যদি এড়াতে পারবে বলে মনে কর, তবেই এস,–নইলে নয়।

চিঠির সঙ্গে গুপ্তধনের একটা ইতিহাস দিলুম, পড়ে দেখলে অনেক সুবিধা হবে। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। –

– ইতি তোমার মেজো কাকা ।”

–বিমলবাবু, আপনি কি মনে করেন, ঐ ম্যাপের জন্যেই আমার ওপরে অত্যাচার হচ্ছে? কিন্তু এ-সব কথা তো আমি আর কারুর কাছেই বলি নি!”

বিমল খানিক্ষণ ঘরের ভিতর নীরবে পায়চারী করে বললে, “কাকার চিঠি আর ম্যাপ এখনো আপনার কাছেই তো আছে।”

–“নিশ্চয়ই! সেই চিঠি আর ম্যাপ আমি শ্ৰীমদ্ভাগবতের ভিতরে পুরে আমার পড়বার ঘরে বইয়ের আলমারির মধ্যে রেখে দিয়েছি। সেখান থেকে কেউ তা খুঁজে বার করতে পারবে না ।” । –

—“আপনার মেজোকাকার চিঠি পেয়েছেন, মাস তিনেক আগে?”

_“হ্যাঁ ।”

—“আর ঠিক তার দু’মাস পরেই আপনার বাড়িতে উপদ্রব শুরু হয়েছে। এতেও কি আপনি বুঝতে পারছেন না যে, চোরেরা ঐ ম্যাপখানাই চুরি করতে চায়?”

—“এ চোরেরা কি অন্তর্যামী? ম্যাপের কথা এতদিন খালি আমি জানতুম, আর আজ আপনারা দুজনে জানলেন।”

– এমন সময়ে বাঘা এসে ঘরের মধ্যে ঢুকল। একবার মানিকবাবুর পা দুটো গম্ভীরভাবে শুঁকে দেখলে, তারপর পথের ধারের একটা জানলার কাছে গিয়ে গর-গর করতে লাগল।

মানিকবাবু বললে, “ওকি মশাই, আপনার কুকুর অমন করে কেন? কামড়াবে নাকি?”

বিমল এক লাফে জানলার কাছে গিয়ে দেখলে, বাইরে রোয়াকের উপরে হুমড়ি খেয়ে বসে কে একটা লোক জানলায় কান পেতে আছে! সে হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেল, কিন্তু পারলে না! লোকটা তড়াক করে রোয়াকে থেকে নেমে রাস্তায় পড়েই তীরের মত ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মানিকবাবু বললেন, “ও আবার কী?”

কুমার বললে, “চোরেরা আপনার পিছনে চর পাঠিয়েছিল।”

—“আমার পিছনে ও বাবা, কেন?”

—“কেন আর, আপনি আমাদের এখানে কেন আসছেন, তাই জানাবার জন্যে । আপনি ম্যাপখানা কোথায় রেখেছেন, লোকটা নিশ্চয়ই তা শুনতে পেয়েছে।”

মানিকবাবু আবার চেয়ারের উপর হতাশ ভাবে বসে পড়ে বললেন, “তাহলে এখন উপায়?”

বিমল বললে, “উঠুন মানিকবাবু, শীগ্‌গির বাড়িতে চলুন। আজ রাত্রে চোরেরা নিশ্চয়ই আপনার বাড়ি আক্রমণ করবে। আজ আমরাও আপনার বাড়িতে পাহারা দেব।”

 

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

আবার যখের ধন (পর্ব ২)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত