পুনর্জন্ম (পর্ব ৩)

পুনর্জন্ম (পর্ব ৩)

একটু পরই স্ত্রীকে ভেতরে রেখে বেরিয়ে এলেন হাসানুজ্জামান।‘চলুন তাহলে আপনাকে কবরটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।’

‘হ্যাঁ,চলুন,’বলে হাসানুজ্জামানের সাথে বাইরে বেরিয়ে এল তারেক।

বাড়ির পেছনটা বড় বড় ঘাসে ছাওয়া।তারেকের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে হাসানুজ্জামান ব্যাখ্যা দিলেন,‘আমি ইচ্ছে করেই বাড়ির পেছনটা পরিষ্কার করাইনি।’

‘কেন?’

‘আমাদের লন্ডনের বাড়িটার পেছনেও এমন ঘাস ছিল।পুরনো স্মৃতি ধরে রাখার একটা চেষ্টা বলতে পারেন।’
তারেক ভ্রু কুঁচকে বলল,‘আচ্ছা আপনাদের লন্ডনের বাড়িটায় কিংবা আশেপাশের কোনো বাড়িতে এমন লাশ পাবার ঘটনা ঘটেছিল কিনা?লন্ডনে এমন ঘটনা অস্বাভাবিক না।’

‘না তো।’

‘আপনি শিওর?’

‘হুমম,কেন?’

‘সেক্ষেত্রে ওই ঘটনা আপনার স্ত্রীর অবচেতন মনে ছাপ ফেলতে পারে।পরবর্তীতে যখন তিনি এই বাড়িটা দেখলেন তখন তার অবচেতন মনে জমা হয়ে থাকা স্মৃতি তাকে ভয় দেখাতে লাগল।তিনি ভাবতে লাগলেন এই বাড়িটাতেও বুঝি একটা লাশ আছে।এবং কাকতালীয়ভাবে এই বাড়িটাতে আসলেও একটা লাশ আছে।’

‘হুমম,আপনার কথায় যুক্তি আছে তবে আমার যতদুর মনে পড়ে এধরনের কোন ঘটনা আমাদের আশেপাশে ঘটেনি।’

‘তাহলে অন্যভাবে এগোতে হবে আমাদের।’

‘সেটা কিভাবে?’

‘এই এলাকার প্রবীণ কোনো বাসিন্দার সাথে আলাপ করতে হবে,যিনি এই বাড়িটা সম্পর্কে জানবেন।তেমন কেউ আছেন আপনার পরিচিত?’

‘না,এমন কারো কথা মনে পড়ছেনা।’

‘সমস্যা নেই খুঁজে নেব,’বলতে বলতে কবরটার সামনে এসে দাড়াল তারেক আর হাসানুজ্জামান।
খোলা কবরটা দেখে গা-টা ছমছম করে উঠল তারেকের।এখানেই বহু বছর ধরে শুয়ে ছিল একটা মানুষ,ভাবতেই যেন কেমন করে ওঠে মনটা।
ভালমত কবরটা দেখতে লাগল তারেক।যদিও লাশ উঠিয়ে নেবার পর আর দেখার তেমন কিছুনেইও।মাটি থেকে একটা বোটকা গন্ধ এসে নাকে লাগছে।দীর্ঘদিন পঁচা লাশের সংস্পর্শে থাকার ফল।

হঠাৎ কবর থেকে কি যেন একটা ঝিলিক দিয়েউঠল।মনে হচ্ছে কোনো ধাতব পদার্থে রোদ লেগে ওমন হয়েছে।

তারেক অতি সন্তর্পণে কবরের মাটিতে পা রাখল।মাটির মধ্যে অর্ধেক ডেবে থাকা ছোট্ট একটা বস্তু তুলে নিয়ে এল।

‘কী এটা?’প্রশ্ন করলেন হাসানুজ্জামান।

‘আংটী,’বলে হাত তুলে আংটীটা দেখাল তারেক।অনেকদিন যাবত মাটিতে পড়ে থাকায় খানিকটা উজ্জলতা হারিয়েছে।হালকা সবুজাভ একটা রং পেয়েছে।আংটীটা সোনার।একটা লাল রং-এর পাথর বসানো।

‘কার আংটী এ্টা?’জানতে চাইলেন হাসানুজ্জামান।
‘সম্ভবত এখানে যিনি শুয়ে ছিলেন।’

‘তাহলে আমরা যখন কবরটা খুড়লাম তখন এটা চোখে পড়লনা কেন?’

‘আপনারা কবর খুড়েছেন বিকে্লে।তখন তেজ কম থাকায় আংটীটার উপর রোদের প্রতিফলন হয়নি।’

‘ও আচ্ছা।কিন্ত আংটীটা কী আপনার কোনো কাজে আসবে?’

‘কখন কোন জিনিস কাজে লেগে যায় কে বলতে পারে।হতে পারে এই সামান্য আংটীটাই সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি।

আচ্ছা,আপনিতো বাড়িটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর মাধ্যমে কিনেছেন,বাড়ির আগের মালিকের ব্যাপারে কিছু জানেন?’

‘উঁহু,শুধু জানি,বাড়িটা দীর্ঘদিন যাবত খালি পড়ে ছিল।’

‘কতদিন?’

‘সেটা তো বলতে পারবনা।আসলে পছন্দমত বাড়ি খুঁজে পাওয়ায় বাড়ির মালিককে নিয়ে অত মাথা ঘামাইনি।

‘ঘামানো উচিত ছিল।যাকগে আমারএখানকার কাজ আপাতত শেষ।এখন আমি আশপাশের স্থানীয় মানুষের সাথে কিছু কথা বলব।’

‘চলুন।’

তারেক আর হাসানুজ্জামান কবরটার কাছ থেকে সরে এল।

তিন

দোতলা একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়াল তারেক।খোঁজ নিয়ে জেনেছে এবাড়ির বাসিন্দা লুতফর সাহেব বহু বছর ধরে এই এলাকায় আছেন।তাঁর কাছ থেকে হাসানুজ্জামান সাহেবের বাড়িটার ব্যাপারে জরুরী কিছু জানতে পারার আশায় এসেছে তারেক এখানে।একাই এসেছে,হাসানুজ্জামানকে সাথে আনেনি।
দরজায় কড়া নাড়তে এক বৃদ্ধ খুলে দিলেন।হাতে আজকের দৈনিকপত্রিকা ধরা।তারেক কেদেখে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন তিনি।

তারেক তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,‘আমি এই এলাকার পুরনো বাড়িগুলো নিয়ে একটা জরিপ চালাচ্ছি।’হাত তুলেপাশের বাড়িটাদেখিয়ে বলল,‘এই বাড়িটার ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।’অবলীলায় মিথ্যে কথাটা বলে ফেলল তারেক।গোয়েন্দাগিরি করতে এসে যুধিষ্ঠির সাজতে চাওয়া আর চোখ খোলা রেখে ঘুমাতে চাওয়ার মধ্যে বিশেষ কোনো তফাত নেই।

বৃদ্ধ বোধহয় খুশিই হল।এবয়সী মানুষদের সবচাইতে বড় অসুখ হল নিঃসঙ্গতা।বললেন,‘ভেতরে আসুন।’
তারেক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,‘আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন।’

‘আচ্ছা,বাবা।’

একটা সোফায় মুখোমুখি বসল তারেক আর লুতফর সাহেব।বৃদ্ধের বয়স হবে আন্দাজ সত্তর থেকে পচাত্তর।চুলগুলো সবই সাদা হয়ে গেছে।

‘তা কী জানতে চাও বাবা?’

তারেক সরাসরি কাজের কথায় চলে এল,‘আমি যতদুর জানি,ওই বাড়িটা অনেকদিন যাবত খালি পড়ে ছিল।’
‘হ্যাঁ তা তো প্রায়চল্লিশ বছর হবেই।’

তারেক মনে মনে চমকে উঠল।‘চল্লিশ বছর খালি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলে তো বাড়িটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।’

‘আসলে ঠিক পরিত্যাক্ত নয়।আগের মালিকের কেয়ারটেকার দেখাশোনা করত।’

‘সেই কেয়ারটেকার এখন কোথায় থাকে?’

‘মালিকের মৃত্যুর পর এখান থেকে চলে গিয়ে গাজীপুর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকে।প্র্তি সপ্তাহে এসে দেখে যেত বাড়িটা।শুনেছি,রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর মাধ্যমে বাড়িটা কিছুদিন আগে এক লন্ডন প্রবাসী দম্পতির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে সে।’

‘কেন,আগের মালিকের ওয়ারিশ নেই?’

‘সে এক আজব কাহিনী!’

রহস্যের গন্ধ পেয়ে তারেক নড়েচড়ে বসল।‘ইয়ে,আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে কাহিনীটা শুনতে আমি আগ্রহী।’

‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।এ বাড়িটা বানিয়েছিল লোকমান মির্জা নামে এক লোক।তার পরিবার নাকি খুবই প্রভাবশালী ছিল তাদের এলাকায়।জমিদার টাইপ আরকি।কিন্তু লোকমান মির্জা ছিল তাদের পরিবারের,কী বলব,কলঙ্ক।মদ খাওয়া,জুয়া খেলা,মোটকথা হেন কুকাজ নেই যা সে করত না।আমি নিজেই দেখেছি লোকটা কেমন ছিল।প্রতিদিন সন্ধ্যায় বারে যেত।প্রায় রাতেই বাড়িতে মেয়েমানুষ আসত।যাইহোক,ছেলের এমন অবস্থা দেখে তার বাবা নাকি তাকে ত্যাজ্য করে।বাই দ্যা ওয়ে,আমি যা বলছি,সবই কিন্তু লোক মুখে শোনা।’

‘সমস্যা নেই।যা রটে তার কিছু তো ঘটে।’

‘হুমম,সেটাই।তো যা বলছিলাম,লোকমান মির্জা পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে নিজের চেষ্টায় প্রচুর টাকা পয়সা কামাই করে।স্বাভাবিক,অসৎমানুষ ছিল লোকমান মির্জা।অসৎ পথে কামাই করা তার পক্ষে কঠিন কিছুনা।মাত্র চল্লিশ বছরে বয়সেই সে এই বাড়িটা বানায়।একাই থাকত লোকমান মির্জা এবাড়িতে।শুধু তার সেই কেয়ারটেকার থাকত তারসাথে।তখন অবশ্য সে শুধু কেয়ারটেকার ছিলনা।লোকমান মির্জার সব কাজকর্ম তাকেই করতে হোত।বলতে গেলে লোকমান মির্জার অন্ধের ষষ্ঠি ছিল রফিক।’এই পর্যন্ত বলে থামলেন লুতফর সাহেব।

‘আচ্ছা,লোকমান মির্জা কিভাবে মারা যায়?’

‘সে আরেক রহস্য।’

‘যেমন?’

‘লোকমান মির্জার মৃত্যুটা যে আসলে কিভাবে হয়েছিল,কিংবা আদৌ সে মারা গেছে কিনা তা কেউ জানেনা।’

‘মানে?’

‘বাড়িটা তৈরী করবার প্রায় দুবছর পর রফিকের মা মারা যান।সে সময় রফিক এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি যায়।একসপ্তাহ পর ফিরে দেখে তার মালিক বাড়িতে নেই।বেশ অবাক হয় রফিক,কারণ তার মালিক সন্ধ্যায় বারে যাওয়া ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতনা বললেই চলে।রফিক ভাবে হয়ত একা একা ভাল লাগছেনা বলে বাইরে গেছে,চলে আসবে।কিন্তু আর কোনোদিনই ফিরে আসেনি লোকমান মির্জা।’

‘অদ্ভুত!’ছোট করে মন্তব্য করল তারেক।গতকাল আবিষ্কৃত লাশের পরিচয় পেয়েগেছে তারেক।

‘আপনারা,মানে প্রতিবেশীরা কিছু টের পাননি?’

‘তোমাকে তো আগেই বলেছি,লোকমান মির্জা ভাল মানুষ ছিলনা।কারো সাথে তার পরিচয়ও ছিলনা।আমরাও তাকে এড়িয়ে চলতাম।সুতরাং কিভাবে কী ঘটেছে আমরা কেউ বলতে পারবনা।তবে দুদিন পরও যখন সে ফিরে এলনা,তখন পুলিশে খবর দেয় রফিক।বেশ জোরেসোরেই তদন্ত চলে,কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।খোঁজ নিয়ে জানা যায় রফিক যেদিন ছুটি নেয় সেদিনই শেষবারের মত লোকমান মির্জাকে বারে দেখা যায়।সন্দেহের তীর অবশ্য রফিকের দিকেই যায় কিন্তু জোরাল এলিবাই থাকার কারণে বেচে যায় সে।’

‘কেন,তার দিকে সন্দেহের তীর যাবার কী কারণ?’

‘উইল।’

‘উইল?’

‘হ্যাঁ, লোকমান মির্জার উইল।পুলিশ যখন তদন্ত শুরু করেত খন লোকমান মির্জার উইল খুঁজে পাওয়া যায় তার ড্রয়ারে।’থামলেন লুতফর সাহেব।তারেকের আগ্রহটা উপভোগ করছেন।অনেকদিন যাবত বোধহয় এমন মনোযোগী শ্রোতা পাননা ভদ্রলোক।

‘কী ছিল সেই উইলে?’

‘উইলের সারমর্ম ছিল,লোকমান মির্জার কিছু হলে চল্লিশ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।যদি এসময়ের মধ্যে যদি তার কোনো ওয়ারিশের খোঁজ পাওয়া যায় তবে সব সম্পত্তির মালিক সে হবে।আর এই চল্লিশ বছর পর্যন্ত বাড়িটার দেখাশোনার দায়িত্ব থাকবে রফিকের উপর।বিনিময়ে মাসে মাসে ব্যাঙ্কে জমানো টাকা থেকে একটা ভাতা পাবে রফিক।চল্লিশ বছর পরও যদি কেউ সম্পত্তি দাবি না করে সেক্ষেত্রে সব সম্পদের মালিক রফিক হয়ে যাবে।’

‘হুমম,খুন করার জোরাল মোটিভই বলা যায়।’
‘হ্যাঁ,যদি রফিক ওই সময় গ্রামের বাড়িতে না থাকত তবে নিশ্চিত গ্রেফতার হয়ে যেত।’

‘তবে,গাজীপুর থেকে লোকমান মির্জাকে খুন করে আবার ফিরে যাওয়া কিন্তু কঠিন কিছু নয়!’

তারেকের কথা শুনে এবার একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন লুতফর সাহেব।‘বাবা,তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছেনা তুমি জরিপ টরিপ করতে এসেছ।তুমি আসলে কে বল তো?’

‘চাচা,আমি একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ।’

‘তা সেটা আগে বলবে তো?’

‘আসলে এ পরিচয়টা দিলে কেউ সাহায্য করতে চায়না।’
‘সেটা অবশ্য স্বাভাবিক।সবারই তো গোপণ করার মত কিছু বিষয় থাকে।’

কথাটা খুব মনে ধরল তারেকের।মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল।এরপর বলল,‘চাচা,তারমানে এখন সমস্ত সম্পত্তির মালিক তাহলে রফিক?’

‘হ্যাঁ।উইল অনুযায়ী তো সেটাই হবার কথা।গত চল্লিশ বছরে তো কেউ সম্পদের দাবি জানাতে আসেনি।’

‘আচ্ছা, রফিকের বাড়ির ঠিকানাটা দেয়া যাবে?’

‘ঠিকানা তো আমার কাছে নেই বাবা।’

‘ঠিকআছে ,সমস্যা নেই।প্রয়োজন হলে আমি যোগার করে নেব।চাচা,আমিএখন তাহলে আসি।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘না,না,ধন্যবাদ কিসের।তোমার যখনই প্রয়োজন হবে তখনই চলে আসবে।’

লুতফর সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল তারেক।কয়েকটা প্রশ্নের জবাব পেলেও আরো কয়েকটা প্রশ্ন সামনে এসে হাজির হয়েছে।তবে হাসানুজ্জামানের স্ত্রী মিসেস নার্গিসের সমস্যা যে পুনর্জন্ম টুনর্জন্ম কিছুনা সে ব্যাপারে তারেক নিশ্চিত।কারণ লোকমান মির্জা মারা গেছে চল্লিশ বছর আগে,এবংসেটা মিসেস নার্গিসের বর্তমান জন্মেই।সুতরাং পুনর্জন্মের মুখরোচক গল্প এক্ষেত্রে খাটবেনা।এরচাইতেও জটিল কোনো রহস্যপুরো ব্যাপারটাকে ঘিরে রেখেছে।কী সেই রহস্য?

আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……

পুনর্জন্ম (পর্ব -১)
পুনর্জন্ম (পর্ব -2)
পুনর্জন্ম (পর্ব -3)
পুনর্জন্ম (পর্ব -4 শেষ পর্ব)

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত